#ফিরে_আসা
৩১+৩২
লেখা : অতন্দ্রিলা আইচ
অস্বাভাবিক বিয়েটা নিয়ে দোনমনো আপাতত বন্ধ হয়েছে। অরার জীবনটা এখন বেশ স্বাভাবিক পর্যায়ে চলে গেছে। এ বাড়িতে তার দিনকাল ভালোই কাটছে। বিশাল এই বাড়িটা ঘুরে ঘুরে দেখছে, কোথাও কোনো অসামঞ্জস্য চোখে পড়লে নিজের মতো করে ঘর সাজাচ্ছে, আব্দুলের কাছে রোজ নতুন নতুন রান্না শিখছে। তার থেকেও আশ্চর্যজনক বিষয়, সময় সুযোগ পেলে আরশাদের সঙ্গে কথা হচ্ছে।
ব্যক্তি আরশাদকে অরা চেনে চার বছরেরও অধিক সময় জুড়ে। তবে এখন মনে হচ্ছে তাকে চেনার আরও অনেক কিছু বাকি আছে। আরশাদ তার মধ্যে বিচিত্র একটা জগৎ লুকিয়ে রাখে। যে জগতটাকে সে সাধরনত মানুষের আড়ালেই রাখে। তবে এক বাড়িতে থেকে সেই জগতের কিছুটা আভাস হলেও পায় অরা।
কাজের বাইরে আরশাদের মুখে কোনো কথা শুনে অভ্যস্ত নয় অরা। সে তো ধারণাই করে নিয়েছিল আরশাদ নিতান্ত রোবট প্রকৃতির। তবে সেই ধারণা মোটেও সত্যি নয়। আরশাদও মন খুলে কথা বলতে পারে, গল্প করতে পারে। নিজের ক্যারিয়ারের শুরুর দিককার গল্প, সিনেমার শুটিংয়ের গল্প। শুধু যে নিজের গল্প করে তা নয়। আরশাদ চারপাশের জগত সম্পর্কে অগাধ জ্ঞান রাখে। তার সঙ্গে কথা বলে কত কিছু যে শেখা যায়!
সূর্য ঢলে পড়ছে পশ্চিম আকাশে, অস্ত যাওয়ার অপেক্ষা। আলো থেকে অন্ধকারে যাওয়ার এই সময়টা বিচিত্র এক হতাশায় জড়িয়ে থাকে। মন কেমন অবশ হয়ে ওঠে। অনুভূতিগুলো ঠিকঠাক কাজ করে না। মনে হয় যেন, সময়টা কোনমতে পাড় করে দেওয়াটাই কষ্টের।
ছাদে হাঁটাহাঁটি করছে অরা। লাইব্রেরির পাশাপাশি আজকাল তার এ বাড়ির ছাদে সময় কাটাতে ভালো লাগে। ঘরে আবদ্ধ থেকে দমবন্ধ হয়ে আসলেই অরা ছুটে আসে এখানে। ছাদে আগে থেকেই দেশি-বিদেশি ফুলের বহু গাছ ছিল। এখান সেখানে নতুন সংযোজন, আরশাদের সবজির বাগান।
আরশাদ যে শখ করে বাগান করছে এমনটা নয়। শখ করার সময় তার নেই। বাগান করছে কাজের খাতিরে। পরবর্তী সিনেমায় তার চরিত্রটা একটু পাগলাটে প্রকৃতির। তার বিশাল অর্গানিক গার্ডেন আছে। সে দিনরাত বাড়িতে পড়ে থেকে বাগান করে। আরশাদ সত্যিকারের জীবনে কোনদিন বাগান করেনি। তবে পর্দায় তাকে ফুটিয়ে তুলতে হবে একজন অনুরাগী বাগানপ্রেমীর চরিত্র। ওই সিনেমার শুটিং শুরু হতে এখনো মাস দুয়েক বাকি। মাঝের এই সময়টুকুতে আরশাদ বাগান করে নিজের হাত পাকাচ্ছে।
“সরি! বিরক্ত করলাম?”
