#হৃদয়জুড়ে_প্রেয়সীর_আভাস (২)
#পর্ব_১৯+২০
#মোহনা_হক
সবার মুখশ্রীতে চিন্তিত ভাব। মেহরুবা বার বার তার মেয়ের হাত পায়ে মালিশ করে দিচ্ছে। সাথে মায়া চৌধুরী আর জেবা ও রয়েছে। চোখ মুখে কঠোর ভাব ফজলুল চৌধুরীর। রাত বেশি হয়ে যাওয়াতে ডাক্তার নিয়ে আসতে পারেনি। এমন পরিস্থিতি ও না যে এই মুহুর্তে কোনো ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাওয়া যাবে। আয়াজের সে কাঙ্খিত বাক্যটি শোনার পর অস্ফুট স্বরে রুয়াত কিছু বলে জ্ঞান হারিয়ে ফেলে। চৌধুরী বাড়ির কোনো মানুষ কখনো এসবের সাথে জড়ায়নি। আর ভবিষ্যতে জড়াবে এটাও ভাবতে পারেনি রুয়াত। তাও কিনা সে ব্যাক্তিটি তার ভালোবাসার মানুষ। এমন কথা সহ্য করতে না পেরে জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিলো। আগে কখনো এরকম পরিস্থিতির স্বীকার হয়নি রুয়াত। আজ এমন কথা শুনে নিজেকে আর ঠিক রাখতে পারেনি। হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে ফেলে সে।
খুব মনোযোগ দিয়ে রুয়াত কে পর্যবেক্ষণ করছে আয়াজ। অনেক সময় পেরিয়ে গিয়েছে অথচ জ্ঞান আসছে না। মোটামুটি সবাই খানিকটা চিন্তিত। মেহরুবার মনে একটাই প্রশ্ন ঘুরছে কিভাবে জ্ঞান হারালো? আর জ্ঞান এখনো আসছে না কেনো? বিশেষ করে ফজলুল চৌধুরী বেশ সন্দেহ করছেন আয়াজের উপর। কিন্তু চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছেন শুধু। তিনি ভাবছেন আয়াজ আবার কিছু বললো না তো? যে কারণে জ্ঞান হারিয়েছে। ইনিমা, আরহাম এমনকি নিমি কেউ কারণ জানে না এর রহস্য। রুয়াত জ্ঞান হারানোর পর আয়াজ তাড়াতাড়ি করে ধরে ফেলে তাকে। এমতাবস্থায় উচ্চস্বরে তিনজন কে ডাকা শুরু করে। যেহেতু আয়াজ হাঁটতে যাওয়ার সময় গাড়ি নিয়ে যায়নি। এমন কিছু হবে সেটাও তো তার খেয়ালে আসেনি। হুট করে রুয়াত কথাটি শোনার পর এরূপ কিছু হয়েছে। তাই আয়াজ কোনো কিছু না ভেবেই ইনিমার সাহায্য নিয়ে রুয়াত কে সহকারে একটা রিকশায় করে বাসায় চলে আসে। অতঃপর সবাইকে জানায় হঠাৎ ভয় পাওয়ার কারণে রুয়াতের জ্ঞান হারায়। স্বাভাবিক রাতের বেলায় হাঁটতে বের হয়েছে ভয় পেতেই পারে। সেটা অনুমান করেই কেউ আর কিছু বলেনি। কিন্তু বিষয়টি কেমন জানি মনেহলো মেহরুবার। ভয় পেয়ে অজ্ঞান হয়ে যাবে এমন মেয়ে রুয়াত নয়। কিন্তু তার মেয়ের এমন অবস্থা দেখে তাড়াতাড়ি করে রুমে নিয়ে আসে।
