#এ_শহরে_বৃষ্টি_নামুক পর্ব ৪০
#লেখিকা_মালিহা_খান❤️
রাত গভীর হবার পথে। ঘড়ির কাঁটা গড়াচ্ছে আপন স্বভাবে, নিজগতিতে। আকাশ তারা নেই। চাঁদ নেই। মেঘগুলো সাদা হয়েছে খুব কিন্তু বৃষ্টি নামছেনা। কোথায় যেনো একটা বাঁধা। অদৃশ্য কাঁটাতার। বৃষ্টির জল আঘাত পাবে। সাদা শাড়িটা লন্ড্রি বিনে রেখে দিলো নিভ্রান। রক্ত মেখে আছে আঁচলে। দেখলেই কেমন ভীত হয়ে উঠে মন। একটা শনির আশঙ্কা। কম্পমান হৃদয়। শাড়ি বদলে দিয়ে একটা আকাশী রংয়ের পাতলা কামিজ রাত্রিকে পড়িয়ে দিয়েছে সে। মিস.নিকিতা বলে গিয়েছিলো একঘন্টার মধ্যে জ্ঞান ফিরবে অথচ দেড়ঘন্টার বেশি হয়ে গিয়েছে ও নড়েনি বিন্দুপরিমানও। ঘরের বাতি নিভানো। বাইরে থেকে আগত মৃদু আলোয় আঁধার কাটছে।
নিভ্রান রাত্রিকে জড়িয়ে ধরে ঘাড়ে মুখ গুঁজে রইলো কতক্ষণ। শ্বাস- প্রশ্বাসতো একদম স্বাভাবিক। কপালে কি বেশি ব্যাথা পেয়েছে? মাথাব্যাথায় জ্ঞান আসছেনা? যেদিন বমি হলো সেদিনই মধ্যরাতে উঠে বসেছিলো মেয়েটা। পেটে ব্যাথা করছিলো নাকি। সে ভেবেছে নরমাল ফুড পয়জন। কিন্তু না হয়তোবা!
বাইরের একটা ধাবিত দমকা হাওয়া শরীর ঠান্ডা করে দিলো। রাত্রি অস্ফুট আওয়াজ করলো। হাল্কা গোঙানি। নিভ্রান মাথা উঠালো। মুখ বরাবর তাকিয়ে গালে হাত রেখে দ্রুত ডাকলো,”রাত? রাত? রাত উঠো।”
রাত্রি তাকালো। আধবোজা চোখ। দূর্বল চোখের পাতা। নরম দৃষ্টি। শুকনো রুক্ষ ঠোঁট নাড়ানোর চেষ্টা। মনে পরলো সেই মাথা ঘোরানো, চোখের সামনে আচানক সব কালো হয়ে যাওয়া। কপালে কি অসহ্য একটা ব্যাথা!
মুখে হাসি ধরা দিলো নিভ্রানের। মোটা ব্যান্ডেজের উপরই ঠোঁট ছোঁয়ালো সে। রাত্রি শক্তিহীন হাতটা তার ঘাড়ে রাখলো। নিভ্রান আবার ঠোঁট ছুঁইয়ে দিলো একই জায়গায়। চাপা গলায় বললো,”ভয় পাইয়ে দিয়েছিলে রাত, খুব ভয় পাইয়ে দিয়েছিলে।”
রাত্রি হাসলো একটু। কোনরকমে ঠোঁট নাড়িয়ে তেজশূন্য কন্ঠে বললো,
—“ঠি ক আছিতো। শান্ত হন।”
নিভ্রান উঠে পরলো। আলো জ্বালিয়ে দিলো। রাত্রিকে দু’হাতে ধরে বিছানায় হেলান দিয়ে বসালো।
রাত্রি মাথা চেপে ধরলো সঙ্গে সঙ্গে। আয়নায় দেখলো কপালের ব্যান্ডেজ। আঙ্গুলের ব্যান্ডেজ টাও চোখে পড়লো সহজেই।
নিভ্রান বাইরে গেলো। ভাত নিয়ে আসলো প্লেটে করে। রাত্রি দাড়িয়ে পরেছে একা একাই। একহাতে বিছানার ব্যাকসাইড ধরে টলমলে পায়ের ব্যালেন্স রাখছে। নিভ্রান প্লেটটা নামিয়ে রাখতে রাখতে ধমকে উঠলো,
—“একা একা উঠেছো কেনো?”
