শেষটা_সুন্দর #জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা ৫৯।

0
632

#শেষটা_সুন্দর
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
৫৯।

ফজরের নামাজ শেষ করে বারান্দায় তাকাতেই দেখে এক সুন্দর সকালের সূচনা। জায়নামাজ ভাঁজ করে মেহুল উঠে দাঁড়ায়। চারদিক তখন পাখিদের কিচিরমিচির শব্দে রি রি করছে। সকাল হয়েছে, সেটাই দলবেধে হৈ চৈ করে জানান দিচ্ছে তারা। বারান্দায় এসে মেহুল দাঁড়ায়। আস্তে আস্তে এখন অনেকটাই আলোকিত চারদিক। কেমন একটা ঘোলাটে পরিবেশ। মৃদু মন্দ বাতাসটা গায়ে স্পর্শ করতেই যেন শিহরণ জাগে। রোযার সময়টাই অদ্ভুত সুন্দর। সেই সময় বাতাসেও যেন শান্তির পরশ পাওয়া যায়।

মেহুল গ্রিল আঁকড়ে ধরে চোখ বন্ধ করে। বাইরের ঠান্ডা বাতাস শরীরে মিশছে তার। ভীষণ শান্তি পাচ্ছে মনে। নিজের মাঝে এতটাই বিভোর ছিল যে, রাবীরের উপস্থিতি সে টের পায়নি। কয়েক পল পরে তার উষ্ণ স্পর্শে ধ্যান ভাঙে। ঠোঁট নাড়িয়ে জিজ্ঞেস করে,

‘কখন এলেন?’

রাবীর মুখ এনে কানের কাছে মিহি সুরে বলে,

‘মাত্রই।’

মেহুল আবার আগের মতোই চক্ষু রুদ্ধ করে। রাবীর আরেকটু এগিয়ে আসে। মেহুলের মুখের উপর পড়ে থাকা চুলগুলো খুব যত্নে কানের পিছে গুঁজে দেয়। তার গালে আলতো করে ঠোঁট ছোঁয়ায়। মেহুল বরাবরের মতোই নিরব। রাবীর পাশাপাশি দাঁড়ায়। জিজ্ঞেস করে,

‘ঘুমাবেন না?’

মেহুল তার দিকে না তাকিয়ে প্রত্যুত্তর করে,

‘ঘুম আসছে না।’

রাবীর সময় নিয়ে প্রশ্ন করে,

‘কোনো ব্যাপার নিয়ে দুশ্চিন্তা করছেন?’

মেহুল এবার তাকায়। রাবীর ভীষণ স্বাভাবিক। তবে মেহুল কিছুতেই স্বাভাবিক থাকতে পারছে না। সেহেরির পর খাবার টেবিলে, রাবীর তাকে মা’কে বলেছিল, “মেহুলকে যেন তিনি বাচ্চা নেওয়ার ব্যাপারে কোনোপ্রকার চাপ প্রয়োগ না করেন। বাচ্চা নিয়ে চিন্তা ভাবনা করাটা একান্তই তাদের ব্যক্তিগত ব্যাপার। তাই এই নিয়ে ভবিষ্যতে কেবল সে আর মেহুল’ই কথা বলবে।” মেহুল আড়ালে দাঁড়িয়ে এসব কিছু শুনেছিল। আর এটা শোনার পর থেকেই মনটা আরো বেশি খচখচ করছে তার। মনে বলছে, কিছু তো একটা ব্যাপার আছে; যার জন্য রাবীর এমন করছেন। কিন্তু, সেই ব্যাপার জানার জন্য সে রাবীরকে সরাসরি প্রশ্ন করার মতো সাহসও জুগাতে পারছে না।
মেহুল তাই আর প্রশ্ন করে না। কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে বিমূঢ় সুরে বলে,

‘চলুন, শুয়ে পড়ি।’

মেহুল শরীর টেনে বিছানায় যায়। চুপচাপ শুয়ে পড়ে সেখানে। রাবীরও তার পেছন পেছন আসে। সাড়াশব্দ না করে সেও শুয়ে পড়ে।

______________

সকাল থেকেই রিতার বেশ দুশ্চিন্তা। সে খেয়াল করেছে, কিছু একটার গন্ধেই তার বমি বমি পাচ্ছে। মূলত এই নিয়েই যত দুশ্চিন্তা তার। রোযা রেখেছে, এখন বমি করলেই রোযা শেষ। তাই এখন পর্যন্ত রুমেই ঘাপটি মেরে বসে আছে সে। নিচে নামলেই আশেপাশের বিভিন্ন জায়গা থেকে গন্ধ এসে নাকে ঠেকে তার। বিশেষ করে, রান্নাঘর। এই ঘরে কিছু রান্না হোক বা না হোক, একটা ভ্যাপসা গন্ধ ঠিকই করবে। তাই সেদিকে তো ভুলেও ফিরে চাচ্ছে না সে।

