#শেষটা_সুন্দর(সিজন-২)
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
১২।
অগত্যাই সারাজের জন্য চা বানাচ্ছে পুতুল। চোখে মুখে তার মহা বিরক্তি। চা বানানো আহামরি কোনো ব্যাপার না। কিন্তু, এই সহজ কাজেও খুব একটা পটু না সে। আবার তার হাতের চা যে খুব বেস্বাদ হয়, তেমনও না। কোনোরকমে চালিয়ে দেওয়া যায় আরকি। তবে এই কোনোরকমে চালিয়ে দেওয়াটাকেও আরো জঘন্য করার পাঁয়তারা করছে সে। এক কাপ চায়ের জন্য চার চামচ চা পাতা দিয়েছে। তাতেও মন ভরেনি। আরো এক চামচ দিয়ে তবেই ক্ষান্ত হলো। অনেকক্ষণ ধরে পানি ফুটাল দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে। মনে মনে ততক্ষণে ভেবে নিল, এই তরল পানীয়কে আরো কীভাবে জঘন্য বানানো যায়।
‘চা করছিস কার জন্য?’
মায়ের গলা পেয়ে ঘাড় কাত করে তাকায় পুতুল। বলে,
‘তোমার আদরের ছেলের জন্য।’
‘বাহ, ভালো।’
মেহুল খুশি হয়েছে। খুশি হওয়ারই কথা। বিয়ের আগেই স্বামীর এমন একটু আধটু যত্ন নেওয়া শিখে রাখা ভালো।
মেহুল এগিয়ে এসে বলল,
‘নামিয়ে ফেল না, হয়ে গিয়েছে তো।’
পুতুল চায়ের পাতিলের দিকে চেয়ে বলল,
‘নামাব নামাব। অত তাড়া দিও না। আজকে ভীষণ স্পেশাল একটা চা বানাচ্ছি বুঝলে।’
পুতুলের হাবভাব দেখে কপাল কুঁচকায় মেহুল। জিজ্ঞেস করে,
‘এই, উল্টাপাল্টা আবার কিছু করবি না তো?’
‘আরে না মা, স্পেশাল মানেও বুঝো না? খুব মজা করে বানাব। যেন একবার খেলে আর খেতে ইচ্ছে না করে।’
পুতুলের শ য়তানী মাখা হাসি দেখে মেহুল ঠিক বুঝল, মেয়েটার মাথায় কিছু চলছে। যা পাজি হয়েছে না। বিয়ের পর যে সারাজ একে কী করে সামলাবে কে জানে।
‘মা, বাবা কখন আসবে বলেছে?’
‘হ্যাঁ। কল দিয়েছিলেন; বললেন রাস্তায় আছেন।’
‘আচ্ছা, তুমি তাহলে বাকি নাস্তা বানাও। আমি চা টা সারাজ ভাইকে দিয়ে আসি।’
‘কিরে, চিনি না দিয়েই নিয়ে যাচ্ছিস কেন?’
‘দিয়েছি মা, তুমি খেয়াল করোনি।’
বলেই দ্রুত পায়ে রান্নাঘর ছাড়ল পুতুল। মেহুল চোখ পিটপিট করে মনে করার চেষ্টা করল, আদৌ পুতুল চায়ে চিনি দিয়েছে তো?
সারাজকে খুঁজতে খুঁজতে পুতুল গেল তার স্টাডি রুমে। এই রুমটা সারাজের জন্যই বরাদ্দ। তাই নিজের মতো রুমকে সে গুছিয়ে নিয়েছে। সে না আসলে এই রুম লক করা থাকে। কারোর প্রবেশের অনুমতি নেই, পুতুলেরও না।
দরজায় নক করল পুতুল। বলল,
‘সারাজ ভাই, আসব?’
‘আয়।’
সারাজের অনুমতি পেয়ে মৃদু ছন্দে ভেতরে প্রবেশ করল সে। গিয়ে দেখল সারাজ তার দিকে পিঠ করে দাঁড়িয়ে কোনো একটা বই পড়ছে। পেছন থেকে বার কয়েকবার উঁকি ঝুঁকি মেরে অতঃপর পুতুল বলল,
‘তোমার চা।’
‘নিয়ে আয়।’
পুতুল চোখের মনি ঘুরিয়ে ফুঁস করে নিশ্বাস ছাড়ল। চা টা এসেও নিতে পারছে না। যেন কোন মহারাজা। সারাজের মুখের সামনে চায়ের কাপটা এগিয়ে দিয়ে বলল,
‘নাও।’
সারাজ বই রেখে কাপটা হাতে নিল। পুতুল যাওয়ার জন্য পা বাড়াতেই সারাজ বলে উঠল,
‘কোথায় যাচ্ছিস? আমি বলেছি চলে যেতে?’
