#শেষটা_সুন্দর(সিজন-২)
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
৫।
‘আশ্চর্য, এমন ভাবে বলছিস যেন আমি তোর প্রেমে পাগল হয়ে দিশেহারা হয়ে গিয়েছি। এখন তুই ছাড়া আমার আর কোনো দিশা নেই। তাই এখন আমি তোর ভালোবাসা পাওয়ার জন্য উঠে পড়ে লেগেছি। তোকে বিরক্ত করছি। রাত দিন চব্বিশ ঘন্টা তোর আশেপাশে ঘুরছি। কিরে, এটাই তো বলতে চাচ্ছিস তুই?’
বেশ কঠিন শুনাল সারাজের গলা। তাতে কী? পুতুল তো বেশ মজা পেয়েছে কথাটা শুনে। ঠোঁট টিপে হাসলও। শব্দ করলে নির্ঘাত এই লোক এই রাতে এসেও তাকে আছাড় মারতে পারে। উনাকে বিশ্বাস করা যায় না। পুতুল দুই ঠোঁট চেপে কিছু ভাবল। পরে ফিক করে হেসে দিয়ে বলল,
‘এমন হলেও, মন্দ হতো না কিন্তু।’
বলেই ফোন কাটল সে। আর ফোন ধরে রাখার সাহস নেই তার। এমনিতেও আজকাল বেশ দুঃসাহসিক কাজ করে ফেলছে সে। না জানি, আবার কবে সারাজ তাকে বাগে পায়। সেদিন গড়ায় গন্ডায় হিসেব করে সব শোধ তুলবে।
তাও ভীষণ মজা পাচ্ছে সে। সারাজ ভাইকে ক্ষেপানোর চেয়ে দ্বিগুণ আনন্দের আর কিছু হতেই পারে না। এখন সেই আনন্দ’ই পুরো শরীর জুড়ে বিরাজ করছে তার।
চুপ করে বিছানায় শুয়ে পড়ে। তখনই ফোনে টুং করে একটা শব্দ হয়। মেসেজ এসেছে। পুতুল হাতে নিয়ে দেখে সারাজের নাম্বার। উপুড় হয়ে শুয়ে পড়ল। মনোযোগ দিল ফোনের স্ক্রিনে। সেখানে লেখা,
‘আজকাল খুব সাহস বেড়েছে, তাই না? মাথায় তুলে আছাড় মারলে সব সাহস ফুঁস হয়ে যাবে। আশা করছি, আর কিছু বলার আগেই শুধরে যাবি। এখন চুপচাপ ঘুমা। ফেসবুকে এক্টিভ দেখলে, আছাড়টা এখনই এসে দিয়ে যাব। গুড নাইট।’
মেসেজ’টা একবার দুবার না এই নিয়ে পঞ্চাশবার পড়ে ফেলেছে। এই যে মেসেজ জুড়ে এত হম্বিতম্বি দেখাল লোকটা, তাও তো পুতুলের মনে কিঞ্চিত ভয় ঢুকল না। তার কাছে এই মেসেজ যেন কোনো হুমকি না, বরং ছোট খাটো একটা প্রেমপত্র। যেই প্রেমপত্রের প্রতিটা লাইন, প্রতিটা অক্ষর মনের ভেতর যেন নতুন এক শিহরণ জাগাচ্ছে।
_________
চোখ মেলে তাকাতে বেশ কষ্ট। তাও তাকাতে তো হবেই। এখন না তাকালে আজকে আর ভার্সিটিতে যাওয়া হবে না। তাই শত কষ্ট উপেক্ষা করে ঢুলতে ঢুলতে উঠে বসল পুতুল। চোখ জোড়া নিভু নিভু। কিছুতেই বিছানা ছাড়তে ইচ্ছে করছে না। তাও একপ্রকার জোর করেই শরীরকে টেনে ওয়াশরুম অবধি নিয়ে গেল।
ডাইনিং এ বসে গোগ্রাসে পুতুল খাবার গিলছে। মেহুল যতই তাকে শান্ত থাকতে বলছে সে ততই তার খাওয়ার স্পিড বাড়াচ্ছে। মেহুল একপর্যায়ে মেজাজ হারায়। ধমক দিয়ে বলে,
‘আস্তে খা না, পুতুল। গলায় খাবার আটকাবে তো।’
