#শেষটা_সুন্দর(সিজন-২)
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
১১।
সামনে ভার্সিটিতে প্রোগ্রাম আছে। নববর্ষের প্রোগ্রাম। সেই নিয়ে ভার্সিটিতে বেশ তোড়জোড় চলছে। এক ঝাক ছেলে মেয়ে হৈ চৈ বাঁধিয়ে ভার্সিটির প্রাঙ্গন আলপনা করতে নেমেছে। কেউ কেউ আবার কাগজ দিয়ে অনেক রকমের শিল্প কর্ম তৈরি করছে। কেউ আবার প্রোগ্রামের বিভিন্ন কার্যবলীগুলো তালিকাবদ্ধ করছে। সবাই যার যার মতো ব্যস্ত। পুতুল আর লীনাও ব্যস্ত। প্রোগ্রাম নিয়ে তাদের পরিকল্পনারও শেষ নেই। নতুন বছরকে নতুন ভাবে বরণ করতেই যত আয়োজন তাদের। পুতুল ঠিক করল সে প্রোগ্রামের দিন গান গাইবে। তার গানের গলা বেশ ভালো। মায়ের কাছ থেকেই গানের হাতেখড়ি তার। তারপর এক দুবার কলেজ আর ভার্সিটির প্রোগ্রামে গানও গেয়েছে।
‘তুই কিছু একটাতে নাম দে।’
‘আমি? আমি তো কিছুই পারিনা।’
মুখ কালো করে বলল লীনা। পুষ্প তার বাহুতে হালকা করে চড় মেরে বলল,
‘বলেছে তোকে। তুই অনেক ভালো আবৃত্তি করতে পারিস। আবৃত্তিতে নাম দে। দাঁড়া, আমিই গিয়ে ভাইয়াকে বলে আসি।’
পুষ্প অডিটরিয়ামের এক কোণে বসা একটা ছেলের দিকে এগিয়ে গিয়ে বলল,
‘ভাইয়া, আমার বান্ধবী আবৃত্তিতে নাম দিবে। আপনি ওর নামটা একটু আবৃত্তির লিস্টে লিখে ফেলুন।’
ছেলেটির চোখে মোটা গোল চশমা। সেই চশমার কাঁচ বেধ করে সে বিরক্ত চোখে পুষ্পর দিকে চাইল। বলল,
‘আপনার বান্ধবী কি নিজে এসে বলতে পারছেন না? উনার মুখ নেই?’
পুষ্প কপাল কুঁচকায়। এত ত্যাড়া ভাবে কথা বলার কী আছে? সে তার বান্ধবীর হয়ে বলেছে তো কী হয়েছে তাতে? ছেলেটার কথা পুতুলের পছন্দ না হলেও মুখে হাসির রেখা টেনে সে বলল,
‘দাঁড়ান, ওকে ডাকছি।’
পুতুল হাত নাড়িয়ে লীনাকে ডাকে। এগিয়ে আসে লীনা। চোখে মুখে সংকোচ তার। আবৃত্তিতে নাম দিবে কি দিবে না ভাবছে। পুতুল বলে উঠে,
‘এই যে আমার বান্ধবী, লীনা। এই লীনা বল, নাম দিবি না আবৃত্তিতে?’
ছেলেটিও চাইল লীনার মুখের দিকে। লীনা এখনও ভেবে যাচ্ছে। সে যে পরিমাণ ভীতু মেয়ে, স্টেজে গিয়ে না আবার সবকিছু গুলিয়ে ফেলে। ছেলেটি কপালের ভাঁজ দৃঢ় করে বলল,
‘আপনি কি কালা? কানে শুনেন না? আপনাকে কেউ কিছু বলছে তো।’
ছেলেটার কথায় ভড়কে যায় লীনা। এগুলো কি তাকে বলছে? সে কালা? চোখ মুখ কুঁচকে তাকায় সে। কিছু বলার আগেই ছেলেটা আবারও একই সুরে জিজ্ঞেস করে,
‘নাম কি দিবেন আপনি? আশ্চর্য, কখন থেকে এক ভাবে দাঁড়িয়েই আছেন। বলুন কিছু।’
লীনা নাক ফুলিয়ে পুতুলের দিকে চাইল। পুতুল হে হে করে হেসে বলল,
‘জি ভাইয়া, ও নাম দিবে। আপনি লিখে ফেলুন।’
ছেলেটার বিরক্তির মাত্রা বাড়ল। লীনার দিকে গরম চোখে চেয়ে মনে মনে কী কী যেন বিড়বিড় করল। তারপর আবার মনযোগ দিল খাতার দিকে। ক্ষিপ্ত সুরে জিজ্ঞেস করল,
‘নাম কী?’