অরা আঁতকে উঠে পেছন ফিরলো। আরশাদ কথাটা বলতে বলতে ছাদে প্রবেশ করেছে। আরশাদের এই ব্যাপারটা অরাকে প্রচন্ড মুগ্ধ করে। পুরো দুনিয়া তাকে সুপারস্টার মনে করলেও তার মধ্যে বিন্দুমাত্র হামবড়া ভাব নেই। নিজেকে আর দশটা মানুষের মতোই মনে করে সে। অন্যকে মানুষ হিসেবে সন্মান করতে জানে। তা না হলে আরশাদ নিজের ছাদে ঢোকার আগে অরাকে জানান দেওয়ার প্রয়োজন মনে করতো না। নিজেকে সাধারণ মনে করে বলেই আরশাদ বলেছে, “বিরক্ত করলাম?” অথচ সে জানেই না তার উপস্থিতির জন্যে মানুষ কতটা উদগ্রীব হয়ে থাকে।
অরা হাসিমুখে বলল, “না স্যার! আমি তো আপনার বাগানটাই দেখছিলাম।”
ছাদের পাশের থাকা ছোট্ট স্টোররুমে চলে গেল আরশাদ। বাগান করার যাবতীয় সব সরঞ্জাম সেখানেই রাখা আছে।
সেগুলো আনতে আনতে আরশাদ বলল, “কেমন লাগছে বাগানটা এখন?”
অরা হাসিমুখে বলল, “খুব সুন্দর! এই কয়দিনে অনেক ভালো যত্ন নিয়েছেন আপনি।”
আরশাদ প্লাস্টিকের গ্লাভস হাতে পড়তে পড়তে খানিক ক্লান্ত স্বরে বলল, “ক্যারেক্টারের জন্য কতকিছু যে করতে হয়!”
অরা মন দিয়ে দেখতে লাগলো আরশাদের বাগান করার দৃশ্য। প্রথমে সে স্প্রে নিয়ে সবগুলো গাছের গায়ে পানি দিলো। এরপর একটা কাঁচি নিয়ে পেকে যাওয়া পাতাগুলো কেটে ফেলতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো। সবশেষে ছাঁটাইয়ের জন্যে ব্যবহৃত বিশেষ একধরনের কাঁচি একটা গাছের আগাচাগুলো ছাঁটাই করছে।
অরা কৌতূহলী গলায় জিজ্ঞেস করলো, “এটা কী গাছ স্যার?”
“আমি নিজেও জানি না। প্রোডাকশন থেকে গাছ দিয়ে গেছে আর আমি গার্ডেনিং করছি। ফল আসার পরেই বোঝা যাবে কী গাছ।”
“আমার ধারণা এটা বেগুন গাছ।”
আরশাদ কিছুটা অবাক গলায় বলল, “তুমি গাছ-গাছালিও চেনো?”
“একটু-আধটু চিনি। ছোটবেলাটা তো বনে-বাঁদাড়ে ঘুরে ঘুরেই কাটিয়েছি। আমাদের বাড়ির খানিক পেছনে কয়েকটা বেগুন গাছ ছিল। ছোট ছোট বেগুন ফুটে থাকতো আর আমি গিয়ে তুলে আনতাম। আর না সেগুলোর ভর্তা করতো।”
“তুমি পারো বেগুন ভর্তা করতে?”
“জি স্যার পারি।”
“ঠিক আছে, এটা যদি সত্যিই বেগুন গাছ হয়, তাহলে গাছের বেগুনগুলোর ভর্তা তুমি করবে।”
অরা হাসিমুখে ঘাড় কাত করে সায় জানালো। একটু একটু করে সে যেন এই বাড়ির সদস্য হয়ে উঠছে। যদিও সে একবছরের জন্যে এ বাড়ির অতিথি, তবুও আরশাদ তাকে অতিথির মতো দেখে না। আরশাদের কথায় বা আচরণে অরার মনে হয় যেন সে নিজের বাড়িতেই আছে।
“আচ্ছা স্যার? একটা প্রশ্ন করবো?”
আরশাদ ভ্রু কুঁচকে বলল, “প্রশ্ন করার আগে প্রশ্ন করার দরকার কী?”
অরা ঢোক গিলে বলল, “ক্যারেক্টারের জন্য আপনাকে এই পর্যন্ত সবথেকে কঠিন কোন কাজটা করতে হয়েছে?”
আরশাদ কিছুটা সময় নিয়ে ভেবে বলল, “বলা মুশকিল! আমার জীবনে প্রায় সবকিছুই শেখা ক্যারেক্টারের জন্য। আমি আগে স্মোক করতাম না। কিন্তু প্রথম সিনেমাতেই চেইন স্মোকারের ক্যারেক্টার পেলাম। সিগারেট খাওয়া শিখতে হলো। পরের সিনেমার জন্য ড্রাইভিং শিখতে হলো। এখন আবার এই গার্ডেনিং শিখছি। প্রথম প্রথম সবকিছুই শিখতে যাওয়ার সময় কঠিন মনে হয়েছে।”
অরা প্রশংসার সুরে বলল, “কোনো অভিনেতা অভিনয়কে আপনার মতো সিরিয়াসলি নেয় না।”
“কী আর করা? কাজটাকে অবহেলা করতে পারি না তো। তুমি যেমন করছো!”