‘থেকে যেতেও তো বলোনি।’
সারাজ ভ্রু কুঁচকাতেই পুতুল দাঁত কেলিয়ে হাসে। বলে,
‘চা টা খেয়ে বলো না কেমন হয়েছে।’
সারাজ তারদিকে চোখ রেখেই চায়ের কাপে চুমুক দিল। সেই তরল বিদঘুটে পানীয় গলা অবধি গিয়েই আটকে গেল যেন। ফেলে দিলে ভালো হতো। এই জঘন্য জিনিস গেলা যায় না। তবে, সারাজ ফেলল না। পুতুলের মুখের দিকে চেয়ে থেকেই টুপ করে গিলে ফেলল সেটা। কোনো প্রতিক্রিয়া নেই তার মাঝে। এমন একটা কুৎসিত জিনিস গিলেও কী করে এত স্বাভাবিক সে? পুতুল ভেবে পেল না। নিচের ঠোঁট কামড়ে ধরে গভীর মনোযোগে চেয়ে রইল সারাজের মুখের দিকে। মূলত তার মুখের অবয়ব বোঝার চেষ্টা করছে। যার মাঝে কোনো পরিবর্তন নেই। সারাজ খেয়াল করল পুতুলের ঠোঁট কামড়ে তাকিয়ে থাকাটা। তার তখন দৃষ্টি গেল পুতুলের কামড়ে ধরা অধরের দিকে। দাঁতের চাপ পড়াতে জায়গাটা কেমন লালচে হয়ে আছে যেন। ঢোক গিলল সারাজ। সঙ্গে সঙ্গেই সেই বিদঘুটে স্বাদের চায়ের কাপে আবার বড়ো করে একটা চুমুক দিয়ে দিল। এক চুমুকে অনেকটা চা খেয়ে ফেলল সে। পুতুল ড্যাবড্যাব করে চেয়ে আছে। লোকটা কী সাংঘাতিক! এমন একটা জিনিস তার হজম হচ্ছে কী করে?
টেবিলে চায়ের কাপটা রেখে সারাজ মৃদু সুরে জিজ্ঞেস করল,
‘চা টা তুই বানিয়েছিস?’
পুতুল আলগোছে মাথা নাড়িয়ে বলে,
‘হ্যাঁ। কেন, মজা হয়নি?’
সারাজ চোখ তুলে একবার চাইল। পরে আবার টেবিলে রাখা বইটা তুলে বলল,
‘মারাত্মক হয়েছে। এখন থেকে প্রতিদিন আসলে এইভাবেই চা বানিয়ে দিবি।’
‘কী?’
হতভম্ব পুতুল। এই জঘন্য একটা জিনিস কারোর কী করে পছন্দ হতে পারে? তার তো মাথাতেই ঢুকছে না কিছু। পুতুলকে হা করে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে সারাজ কপাল কুঁচকাল। জিজ্ঞেস করল,
‘কী হলো, বিশ্বাস হয়নি? না হলে তুই নিজেই খেয়ে দেখ না, কেমন চা বানিয়েছিস।’
সারাজের কথা মতো পুতুল চায়ের কাপটা হাতে নিল। ধীরে ধীরে ঠোঁট এগিয়ে চুমুক বসাল তাতে। জিভ তার চায়ের টেস্ট বুঝতেই মারাত্মক রকম তেতিয়ে উঠে মস্তিষ্ক সিগন্যাল পাঠাল, এটা একটা জঘন্য জিনিস। এক্ষুনি মুখ থেকে বের করে এটাকে। কিন্তু, এখন মস্তিষ্কের কথা ভুলেও শোনা যাবে না। সারাজের দৃষ্টি তার দিকে স্থির। তাই উপায়ান্তর না পেয়ে গিলে ফেলল সেটা। সঙ্গে সঙ্গে যেন শরীর অদ্ভুত ভাবে কেঁপে উঠল। কী খেল এটা। করলার জুসের চেয়েও খারাপ।
সারাজের ঠোঁটের কোণে কিঞ্চিত হাসির রেশ। প্রশ্ন ছুড়ল,
‘কিরে, দারুন না?’
‘হ্যাঁ? হ্যাঁ হ্যাঁ, দারুণ দারুণ। ভীষণ দারুণ হয়েছে। এমন চা আর কোথাও পাবে না। আমার হাতের স্পেশাল চা। দারুণ না হয়ে উপায় আছে?’
সারাজ ঠোঁটের হাসি বহাল রেখে বইয়ের দিকে চাইল। এক সেকেন্ড বিরতি নিয়ে বলল,
‘তবে, আজ থেকে তোর চা বানানোর চাকরিটা কনফার্ম। ঠিক এইভাবেই প্রতিদিন চা বানাবি, মনে থাকবে তো?’
পুতুল বিরক্ত হয়ে মাথা নাড়িয়ে চলে এল সেখান থেকে। এতকিছু করেও কোনো লাভ হলো না। সেই তাকে সারাজের কাছে পরাস্ত হতে হলো। মাত্রাতিরিক্ত বিরক্তিতে চোখ মুখ কুঁচকে আছে তার। রান্নাঘরে ফিরে এসে বলল,
‘মা, নাস্তা লাগবে না। আমাকে খালি এক কাপ চা দাও।’
‘সারাজ তোর হাতের চা খেয়ে কী বলল?’