রাত্রি থতমত খেয়ে মিনমিন করে বললো,”ওয়াশরুমে যাবো।”
নিভ্রান এগিয়ে গিয়ে দু’বাহু ধরলো। ভরাট গলায় বললো,
—“তো? আমাকে বললেই তো হয়। একা একা উঠবানা আর, খবরদার।”
—“উফফ! আমি ঠি ক আছিতো। আপনি অযথাই চিন্তা করছেন।”
ভাতের শেষ লোকমাটা মুখে তুলে দিয়ে নিভ্রান খেয়াল করলো রাত্রি একহাতে পেট চেপে ধরেছে। একপলক চেয়ে সে আস্তে করে বললো,
—“পেটে ব্যাথা?”
রাত্রি কপালে ভাঁজ ফেলে বিরক্তি নিয়ে বললো,
—“হু, তরকারিতে ঝাঁল বেশি হয়েছে। মরিচগুড়াটার রং সুন্দর না। আমি ভেবেছি ঝাঁল হয়না তাই পরে আরো দু’চামচ মিশালাম। এখন মুখেই দেয়া যাচ্ছেনা।”
—“দুপুরেও এটাই খেয়েছি তখন ঝাঁল লাগলোনা?”
রাত্রি ভাবলেশহীন বললো,”লেগেছে মনেহয়, তখন টের পাইনি।”
নিভ্রান নিশব্দে হাসলো। প্লেট রেখে পানি খাওয়ালো। ঠোঁট মুছিয়ে দিতে দিতে বললো,”ডক্টর এসেছিলো। তোমার প্রেগনেন্সির টেস্ট দিয়ে গেছে।”
রাত্রি বিষম খেলো যেনো। চোখের দৃষ্টি এলোমেলো। কোনরকমে মুখের পানিটা গিলে নিয়ে অদ্ভুত কন্ঠে বললো সে,
—“জি?”
নিভ্রান গলা ঝেঁড়ে বললো,”মাথা ঘুরায়, বমি হয়, পেটে ব্যাথা এসব কি এমনি এমনি নাকি? বাসায় আসলেই দেখি তুমি ঝিঁমাও সারাক্ষণ। এইযে এখনো, খাবার মাঝে কয়বার হাই তুললে? চারবার। অথচ এতক্ষণ যাবত শুয়েই ছিলে। সকালে যাবো। টেস্ট করাতে। এখন ঘুম পেলে ঘুমিয়ে পড়ো।”
সে রজনীতে বিস্তর শূণ্যের জলধারা রুষ্টই থাকলো। আসবে আসবে করেও শেষমেষ অনুপস্থিত সে। কাটলো সময়। সাদা মেঘের বর্ষণের বদলে রাঙা সূর্যের রং মাখলো পৃথিবীতে। সকাল হতেই তাকে নিয়ে হসপিটালে ছুটলো নিভ্রান। কি ভীষণ গরম পরেছে আজ। ভাদ্রমাসের মাঝামাঝি। তাল পাকা গরম। ভ্যাপসা পরিবেশ। গাড়ির জানালা বন্ধ করে এসি ছেড়ে রেখেছে নিভ্রান। গাড়ি চলছে ভার্সিটির পথে। ইউরিন টেস্ট করতে স্যাম্পল দিয়ে এসেছে ল্যাবে। আল্ট্রাসোনোগ্রাফি করিয়ে এসেছে। সন্ধ্যায় রিপোর্ট নিয়ে আসবে। নিভ্রান বলে এসেছে আর্জেন্ট করে দিতে।
মাঝে তেমন কথা হলোনা। নিভ্রান এক দুইবার জিজ্ঞেস করলো শরীর খারাপ লাগছে নাকি। রাত্রি মাথা নাড়িয়ে না জানালো। গাঁট হয়ে বসে আছে মেয়েটা।
ভার্সিটিতে নামিয়ে দিয়ে অফিসে গেলো নিভ্রান। রাত্রির ফাইনাল পরীক্ষা কয়দিন পরই। বেশি হলে এক দু’মাস বাকি হয়তো। শুধু বাসায় নোটস এনে দিলে কুলাবে না তার। ক্লাস করাটা খুব জরুরি। প্রফেসরের লেকচার তো আর বাসায় পাওয়া যাবেনা। মেয়েটার পড়াশোনায় চুল পরিমাণ বাঁধাও আসতে দিতে চায়না সে।
______________
ওই বাসার টি উশনিটা ছেড়ে দিয়েছে মাসখানেক হলো। এখন বিকেলেই বাড়ি ফিরে যায় রাত্রি। মাঝেমধ্য নিভ্রানের অফিসে যায়। তারপর সেখান থেকে একসাথে বাড়ি ফিরে সন্ধ্যায়। আজ অবশ্য ব্যাতিক্রম।
নিভ্রান নিজেই চলে এসেছে গাড়ি নিয়ে। ড্রাইভার দিয়ে পাঠায়নি। হসপিটালে যাবে সে। রাত্রি মিনমিন করে বললো,”এতো তাড়াতাড়ি তো রিপোর্ট রেডিই হয়নি। বললোনা সন্ধ্যায় যেতে?”