অরা হতভম্ব হয়ে বলল, “আমি কখন কাজে অবহেলা করলাম স্যার?”
“কাল রাতে বলেছিলাম শুটিংয়ের নেক্সট শিডিউলটা আমাকে মেইল করে দাও। আজ বিকেল হয়ে গেল। অথচ এখনো শিডিউল পেলাম না।”
অরা ব্যস্ত হয়ে বলল, “I’m so sorry sir! একেবারেই ভুলে গিয়েছিলাম। আমি এক্ষুনি পাঠিয়ে দিচ্ছি।”
আরশাদ শান্ত ভঙ্গিতে বলল, “আরে ব্যস্ত হতে হবে না অরা। এই সপ্তাহের মধ্যে পাঠালেই হবে।”
অরা চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল। আগাছা পরিষ্কার শেষে আরশাদ এবার গাছগুলোর নিচে সার দিচ্ছে। সার দেওয়ার নিয়মটা সে আগেই ইউটিউব থেকে শিখে নিয়েছে। একজন সুপারস্টার চরিত্রের জন্যে এত কষ্ট করছে। ভাবা যায়? যদিও এত কষ্টের কোনো প্রয়োজন নেই। সে ভালো অভিনয় করুক বা না করুক, আরশাদ হকের সিনেমা চলার জন্যে ওই নামটাই যথেষ্ট।
অরা হঠাৎ কী যেন মনে করে বলল, “স্যার? আব্দুল ভাই কি চলে গিয়েছে?”
“হুঁ, মাত্রই তো বের হলো ওরা।”
“যাক! এবার তাহলে রান্নাঘরে পা রাখা যাবে। সকাল থেকে রান্নাঘর তো উনার দখলেই থাকে।”
আরশাদ কিছু বলল না। স্বভাবসুলভ ক্ষীণ হাসি হেসে কাজে মনোযোগ দিলো।
অরা হালকা গলায় বলল, “কফি খাবেন স্যার?”
“খেতে পারি।”
“আমি আসছি তাহলে।”
ব্যস্ত পায়ে নিচে নেমে গেল অরা। রান্নাঘরে কফির পানি বসিয়ে রেখে চলে এল নিজের ঘরে। ল্যাপটপটা অন করাই ছিল। নোটে সেভ করে রাখা শিডিউলটা অরা পাঠিয়ে দিল আরশাদের মেইলে। কাজটা ফেলে রেখে ঠিক স্বস্তি পাচ্ছিল না। কাল রাতেই পাঠাতে চেয়েছিল, কিন্তু কোনো এক অদ্ভুত কারণে বেশ আগেভাগেই চোখ লেগে এসেছিল তার।
অরা কফি নিয়ে ফিরে যেতেই দেখলো আরশাদের কাজ প্রায় শেষের দিকে। সার দেওয়া শেষ করে আরশাদ সরঞ্জামগুলো আবার রেখে এলো স্টোর রুমে। হাত ধুয়ে ফিরে আসতে তার মগটা অরা এগিয়ে দিলো তার দিকে।
কফির মগ হাতে নিতে নিতে আরশাদ বলল, “Thank you!”
স্বভাবসুলভ হেসে অরা ছাদের রেলিংয়ে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে বলল, “এটা কথা ছিল স্যার।”
আরশাদ তার পাশে এসে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বলল, “হুঁ, বলো।”
“ইশতিয়াক সাহেব ফোন করেছিল।”
ইশতিয়াকের নাম শুনতেই অন্ধকার নেমে এলো আরশাদের চোখেমুখে। কোনো এক বিচিত্র কারণে নিজের ব্যক্তিগত চিকিৎসককে একেবারেই দেখতে পারে না সে।
আরশাদ গম্ভীর গলায় বলল, “কেন?”
অরা ইতস্তত করে বলল, “বলছিলেন…”
কথাটা আর শেষ করতে পারলো না অরা। কী করে আরশাদকে বলবে তাই ঘুরছে তার মস্তিষ্ক জুড়ে।
“বলো!”
অরা ভয়ে ভয়ে বলল, “বলছিলেন আপনার থেরাপি সেশনে যাওয়াটা জরুরি।”
আরশাদ থমথমে গলায় বলল, “যাবো না।”
“কেন স্যার?”
