মন_মোহনায়_ফাগুন_হাওয়া #লেখিকা: #নুরুন্নাহার_তিথী #পর্ব_৩২

0
322

#মন_মোহনায়_ফাগুন_হাওয়া
#লেখিকা: #নুরুন্নাহার_তিথী
#পর্ব_৩২
আজকের দিনটা বেশ সারপ্রাইজিং ছিল মীরার জন্য। শেহজাদ ও-কে ভার্সিটিতে নামিয়ে দিয়ে যাওয়ার পর কলিগদের থেকে শুরু করে স্টুডেন্টদের ভালোবাসায় মন সিক্ত হয়েছে তার। আজকের দিনে যে কয়টা ক্লাস নিয়েছে, প্রতিটা ক্লাস থেকে কিছু না কিছু গিফট তো পেয়েছেই। সাথে স্টুডেন্টদের আন্তরিক শুভেচ্ছা। তারমধ্যে প্রত্যেকের থেকে ফুলের তোড়াও উপহার পেয়েছে। ভার্সিটির অফিস টাইম শেষে মীরা অপেক্ষা করছে শেহজাদের জন্য। মীরার কলিগ দুজনের মধ্যে কনক ম্যাম নিজের ব্যাগ গুঁছিয়ে বেরোবে তখন হাস্যরসে বলে,
“হাসবেন্ডের জন্য অপেক্ষা করছো? আমারও এমন হতো। বিয়ের প্রথম দিকে। কষ্ট করে হলেও নিতে আসবেই।”

মীরা মৃদু হাসে। সাবিহা ম্যামও সাথে তাল মেলায়,
“আমার জন বড্ড অলস। সকালে দিয়ে যায় তারপর বিকেলে এই ট্রাফিক ঠেলে তার নিতে আসতে মোটেও ইচ্ছে করে না। তাই আমি উবার ডেকে চলে যাই। কনক ম্যামের তো এখন নিজস্ব গাড়িই আছে।”

“গাড়ি থাকলেও কী! অলসতার জন্য ড্রাইভিং শিখতে পারলাম না।”

“রিল্যাক্সে বাড়ি ফিরতে পারলে শেখার থেকে না শেখাই ভালো। তবে সেফটির জন্য শেখা থাকা উচিত।”

মীরা ওদের কথায় এবার প্রত্যুত্তর করে,
“আমিও উনাকে ট্রাফিকের কথা বলেছিলাম, কিন্তু শোনেনি। ভালোই হয়েছে, উবার বা পাবলিক ট্রান্সপোর্টে একটু কেয়ারফুল থাকতে হয়।”

“হুম। থাকো তবে। উবার কাছাকাছি চলে এসেছে। গেলাম।”

সাবিহা ম্যাম চলে গেলেন। কনক ম্যামও ফোন আসাতে কথা বলতে বলতে বিদায় জানিয়ে বেরিয়ে পড়েন।

প্রায় আধঘণ্টা পর শেহজাদ কল করলে মীরা নিজের অফিস রুম থেকে আজকের উপহার গুলো নিয়ে বেরোয়। সে গাড়ির কাছে পৌঁছালে, ড্রাইভিং সিটে বসে শেহজাদ গাড়ির ফ্রন্ট সিটের ডোর খুলে দেয়। মীরা গাড়িতে বসেই আগে নিজের ব্যাগ ও ফুলগুলো পিছনের সিটে রেখে তারপর ডোর লক করে। শেহজাদ সরু দৃষ্টিতে এসব দেখছে। মীরা সোজা হয়ে বসলে শেহজাদ জিজ্ঞাসা করে,

“এতো ফ্লাওয়ার?”

“হ্যাঁ স্টুডেন্টরা দিলো। সুন্দর না দেখুন? লিলি ফ্লাওয়ারের দুটো রঙের দুটো তোড়া। তারপর ডিফরেন্ট কালারের ডেইজি ফ্লাওয়ারের একটা তোড়া। খোঁপায় দেখুন। (মীরা হালকা পিছ ঘুরে তার খোঁপা দেখালো) একটা কালো গোলাপ ও দুইটা লাল গোলাপ। হলুদ ও হালকা গোলাপি ও সাদার মিশেলেরও গোলাপ দিয়েছে। তোড়াগুলোর মধ্যে রেখে দিয়েছি। আসলে তিনটা খোঁপায় পড়িয়ে দিলো বলে তোড়াটা খুলতে হলো।”

শেহজাদ গাড়ি স্টার্ট করে বলে,
“ওয়াও! ভার্সিটিতে কোয়াইট ফেমাস তুমি!”