কে শোনে কার কথা। এমনিতেই তার লেইট হয়ে যাচ্ছে। এখন আস্তে খেলে আরো লেইট হয়ে যাবে। কোনো রকমে প্লেটের খাবার শেষ করে সে উঠে দাঁড়ায়। বড়ো একটা ঢেক তুলে। মেহুল নাক মুখ কুঁচকে বলে,
‘অসভ্য মেয়ে। জীবনেও মানুষ হবে না।’
সেই কথা পুতুলের কান অবধি গেল না। সে কোনোরকমে ব্যাগটা কাঁধে ঝুলিয়ে দরজার কাছে ছুটল। পেছন ফিরে একবার বলল,
‘মা, যাচ্ছি।’
বলেই উধাও সে। মেহুল সব দেখে চাপা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। এত চঞ্চল মেয়েটাকে সে কী করে সামলাবে। একমাত্র সারাজ ছাড়া যে সে কাউকেই ঠিকমতো ভয় পায় না। কবে যে এই ছেলের হাতে পুরোপুরি দায়িত্ব দিয়ে একটু স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলবে, কে জানে?
________
বাবা মন্ত্রী হওয়ায় মোটামুটি ভার্সিটির সবার পরিচিত মুখ পুতুল। তাছাড়া তার দূরত্বপনা এমনিতেও তার পরিচয় বাড়িয়ে দিয়েছে। ভার্সিটির নাম্বার ওয়ান চঞ্চল মেয়ে হিসেবে সবাই পুতুলকেই চিনে। তবে মন্ত্রীর মেয়ে বলে এই পরিচয় তার উপর খুব একটা প্রভাব ফেলতে পারে না। ভার্সিটির স্যার ম্যাডামরা বেশ চোখে চোখে রাখে তাকে।মন্ত্রী বাবার কাছ থেকে কখন কী সাহায্য লাগে বলা তো যায় না।
সাহিত্য বরাবরই পুতুলের কাছে একটা বিরক্তিকর বিষয়। তাও যদি সেই সাহিত্য হয় আবার ইংরেজীর উপর, তাহলে তো আর কোনো কথাই নেই।
ক্লাসে বিন্দুমাত্র মনোযোগ নেই পুতুলের। তার পাশে বসে লীনাকেও মনোযোগ দিতে দিচ্ছে না। সে মনোযোগ দিচ্ছে না, তো কেউ দিবে না। সে ফেইল করবে, তো সবাইকে ফেইল করতে হবে, ব্যাপারটা অনেকটা এরকম। লীনা বারবার চোখ পাকিয়ে তাকে থামতে বলছে। কিন্তু, ঐটুকু চোখ পাকানোতে কি আর পুতুলকে থামানো যায়। পুতুলের খোঁচাখুঁচি থামল না। কলম দিয়ে লীনার পিঠে গুতা দিতে গিয়ে সেই কলমের ঢাকনা উড়ে গিয়ে পড়ল আরেক ছেলের উপর। ছেলেটা চশমা ফাঁক করে পুতুলের দিকে চাইল। পুতুল ইশারায় বুঝাল, তাকে কলমের ঢাকনাটা ফেরত দিতে। ছেলেটা ঢাকনটা তুলল ঠিকই কিন্তু, ফেরত দিল না। পুতুল বারবার ইশারা করছে তাকে। সেই ছেলে শুনলে তো। শেষে পুতুল রেগে গিয়ে উঠে দাঁড়ায়। বিরক্ত গলায় বলে উঠে,
‘ম্যাম, সাহেল আমার কলমের ঢাকনা দিচ্ছে না।’
চোখের সামনে থেকে বই সরিয়ে মোটা খাটো ধরনের মহিলাটা তীক্ষ্ণ চোখে পুতুলের দিকে চাইল। পুতুল ফের একই কথা বলল। ম্যাম এবার তাকালেন সাহেল নামের সেই ছেলেটার দিকে। ছেলেটা ইতস্তত করছে। একটা কলমের ঢাকনার জন্য এমন করা লাগে নাকি? সে উঠে দাঁড়িয়ে বলল,
‘ও আমার উপর এটা ছুড়ে মারল কেন?’