“থেরাপি সেশন আমার জন্যে কাজ করে না। যে ট্রমাটাইজিং স্মৃতিগুলো আমি ভুলে থাকার চেষ্টা করি, থেরাপি সেশনে বারবার ওই স্মৃতিগুলো মনে করতে বলে।”
অরা সাহস করে বলল, “কিন্তু স্যার, মেন্টাল হেলথকে এভাবে অবহেলা করা তো উচিত নয়।”
আরশাদ তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বলল, “আমি জানি অরা। কিন্তু কিছুই করার নেই।” ছোট্ট দীর্ঘশ্বাস গোপন করে আরশাদ আবারও বলল,
“তোমার কাছে তো কিছু অজানা নয়, তুমি আমার সবটাই জানো। আমার মস্তিষ্কে ওই রাতের প্রতিটা স্মৃতি গেঁথে আছে। তিন বছর পেড়িয়ে গেছে ওই ঘটনার। তবুও এখনো কাজে-কর্মে একটু অবসর পেলেই ওই স্মৃতিগুলো আমার চোখের সামনে ভেসে ওঠে।”
অরা নরম সুরে বলল, “এজন্যেই তো থেরাপি নিতে বলছে স্যার। তারা নিশ্চয়ই আপনাকে কোনো না কোনোভাবে হেল্প করতে পারবে।”
“আমাকে কেউ হেল্প করতে পারবে না।”
“কেন পারবে না স্যার? আপনি একটু সহযোগিতা করলেই পারবে।”
আরশাদ কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থেকে আর্দ্র গলায় বলল, “কখনো কাউকে ভালোবেসেছ?”
প্রশ্নটায় রীতিমত হকচকিয়ে গেল অরা। ভালোবাসা এমন একটা প্রসঙ্গ, যা নিয়ে প্রত্যেকটা মানুষের আগ্রহের শেষ নেই। তবুও এই বিষয় নিয়ে কেউ কথা বলে। নিমিষেই নিজেকে সামলে নিয়ে অরা না-সূচক মাথা নাড়ল।
আরশাদ শুকনো গলায় বলল, “তাহলে তো বুঝতেই পারবে না। মানুষ যাকে ভালোবাসে, তার ওপর এতোটাই ডিপেন্ডেন্ট হয়ে পড়ে যে, তাকে ছাড়া পৃথিবীটা অন্ধকার দেখে। একটা মানুষ যতটাই স্ট্রং হোক না কেন, ভালোবাসার মানুষের দেওয়া কষ্ট সহ্য করা তার পক্ষে সম্ভব নয়। গভীর ক্ষত সেরে গেলেও তার দাগ ঠিকই রেখে যায়। আমার ব্যাপারটাও কিছুটা সেরকম।”
“স্যার?”
“হুঁ?”
একটু একটু করে হৃদস্পন্দন বেড়ে যাচ্ছে অরার। কেন জানি মনে হচ্ছে, যে প্রশ্নটা তার মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে তার উত্তর তাকে জানতেই হবে। তবে প্রশ্নটা শুনে আরশাদের কী প্রতিক্রিয়া হবে তাই বুঝতে পারছে না? যদি রেগে যায়? রেগে দিয়ে প্রচন্ড এক ধমক দিয়ে চলে যায় এখান থেকে? এই সুন্দর বিকেলটা কিছুতেই নষ্ট করতে চাইছে না অরা।
তবুও নিজের অজান্তেই প্রশ্নটা করে ফেলল, “এখনো ভালোবাসেন?”
আরশাদ রেগে গেল না। বরং শান্ত ভঙ্গিতে বলল, “না। ভালোবাসা জিনিসটা আমার মন থেকে উঠে গেছে। কাউকে ভালোবাসার ক্ষমতা আমার মধ্যে আর নেই।”
অবাক দৃষ্টিতে অরা তাকিয়ে রইল আরশাদের দিকে। এই মানুষটার কষ্ট উপলব্ধি করার ক্ষমতা তার নেই। কারোই নেই। যে মানুষ কষ্টটা অনুভব করে, কেবল সেই জানে তার তীব্রতা কতটুকু। তবুও অরা প্রাণপণ প্রার্থনা করে আরশাদের কষ্টগুলো যেন অদৃশ্য হয়ে যায়। যেন এতটা সুখ তার জীবনে আসে, যে সে ভুলে যায় কষ্ট কাকে বলে।
আরশাদ দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে বলল, “এসব কথা বাদ দাও। তোমার কথা বলো।”
অরা নিজেকে স্বাভাবিক করে হালকা গলায় বলল,“আমার কী কথা বলবো?”
