মুঠোভরা_চোরাবালি #আলিশা_আঞ্জুম #পর্ব_১৮

0
351

#মুঠোভরা_চোরাবালি
#আলিশা_আঞ্জুম
#পর্ব_১৮

গলায় কান্না আটকে হন্যে হয়ে ছুটতে চাইলো ফাইজা শশুর বাড়ির পানে। মস্তিষ্ক জুড়ে ভাবনা কেবল তাসরিফকে নিয়ে। এমন কেন শুনতে হলো তার? সাফা কেমন খবর দিলো যা ফাইজার সহ্যশক্তি বহন করতে পারছে না? ফাইজা ভুলে গেলো সব। কাব্যর কথাও তার মাথা থেকে বহুদূরে। সে তাড়াহুড়োর ওপর সম্মুখে বাসের দেখা পেতেই উঠে পরলো তাতে।

.
নারির টান বলে একটা কথা থাকে। মায়ের চাইতে আপন কেউ হয় না। তাসরিফের মায়ের আচমকা ছেলের ওপর জমানো অভিমান রাগ উবে গিয়ে মনে দুশ্চিন্তা জায়গা করে নিলো। মায়ের সোহাগি, আবেগী মন আকুল হলো হঠাৎ। একের পর এক ফোন করতে শুরু করলেন তিনি তাসরিফ কে। কিন্তু ফোন ওঠানো হচ্ছে না। তাসরিফ তো তাকে এড়িয়ে চলার মতো ছেলে নয়? বুকের ভেতর দুমড়ে মুচড়ে উঠলো তসলিমার। ঠিক আছে তো তাসরিফ?
.

ফাইজার দেখা না পেয়ে কাব্য রওনা হলো বাড়ির দিকে। হয়তো ফাইজা চলে গেছে তাসরিফের সঙ্গে। তাসরিফ তো দ্বিতীয় বিয়ে করেনি। বুকে অবাধ্য অগ্নিদাহ নিয়ে কাব্য পথ চলতে শুরু করলো৷ আঁধারের মাঝে বেশ কিছু কষ্ট এসে যেন ঘিরে ধরলো তাকে। পকেটে দু-হাত গুঁজে দিলো হেলতে দুলতে চলা ছেলেটাকে হঠাৎ আয়রা ডেকে উঠলো অদূর হতে। চোখে নোনাজল, কন্ঠ কম্পমান, পাশে তার থেকে এক বছরের ছোট এক কাজিন। হাতের ফোনে ফ্লাশ জ্বলিয়ে ছেলেটা ভয়ার্ত চোখে দেখছে নিথর দেহে শুয়ে থাকা বরকে। ইনি কি ঠিক বর? বর সেজে এসে বিয়ে করেনি তার চাচাতো বোনকে। তবে আয়রার কান্নার হেতু খুঁজে পাচ্ছে না ছেলেটা। রাগ ক্ষোভের পরিবর্তে আয়রা অস্থির হয়ে ছুটে এসেছে এই বরকে বাঁচাতে। ছাদে তার সঙ্গে মনমরা হয়ে বসে থাকাকালীন হঠাৎই উত্তরের রাস্তার মাথায় ল্যামপোস্টের নিচে নিথর দেহ দেখে আয়রা দৌড়ে চলে এসেছে। সঙ্গে নিয়ে এসেছে তাকে।

কাব্যর জ্বলে যাওয়া চোখ ও হৃদয় রজনী কালে মেয়েলি কন্ঠ শুনে আলগোছে দমে গেলো। পিছু ফিরে চাইতেই কাব্যর চোখে ধরা দিলো নিথর দেহ, চোখভরা জলের কণ্যা আর ভয়ার্ত এক ছেলে। অজান্তেই বুক মুচড়ে উঠলো তার।

.
ফাইাজ দৌড় এসে গেটের নিকট থমকে যায়। ভয়ে পা উঠতে চায় না। অবশ হয়ে আসছে শরীরটা। চোখের জল বাঁধ ভাঙা নদী হয়েছে। তবুও ফাইজা পা চালালো। যেভাবে এক ছুটে সে এবাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে গিয়েছিল ঠিক সেভাবেই ফাইজা এক দমে ফ্লাটের দরজার নিকট গিয়ে স্থির হলো। কলিং বেল চাপার দশ সেকেন্ডের মাঝে দরজা খুলে দিলেন তাসলিমা। তিনি অপেক্ষায় ছিলেন তাসরিফের। ফাইজাকে দেখামাত্র তার প্রথম বাক হলো

— তাসরিফ কোথায়?

ফাইজার মুখের নেকাব মাথায় তোলা ছিলো। রক্তিম নাক মুখ চোখ নিয়ে ভাইজা বলল

— বাড়িতে নেই? উনি আসেননি বাড়িতে?

— মানে? ও তোমার সাথে নেই? তোমার কাছে যায়নি?

তাসলিমার বুকটা খা খা করে উঠলো। তিনি স্বামীর উদ্দেশ্যে বললেন

— আমার চিন্তা হচ্ছে। ও যদি ফাইজার কাছেও না থাকে তবে কোথায় যাবে?

