মন_মোহনায়_ফাগুন_হাওয়া #লেখিকা: #নুরুন্নাহার_তিথী #পর্ব_২৩

0
339

#মন_মোহনায়_ফাগুন_হাওয়া
#লেখিকা: #নুরুন্নাহার_তিথী
#পর্ব_২৩
কফির মগ হাতে রুমের আলো নিভিয়ে শেহজাদ ও মীরা ব্যালকনিতে যায়। গ্রিলহীন খোলা ব্যালকনিতে মুখোমুখি চেয়ার পাতা, মধ্যিখানে ছোট্ট একটা টেবিল। চারপাশে সব অন্ধকারে আবৃত। কেবল মাথার উপর বিস্তৃত অম্বরে লাখো তারকারাজির মাঝে এক অর্ধচন্দ্রমার রাজত্ব চলছে। যার স্নিগ্ধ আলোকরশ্মি জোৎস্না স্বরূপ পৃথিবীর ঘন অন্ধকারকে দূর করার আপ্রাণ প্রয়াস করে চলেছে। মীরা চাঁদের দিকে চেয়ে মৃদু হেসে বলে,

“বলুন এবার।”

শেহজাদ কফির মগে এক চুমুক দিয়ে বলে,
“আমার তো মনে হচ্ছে, আমার স্টোরি শোনার জন্য তুমি অনেকদিন ওয়েট করে ছিলে!”

মীরা ফিক করে হেসে ফেলে বলে,
“আপনার ও ফিওনা আপুর লাভ স্টোরি জানার জন্য পুরো ডিপার্টমেন্ট উৎসুক ছিল। পুরো ডিপার্টমেন্টের মধ্যে মেয়েরাই বেশি। ”

শেহজাদও হালকা হাসে। ফের বলে,
“কিন্তু এটা তো লাভ স্টোরি না!”

“মানে? লাভ স্টোরি না হলে একটা মেয়ে নিজের সব ছেড়ে আপনার কাছে চলে এসেছে?”

মীরার কণ্ঠে বিস্ময়। শেহজাদ লম্বা নিঃশ্বাস ছেড়ে বলতে শুরু করে,
“আমি তাকে ভালো বাসতাম না কিন্তু সে ভালোবাসতো। ফিওনা ছিল আমার ইউনিভার্সিটির প্রফেসরের মেয়ে এন্ড ভার্সিটিতে ওয়ান ইয়ার সিনিয়র। আমার এইচএসসির পর বাবা-মা ও আমি আমেরিকা শিফট হই। সেখানেই ভার্সিটিতে ভর্তি হই। আমেরিকায় শিফট হওয়ার পর আমরা যেই বাড়িটিতে উঠেছিলাম, সেটার একটা বাড়ি পরেই ছিল প্রফেসর হ্যারিসনের বাড়ি। ফিওনার বাবা তিনি। প্রফেসর হ্যারিসন তার মা ও মেয়ের সাথে সেখানে থাকতেন। ফিওনার মা ওর জন্মের সময় মা**রা যান। তারপর স্যার আর বিয়ে করেননি। তিনি নিজের কাজ, রিসার্চ, পাবলিকেশন এসব নিয়েই ব্যস্ত থাকতেন। আমার ইউনিভার্সিটিতে এডমিশনের জন্য বাবাকে তিনি অনেক হেল্প করেছিলেন। সেই সুবাদে আমাদের দুই পরিবারে একটা ভালো সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। ইউনিভার্সিটিতে ফিওনা আমার সাথে খুব মিশতে চাইতো। অফডে বা ফ্রি টাইমে আমাদের বাড়িতেও চলে আসতো। আমার সাথে গল্প করতে চাইতো। আমি এসব নিয়ে ভাবতাম না। আমি নিজের পড়াশোনাতেই মনোযোগ দিতাম। এভাবেই তিন বছর পেরিয়ে যায়। তখন ফিওনার গ্রাজুয়েশন কম্পিলিট। একদিন ফিওনা আমাকে কল করে বলে ব্রেক টাইমে ভার্সিটির এক জায়গায় দেখা করতে। আমি প্রথমে ভেবেছিলাম যাব না। তাই ব্রেক টাইমে যাইনি। তারপর ছুটির পর কী ভেবে ওইদিক দিয়ে বাড়িতে যাওয়ার ওয়েটা ইউজ করেছিলাম। ওটা একটু লম্বা পথ। সচরাচর সেখান দিয়ে যেতাম না। সেখানে গিয়ে দেখলাম, ফিওনা একা সেখানে বসে ছিল। তখন উইন্টার সিজন। বিকেলবেলা, সন্ধ্যা নামবে নামবে ভাব। হিম শিতল বাতাসে শুষ্ক পাতার ধ্বনি জনমানবহীন পরিবেশটা কেমন অদ্ভুত! ফিওনা ছাড়া আশেপাশে কেউ নেই। ফিওনাকে একা বসে থাকতে দেখে আমি এগিয়ে গিয়েছিলাম। ওর পাশে যথেষ্ঠ দূরত্ব রেখে বসেছিলাম। আমি বসা মাত্রই ও আধো বাংলায় বলে উঠেছিল,
‘খুব লেট করে ফেলেছ, শেহজাদ!’
ওর মুখে প্রথমবার নিজের মার্তৃভাষা শুনে আমি অবাক হয়ে তার দিকেই চেয়ে ছিলাম। তারপর ও ফিরলো আমার দিকে। হঠাৎ আমার হাত ধরে হাসি মুখে বলেছিল,
‘আই রিয়েলাইজ আই অ্যাম নট ইম্পরট্যান্ট ফর ইউ। নেক্সট উইক ইউ আর ইনভাইটেড।’
ওর কথা ও মুখের হাসির সাথে চোখের ভাষার মিল ছিল না। আমি কারণ জিজ্ঞাসা করলে বলে, নেক্সট উইক নাকি ওর বিয়ে। কথাটা বলে ও দেরি করে না। সাথে সাথে উঠে চলে যায়। একবারও পেছনে ফেরেনি।”