“আমার জীবনের সবথেকে বড় সিক্রেটটা তুমি জানো। তোমার জীবনের সিক্রেট কী?”
অরা হাসিমুখে বলল, “আমার কোনো সিক্রেট নেই স্যার। আপনার ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে হাজারো মানুষের আগ্রহের শেষ নেই। তাই কিছু কিছু কথা হয়তো অতি গোপনে জমা করে রাখতে হয়। আমার জীবন নিয়ে কারো কোনো আগ্রহ নেই, তাই কোনো সিক্রেটও নেই।”
“সিক্রেট না হয় নেই। কিন্তু এমন ঘটনা
নিশ্চয়ই ঘটেছে যা কাউকে জানাওনি।”
অরা খানিকক্ষণ ভেবে বলল, “আমি তো মূলত আমার পাস্ট লাইফের কথাই কাউকে জানাই না, যেটা আপনি জানেন। এছাড়া… একটা ঘটনা অবশ্য আছে।”
“কী সেটা?”
“আমি একজনকে পছন্দ করতাম। পছন্দ করতাম বললে ভুল হবে, পছন্দ করতে শুরু করেছিলাম।”
আরশাদ কৌতূহল নিয়ে বলল, “কে সে?”
“আমার ভার্সিটিতে পড়ে, সাবের। সেরকম সিরিয়াস কোনো সম্পর্ক ছিল না তবে, ওর সঙ্গে কথা বলে আরাম পেতাম। আমার কথা মন দিয়ে শুনতো। ওকেই বিশ্বাস করে আমার পাস্ট লাইফের গল্পটা বলেছিলাম। আমি বুঝতে পারতাম সাবের আমাকে পছন্দ করে, কিন্তু মুখ ফুটে বলতে পারছে না। আমিও একটু একটু করে পছন্দ করতে শুরু করেছিলাম। কিন্তু হঠাৎ একদিন ওকে ধরে ফেলি একটা মেয়ের সঙ্গে ঝগড়া করতে। কথাবার্তায় বুঝলাম মেয়েটার সঙ্গে ওর অনেক দিনের সম্পর্ক। সাবের আমার সঙ্গে মিশছে বলে মেয়েটা কান্নায় ভেঙে পড়েছে। আর সাবের তাকে বুঝ দেওয়ার চেষ্টা করছে আমার সঙ্গে কয়েকদিন কেবল প্রেমের অভিনয় করবে। কারণ আমি আপনার ম্যানেজার। আমার মাধ্যমে ভালো একটা চাকরি পাওয়ার চেষ্টা করবে। পেয়ে গেলেই আমাকে ছেড়ে দেবে।”
আরশাদ তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বলল, “বিশ্বাসঘাতকতার স্বাদ তাহলে তুমিও পেয়েছ দেখছি।”
“খানিকটা।”
“তুমি ওকে বলনি, আমার ম্যানেজার হলেও চাইলেই কাউকে ভালো চাকরি জোগাড় করে দিতে পারবে না তুমি?”
“না স্যার। ওর সঙ্গে কথা বলার রুচি আর হয়নি। যদিও সাবের বেশ কয়েকবার আমার সাথে কথা বলার চেষ্টা করেছে। আমার কাছে দ্বিতীয় সুযোগ চেয়েছে।”
“দিয়েছো না-কি?”
“মোটেই না।”
“এই পৃথিবীতে দ্বিতীয় সুযোগ বলে কিছু হয় না। মানুষ একবারই সুযোগ পায়। সেই সুযোগটা যে ঠিকভাবে কাজে লাগাতে পারে সেই জিতে যায়।”
অরা মজার ছলে বলল, “দ্বিতীয় সুযোগ না হলেও, দ্বিতীয় সিক্রেট কিন্তু হয় স্যার।”
আরশাদ অবাক গলায় বলল, “এখন দ্বিতীয় সিক্রেট বলতে হবে?”
“হুঁ।”
আরশাদ অনেকটা সময় নিয়ে ভেবে বলল, “আমার দ্বিতীয় সিক্রেট হলো আমি কখনো ফেমাস হতে চাইনি।”
অরা হতবিহ্বল কণ্ঠে বলল, “আসলেই?”
“হুঁ। ছোটবেলায় আমার সব বন্ধুরা ফেমাস হতে চাইতো। একমাত্র আমারই মনে হতো ফেমাস হতে চাওয়ার স্বপ্ন দেখা নিতান্তই বোকামির।”
“কেন স্যার?”