মীরা এটাকে কম্পিলিমেন্ট হিসেবে নিলেও শেহজাদ মোটেও এটা প্রশংসাবাদ দেয়নি। মীরা খুশি মনে বলে,

“ফেমাসের জন্য না। বিয়ের পর আজকে ফার্স্ট ক্লাস নিলাম। ওরা নিজেদের ভালোবাসা প্রকাশ করেছে। ওরা খুব ফ্রেন্ডলি।”

“ইয়াস্টারডে তো আমিও ভার্সিটিতে গেলাম। তো?”

মীরা এবার শেহজাদের বলার ধরণ খেয়াল করে। সামান্য ঘুরে বসে শুধায়,
“আপনি কি জে*লাস? আপনার স্টুডেন্টরা আপনাকে কেন ফুল দিলো না তাই জন্য?”

শেহজাদ থতমত খেয়ে চো*রা নজরে একবার তাকিয়ে কণ্ঠে স্বাভাবিকতা এনে বলে,
“অফকোর্স নট। জাস্ট আস্কিং। ফ্লাওয়ার এসব ফিমেইল ফ্যাকাল্টিদেরকেই স্টুডেন্টরা দেয়। তোমার স্টুডেন্টদের ম্যাক্সিমাম কি ফিমেইল?”

“না। এভারেজ। কিছু ক্লাসে মেয়ে বেশি, কিছুতে ছেলে বেশি। আপনি তো বুঝেনই।”

“হুম। আচ্ছা একটা কথা জিজ্ঞাসা করি?”

“করুন।”

“যখন তুমি আমার স্টুডেন্ট ছিলে, তখন তোমার আমাকে কেমন মনে হতো? লিটারেলি আমি দেখি স্টুডেন্টরা আমাকে দেখলে কেমন রো*বটের মতো থেমে যায়। লিফটে এমনটা বেশি হয়। করিডরে তো জলদি করে সালাম দিয়ে পাশ কা*টা*তে পারলেই যেন বেঁচে যায়, এমন ভাবে চলাচল করে।”

মীরা মুখ ঘুরিয়ে নিয়ে অতি স্বল্প আওয়াজে নিজে নিজেই বলে,
“ভার্সিটির ফার্স্ট দিন আপনাকে ফার্স্ট দেখেই তো আমি সহ আমার বান্ধবীরা ক্রা*শ খেয়ে বসেছিলাম! এটা এখন কীভাবে বলি!”

শেহজাদ নিজের প্রশ্নের জবাব না পেয়ে ফের শুধায়,
“বললে না?”

“ও ও হ্যাঁ।!

মীরা দ্রুত সোজা হয়ে বসে। শেহজাদেে দিকে তাকালে শেহজাদ ইশারায় বলতে বলে সামনের দিকে ফিরে ড্রাইভ করতে থাকে। মীরা বলেই ফেলে,
“আপনি তো ডিপার্টমেন্টের মেয়েদের ক্রাশ ছিলেন!”

শেহজাদ মীরার দিকে সরু দৃষ্টি নিক্ষেপ করে হেসে বলে,
“তোমারও?”

“না না। আমার ক্রাশ হতে যাবেন কেন! আমি সবার কথা বলছি।”

মীরা জিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে নিয়ে ঠোঁট কা*ম*ড়ে সিটে গা এলিয়ে দেয়। অতঃপর ঠিক হয়ে আবার গাড়ির সামনে রাখা পানির বোতল নিয়ে পানি খায়। শেহজাদ ওর অস্থিরতা দেখে মুচকি হেসে কয়েক সেকেন্ড নিরব থেকে বলে,
“যেদিন আমার মেয়ে পৃথিবীতে এলো, সেদিন ক্লাসে সবাইকে নিউজটা দিতেই সবাই চমকে উঠেছিল। মেয়েরা একযোগে আস্ক করে বসে, ‘স্যার আপনি ম্যারিড?’ সেদিনি আমার টিএ অফিস আওয়ারে এসে ব্যাপারটা নিয়ে আমাকে বলছিল। ডিপার্টমেন্টের মেয়েরা নাকি আজ অনেক দুঃখী।”