নিভ্রান শুনলোনা কিছুই। সোজা হসপিটালে গেলো। সকালেও সে এমনই করেছে। সবার আগে যেয়ে হলপিটালে পৌঁছেছে।
রিপোর্ট সত্যিই হয়নি তখনো। সাতটার পরে দিবে। এখন বাজে পাঁচটা চল্লিশ। পাগলটা একঘন্টা বিশমিনিট অপেক্ষা করলো সেখানেই। রাত্রি গাড়ির পিছের সিটে শুয়ে রইলো। ক্লান্ত লাগছে। লোকটা আসলেই পাগল। পুরো উন্মাদ।
কাগজে স্পষ্ট ইংরেজি গোটা গোটা অক্ষরে “Positive” লেখা। আল্ট্রা রিপোর্টে দেয়া বাচ্চার বয়স
১ মাস+ অর্থ্যাৎ ৫ সপ্তাহ। সুস্থ আছে একদম। নিভ্রান রিপোর্টগুলো হাতে নিয়ে বসে রইলো কতক্ষণ। চেয়ে থাকলো নির্নিমেষ। মিস.নিকিতা কিসব যেনো বলে যাচ্ছে রাত্রিকে। নিভ্রানের কানে ঢুকলোনা। উত্তেজনায় ভেতরটা কাঁপছে। বাইরেটা নিশ্চল, শান্ত। হুঁশ ফিরলো রাত্রির ধাক্কায়। তার বাহুতে হাত রেখে চাপা স্বরে ডাকছে।
নিভ্রান পলক ফেলে বললো,”কি হয়েছে?”
রাত্রি চাঁপা গলায়ই বললো,
—“আপু ডাকছেন আপনাকে।”
নিভ্রান রিপোর্টটা কোলের উপর রাখলো। কোনরকমে ঠোঁটে হাসি ফুটিয়ে বললো,”জি বলুন ডক্টর।”
মিস.নিকিতা হাসলেন। হাসি বজায় রেখেই বললেন,”স্ত্রীর খেয়াল রাখবেন মিস্টার।”
নিভ্রান মাথা নাড়ালো। মৃদুস্বরে সম্মতি দিলো। তার লজ্জা লাগছে কেনো যেনো। অদ্ভুত!
________________
আকাশে চাঁদ উঠেছে। সরু অর্ধচাদ। হাসছে যেনো উচ্ছাসে ফেঁটে। ঠোঁট বাঁকা খুশির হাসি। নদীর পানিতে কি সুন্দর আলোর খেলা। ঝিলমিলে ঢেউ। হাল্কা হাল্কা স্রোত। শব্দ! দূরে একটা লন্চ যাচ্ছে। ভনভনে আওয়াজটাও মধুর শোনাচ্ছে। কি ভীষণ সম্মোহনী পরিবেশ! গাড়ি থামলো। সামনের হেডলাইটদুটো নিভলো। হাতের ড্রাই কেকের প্যাকেট থেকে শেষ টুকরোটা চিবাতে চিবাতে রাত্রি বললো,”এটা কোথায়?”