তবে সে যে একাই দুশ্চিন্তাগ্রস্থ তা কিন্তু না। সাদরাজও সমান তালে দুশ্চিন্তা করে যাচ্ছে। সে প্রথমবারের মতো বাবা হতে চলেছে। ঠিক বুঝতে পারছে না, বাবাদের কী কী করতে হয়। এই নিয়েই যত অস্থিরতা তার। রিতাকে তো প্রথমে রোযাই রাখতে দিচ্ছিল না। পরে ডাক্তারের সাথে কথা বলে কিছুটা নিশ্চিন্ত হয়।

.

রিতা কিছুক্ষণ ভ্রু কুঁচকে সাদরাজের দিকে চেয়ে রইল। সাদরাজের হাবভাব ঠাহর করতে না পেরে প্রশ্ন ছুড়ল,

‘কী ব্যাপার, আজকে আপনি অফিসে যাবেন না?’

সাদরাজ লেপটপ থেকে দৃষ্টি সরিয়ে তার দিকে চাইল। বলল,

‘অফিসের কাজ বাসায় করছি তো।’

রিতা ভ্রু দৃঢ় করে বসে। লোকটার দিকে নিমিষ চেয়ে থাকে। এই লোকটাকে ঠিকভাবে চিনে উঠা বড়ো দায়। কখনোই উনার কোনো কাজের মিল পাওয়া যাবে না। যখন যা মন চায়, তাই করেন। রিতা বসে বসে এসব ভেবে দীর্ঘশ্বাস ফেলে।

____________

দুপুরের নামাজ শেষ করে মেহুল রিতাকে কল দেয়। রিতাও তখন মাত্র নামাজ শেষ করে উঠেছে। মেহুলের কল দেখে খুশি হয়। বিছানায় আরাম করে বসে কলটা রিসিভ করে। অনেকক্ষণ একে অপরের নানান প্রাসঙ্গিক কথাবার্তা বলে একপর্যায়ে মেহুল বেশ হতাশ সুরে বলে,

‘জানিস রিতা, আমি বাচ্চা নিতে চাইলেও রাবীর কিছুতেই রাজি হচ্ছেন না। উনার কথা শুনে মনে হচ্ছে, যেন এই রাজি না হওয়ার পেছনে কোনো গুরুতর কারণ আছে, যেটা এখন উনি আমাকে বলতে চাইছেন না।’

রিতা কথা শুনে কিছুটা অবাক হয়। জিজ্ঞেস করে,

‘আশ্চর্য, ভাইয়া এমন কেন করবেন? এখানে লুকানোর কী আছে?’

‘সেটা তো আমিও বুঝতে পারছি না। না উনিও আমাকে সরাসরি বলছেন কিছু।’

‘তাহলে তুই নিজ থেকে সরাসরি কথা বল। দুজনে একসাথে বসে আলোচনা কর। দেখবি, সবকিছু ঠিক আছে।’

মেহুল তপ্ত শ্বাস ছাড়ল। বলল,

‘উনি যেভাবে ব্যাপারটাকে অগ্রাহ্য করছেন; আমার তো এখন এই ব্যাপারে কথা বলতেই অস্বস্তি হচ্ছে।’

‘আরে ভাই, উনি তোর হাজবেন্ড। উনার সামনে আবার কীসের অস্বস্তি?’

‘আচ্ছা, কথা বলব।’

‘ঠিক আছে। কথা বল, আর খুব জলদি আমাকেও খালা বানা।’

মেহুল হেসে ফেলে। বলে,

‘আচ্ছা, বানাব।’

_____________________

রমজানের প্রথম পাঁচদিন খুব স্নিগ্ধতায় কেটে গেল। কীভাবে, কোন ফাঁকে গেল মেহুল তা একদমই টের পায়নি। সেহেরি, ইফতার, নামাজ-কালাম এসব নিয়ে খুব সুন্দর সময় কাটছে তার। দিনগুলোও যেন তাই দ্রুত কাটছে বলে মনে হচ্ছে। এই কয়দিন মেহুল আর রাবীরের সামনে কোনো বাচ্চার কথা উল্লেখ করেনি। সেও রাবীরের মতো বেশ স্বাভাবিক ছিল। তবে সবকিছুর মাঝেও তার মনে কী চলছিল, সেটা কেবল সে’ই জানে।