তাসরিফের বাবা আশ্বাস দিয়ে বললেন

— এতো টেনশন করছো কেন? ছেলে কি ছোট? হারিয়ে যাবে না।

ফাইজা ভেতরে প্রবেশ করলো। তাসলিমা আজ ফাইজাকে নিয়ে তর্কে গেলেন না। তিনি স্বামীর কথার বিপরীতে বলে উঠলেন

— ওর শরীরটা আমি ভালো দেখিনি দুইদিন হলো। গতরাতে খাওয়ার জন্য ডাকতে গিয়ে কি দেখি জানো? হাশফাশ করছে। আমি ভেবেছি ওকে ডাক্তার দেখাতে বলবো।

বলতে গিয়ে তাসলিমার চোখ ছলছল করে উঠলো। নিস্তেজ হয়ে গেলো কন্ঠস্বর। ফাইজার ভয় প্রগাঢ় হলো। সে আচমকা ছুটে গেলো তাসরিফের ঘরের পানে। প্রথমেই ল্যাম্পরাখা ছোট ওয়ারড্রবের ন্যায় বস্তুটার ড্রয়ারগুলো একে একে খুলতেই বেরিয়ে এলো এক গাদা ওষুধ, প্রেসক্রিপশন। ফাইজা বসে পরলো বিছানায়। ডুকরে কেঁদে উঠলো সে। ঠিক এমন সময়ই আচমকা ড্রয়িং রুম হতে চিৎকার ভেসে এলো। তাসরিফের বাবা ডেকে উঠলেন ফাইজার নাম ধরে। তড়বড় করে ফাইজা ড্রয়িং রুমে আসতেই আঁতকে উঠল। তাসরিফের মা হাত পা ছেড়ে দিয়ে ঢলে পরে যাচ্ছেন মাটিতে। হাতে তার ফোন। ফাইজা তড়িঘড়ি করে শাশুড়ি কে সোফায় বসিয়ে দিয়ে তার হাত থেকে ফোন নিয়ে নিজের কানে ধরতেই ওপাশ হতে আায়রা কন্ঠে উচ্চারিত হলো

— তাসরিফ ভাইয়া রাস্তার মাঝে পরেছিল আন্টি। ভাইয়া অজ্ঞান হয়ে গেছে। ডাক্তারের কাছে আনা হয়েছে। ডাক্তার বলছে ভাইয়াকে বাঁচানো যাবে কিনা তারা জানে না।

ভাঙা গলা আয়রার। ডুকরে কাদার স্বর। ফাইজার পৃথিবী যেন ওলট পালট হয়ে গেলো। হাত পা অবশ হয়ে এলো তারও। তাসরিফের বাবা স্তব্ধ হয়ে গেছেন আয়রার কন্ঠ শুনে।

.
মাথায় ভেঙে পরা আকাশ নিয়ে তিনজন মানুষ ছুটলো পাগলের মতো। ফাইজা দিশেহারা হয়ে বেরিয়ে পরলো আগে। তাসলিমা শক্তিহীন হাত পা নিয়ে ফাইজার সঙ্গে। আজ হঠাৎ কোমল হয়ে তিনি ফাইজার পানে চেয়ে একবার বললেন

— আমার তাসরিফ কি ঠিক হবে ফাইজা?

ফাইজা উত্তরে বলল

— কেন হবে না মা? তার ঠিক হতে হবে। আপনাকে ছেড়ে ও কোথাও যাবে না।

তাসলিমার চোখের জল গড়িয়ে পরলো প্রথমবারের মতো ফাইজার জন্য। ফাইজা কিভাবে শক্ত পায়ে হেঁটে চলেছে?

ফাইজাকে নিয়ে গাড়ি করে হসপিটালে পৌঁছেই তাসলিমা আয়রার নিকট গেলেন। ফাইজা গেলো তাসরিফের নিকট। কাব্য বেশ অবাক হলো। সেই সাথে তার হৃদপিণ্ড আহত হলো বেশ করে। বুকে শুরু হলো জ্বালাপোড়া। নিঃশব্দে বন্ধ আখিতে শুয়ে থাকা তাসরিফ কে দেখতে গিয়ে ফাইজার চোখ ঝাপসা হয়ে এলো বারংবার। স্পষ্ট প্রতিচ্ছবি সে দেখতে পেলো না। ডাক্তারদের শলাপরামর্শ তাসরিফ কে ঘিরে। বেশ কিছু টেস্ট করবে তারা। নিয়ে যাওয়া হলো তাসরিফ কে অন্যরুমে। ফাইজা হনহন করে হসপিটালের করিডরের শেষ মাথায় চলে গেলো। মুখে হাত চাপা দিয়ে এবার উন্মুক্ত করে দিলো কান্না। স্বামী দিন কয়েক পর না ফেরার দেশে চলে যাবে। এক স্ত্রী কেবল দেখে যাবে সে বিষাক্ত দিন। ছটফট করবে কেবল দু’টো মানব। স্ত্রীর সাধ্য থাকবে না আটকানোর। চাইলেও পারবে না প্রিয় মানুষটাকে বাঁচিয়ে রাখতে।

কাব্য অদূর হতে ফাইজার কান্না অবলোকন করলো।ফাইজার অশ্রুকণা বুকে পাথর হয়ে এসে আঘাত করছে যেন।
নীরব এক ব্যাথা হুহু করে উঠলো কাব্যর বুকের ভেতর। মুহূর্তেই মনে হলো সবই ফিকে। পুরো পৃথিবীর ভার যেন একদিকে আর তাসরিফের ভালোবাসা যেন একদিকে। এটা কেমন ভালোবাসা? এতো যত্ন করে কেউ কাউকে ভালোবাসতে পারে? কাব্য দূর থেকেই সুন্দর। তাসরিফের ভালোবাসা নিকট কাব্যর ভালোবাসা মলিন। সত্যিই মলিন। তবে কাব্য যে পেলো না ফাইজাকে? আফসোস, কষ্ট রয়েই যায় বুকে। চোখ ছলছল করে ওঠে কাব্যর। ইশ! না পাওয়ার ব্যাথা!

চলবে……

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here