পুতুল বলার জন্য হা করতেই ছেলেটা হাত দেখিয়ে থামিয়ে দেয়। বলে,
‘উনার নামটাও কি আরেকজনকে বলে দিতে হবে?’
লীনার ছেলেটার উপর মাত্রাতিরিক্ত রাগ হচ্ছে। এই ছেলের তাকে নিয়ে এত কী সমস্যা? তার ইচ্ছে, সে বলবে না। তাতে, এই ছেলের কী?
লীনা তীব্র আওয়াজে বলল,
‘লীনা। আমার নাম লীনা।’
আবারও বিরক্ত হলো ছেলেটা। মাথা তুলে জিজ্ঞেস করল,
‘আগে পিছে কিছু নেই? খালি লীনা আবার কেমন নাম?’
লীনা তেতে উঠল এবার। কর্কশ সুরে বলল,
‘লীনা আহমেদ। এবার হয়েছে?’
‘জি।’
লীনা চলে যাওয়ার জন্য পা বাড়াতেই পেছন থেকে আবার তার ডাক পড়ে। ছেলেটা ডাকে। বলে,
‘এই যে লীনা আহমেদ, আমার কথা শেষ করতে দিন।’
লীনা দাঁত খিচে চাইল। ক্ষুব্ধ হয়ে জিজ্ঞেস করল,
‘আর কী বলতে চান?’
‘শুনুন, নাম দিয়ে দিয়েছেন; এখন আর চাইলেও নাম কাটা যাবে না। এর আগেও অনেকে এমন করেছে। নাম দিয়ে প্রোগ্রামের দিন উধাও। এতে আমাদের সিনিয়রদের রেপুটেশন খারাপ হয়। ডিপার্টমেন্টে কথা আমরা শুনি। তাই আগেই সাবধান করছি। নাম দেওয়ার পর কোনো অজুহাত শোনা হবে না। আর ক্লাস শেষে প্রতিদিন অডিটরিয়ামে চলে আসবেন। প্র্যাক্টিস করতে হবে, বুঝেছেন?’
লীনা এদিক ওদিক চোখ ঘুরিয়ে অতঃপর নিশ্বাস ছাড়ল। বলল,
‘জি, বুঝেছি। আর কিছু?’
‘না। এবার আপনি আসতে পারেন। ক্লাস শেষ করে আবার চলে আসবেন।’
লীনা জবাব না দিয়েই পা বাড়াল। বিরক্তিকর ছেলে একটা। এই ছেলের ব্যবহার বরাবরই এমন। ভার্সিটিতে আসার পর থেকেই দেখেছে, ছেলেটা সবার সাথেই এভাবে কথা বলে; যেন সবার উপর ভীষণ বিরক্ত সে। কাউকেই তার পছন্দ না। এই ভার্সিটি, এই দায়িত্ব, কেউ বোধ হয় জোর করে তার উপর চাপিয়ে দিয়েছে, তাই এই অবস্থা। একেবারে রসকষহীন একটা রোবট মানুষ।
‘ঐ লোকটাকে দেখলেই আমার রাগ হয়।’
‘আমার তো খারাপ লাগে না। সব প্রোগ্রামেই নিজ দায়িত্বে সবকিছু করে। আর উনার তদারকিতেই তো প্রোগ্রামগুলো এত সুষ্ঠুভাবে হয়। নাহলে, অন্য কোনো সিনিয়রদের এসব নিয়ে এত মাথা ব্যথা আছে নাকি।’
‘কই, আমার তো তা মনে হয় না। আমার তো মনে হয়, উনি বোধ হয় এসবে বিরক্ত। তাই দেখিস না, সবার সাথে কেমন ত্যাড়া ত্যাড়া করে কথা বলে।’
‘তা অবশ্য ঠিক। তবে কিছু মানুষ জন্মগত ভাবেই একটু ত্যাড়া থাকে। লাইক, সারাজ ভাই।’
বলেই ফিক করে হেসে দিল পুতুল। তার হাসি দেখে লীনাও হেসে ফেলল।
প্রোগ্রামের প্রস্তুতি নিতে নিতে বাসায় ফিরতে ফিরতে পুতুলের বিকেল হয়ে গেল। গাড়ি এসে গেইটের সামনে থামতেই পুতুল দেখল সারাজের বাইক। খুশি হলো সে। দ্রুত গাড়ি থেকে নেমে বাসার দিকে পা বাড়াল।
বসার ঘরে সারাজকে একাই পেল সে। মা বাবা কোথায় কে জানে। সারাজ সোফায় পায়ের উপর পা তুলে বসে বেশ আয়েশ করে ফোন দেখছে। পুতুল যে এসেছে সেই খেয়াল নেই তার। পুতুল এই সুযোগে ধীর পায়ে আস্তে আস্তে করে সোফার পেছনে গিয়ে দাঁড়ায়। ঠিক সারাজের মাথার পেছনের দিকটায়। দৃষ্টি তার সারাজের মোবাইলের স্ক্রিনে। কী দেখছেন সারাজ ভাই? বোঝার জন্য একটু ঝুঁকে আসে। ভালো মতো তাকায় ফোনের স্ক্রিনে। কী যেন পড়ছেন তিনি। কোনো ওয়েবসাইট থেকে থেকে হয়তো কোনো আর্টিকেল পড়ছেন। সে স্বস্তির নিঃশ্বাস ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়। চট করে তখন সারাজ বলে উঠে,
‘দেখা শেষ?’