মায়ের প্রশ্নে বিরক্তির মাত্রা যেন আকাশ ছুঁলো। বিক্ষিপ্ত সুরে বলল,
‘বলেছেন, এমন চা নাকি জীবনেও খাননি। আমি যেন এরপর থেকে প্রতিদিন উনাকে এভাবে চা বানিয়ে দেই।’
মেহুল খুশি হয়ে বলল,
‘তাই নাকি, এত ভালো হয়েছে? কই, আমাদের তো কখনও এত ভালো চা বানিয়ে খাওয়াসনি; আজ তাহলে তোর বাবা আসলে আমাদেরকেও তোর স্পেশাল চা টা বানিয়ে খাওয়াস।’
পুতুল হম্বিতম্বি দেখিয়ে বিরক্ত গলায় বলল,
‘পারব না আমি। নিজের চা নিজে বানাও। আমি জীবনেও আর কারোর জন্য চা বানাব না।’
বলেই চটাস চটাস পা ফেলে নিজের রুমে চলে যায়। মেহুল অবাক হয়ে মনে মনে ভাবে, “মেয়েটা হঠাৎ রাগল কেন, আশ্চর্য!”
________
রাবীর অফিস থেকে ফেরার পর সারাজ তার সাথে আলোচনায় বসে। মূলত সে বাবার অফিস আর রাবীরের দেওয়া দায়িত্ব দুটোই একসাথে সামলাতে চায়। রাবীর বারণ করে। বলে, দুই নৌকায় একসাথে পা দিয়ে চলা যায় না। শেষে দুই দিকই হারাতে হবে। কিন্তু, বুঝতে চায় না সারাজ। সে তার মতো রাবীরকে বুঝিয়ে নেয়। সারাজের যথোপযুক্ত কথার বিপরীতে রাবীরের সব মেনে নেওয়া ছাড়া আর কোনো উপায়ও ছিল না। সারাজের কষ্ট হলেও সে দুদিক সামলে নিবে।
মেহুল, রাবীর দুজনেই চিন্তায় পড়ে খুব। সবদিক বিবেচনা করে মেহুলও চাইছে না, সারাজ রাজনীতি করুক। এই নিয়ে সারাজকে বুঝিয়েও ছিল। কিন্তু, সারাজ তার কথাকে আমলে নেয়নি। আর নিবে বলেও মনে হচ্ছে না। এইদিকে সে স্পষ্ট বুঝতে পারছে, ভবিষ্যতে এই নিয়ে আরো ঝামেলা হবে। সারাজের মাথা থেকে রাজনীতির ভূতটা বের করা দরকার। নয়তো দুই পরিবারের মাঝে আবার ঝামেলা হবে, ফাটল ধরবে। এমনটা মেহুল চায় না। আপাতত সারাজের মাথা থেকে রাজনীতির ভূত সরাতে অন্যকিছুর চিন্তা মাথায় ঢুকাতে হবে। এই নিয়ে পরিকল্পনা করাও হয়ে গিয়েছে তার। এখন ঠিকঠাক অভিনয়টা করতে পারলেই হয়।
বেশ গুরুগম্ভীর আলোচনা শেষে বসার ঘরে এখন পিনপতন নিরবতা। পুতুল সিঁড়িতে বসে বসে এতক্ষণ সারাজ আর রাবীরের কথা শুনছিল। সবার কথাই বেশ যুক্তিযুক্ত। এখন যে ঘটনা কোনদিকে গড়াবে কে জানে। অতশত চিন্তা তার ছোট্ট মাথা নিতে পারবে না। আপাতত তাকে নববর্ষের প্রোগ্রাম নিয়েই ভাবতে হবে। অলস ভাবে উঠে দাঁড়িয়ে রুমের দিকে পা বাড়াতেই হঠাৎ মায়ের কথায় পা সেখানেই আটকে যায় তার।
মেহুল সমস্ত নিরবতার মাঝে যেন বোম্ব মেরে বসল। সে বলল,
‘জানেন তো, আমি কয়দিন ধরেই না পুতুলের বিয়ের কথা ভাবছিলাম। আজ সকালেই রিতা ফোন দিয়ে বলল, সে নাকি একটা ভালোর ছেলের সন্ধান পেয়েছে। ছেলে সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার। দেখতেও নাকি রাজপুত্র। বলল, আমাদের পুতুলের সাথে নাকি বেশ মানাবে। এখন আপনি কী বলেন? কথা আগাব?’
আকস্মিক এমন ঝটকা পুতুল নিতে পারল না। ধপ করে আবার বসে পড়ল পূর্বের জায়গায়। রাবীর হকচকিয়ে উঠেছে যেন। মেহুল এখন এসবের মাঝে পুতুলের বিয়ের কথা কীভাবে উঠাল? মাথাটা কি খারাপ হয়েছে তার? অন্যদিকে সারাজ স্তব্ধ। বারবার একটা কথাই মস্তিষ্কে বাজছে, “পুতুলের বিয়ে? তার পুতুলের বিয়ে? তাও আবার অন্যকারোর সাথে?”
চলবে…