কিছুটা ঝুঁকে আয়াজ দু আঙুল দিয়ে রুয়াতের গাল স্পর্শ করে। তার মনেও অনেক চিন্তা একসাথে এসে জমাট বেঁধেছে। এক তো প্রেয়সীর চিন্তা দ্বিতীয়ত নিজেকে নিয়ে চিন্তা। মেহরুবা অস্থির হয়ে উঠেছে। অনেক সময় পেরিয়ে গেলো অথচ মেয়ের জ্ঞান আসছে না। কপালের কিঞ্চিৎ ঘাম জমা হয়। অস্থির হয়ে বললো,
-‘আয়াজ বাবা ওর এখনো জ্ঞান আসছে না কেনো? কতক্ষণ হয়ে গেলো। আমার তো এবার চিন্তা হচ্ছে ভীষণ। না জানি মেয়েটার কি হয়েছে।’
মেহরুবার কথায় আয়াজের কপালে ভাঁজ পড়ে। যদি একবার টের পেতো প্রেয়সী তার পেছনে দাঁড়িয়ে আছে কখনো এসব কথা বলতো না। বড় একটা নিঃশ্বাস টানে। আয়াজ সোজা হয়ে দাঁড়ায়। অনেক্ক্ষণ পর রুয়াতের জ্ঞান আসে। পিটপিট করে চোখ খুলে। আয়াজ খানিকটা দূরে সরে যায়। যেনো চোখ খুলতেই প্রেয়সী তাকে না দেখে। নাহলে আবার মনে পড়ে যাবে সে কথা। সেটা ভেবেই আয়াজ দূরে সরে আসে।মেহরুবা তাড়াহুড়ো করে রুয়াতের পাশে এসে বসে। রুয়াতের মাথায় হাত রাখে।
-‘ঠিক আসছি মা? কি হয়েছে যে এভাবে অজ্ঞান হয়ে গেলি?’
রুয়াত শুধু চেয়ে আছে। মাথাটা চারপাশে একটু ঘোরায়। সে তো জ্ঞান হারিয়েছিলো অন্য একটা জায়গায়। সেখান থেকে এখানে এসেছে কিভাবে? চারপাশ খুঁজে ও একজন মানুষটি কে দেখতে পেলো না। তৎক্ষনাত মনে পড়লো কিভাবে মানুষটি সিংহের গর্জনের ন্যায় কথাটি বলেছিলো। সারা অঙ্গ মৃদু কেঁপে ওঠে তার। এক কাহিনী নিয়ে আর ভাবতে পারছে না। ক্রমশ দম বন্ধ হয়ে আসছে। তার ভালোবাসার মানুষ এমন ঘৃণিত কাজের সঙ্গে জড়িত মনে করতেই কেমন করে উঠছে শরীরটা। মাথাটা আবারও ব্যাথা করছে। কেনো এতো খারাপ লাগছে তার? কেনো সহ্য করতে পারছে না? একই প্রশ্ন বারবার কেনো ঘুরপাক খাচ্ছে?
মেহরুবা রুয়াতকে উঠিয়ে বসায়। আয়াজ দ্রুত বের হয়ে আসে রুম থেকে। এখানে থাকা মানেই রুয়াত কে সে ঘটনা মনে করিয়ে দেওয়া। ইনিমা এক পলক তার ভাইয়ের দিকে তাকায়। রুয়াতের জ্ঞান এসেছে আর ভাইয়া রুম ছেড়ে বেরিয়ে গিয়েছে এটা বোধগম্য হলো না তার। নিশ্চয়ই তখন কিছু একটা হয়েছে। নাহলে কখনোই আয়াজ রুয়াতের জ্ঞান এসেছে দেখে রুম ত্যাগ করতো না। জানার প্রবল ইচ্ছেটা কে ক্ষনিকের জন্য দমিয়ে রাখলো ইনিমা। পরে সময় করে রুয়াতের কাছ থেকে জেনে নিবে। মায়া চৌধুরী রুয়াতের পাশে এসে দাঁড়ায়। মেয়েটির হাত ধরে বলে-
-‘ঠিক আছিস মা?’