থামে শেহজাদ। মীরা হা করে বোকার মতো চেয়ে আছে। আলোক স্বল্পতার কারণে এটা শেহজাদের দৃষ্টিগোচর হয় না। শেহজাদ এবার কফির মগে শেষ চুমুক দিয়ে নিরব হয়ে রয়। মীরা উৎকণ্ঠিত হয়ে শুধায়,
“তারপর কী হয়েছিল, স্যার?”

“তারপর আর কি! ফিওনার বিয়ে!”

“বিয়ে? আপনার সাথে?”

“না।”

“এ্যাঁ! তাহলে কার সাথে? কী বলতেছেন আপনি? ফিওনা আপুর সাথে আপনার বিয়ে হয়নি?”

শেহজাদ হাত থেকে কফির মগ রেখে চেয়ারে কম্ফোর্টেবল ভাবে বসে আবার বলতে শুরু করে,
“আমি সেদিন বাড়ি ফিরে ফিওনার সেদিনকার বিহেভিয়ার গুলো ভাবছিলাম। সকালে ফোনে তার কণ্ঠে একটা এক্সসাইটমেন্ট, ভয় ছিল যা বিকেলে ছিল না। কিন্তু এসব ভাবনা-চিন্তা আমার বেশি লং টাইমের জন্য হয়নি। কারণ আমার মনে ওর জন্য কোনো ফিলিংস ছিল না। আমার দিন আর পাঁচটা সাধারণ দিনের মতোই চলছিল। দুইদিন পর প্রফেসর হ্যারিসন ইনভাইটেশন কার্ড নিয়ে আমাদের বাড়িতে আসেন। সেদিন উইকেন্ড ছিল। ফিওনা তার এক ক্লাসমেটকে বিয়ে করছে। খুব তাড়াহুড়ার মধ্যে। স্যার বলছিলেন যে ফিওনা হুট করে তাকে বিয়ে কথা বলে আর যাকে বিয়ে করবে তার নামও বলে। তারপর…”

কথার মাঝেই মীরা থামায় শেহজাদকে। সে জিজ্ঞেসা করে,
“ফিওনা আপু না আপনাকে পছন্দ করতো? তাহলে অন্য ছেলেকে বিয়ে করার কথা বলল কীভাবে? তাও ক্লাসমেট। মানে বুঝলাম যে আপনি ইগনোর করাতে সে হার্ট হয়েছিল কিন্তু বিয়ের জন্য ছেলে সে নিজেই সাজেস্ট করেছিল?”

“হ্যাঁ করেছিল। সে রেনডমলি ছেলে পছন্দ করেছিল। সে ছিল ইউনিভার্সিটিতে মোস্ট ফেমাস এন্ড এট্রাক্টিভ গার্ল। সবার ক্রাশ বলা যায়। অতিরিক্ত সুন্দরী। তাই সে রেনডমলি নিজের এক ক্লাসমেটকে চুজ করেছিল বিয়ে করার জন্য। যাকে চুজ করেছিল, সেই ছেলে ফিওনাকে প্রপোজ করা ছেলেদের মধ্যেই একজন। বলা যায়, সবার শেষে প্রপোজ ওই ছেলেই করেছিল।”

“তারপর কী হলো? আপনি কি ফিওনা আপুর সাথে কথা বলেননি?”

