#শেষটা_সুন্দর(সিজন-২)
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
২৩।
সকালে কোনোরকমে নাস্তা সেরে বেরিয়ে পড়ে পুতুল। মায়ের সাথে একটাও কথা বলেনি। বাবার সাথেও না। সবার উপর রাগ তার। কেউ তাকে বুঝল না। সে মিছে মিছি বলল, আর অমনিই সবাই বিয়ে নিয়ে একেবারে হুলুস্থুল বাঁধিয়ে দিয়েছে। কেউ বুঝল না, তার মনে কী চলছে। সারাজ ভাইও না।
ভার্সিটির গেইটের সামনে গাড়ি থামতেই নেমে দাঁড়াল পুতুল। ড্রাইভারকে উদ্দেশ্য করে বলল,
‘আপনি চলে যান। আমি আজ রিক্সা করে বাড়ি ফিরব।’
‘কিন্তু ম্যাডাম, স্যার শুনলে তো রাগ করবেন।’
‘স্যারকে শোনানোর কী দরকার? কাউকে কিছু বলার দরকার নেই। আর কোনো সমস্যা হলে আমি আপনাকে বাঁচিয়ে নিব। চিন্তা নেই, যান।’
এই বলে পুতুল ভার্সিটির ভেতরে চলে যায়। ক্লাসে গিয়ে দেখে লীনাও এসে পড়েছে। পুতুল আলগোছে তার পাশে গিয়ে বসে। তাকায় লীনার দিকে। অথচ লীনা এখনও পুতুলের উপস্থিতি টের’ই পায়নি। মুখের ভেতর কলম ঢুকিয়ে সামনের দিকে চেয়ে কী যেন ভাবছে। তাকে এভাবে দেখে ভ্রূকুটি হলো পুতুলের। হালকা করে তাকে ধাক্কা দিয়ে বলল,
‘কী-রে, কী ভাবছিস এত?’
লীনা সম্বিত হয়। ভড়কে যাওয়ার দৃষ্টিতে পুতুলের দিকে চেয়ে বলে,
‘জানিস, কাল কী হয়েছে?’
পুতুল নিঃস্পৃহ সুরে বলে,
‘না বললে কী করে জানব? আমি তো আর অন্তর্যামী না।’
লীনা প্রথমে ভ্রু কুঁচকায়। তারপর আবার রয়ে সয়ে কিছু বলতে যাবে, তার আগেই ক্লাসে শিক্ষক চলে আসে। ফুঁস করে নিশ্বাস ছেড়ে লীনা বলল,
‘আচ্ছা, পরে বলব।’
টানা দুইটা ক্লাস হয়। ক্লাসের মধ্যে কথা বলার জো নেই। এখন আবার ক্লাস শেষে যেতে হবে অডিটরিয়ামে। হাতে আর মাত্র দু’দিন আছে। তাই সবাই বেশ মনোযোগী তাদের অনুশীলনে। পুতুল আর লীনা অডিটরিয়ামে প্রবেশ করে। আজ একটু বেশিই মানুষ এখানে। এতদিন যারা অনুশীলন করেনি, তারাও আজ এসেছে অনুশীলন করতে। পুতুল আর লীনা এক কোণে গিয়ে বসে। তারপর পুতুল লীনার দিকে চেয়ে জিজ্ঞেস করে,
‘তুই না তখন কী যেন বলতে চেয়েছিলি?’
লীনা ঠোঁট গুঁজ করে মাথায় নাড়ায়। তারপর বলে,
‘কাল একটা আননোন নাম্বার থেকে আমার কাছে প্রেম পত্র এসেছে। না, ঠিক প্রেমপত্র না, প্রেমকাব্য।’
‘প্রেমকাব্য?’
অবাক হয়ে প্রশ্ন করে পুতুল। লীনা মাথা ঝাঁকিয়ে বলে,
‘হ্যাঁ। দাঁড়া, দেখাচ্ছি তোকে।’
এই বলেই লীনা তার ফোন করে পুতুলকে সেই কবিতার মেসেজটা দেখায়। কবিতা পড়ে পুতুল মিটিমিটি হেসে বলে,
‘বাহ, ছেলে তো পুরো কবি। তা, এই কবিকে কই পেলি?’
‘আরেহ, আমি তো চিনি’ই না। প্রথমে কল করে কতক্ষণ জ্বালিয়ে তারপর এই কবিতা পাঠিয়েছে। কে এই মহান কবি কে জানে?’