ছোট্ট করে রুয়াত উত্তর দেয়,
-‘হু বড় মা।’
মন শান্ত নেই মেহরুবার। তার মেয়ে হঠাৎ অজ্ঞান হলো কেনো? কোনো বড় কিছু হয়েছে কি? মায়ের মন শান্ত নেই। তখনকার আয়াজের কথাটিও মেনে নিতে পারছে না। মেয়ের এমন হওয়াতে বড্ড অস্থির অস্থির লাগছে তার। রুয়াতের দিকে কিছু এগিয়ে যায়। মেয়ে গালে আদুরে স্পর্শ করে।
-‘মা কি হয়েছে তোর? কেনো অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলি তখন?’
কিছুটা দুশ্চিন্তার মধ্যে পড়ে যায় রুয়াত। কখনোই এসব কথা মুখেও আনবে না। চায় না আয়াজের এরকম কান্ড কারো সামনে আসুক। যে এসবের সাথে জড়িত সেই জানাবে দরকার হলে। হয়তো এখন এটা রুয়াতের মুখ থেকে কেউ শুনলে বিশ্বাস ও করবে না। চৌধুরী বাড়ির কেউ কখনো এরকম কান্ডে জড়িত ছিলো না। আর সেখানে আয়াজের নামে এ কথাটিও বিশেষ করবে না। শেষে কি আয়াজের হাতেই পরিবারের মান সম্মান সব নষ্ট হবে? রুয়াত কে অন্যমনষ্ক দেখে মেহরুবা তার হাত ঝাঁকায়। ফজলুল চৌধুরী কিছুটা বিরক্তি সুরে বলে-
-‘আহা মেয়েটা কে একটু একা থাকতে দাও তোমরা। মাত্রই তো জ্ঞান আসলো। একটু বিশ্রাম করুক। এখনই এত প্রশ্ন করছো কেনো? সময় কি পাবে না? আর মেহরুবা যাও রুয়াতের জন্য খাবার নিয়ে আসো। রাত কয়টা বাজতে চললো। এখনো খাবার খায়নি কেউই। রুয়াতের আর ওখানে যাওয়ার দরকার নেই। খেয়ে এখানেই ঘুমিয়ে পড়বে। আশা করি সকালের মধ্যে ঠিক হয়ে যাবে সব।’
বলেই ফজলুল চৌধুরী রুম ত্যাগ করে। মেহরুবা আর কথা বাড়ালো না। সোজা মেয়ের জন্য খাবার আনতে চলে যায়। রুয়াতের সাথে কিছুক্ষণ কথা বলে জেবা আর মায়া চৌধুরী ও চলে আসে রুম থেকে। কারণ সবাই কে আবার খাবার দিতে হবে। মায়া চৌধুরী যাওয়ার আগে বলে গিয়েছে যেনো দ্বিতীয়বার ডাকার আগেই ইনিমা আর নিমি খেতে যায়। ইনিমা গেলো না বরং উল্টো রুয়াতের পাশে এসে বসে। কেনো জ্ঞান হারালো রুয়াত? তাদের অগোচরে কি হয়েছিলো? আয়াজ কি অন্য কিছু বলেছে? নিশপিশ করছে ইনিমার মন। শুধু একটু জানতে চায় ঠিক কি হয়েছিলো। যে মুহূর্তে প্রশ্ন করতে যাবে ওই মুহূর্তে মেহরুবা রুয়াতের খাবার নিয়ে হাজির। আর প্রশ্নটি করা হলো না ইনিমার। উত্তরগুলো জানার ইচ্ছে খুব। পরিস্থিতির কারণে সব সামলে উঠতে পারছে না। বারংবার চুপ হয়ে থাকতে হচ্ছে। মেহরুবা নিজ হাতে মেয়ে কে খাইয়ে দিচ্ছেন। আর মেয়ে কে রাগী স্বরে আওড়াচ্ছেন।