‘আমি ইচ্ছে করে মারিনি, ম্যাম। ভুলবশত চলে গিয়েছে। এই ছেলে, আমার ঢাকানা.. না মানে আমার কলমের ঢাকনা দাও।’
ছেলেটা ভীষণ তেতে উঠল। একটা সামান্য কলমের ঢাকনার জন্য যেন মরে যাচ্ছে। সে সেই ঢাকনা ছুড়ে মারে। ভাবে হয়তো পুতুলের বেঞ্চের কাছে পড়বে। কিন্তু, ঢাকনা গিয়ে পড়ে জানলার বাইরে। পুতুল এতে আরো বেশি ক্ষেপে যায়। রাগে কটমট করতে করতে বলে,
‘ম্যাম, ও আমার ঢাকনা বাইরে ফেলে দিয়েছে। আপনি কিছু বলছেন না কেন?’
ম্যাম জোরে জোরে নিশ্বাস ফেলে রাগি গলায় বললেন,
‘মাঝে মাঝে মনে হয়, আমি কোনো ভার্সিটির না বরং কিন্ডার গার্ডেনের স্টুডেন্ট পড়াচ্ছি। একটা সামান্য কলমের ঢাকনা নিয়ে এত কাহিনী করা লাগে? এই বসো তোমরা। একদম বিরক্ত করবে না। আর একটা কথাও বললে ক্লাস থেকে বের করে দিব একদম।’
পুতুলের শরীরের রাগের স্রোত বয়ে যায়। ওটা মোটেও সামান্য জিনিস না। তার অনেক প্রিয় জিনিস। এই ছেলেটাকে সে ছাড়বে না। দরকার পড়লে আস্ত চিবিয়ে খাবে।
ক্লাস শেষ। সবাই যার যার মতো বেরিয়ে গিয়েছে। খালি ক্লাসে কেবল তিন জনের নিশ্বাসের শব্দ শোনা যাচ্ছে। সাহেল বিরক্ত গলায় বলল,
‘একটা কলমের ঢাকনার জন্য কেউ এমন করে নাকি? চলো, আমি তোমাকে আস্ত একটা কলম কিনে দিচ্ছি।’
‘না, আমার ঐ ঢাকনাটাই লাগবে।’
পুতুল রেগে বলল। সাহেল কপাল চাপড়ে বলল,
‘আরে, ওটা তো বাইরে পড়ে গিয়েছে। আমি এখন কোথায় পাব?’