“কারণ ফেমাস মানুষেরা চাইলেই যা খুশি তাই করতে পারে না, যা খুশি তাই বলতে পারে না। মনে করো আমার আজ রাস্তার পাশের ফুচকা খেতে ইচ্ছা করছে। আমি চাইলেই তা পারবো? আবার মনে করো, আমার ধারণা অমুক ডিরেক্টরের সিনেমা একেবারেই অখাদ্য হয়। আমি চাইলেও মানুষের সামনে নিজের এই মতামত রাখতে পারবো না। সবাই ভাববে আরশাদ কতটা রুড।”
অরা হাসিমুখে বলল, “কিন্তু ফেমাস তো ঠিকই হয়ে গেলেন।”
“সেটাই আক্ষেপের বিষয়! অভিনয় ব্যাপারটা আমার বেশ ভালো লাগতো। অভিনেতা হতেই চেয়েছিলাম। তবে ফেমাস না। সিনেমার অডিশন দিতে যেতাম ছোটখাটো কোনো রোলের জন্য। কিন্তু প্রথম সিনেমাতেই লিড রোলের অফার পেয়ে গেলাম।”
অরার বিস্ময়ের সীমা অতিক্রম করে গেল। এই দেশে আরশাদের মতো বড় সুপারস্টার আর কেউ নেই। তার খ্যাতি এই ইন্ডাস্ট্রির থেকেও বেশি। অথচ সে কিনা কোনোদিন বিখ্যাত হতেই চায়নি!
“Your turn.”
“হুঁ?”
“তোমার দ্বিতীয় সিক্রেট কী?”
নিজের দ্বিতীয় সিক্রেটের কথা মাথায় আসতেই খিলখিল করে করে হেসে উঠলো অরা।
আরশাদ অবাক হয়ে বলল, “হাসছো কেন?”
অরা হাসি না থামিয়েই বলল, “আমার দ্বিতীয় সিক্রেটটা জানলে অবাক হবেন!”
“তাই না-কি? কী এমন সিক্রেট?”
“আমি কখনো আপনার সিনেমা দেখিনি।”
আরশাদ অবাক চোখে তাকিয়ে রইল অরার দিকে। সেই দৃষ্টি দেখে অরার হাসি যেন কয়েকগুণ বেড়ে গেল।
আরশাদ বিস্মিত গলায় বলল, “মানে? কী করে সম্ভব? তুমি তো কতবার আমার সাথে প্রিমিয়ার শোতে গিয়েছ।”
অরা বহু কষ্টে হাসি থামাতে পারলেও সেই হাসির রেশ এখনো লেগে আছে তার ঠোঁটে। হাসিমুখেই অরা বলল, “গিয়েছি, কিন্তু কোনোবারই সিনেমায় মনোযোগ দিতে পারিনি। কোনো না কোনো কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকতে হয়েছে।”
আরশাদ অবিশ্বাসের সঙ্গে বলল, “এত বছর ধরে যার জন্য কাজ করছো, তার কোনো সিনেমাই দেখোনি? You should be ashamed of yourself Aura.”
“I am.”
আরশাদ হঠাৎ কী মনে করিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে বলল, “চলো!”
“কোথায় যাবো স্যার?”
“আজকেই তোমাকে আমার সিনেমা দেখাবো।”
আজকের এই ওটিটির যুগে এসেও আরশাদ ডিভিডি সংগ্রহ করে। শুধু নিজের সিনেমাই নয়, অন্যান্য দেশি-বিদেশি সকল সিনেমা সে ডিভিডি সংগ্রহ করে দেখে। সমস্যা হলো, আজকাল ডিভিডির চল প্রায় উঠে গেছে। সিনেমা দেখার জন্যে বেশির ভাগ মানুষই ইন্টারনেটের ওপর নির্ভরশীল হয়ে উঠেছে। তবুও পুরনো এই শখটা ধরে রাখতে আরশাদ খুঁজে খুঁজে ডিভিডিগুলো হাতে পায়। বসার ঘরের টিভির পাশেই রয়েছে তার ডিভিডির বিশাল শেলফ।
অনেক বাছাবাছির পর কতগুলো ডিভিডি সেখান থেকে এনে অরার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল, “এই সবগুলোই তোমার চাকরিতে জয়েন করার পর শুটিং করা। কোনটা দেখবে?”
অরা সেগুলো হাতে নিলো ঠিকই, তবে মুখে বলল, “যেটা আপনার পছন্দ সেটাই দেখবো।”
“তাহলে তো একটা সমস্যা হয়ে যাবে।”
“কী সমস্যা স্যার?”