-‘নিজের প্রতি এত অবহেলা কেনো তোর? এখন তো খাইয়ে দিচ্ছি অসুস্থ বলে। ভাবিস না প্রতিবার এমন হলে খাবার খাইয়ে দিবো। আমি তো জানি তোর শরীর দূর্বল হয়ে গিয়েছিলো তাই জ্ঞান হারিয়েছিস। এভাবে চলতে থাকলে কি হবে পরে তোর? যখন আমি আর এরকম সেবা করবো না তখন ঠিকই সুস্থ থাকবি। এখন এত করে বলছি অন্তত খাওয়া দাওয়াটা ঠিক করে কর। তাও তো করিস না। এমন মেয়েই আমার কপালে জুটলো।’
মুখে খাবার তাও রুয়াত হেসে দিলো তার মায়ের কথায়। কি পরিমাণ রেগেছে। মুখশ্রী তে সে রাগ বিদ্যমান। তবে আজকের এরকম কারণের পেছনে তাকে কিভাবে দায়ী করলো তার মা? সব জানার পর ও মুখ বুজে আছে রুয়াত। ইনিমা খানিকটা ভ্রু কুচকে তাকায় রুয়াতের দিকে। আবারও ডাক পরে ইনিমা আর নিমির। কোনো কিছু না ভেবেই নিমি চলে যায়। তার পেছন পেছন ইনিমা ও যায়। আজ আর এসব কিছুই জিগ্যেস করবে না রুয়াত কে। কাল সকালে একেবারেই জেনে নিবে সব।
মেহরুবা রুয়াত কে খাওয়ানো শেষ হলে চলে যায়। একা একা রুমে শুয়ে আছে রুয়াত। আগেই ভেবে নিয়েছে আজ আর ইনিমা বা নিমি কারো সাথেই ঘুমোবে না। রূহান কে বলবে তার সাথে ঘুমানোর জন্য। সে ভালো করেই অবগত যে ইনিমা কিছু না কিছু হলেও জিগ্যেস করবে। আর সব সত্য কথা শোনার পর কখনো ইনিমা বিশ্বাস করবে না সেগুলো। তার ভাইয়ের নামে এরকম কিছু শুনলে হয়তো না রুয়াতের সাথে কথাও বন্ধ করে দিবে। মুলত তার এমন বাক্য কেউ বিশ্বাস করবে না। যেখানে আয়াজ চৌধুরী বাড়ির বড় সন্তান। তারউপর এমপি। সেখান থেকে বলা যায় রুয়াতের এমন কথা কেউ বিশ্বাস করতে চাইবে না। যেখানে প্রথমেই রুয়াত আয়াজের মুখ থেকে এগুলো শোনার পর বিশ্বাস করে পারেনি। সেখানে রুয়াতের থেকে এসব শুনে কেইবা বিশ্বাস করবে? পাতলা কাঁথা রুয়াত গা’য়ে জড়িয়ে নেয়। এত ভাবনার মাঝে নিজেকে খানিকটা পাগল পাগল লাগছে। মন কে একটু শান্ত করার দরকার। এগুলো ভেবে আর মন কে অশান্ত করে দিতে চায় না। তবে কোনো মতেই সে বাক্যটি ভুলতে পারছে না। কি করে ভুলে যাবে? এতই সহজ ভুলে যাওয়াটা? বেশ কিছু সময়ের মাঝে রুয়াত ঘুমিয়ে পড়ে। মেহরুবা একবার এসে দেখে যায়। সাথে ইনিমা ও এসেছিলো। রুয়াত কে ঘুমোতে দেখে আবার ফিয়ে যায়।