‘খুঁজে বের করো গিয়ে। ঐ ঢাকনা খুঁজে বের করা না অবধি, এই ভার্সিটি থেকে তুমি এক পাও নড়তে পারবে না। তাই তাড়াতাড়ি নিচে যাও। যেদিকে ফেলেছ, সেখানে গিয়ে দেখো, পাও কিনা।’
ছেলেটার চোখ মুখ এক আকাশ বিরক্তিতে কুঁচকে গেল। ক্ষিপ্ত সুরে বলল,
‘ঐ ময়লার স্তুপ থেকে আমি এখন সামন্য একটা ঢাকনা খুঁজতে যাব, ইম্পসিবল।’
‘ওটা মোটেও সামান্য না। ওটা আমার দাদুর দেওয়া শেষ চিহ্ন। আমার কাছে ওটার মূল্য অনেক। এক্ষুনি সেটা খুঁজে এনে দাও তুমি। নয়তো এখান থেকে এক পাও নড়তে দিব না।’
আচ্ছা বিপদ তো। সাহেল পুরোপুরি ফাঁসল যেন। এই মেয়েটার উপর রাগ তরতরিয়ে বাড়ল। কিন্তু, সে জানে এই মেয়ে কেমন নাছরবান্দা। যা বলবে, তা করিয়েই ছাড়বে।
অবশেষে বাধ্য হয়েই তাকে বিল্ডিং এর পেছন দিকে যেতে হলো। সেখানে ময়লা আবর্জনা ছাড়া আর কিছুই নেই। এইগুলোর মধ্যে থেকে একটা ছোট্ট জিনিস সে কী করে খুঁজবে? রাগ আর বিরক্তিতে বেচারার শরীর তিরতির করে কাঁপছে। দূরে দাঁড়িয়ে পুতুল আর লীনা তাকে পর্যবেক্ষণ করছে। লীনা আজকে চাইলেও পুতুলকে বাঁধা দিতে পারছে না। কারণ সেও জানে, এই কলম তার কতটা প্রিয়। প্রতিবার নতুন করে শিষ লাগিয়ে এই কলম ব্যবহার করে আসছে সে। তবুও কলম বদলায়নি। এই কলম স্পর্শ করলে নাকি সে তার দাদিকে ফিল করতে পারে। যদিও লীনা জানে, এসব যুক্তিহীন কথা। তবুও, মানুষের আবেগ সব যুক্তির উর্ধ্বে। আবেগ অতশত বোঝে না।
প্রায় এক ঘন্টার নিরলস পরিশ্রমের পর অবশেষে সে কলমের ঢাকনাটা খুঁজে বের করতে সক্ষম হয়। খুশিতে তখন পুতুলের চোখ মুখ চিকচিক করছে। গদগদ গলায় বলল,
‘ধন্যবাদ। চলো, তোমাকে একটা চায়ের ট্রিট দেই।’
সাহেল জোরপূর্বক হেসে বলে,
‘না, ধন্যবাদ। তুমি যে বলেছ, তাতেই আমি খুশি। আসি এখন। আর দয়া করে পরের বার থেকে তোমার কলম আর কলমের ঢাকনা, দুটোকেই একটু সামলে রেখো।’
পুতুল দাঁত বের করে হাসল। বলল,
‘ঠিক আছে।’
সাহেল হঠাৎ মুগ্ধ হলো। বলল,
‘এই যে, এখন কত সুন্দর লাগছে। অথচ একটু আগে যে রূপ দেখলাম! তুমি তো রীতিমতো আমার ঘাম ছুটিয়ে দিয়েছ।’
পুতুল পুনরায় হাসল। ছেলেটা হঠাৎ আবিষ্কার করল, মেয়েটার হাসি তো ভারি মিষ্টি। প্রেমে পড়ার অন্যতম কারণ হতে পারে এটা।
বেশি সময় দাঁড়াল না। পুতুলকে বিদায় দিয়ে দ্রুত ভার্সিটি থেকে চলে গেল সাহেল। মেয়েটার সাথে দাঁড়িয়ে কথা বলতে একটু অন্যরকম লাগছিল তার। তাই তো, সুযোগ পেয়েই কেটে পড়েছে।
ঐদিকে পুতুল বেজায় খুশি। খুশিতে লীনার কাঁধ জড়িয়ে বলল,
‘সাহেল তো আমার ট্রিট নিল না। চল, তোকেই না হয় ট্রিটটা দেই।’
চলবে…
(গল্পটা সাধারণ প্লটের উপর। এই গল্পে খুব বেশি টুইস্ট বা রহস্য আশা করা বোকামি। তবে কিছু টুইস্ট থাকবে। সেগুলো সামনের পর্বে আসবে। আপাতত, গল্পটা সাধারণ গতিতেই আগাবে।)