মীরা বলে,
“আমরা কিন্তু আপনার মেয়ে হওয়াতে অখুশি হয়েছিলাম, তেমনটা না। আসলে আপনাকে দেখে মনে হতো না আপনি ম্যারিড। তাছাড়া ফেসবুকে আপনার রিলেশনশিপটা হাইড করা। নিজেও কখোনো বলেননি। হঠাৎ করে বেবির খবর পেলে শকড তো হবেই।”

“হুম বুঝলাম। বাদ দাও টপিক। সামনে মেবি ছোটো জ্যাম পড়বে। টায়ার্ড হলে ঘুমাতে পারো।”

মীরা চুপ করে সিটে হেলান দিয়ে থাকলো।

_______

রাতের ডিনার করে মীরা, ফ্রিশাকে ঘুম পাড়াতে গিয়ে নিজেও ফ্রিশার পাশে ঘুমিয়ে পড়েছে। শেহজাদ রাত সাড়ে এগারোটা পর্যন্ত বই পড়ে হঠাৎ খেয়াল হলে মীরাকে খুঁজতে ফ্রিশার ঘরে গিয়ে দেখে মা-মেয়ে দুজনে জড়িয়ে ধরে ঘুমাচ্ছে। শেহজাদ হালকা হেসে ভিতরে গিয়ে ফ্রিশার মাথায় হাত বুলিয়ে কপালে আদুরে ঠোঁ*ট ছুঁইয়ে দেয়। অতঃপর মীরাকেও। মীরা খানিক নড়েচড়ে উঠলে দুজনের গায়ে চাদর টেনে দিয়ে লাইট নিভিয়ে শেহজাদ সেখান থেকে বেরিয়ে আসে। নিজের রুমে এসে শেহজাদও লাইট বন্ধ করে শুয়ে পড়ে।

পরদিন সকালে ফজরের আজানের সময় মীরার ঘুম ভাঙলে নিজেকে ফ্রিশার ঘরে দেখে উঠে বসে। চোখ লেগে যাওয়াতে এখানেই ঘুমিয়ে পড়েছিল। উঠে আস্তে আস্তে নিজের রুমে গিয়ে দেখে শেহজাদ ঘুমাচ্ছে। মীরা মৃদু স্বরে ডাকে। তারপর দুজনে একসাথে নামাজ পড়ে। মীরা কফি বানিয়ে আনে। মীরা ড্রাইকেক খেতে খেতে বলে,
“রাতে কীভাবে চোখ লেগে গেছে। টেরই পাইনি।”

শেহজাদ মীরার দিকে চেয়ে মৃদু হেসে বলে,
“টায়ার্ড ছিলে। হয় এরকম।”

“হুম। আজ কিন্তু আমার সকালে ক্লাস নেই। আমি পড়ে যাব।”

“আচ্ছা। ড্রাইভার ফ্রিশাকে স্কুলে ড্রপ করে তোমাকে ভার্সিটিতে পৌঁছে দিবে।”

মীরা মাথা নেড়ে কফি শেষ করে দুটো মগ ও বাটি নিয়ে কিচেনে চলে যায়। সবার জন্য নাস্তা বানাবে আজ।

_______

আজও মীরা ফ্রিশাকে ঘুম পাড়াতে গিয়ে সেখানেই ঘুমিয়ে গেছে। শেহজাদ, গতদিনের মতো ফ্রিশাকে দেখতে ও মীরাকে খুঁজতে গিয়ে ওদের গায়ে চাদর টেনে রুমের আলো নিভিয়ে চলে আসতে নিবে তখন দরজায় মিসেস শাহিদাকে দাঁড়ানো দেখে। উনার হাতে পানির বোতল। মিসেস শাহিদা শুধালেন,

“মীরা এখানেই ঘুমিয়ে গেছে? তুললে না ও-কে?”