আজ ষষ্ঠ সেহেরি। ইফতারের পর রাতে আর কেউ ভারি কোনো খাবার খায় না। খুব খিদে পেলে, অল্প ফলমূল খায়। রাতে তাই আর কোনো কাজও থাকে না। সেজন্য মেহুলের শাশুড়িও নামাজ শেষ করে খুব তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়েন। রাবীর নামাজ শেষ করে বেশ রাতেই ফিরে। তার নির্বাচনের দিন যত এগুচ্ছে, ব্যস্ততাও তত বাড়ছে। তবে আজ কী ভেবে, সে একটু তাড়াতাড়িই বাড়িতে ফিরেছে। রুমের কাছে এসে দেখে ভেতর থেকে দরজা আটকানো। অবাক হয়ে, দরজায় নক করে। ভেতর থেকে কোনো সাড়া শব্দ নেই। রাবীর এদিক ওদিক তাকায়। মেহুল তো কোথাও নেই। তাহলে রুমেই হবে। সে আবার দরজায় নক করে। মেহুল তো সচরাচর দরজা ভেতর থেকে লক করে না। তবে আজ কী হলো?

রাবীর লাগাতার দরজায় নক করে যাচ্ছে। এবার চিন্তা হচ্ছে তার। কপালে আঙ্গুল ঘষে ঘাম মুছে। মায়ের রুমের দিকে যাওয়ার জন্য উদ্যোত হতেই দরজাটা খট করে খুলে যায়। রাবীর তড়িগড়ি করে পেছনে ফিরে। রুমের দিকে পা বাড়ায়। অন্ধকার রুম। রাবীর হাতড়ে সুইচ অন করে। রুম ফাঁকা। রাবীর চিন্তায় পড়ে ভাবে, মেয়েটা কী করতে চাইছে। সে হাত থেকে ঘড়িটা খুলে রাখে। পাঞ্জাবীর বোতাম দুটো খুলে বারান্দার দিকে এগিয়ে যায়। বারান্দার দরজার কাছে যেতেই থমকে দাঁড়ায়। স্কাউচে বসা শুভ্ররাঙা পরীতে তার চোখ আটকায়। মেহুল চমৎকার হেসে লজ্জামাখা কন্ঠে জিজ্ঞেস করে,

‘আমাকে কেমন লাগছে, নেতা সাহেব?’

রাবীর ঠোঁট প্রসারিত করে হাসে। মেহুলের সামনে হাঁটু ভাঁজ করে বসে। তাকে মনোযোগ সহিত দেখে জিজ্ঞেস করে,

‘হঠাৎ, এত সাজ?’

মেহুল যেন লজ্জা পায়। মাথা নুইয়ে বলে,

‘আপনার জন্য সেজেছি। আমাকে ভালো লাগছে না?’

‘ভীষণ ভালো লাগছে।’

মেহুল লজ্জা পায়। মাথা নুইয়ে মিটমিট করে হাসে। রাবীর তার দু’হাত আগলে নিয়ে হাতের পিঠে চুমু খায়। মেহুল জোরে নিশ্বাস ফেলে। রাবীরের চোখে চোখ পড়তেই ভীষণ অস্বস্তিতে পড়ে। তাও সে নিজেকে সামলে নেয়। রাবীরের দিকে কিছুটা এগিয়ে গিয়ে ফিসফিস করে বলে,

‘আমায় ভালোবাসবেন, নেতা সাহেব? যে ভালোবাসা আমার শরীরের প্রতিটা রন্ধ্রে রন্ধ্রে শিহরণ জাগাবে, সেরকম ভালোবাসা। যে ভালোবাসা বুকের স্পন্দন বাড়িয়ে শরীরকে নিস্তেজ করে দিবে, সেরকম ভালোবাসা। বাসবেন, নেতা সাহেব?’

মেহুলের কন্ঠে এমন আকুতি কানে বাজে রাবীরের। সে বুঝতে পারছে, মেহুল কী চাইছে। সে এগিয়ে মেহুলের কপালে কপাল ঠেকায়। মিহি সুরে বলে,

‘আপনার জন্য আপনার নেতা সাহেবের ভালোবাসা কখনোই ফিকে হয়ে পড়বে না, মেহুল। আমার সবটুকু আমিটা তো আমি আপনাকেই বিলিয়ে দিয়েছি। তবে, আজ এত অনুনয় করে কেন ভালোবাসা চেতে হবে? আপনার জন্য আমার ভালোবাসা সবসময় মুক্ত।’

সে আলতো করে মেহুলের কপালে কপাল ঘষেই ঠোঁটে ঠোঁট রাখে। আর সেই প্রতিটা স্পর্শে সত্যিই তার সমস্ত শিরা উপশিরায় শিহরণ জেগে উঠে।

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here