রাত তিনটা। চারপাশে শুনশান নীরবতা। গ্রাম অঞ্চলে রাতের বেলায় যেসহ পোকামাকড়ের আওয়াজ শোনা যায়। সেগুলোর আওয়াজই ভেসে আসছে কক্ষে। মধ্য রাতের বেলায় গ্রামের বেশিরভাগ মানুষ গভীর ঘুমে থাকে। শহরের মত এত রাতে আর যানবাহনের শব্দ হয় না। মানুষ নিশ্চিন্তে ঘুমোতে পারে। তেমনই নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে আছে রুয়াত। তার সামনে যে এক কঠোর মানব বুকে হাত গুঁজে দাঁড়িয়ে সে কি জানে? প্রায় পনেরো মিনিট ধরে দাঁড়িয়ে প্রেয়সী কে দেখে যাচ্ছে। একজন কে চিন্তায় ফেলে সে এখন শান্তিতে ঘুমিয়ে আছে। আয়াজ হাঁটু গেড়ে বসে রুয়াতের পাশে। আলতো করে স্পর্শ করে মেয়েটির হাত। এক দৃষ্টিতে চেয়ে আছে। তবুও যেনো এভাবে চেয়ে থাকতেই মনে চাচ্ছে শুধু। নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করে আয়াজ। হাতগুলো সেখান থেকে এনে গুঁটিয়ে ফেলে।
-‘আমায় ক্ষমা করো প্রেয়সী। নিজের জীবন রক্ষার্থে এমন কিছু করার জন্য বাধ্য হবো। আমাকে যদি কেউ পৃথিবী থেকে সরানোর চেষ্টা করে তবে আমার কি হাত পা গুঁটিয়ে বসে থাকা উচিৎ বলো তো? এখন কোনো কথাই শুনতে পাচ্ছো না তুমি। এ মুহুর্তটা কেই বেছে নিয়েছি আমি। যাতে শুধু তুমি সামনে থাকো কথা বলার সময়। হয়তো বা আজকে আমার কথাটির কারণ কখনো জানবে না। আবার এখন যে আমি এসব বলেছি তাও জানবে না। যদি না আমি জানাই। বেঁচে থাকার জন্য মানুষ ভীষণ ছটফট করে। এটা শুধুমাত্র তারাই বুঝবে যার মৃত্যুর সাথে লড়াই করছে। যাদের শরীরে প্রাণ নামক জিনিস আছে তারা কখনোই এমন স্বাদ অনুভব করতে পারবে না। শুধুমাত্র মৃত্যুর দুয়ারে না দাঁড়ানো পর্যন্ত। বাঁচার অধিকার সবার আছে। প্রতিটি মানুষ বাঁচতে চায়। যেহেতু আমিও মানুষ। তাই প্রতিনিয়ত বেঁচে থাকার জন্য লড়াই করতে হচ্ছে। সে কি আর আমার প্রেয়সী বুঝবে? একটা কথার ভিত্তিতে হয়তো কিছুদিনের জন্য কথা বন্ধ রাখবে। ব্যাপার না। অভিমান হয়েছে। তবে সেটা বিশাল সমুদ্রের ন্যায় হতে দিবো না। কোনো না কোনো এক উপায়েই তোমার অভিমান ভাঙার চেষ্টা করবো। তোমাদের সবার সাথে শেষ মুহুর্ত পর্যন্ত থেকে যাওয়ার প্রবল ইচ্ছে প্রেয়সী। সে জন্য মানুষের পরিকল্পনার ব্যাঘাত ঘটিয়েছি প্রতিবার। আজ তখন আমার কথাটিই শুধু শুনলে এর কারণ অথচ জানতে চাইলে না। যাই হোক ঘুমাচ্ছো না এখন! ঘুমাও। আর বিরক্ত করবো না। আসছি।’
আয়াজ উঠে দাঁড়ায়। আবারও এক নজরে রুয়াত কে দেখে চলে যায়। প্রেয়সী কে বড্ড আদুরে ছোঁয়া দেওয়ার জন্য মন উৎকন্ঠা হয়ে ওঠে। কোনো অধিকার নামক দলিলের কারণে দমিয়ে রাখছে ইচ্ছেগুলো কে।
(*)