“কোনো কোনো দিন আমার মনে হয়, এই ইন্ডাস্ট্রিতে আমার থেকে ভালো সিনেমা কেউ করে না। আবার কোনো দিন মনে হয় আমার সবগুলো সিনেমা অখাদ্য।”
“আর আজ কী মনে হচ্ছে?”
“আজ আমার সব সিনেমা অখাদ্য।”
অরা হেসে বলল, “আচ্ছা তাহলে আমিই পছন্দ করি।”
ডিভিডিগুলো কিছুক্ষণ ঘাটাঘাটি করে অরা পছন্দ করলো ‘দুর্বার দুর্জয়’ সিনেমাটা। এই সিনেমা দুই বছর আগেকার। শুটিং হয়েছে বান্দরবনে। সিনেমার শুটিংয়ের স্মৃতিগুলো স্পষ্ট মনে আছে অরার।
আরশাদ এই সিনেমায় অভিনয় করেছে পুলিশ ইনভেস্টিগেটর দুর্জয় মাহফুজের চরিত্রে। দুর্জয়ের বৈশিষ্ট্য হলো, সবসময় তার পরনে থাকে সাদা শার্ট আর হাতে সিগারেট। চোখ দিয়ে তার সর্বক্ষণ অগ্নি ঝড়ে। কেবল অপরাধীর চোখের দিকে তাকিয়ে সে বুঝে ফেলতে পারে কোনটা সত্য আর কোনটা মিথ্যা। মুক্তির দীর্ঘ দশ মাস পর্যন্ত এই সিনেমা হলে চলেছে। এখনো দর্শকের পছন্দের তালিকার শীর্ষে।
ডিভিডি প্লেয়ারে ডিভিডি ঢুকিয়ে দিয়ে সিনেমা প্লে করলো আরশাদ। আর অবাক হয়ে লক্ষ্য করলো, সিনেমা শুরু হওয়ার পর থেকে এক মুহূর্তের জন্য টিভির স্ক্রিন থেকে চোখ সরায়নি
অরা। যে মানুষটা কোনোদিনও আরশাদের সিনেমা দেখেনি, আজ প্রথমবারের মতো তার সিনেমা দেখে মুগ্ধ হয়ে যাচ্ছে অরা। আরশাদ যে এতটা ভালো অভিনয় করে সে ধারণাও করতে পারেনি। মনে হচ্ছে যেন পর্দায় আরশাদ নয়, দুর্জয়কে দেখতে পাচ্ছে অরা।
সিনেমায় অরা এতটাই হারিয়ে গেছে যে আশেপাশের কোনোকিছুর প্রতি তার মনোযোগ রইল না। দুর্জয় পর্দায় বন্দুক হাতে ক্রিমিনালের পেছনে ছুটছে। আর এদিকে যেন অরার শ্বাস বন্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রম। যদি ক্রিমিনাল হাতের নাগালের বাইরে চলে যায়?
টান টান উত্তেজনায় পরিপূর্ণ এই সিনেমার শেষ দৃশ্যে দুর্জয় কেস সলভ করে ফেলেছে। এগারোটা খুনের প্রকৃত আসামী কে সে বের করে ফেলেছে। তবে ছোট্ট একটা ভুল করে ফেলছে। খুনিকে ধরতে তার বাংলোতে কোনোপ্রকার ফোর্স ছাড়া একাই চলে গেছে তাকে। তার সেই ভুলের কারণেই খুনি পেছন থেকে তার মাথায় সজোরে আঘাত করে তাকে বন্দী করে ফেলে।
এই দৃশ্যের পরেই পর্দায় ভেসে উঠলো সিনেমার এন্ড টাইটেল।
অরা চমকে উঠে বলল, “মানে কী? দুর্জয়ের কী হলো?”
আরশাদ স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বলল, “সেটা তো সিকুয়ালে দেখা যাবে।”
অরার সঙ্গে সঙ্গে মনে পড়লো গতবছর মুক্তি পেয়েছে এই সিনেমার দ্বিতীয় কিস্তি ‘দুর্জয়ের দুর্দিন।’ দ্বিতীয় কিস্তি প্রথমটার থেকেও অধিক ব্যবসাসফল হয়েছিল।
অরা ব্যাকুল কণ্ঠে বলল, “স্যার! আমাকে সিকুয়ালটা ছেড়ে দিন প্লিজ!”
“সাড়ে নয়টা বেজে গেছে অরা। এখন শুরু করলে শেষ করবে কখন?”