“না! আমি কেন কথা বলব? ওর বিয়ে ও করবে। আমি গেস্ট হিসেবে ফ্যামিলি নিয়ে জাস্ট বিয়ে এটেন্ড করেছিলাম। বিয়ের আগ পর্যন্ত ফিওনা আমার দিকে চেয়ে কয়েকবার হাসি বিনিময়ও করেছিল। তারপর তার বিয়ে হয়ে যায়। এরপর এক বছর আমার সাথে ফিওনার কোনো দেখা-সাক্ষাত বা কথা হয়নি। শুনেছিলাম, অন্য শহরে হাসবেন্ডের সাথে শিফট হয়েছে। আমার গ্রাজুয়েশন শেষ হয়। তিন মাস জব করে মাস্টার্সে ভর্তি হই। তারপর হঠাৎ একদিন বিকেলে ভার্সিটি থেকে বাসায় ফিরে দেখি ড্রয়িংরুমে মায়ের সাথে বসে ফিওনা ও তার দাদি গল্প করছে। তাকে হঠাৎ অনেকদিন পর দেখে অবাক হলেও আরও বেশি অবাক হই তার চোখের নিচে ডার্কসার্কেল, রুক্ষতায় ভরা চেহারা। আগের ফিওনার সাথে মিলাতে পারছিলাম না। ফিওনা আমাকে দেখে দৌড়ে এসে হুট করেই জড়িয়ে ধরেছিল। আমি তখন পুরো ব্যাপারটাতে রোবটের মতো স্টিল হয়ে দাঁড়িয়ে ছিলাম। ফিওনা কাঁদছিল। আমি কিছুক্ষণ পর বিষয়টা বুঝতে পেরে ও-কে সোজা করে দাঁড়া করিয়ে কী হয়েছে? জানতে চাইলে সে জানায়, তার হাসবেন্ডের সাথে তার ডিভোর্স হয়ে গেছে। তাদের নাকি মতের মিল হচ্ছিল না। তার হাসবেন্ড তাকে মেন্টালি টর্চার করছিল। তারপর অন্য এক মেয়ের সাথে টাইমস্পেন্ড করতো। তখন ও-কে কী বলব আমি বুঝতে পারছিলাম না। মা এসে তখন ও-কে নিয়ে যায়। এরপর পরেরদিন ও-কে নিজের ক্লাসে দেখে আমি আরেকদফা অবাক হয়েছিলাম। ও নিজ থেকে আমার পাশে এসে বসেছিল। হাই-হ্যালো এতটুকুই। ধীরে ধীরে ও আগেরমতো প্রাণবন্ত হতে শুরু করে। যেখানেই ঘুরতে যাবে, আমাকে জোর করে হলেও নিয়ে যাবে। এমন একটা অবস্থা যে রাতে ঘুমানোর সময়টুকু ছাড়া বাকি সময় ও আমার সাথেই থাকতো। বাবা-মায়ের সাথেও ওর খুব মিষ্টি সম্পর্ক হওয়াতে ও অনায়াসে স্টাডি, আড্ডা যাই করুক উনারাও বাধা দিতেন না। স্যারও এদিকে নিশ্চিন্ত। মেয়ের ডিভোর্সের পর মেয়েকে নিয়ে তিনি খুব দুশ্চিন্তায় ভুগতেন। হাই ব্লাডপ্রেশার ও হার্টে প্রবলেম ছিল উনার। তাই ফিওনাকে আমার সাথে হাসি-খুশি থাকতে দেখে তিনি কিছুটা হলেও নিশ্চিন্তে ছিলেন।”

শেহজাদ আবারও থামে। এবার উঠে দাঁড়ায়। শেহজাদকে উঠতে দেখে মীরা প্রশ্ন করে,
“কী হলো? উঠলেন কেন?”

“পানি খাব। তুমি তো শুনছ, আর আমি বলছি।”

মীরা অবাক হয়ে বলে,
“এতটুকু বলতে আপনার পানি খেতে হবে? ক্লাস লেকচারের সময় তাহলে কী করেন? তখন তো পানি লাগে না।”

“মীরা!”

“ওকে ওকে। আপনি বসুন। আমিই পানি নিয়ে আসছি।”

এই বলে মীরা বিড়বিড় করে শেহজাদকে ব*কতে ব*কতে পানি আনতে রুমে যায়। রুমে গিয়ে দেখে জগে পানি নেই। এতে সে আরও বিরক্ত হয়ে রুম থেকে বেরিয়ে নিচে ডাইনিং থেকে পানি আনতে যায়।
শেহজাদ চেয়ারে বসে আকাশপানে নিরন্তর চেয়ে দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে আর বলে,

“ফিওনা! ইউ ওয়ার সো স্টাবর্ন!”

চলবে ইনশাআল্লাহ,
আজ আমার দাদুর পঞ্চম মৃত্যুবার্ষিকী। উনার জন্য দোয়া করবেন।
ভুল ত্রুটি থাকলে ক্ষমা করবেন। কপি নিষিদ্ধ।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here