“থাক। ঘুমাক। আপনিও শুয়ে পড়ুন।”

“হুম। গতকালকেও দেখলাম মীরা এখানে ঘুমাচ্ছে। ভাবলাম ঝামেলা হলো কী-না?”

“না ফুফিজান। ঝামেলা হবে কেন? ও টায়ার্ড তাই ঘুমিয়ে পড়েছে।”

“আচ্ছা। সব ঠিক থাকলেই ভালো।”

মিসেস শাহিদা চলে যান। শেহজাদও নিজের রুমে চলে আসে।

গতদিনের মতো মীরা আজও ভোরে ঘুম থেকে উঠে নিজেকে ফ্রিশার ঘরে আবিষ্কার করে নিজে নিজেই বলতে থাকে,

“আরে আমার এই স্বভাব কি যাবে না! বিছানায় একটু গা এলালেই ঘুমে তলিয়ে যাই! স্যার কী ভাবছেন এখন কে জানে! বাড়ির অন্যকেউ নোটিশ করলে তো ভালো দেখাবে না। নাহ্ কাল থেকে ঘুমানো যাবে না।”

মীরা উঠে নিজের রুমে যায়।

______

নিজের ক্লান্তির ধারাবাহিকতা রেখে মীরা পরদিনও একই কাজ করে! ঘুমিয়ে পড়ে। শেহজাদ আজকেও ফ্রিশার রুমে গিয়ে এই অবস্থা দেখে বিড়বিড় করে বলে,
“এই মেয়ে এতো ঘুমকাতুরে কেন? আজকেও ফুফিজান দেখলে কেমন হবে ব্যাপারটা! নাকি আমিও এখানেই থেকে যাব?

কিছু একটা ভেবে শেহজাদ চট করে মীরাকে পাঁজাকোলা করে তুলে নেয়। ঘুমের মধ্যেই মীরা ধড়ফড়িয়ে উঠে চোখ খুলে নিজেকে শেহজাদের কোলে দেখে ভয়ার্ত স্বরে প্রশ্ন করে,

“কী হয়েছে? কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন?”

মীরার ভয়ার্ত আঁখিযুগল বলছে, আচমকা ঘুম ভেঙে যাওয়াতে মীরা পরিবেশ বুঝতে পারছে না। শেহজাদ নরম স্বরে বলে,
“রিল্যাক্স। তুমি আজও এখানে ঘুমিয়ে পড়েছিলে। প্রথমে ভেবেছিলাম আমিও থেকে যাব এখানে কিন্তু চাই না ফুফিজান আজও দেখুক। আগামীকাল না আমরা তোমাদের বাড়িতে যাব? তাই ভেবেছিলাম, তোমার ঘুম না ভাঙিয়ে নিয়ে যাই।”

মীরা বুকে হাত দিয়ে লম্বা নিঃশ্বাস ছেড়ে বলে,
“না মানে সরি। আমি আজ ঘুমাব না ঘুমাব না করে আবার ঘুমিয়ে গেছি। আসলে আমি কিন্তু এতো জলদি ঘুমাই না। ফোন কাছে থাকলে তো বারোটারও বেশি বাজে ঘুমাতে। আচ্ছা নামান আমাকে।”

“কেন? একেবারে রুমে নিয়ে নামাই।”

“আমি তো জেগেই গেছি। নামিয়ে দেন।”

শেহজাদ কোনো কথা না বলে নিশ্চুপে মীরাকে কোলে নিয়েই হাঁটতে থাকে। বাহিরে শীতল হাওয়া তবে বৃষ্টি আসার ভাব হলেও হয়তো আসবে না। শেহজাদের নিরবতায় মীরা খানিক কেঁপে ওঠে। ব্যালকনির দরজা দিয়ে আসা ঠান্ডা হাওয়ার পরিবেশটা বেশ আকাঙ্ক্ষিত! প্রণয়ের হাওয়া দুটি হৃদয়ে এসে ভীড়েছে তারই বহিঃপ্রকাশ যে এ!

চলবে ইনশাআল্লাহ,

ভুল ত্রুটি থাকলে ক্ষমা করবেন। কপি নিষিদ্ধ।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here