অরা উদগ্রীব হয়ে “প্লিজ স্যার! দুর্জয়ের কী হলো না জানতে পারলে আমার রাতে ঘুমই আসবে না।”
অরার অনুনয়ের কাছে পরাজয় স্বীকার করে আরশাদ বলল, “আচ্ছা ঠিক আছে, দেখবে। আগে ডিনার করে নিই চলো। প্রচন্ড ক্ষুধা লেগেছে।”
অরা এ বাড়িতে আসার পর আজই প্রথম একসঙ্গে টেবিলে খেতে বসলো দুজনে। পুরোটা সময়জুড়ে অরাই কথা বলে গেল। কথাগুলোর সারমর্ম, এতদিন সে আরশাদের কোনো সিনেমা না দেখে বিরাট বোকামি করেছে।
দ্বিতীয় সিনেমা সিনেমা মাঝপথে, আরশাদ খেয়াল করলো সোফায় বসে বসেই ঘুমিয়ে পড়েছে অরা। টিভির শব্দ আর ঘরের আলোয় ঘুমে হয়তো ব্যাঘাত ঘটছে। সঙ্গে সঙ্গে টিভির সাউন্ড কমিয়ে একেবারে শূন্যে নামিয়ে আনলো আরশাদ। রাত জেগে আরশাদের অভ্যাস আছে। তার তো রাতের পর রাত নির্ঘুমই কেটেছে। রাত জাগার অভ্যাস যে অরার নেই তা তো নয়। তাকেও তো পড়ালেখার তাগিদে নির্ঘুম রাত যাপন করতে হয়েছিল। তবে আজ কেন আগে আগে ঘুমিয়ে পড়লো কে জানে?
আরশাদ বুঝতে পারছে না তার কী করা উচিত। তার কী মেয়েটাকে এভাবে সোফায় ফেলে রেখে চলে যাওয়া উচিত নিজের ঘরে? তাই হয়তো উচিত, তবে মন সায় দিচ্ছে না। এই মেয়েটার সঙ্গে আজ তার সময়টা দারুণ কেটেছে। অনেকদিন পর মন খুলে কারও সঙ্গে কথা বলতে পেরেছে আরশাদ। অরা এখন এমন একটা মানুষ হয়ে দাঁড়িয়েছে যাকে সে নির্দ্বিধায় মনে জমে থাকা কথাগুলো জানাতে পারে। অরাকে এভাবে ফেলে যেতে সে পারে না।
সাত-পাঁচ ভাবনা বন্ধ করে আরশাদ উঠে দাঁড়ালো, এগিয়ে গেল অরার দিকে। সে গিয়ে মেয়েটাকে তার ঘরে রেখে আসলে মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যাবে না। এমন তো নয় যে অরাকে সে আগে কোনদিন কোলে নেয়নি।
সাবধানে অরাকে কোলে তুলে তার ঘরের দিকে পা বাড়ালো আরশাদ। হাঁটার গতি দ্রুত হওয়ায় আবারও ঘুমে ব্যাঘাত ঘটলো অরার। অস্ফুৎস্বরে আওয়াজ করে উঠলো, “উঁ!” ব্যাপারটা বুঝতে পেরে আরশাদ ধীর গতিতে হেঁটে অরার ঘরে নিয়ে তাকে শুইয়ে দিলো। বিছানায় নেমেই ডান পাশ ফিরে শুয়ে পড়লো অরা।
ঘুমন্ত মানুষের চেহারায় তার অন্তরটা ফুটে ওঠে। অরার চোখেমুখে এই মুহূর্তে খেলা করে বেড়াচ্ছে একরাশ স্নিগ্ধতা। যা হয়তো তার শুদ্ধু হৃদয়েরই বহিঃপ্রকাশ। ক্ষীণ হেসে আরশাদ বাতি নিভিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।
(চলবে)
[ফান ফ্যাক্ট : আজকের পর্বে যে দুর্জয়ের কথা পড়লেন তাকে নিয়ে আমি ভবিষ্যতে গল্প লিখবো। কবে লিখবো জানি না, কিন্তু লিখবো ঠিকই। আরেকটা ফান ফ্যাক্ট : আমাদের এই ছোট্ট পেইজটা আজ দুই হাজার ভালোবাসায় পরিপূর্ণ। আপনাদের প্রত্যেককে অসংখ্য ধন্যবাদ। আশা করি আগামী দিনগুলোতেও এভাবেই পাশে পাবো। আর যারা এই পর্যন্ত পোস্ট করা সবগুলো পর্বের লিংক একসাথে চাচ্ছিলেন, তাদের জন্য সেটা আজই পোস্ট করবো। হ্যাপি রিডিং! ❤️]