হকচকিয়ে উঠে পুতুল। সারাজ ভাই তাকে দেখলেন কী করে? তবে এখন এই প্রশ্ন করার সময় না। এখন পালানোর সময়। সে সিঁড়ির দিকে দ্রুত পা বাড়াতে চাইলেই সারাজ ঘুরে তার হাত টেনে ধরে। থমকে দাঁড়ায় পুতুল। বুকের ভেতরে ঢিপঢিপ করছে। আস্তে আস্তে তার দিকে ঘুরে দাঁড়ায়। বোকা বোকা হাসি দেয়। সারাজ কপাল কুঁচকে চেয়ে আছে। পুতুল তার হাতের দিকে তাকায়। সারাজ এমন শক্ত ভাবে ধরে রেখেছে, যেন ছেড়ে দিলেই সে হারিয়ে যাবে।
‘জিজ্ঞেস করবি না, কীভাবে বুঝলাম?’
সারাজের প্রশ্নে সম্বিত ফিরে পুতুলের। ফ্যালফ্যাল চোখে তাকায়। মনে প্রশ্ন এল, “সত্যিই তো, কী করে বুঝলেন?” তাই ঠোঁট কামড়ে মৃদু হেসে বলল,
‘তোমার নিশ্চয়ই পেছনেও দুইটা চোখ আছে।’
পুতুলের বোকা বোকা কথায় হাসে সারাজ। এই মেয়ে আদৌ বোকা, নাকি বোকার সাজার ভান করে সেটাই সে বুঝে উঠতে পারে না। সে পুতুলের হাত ছেড়ে পুনরায় সোফাতে গা এলিয়ে দেয়। কয়েক সেকেন্ড চুপ থেকে বলে,
‘চোখ বুজেও মানুষ চেনা যায় কী করে জানিস?’
পুষ্প মাথা নাড়াল। সে জানে না। সারাজ বিদ্রুপের সুরে বলল,
‘আমার সাথে ঝগড়া করা ছাড়া তো তুই আর কিছুই জানিস না। (একটু থেমে) চোখ বুজেও মানুষ চেনা যায় তার ঘ্রাণেন্দ্রিয় দ্বারা। প্রত্যেক মানুষের শরীরে নিজস্ব একটা ঘ্রাণ আছে। এই ঘ্রাণ কোনো পারফিউমের ঘ্রাণ না। এই ঘ্রাণ একান্ত তার ব্যক্তিগত। তাই এই ঘ্রাণের তীব্রতাও ব্যক্তি বিশেষে আলাদা। সেইজন্যই চোখ বুজেও ঘ্রাণের মাধ্যমে মানুষ ধরা যায় সহজে। এই যেমন এখন তোকে ধরে ফেললাম।’
পুতুল অপ্রস্তুত হয়ে পড়ল যেন। তার শরীরের ঘ্রাণ থেকে সারাজ তাকে চিনেছে? ছি, তার শরীর থেকে তো এখন নির্ঘাত ঘামের গন্ধ আসছে। পুতুল জামার কলারের কাছটা একটু তুলে নাকের কাছে ধরে। না তেমন কোনো ঘ্রাণ পাচ্ছে না সে।
‘নিজের শরীরের ঘ্রাণ নিজে পাবি না, বোকা। যা রুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে আয়। তারপর এসে এক কাপ চা বানিয়ে দিস। আমি তো তোর বাবার অপেক্ষা করতে করতে ক্লান্ত। কবে আসবেন, কে জানে?’
‘মা’কে ডাকব?’
‘না, থাক। মা ঘুমাচ্ছেন। ঘুমাতে দে। আর তুই ফ্রেশ হয়ে জলদি নিচে আয়। কোনো ফাঁকিবাজি যেন না হয়।’
পুতুল বিরক্ত গলায় বলল,
‘ঠিক আছে।’
চলবে….