‘এখনই একটা কল দে এই নাম্বারে। কথা বললেই সব পরিষ্কার হয়ে যাবে।’
লীনা সাথে সাথেই কল লাগায়। হ্যাঁ, কল হচ্ছে। হঠাৎ একটা রিংটোনের শব্দ কানে আসে তাদের। ঠিক তাদের পেছন থেকে। লীনা আর পুতুল দুজনেই ভ্রু কুঁচকে পেছনে তাকায়। দেখে, মাহাতের কল বাজছে। লীনা আর পুতুল তখন একজন অন্যজনের দিকে দৃষ্টি বিনিময় করে। ব্যাপারটা তাদের বোধগম্য হচ্ছে না। মাহাত ফোন হাতে নিয়ে সেখান থেকে বেরিয়ে যায়। লীনার এবার কিঞ্চিৎ সন্দেহও হয়। পরক্ষণেই আবার ভাবে, এত ছেলে থাকতে এই রষকষহীন অগাধ ছেলে কেন তাকে অযথা প্রেমকাব্য পাঠাতে যাবে? উনাকে হয়তো অন্যকেউ কল দিয়েছে। পুতুল বলে উঠে,
‘এই, কলটা তো কেটে গেল।’
লীনা চেয়ে বলে,
‘ওমা, তাই তো! ছেলেটা কলটা রিসিভ করল না?’
‘আবার দে।’
পুতুল আর লীনা লাগাতার সেই নাম্বারে কল দিয়ে যাচ্ছে। এর মাঝেই সেখানে এসে দন্ডায়মান হয় মাহাত। তাদের দুই বান্ধবীর দিকে কপাল কুঁচকে তাকায় সে। বিমুখ সুরে বলল,
‘কী ব্যাপার, অনুশীলন না করে আপনারা দুজন এখানে কী করছেন?’
হঠাৎ মাহাতকে দেখে দুজনেই চমকে তাকায়। লীনা আমতা আমতা করে বলে,
‘না, মানে… এখনই প্র্যাকটিসে যাচ্ছিলাম।’
‘জি, তাড়াতাড়ি করুন। আর আপনি পুতুল, আপনার গানের গ্রুপ ঐ দিকে। ওদের সবার সাথে গিয়ে প্র্যাকটিস করুন।’
পুতুল মাথা কাঁত করে সম্মতি জানিয়ে সেখান থেকে চলে গেল। লীনা তার ফোনের দিকে চেয়ে আছে, ফোন তো এখনও যাচ্ছে ঐ নাম্বারে। আর তার ঠিক সামনেই তো মাহাত দাঁড়ানো। উনি হলে এতক্ষণে নিশ্চয়ই উনার ফোন বেজে উঠতো। না, তাহলে উনি নন। লীনা দীর্ঘশ্বাস ফেলে। কলটা কেটে দিয়ে উঠে দাঁড়ায়। সামনের দিকে অগ্রসর হতেই মাহাত আবার ডাকে তাকে। লীনা ফিরতেই সে বলে,
‘আজ প্র্যাকটিস শেষ হলে আমাকে শোনাবেন।’
লীনা মাথা ঝাঁকিয়ে ফের অগ্রসর হলো সম্মুখে।
______
মাহাতকে আজ কবিতা আবৃত্তি করে শোনানোর সময় লীনা বেশ অস্বস্তিতে পতিত হয়েছিল। ছেলেটা কেমন করে যেন চেয়ে ছিল তার দিকে। একবারের জন্যও অন্যদিকে তাকায়নি। এক দৃষ্টিতে চেয়ে ছিল কেবল তার মুখের দিকে। যেন চোখ সরালেই কোনো মহা মূল্যবান জিনিস সে হারিয়ে ফেলবে। কই, আরও তো কত ছেলে মেয়ে আজ আবৃত্তি করল, তাকে শোনাল; তাদের কারোর দিকে তো উনি এভাবে চেয়ে ছিলেন না। তবে তার বেলাতেই কেন? লীনা সেই প্রশ্নের জবাব পায় না। শিরঃস্থিত মজ্জার নিউরন কি তাদের কর্ম আজ গ্রথন করেছে? তবে কেন সে এই সহজ প্রশ্নের উত্তর পাচ্ছে না?
লীনার ভাবুক মুখখানা দেখে পুতুল প্রশ্ন করে,
‘কী-রে আবার কী ভাবছিস?’
লীনা অপ্রস্তুত হেসে বলে,
‘না, কিছু না। কিন্তু, তোর আজ কী হয়েছে বলতো? সকাল থেকে এমন মনমরা হয়ে আছিস?’
পুতুল ভারি নিশ্বাস ছাড়ে। বিষন্ন সুরে বলে,
‘আমার বিয়ে ঠিক হয়েছে।’
লীনা চমকে বলে,
‘কী বলিস? কবে, কোথায়? আমাকে তো কিছুই জানালি না।’
‘আর জানানো। কী হবে জানিয়ে? আমার তো এই বিয়েতে কোনো মত’ই নেই।’
লীনা অবাক কন্ঠে বলে,
‘তবে কি আন্টি আংকেল জোর করে তোর বিয়ে দিচ্ছেন?’