নিভ্রান তার সিটবেল্টটা খুলে দিলো। হাতের খালি প্যাকেটটা নিয়ে পকেটে ভরে ফেললো। আশেপাশে ডাস্টবিন নেই। ড্রয়ের থেকে পানির বোতল বের করে ঠোঁটের কাছে ধরে বললো,
—“হা করো, শুকনো জিনিস। গলায় আটকাবে।”
রাত্রি পানি খেয়ে আবার বললো,”বাসায় যাবেননা?” প্রশ্ন করে নিভ্রানের কব্জি টেনে ঘড়ি দেখলো সে। সাড়ে আটটার অনেক বেশি। নয়টা ছুঁইছুঁই প্রায়। তারপর আবার বললো,”দেখুন, ন’টা বাজে।”
নিভ্রান ঝুঁকে তার পাশের দরজার লক খুলতে খুলতে বললো,” এটা কোন নদীটা জানো? ওইযে ব্যালকনি থেকে দেখা যায়। তুমি দাড়িয়ে দাড়িয়ে দেখোনা? সেদিন বললে, সামনাসামনি দেখার খুব ইচ্ছে।…কাল নৌকা বানালে। বৃথা যাবে নাকি তোমার কষ্টটা? আমি নিয়ে এসেছি নৌকাগুলো। নদীর পানিতে ভাসাবো, চলো। আশেপাশে আর কোথাও নদী- নালা নেই রাত। নয়তো এতদূর কষ্ট করিয়ে আনতাম না তোমাদের।”
রাত্রি ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থাকলো। বিস্ময়ে চোখ ছলছল করছে। কোঁণে জ্বালা করছে। নিভ্রানের নিরবতায় ভেবে নিয়েছিলো সে হয়তো খুশি হয়নি তেমন। বাচ্চাটা হয়তো তার জন্য অনাকাঙ্খিত। কিন্তু না! লোকটা হয়তো সবার মতো প্রকাশ করতে পারেনা। অন্যভাবে প্রকাশ করে। একদম অন্যভাবে। যা শুধু সেই বুঝে। আল্লাহ শুধু তাকেই এই ভিন্নতা বোঝার ক্ষমতা দিয়েছে। আর কাউকে না।
রাত্রির চোখের পানি লক্ষ্য করে মূহুর্তেই চোয়াল শক্ত করলো নিভ্রান। কাঠকাঠ গলায় বললো,
—“খবরদার! কাঁদবেনা রাত। একদম কাঁদবেনা! পানি যেনো না পড়ে। আমি কিন্তু এক্ষুনি গাড়ি ঘোরাবো।”
রাত্রি পানি গড়ানোর আগেই মাথা ঝুঁকিয়ে ফেললো। দু’হাত কঁচলে চোখ মুছলো। অশ্রুসিক্ত কন্ঠেই বললো,
—“আপনার বাচ্চা কিন্তু আপনাকে পাগল ভাববে নিশ্চিত।”
—“ভাবুক। ভাবার কি আছে ও জানুক ওর বাবা পাগল। ওর মা-ই তো বানিয়েছে।”
রাত্রি চোখে পানি নিয়েই হেসে ফেললো। নিভ্রান চেয়ে থেকে বিরবির করলো,
—“তুমি এভাবেই হাসো রাত। সবসময় হাসো। আমি আমৃত্যু সেই হাসিতে মুগ্ধ হতে থাকি শুধু।”
________________
নৌকাগুলো ভাসছে নদীতে। এত্তো সুবিশাল উদার নদীরও ক্ষুদ্র অংশ ঢেকে গেছে সযত্নে তৈরি করা কাগজের ভালবাসায়। পাড়ে বসে আছে দুজন মানব- মানবী। একজনের ঠোঁটে বাচ্চাসূলভ মিষ্টি হাসি। আরেকজনের চোখে সেই হাসির পানে চেয়ে থাকা গুচ্ছ গুচ্ছ মুগ্ধতা। হাত বাড়ালেই পানি। একদম ঘাটে বসে আছে তারা। এপাশটা এখন নিরব। খানিকটা দূরে নৌকা টোকা এসে ভিড়ছে। নিভ্রান আচমকাই রাত্রির কোলে মাথা রাখলো।
রাত্রি আৎকে উঠলো। কপট রাগ দেখিয়ে বললো,
—“আল্লাহ! কি করেন? গায়ে মাটি লাগবে। ঘরে যেয়ে মাথা রেখেন। এখন উঠেনতো।”
নিভ্রান পাত্তা দিলোনা। বরং পাশ ফিরে পেটে মুখ গুঁজে ধীর গলায় বললো,
—“ও কি বুঝতে পারছে ওর বাবা ওর কত কাছে? এইতো অল্প একটু দুরত্ব। নয়তো ওকে ছুঁয়ে ফেলতাম। তাই না রাত?”
রাত্রি হাসলো। ঝাঁকড়া চুলে হাত গলিয়ে বললো,”ওর এখনো হাত পা হয়ইনি মনেহয়। মাত্র তো ১ টা মাসই।”
~চলবে~