‘না, ঠিক জোরও না। আসলে, ওরা কেউ আমাকে বুঝতে চাইছে না। আর আমিও আমার মনের কথাটা ওদের বলতে পারছি না। আমি চাই না, এই বিয়ে হোক।’
‘তুই কি অন্যকাউকে পছন্দ করিস, পুতুল?’
পুতুল গোল গোল চোখে কিছুক্ষণ চেয়ে থাকে লীনার দিকে। এখন তাকে “হ্যাঁ” বললেই, মেয়েটা সেই অজ্ঞাত ব্যক্তির পরিচয় জানার জন্য উতলা হয়ে উঠবে। কিন্তু, পুতুল এখনই লীনাকে সারাজ ভাইয়ের প্রতি তার অনুভূতির কথা জানাতে চাইছে না। তাই সে কথা ঘুরাতে বলল,
‘চল, আজকে একটু টং এর চা খেয়ে আসি।’
লীনা সন্দিহান কন্ঠে বলল,
‘তুই কিন্তু আমার প্রশ্নের কোনো জবাব দিস-নি।’
‘দিব, সময় হলেই সব প্রশ্নের উত্তর পেয়ে যাবি।’
লীনা বিদ্বিষ্ট হয়ে চেয়ে থাকে পুতুলের দিকে। পুতুল সেই দৃষ্টি অগ্রাহ্য করে তার হাত টেনে নিয়ে যায় চা খেতে।
_______
টং এর দোকানের চায়ের টাকা দিয়ে ফিরতেই পুতুল চমকে ওঠে। তার সম্মুখে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটিকে দেখে চিত্ত জুড়ে শীতল স্রোত বয়ে যায়। ছাই রঙের গাড়িটার সাথে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে সারাজ। স্যূট বুট গায়ে একেবারে ফর্মাল গেট আপ তার। উজ্জ্বল শ্যামলা গায়ের রংটা মিহির অংশুতে চকচক করছে যেন। পুতুল তো তার দৃষ্টি সংযত করতে পারছে না। ছি, কী বেহায়া তার অক্ষিযুগল। সারাজের শঅনিত চোখের দৃষ্টি এবার কোমল হয়। অধর জুড়ে ফুটিয়ে তুলে নিরুপম সুন্দর হাসি। এগিয়ে আসে পুতুলের দিকে। হালকা মাথা নুইয়ে বলে,
‘আরেক কাপ চা খাবি?’
পুতুল বড়ো বড়ো চোখে তাকায়। সারাজ ভাই তাকে টং এর চা খেতে বলছেন? হৃষ্টতা সহিত সে বলে উঠে,
‘অবশ্যই।’
তারপর সারাজ লীনার দিকে চেয়ে বলে,
‘তুমি খাবে আরেক কাপ?’
লীনা ইতস্তত সুরে বলে,
‘না না, ভাইয়া। আমি এক কাপের বেশি খেতে পারি না।’
সারাজ হেসে টং এর মামাকে বলে, আরও দুই কাপ চা দিতে। চিনি কম দিয়ে কড়া লিকারের দুধ চা।
সারাজের এহেন আচরণে পুতুল ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে আছে তার দিকে। সারাজ ভাইয়ের আজ অকস্মাৎ কী হলো, সেটাই ভাবছে সে।
লীনা আর দাঁড়িয়ে থেকে কী করবে। তাই সে পুতুলের কাছে গিয়ে বলে,
‘তোরা চা খা। আমি বরং যাই।’
‘কেন, থাক না আরো কিছুক্ষণ। এত তাড়া কীসের?’
‘না, আমার এখানে থেকে কোনো কাজ নেই। তুই বরং তোর ভাইয়ের সাথে চা খা। আসছি।’
‘আচ্ছা, সাবধানে যাস।’
লীনা হেসে রিক্সা ডেকে সেখান থেকে চলে যায়।
.
এই অপরাহ্নে উদম অম্বরতলে দাঁড়িয়ে প্রিয় মানুষের সাথে এক কাপ চা খাওয়ার মতো সুখকর ব্যাপার আর কিছু হতে পারে না। এই চায়ের স্বাদ অমৃতের চেয়েও কম কিছু না। চায়ের কাপে চুমুক দিয়েই তৃপ্তিতে নেত্র রহিত করে পুতুল। আহ, কী শান্তি।
সারাজ মৃদু হেসে পুতুলের সামনের ছোট চুলগুলো কানের পিছে গুঁজে দেয়। চট করে তাকায় পুতুল। ড্যাবড্যাব করে চেয়ে থাকে। সারাজের ঠোঁটের কোণে মৃদু হাসির রেশটা এখনও প্রতীয়মান। পুতুল বিভোর সুরে বলে,
‘তোমার আজ কী হয়েছে, সারাজ ভাই?’
সারাজ মোহগ্রস্ত কন্ঠে বলে উঠে,
‘আমার না খুব প্রেম প্রেম পাচ্ছে, পুতুল।’
চলবে….