সকালে ভোরেই রুয়াত উঠে পড়ে। পুরো বাড়ির মানুষ গুলো এখনো ঘুমিয়ে আছে। অথচ পাখিদের শব্দ কমছে না। রুয়াত ও আজ সকাল বেলার পাখির মতো তাড়াতাড়ি করে উঠে পড়ে। একবার ঘুম ভেঙে গেলে আর ঘুম আসে না তার। চোখের পাতা বারবার ঝাকড়ানোর ফলেও ঘুম আসেনি। তাই আর অপেক্ষা করলো না রুয়াত। রুম ছেড়ে বেরিয়ে আসলো। তার ধারণা ভুল। মায়া চৌধুরী ঘুমোয়নি। বাগানের এক পাশে চেয়ারে বসে আছে। তার সাথে আর কেউ নেই। একাই বসে আছে বাগানে। রুয়াত সোজা মায়া চৌধুরীর সামনে এসে দাঁড়ায়। তিনি খানিকটা ভড়কে যায় রুয়াত কে দেখে। সাত সকালে রুয়াত ঘুম থেকে উঠে পড়েছে? কাল না অসুস্থ ছিলো ভীষণ? সাথে সাথেই মায়া চৌধুরী বলে-
-‘রুয়াত এত সকালে উঠেছিস কেনো মা? এখন শরীর ঠিক আছে তো? আর খারাপ লাগছে?’
মুচকি হাসে রুয়াত।
-‘না বড় মা। এখন মোটামুটি ভালো লাগছে। ও তখন শুধু একটা মাথাটা ভীষণ ভাড় লেগেছিল। এই যা। তা এত সকালে তুমি এখানে বসে আছো যে?’
-‘ঘুম আসছে না রুয়াত। নামাজ পড়েই এখানে এসেছি। এখন তো সকাল হয়ে গেলো একদম।’
রুয়াত আমতা আমতা করে বলে-
-‘বড় মা একটু বাবার কবরের কাছে যাবো। এসেছি পর্যন্ত যেতে পারিনি। মায়ের যদি মনটা খারাপ হয়ে যায় সেজন্য। ইনিমা আপু আর নিমির সঙ্গে ঘুমানোর ফলে সকালে তাড়াতাড়ি করে উঠতে পারতাম না। আজ ভালোই হলো মা ও ঘুমিয়ে আছে। জানবে ও না কোঁথায় গিয়েছি। আমি শুধু কবরটা একটু দেখে চলে আসবো। বাবার চেহেরা দেখতে না পারি তার কবরটা দেখে আসবো শুধু। গ্রামে এসেছি অথচ সেখানে যাবো না? যাই বড় মা?
অবাক হয় মায়া চৌধুরী। সরু চোখে তাকায় রুয়াতের দিকে। চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে রুয়াতের কাঁধে হাত রাখে। মেয়েটা সম্পুর্ণ মাথা নিচুস্তর করে রেখেছে। কান্না পাচ্ছে ভীষণ। তাও সেটা থামানোর চেষ্টা করছে। এক পর্যায়ে বারবার ঢোক গিলে। নিজের মনে থাকা কষ্ট সেখানটাই সীমাবদ্ধ করে রাখতে চায়।
-‘চল আমিও যাবো তোর সাথে।’
রুয়াত মাথা তুলে তাকায় মায়া চৌধুরীর দিকে। সে কিছু সময় একা থাকতে চায় তার বাবার কবরের পাশে। তাই বলে-
-‘বড় মা আমি একা যাই? বাসার কেউ উঠলে তো আবার আমাদের খুঁজে না পেয়ে চিন্তা করবে। তুমি থাকো আমি যাই। মা আমাকে খুঁজলে বলো যে বাহিরে হাঁটাহাঁটি করছি। আর মা উঠার আগেই চলে আসার চেষ্টা করবো।’
মায়া চৌধুরীর রুয়াত কে একা ছাড়তে মন সায় দিলো না। তৎক্ষনাত কিছু ভেবে যাওয়ার জন্য অনুমতি দিলো। রুয়াত আর কিছু না ভেবেই হাঁটা শুরু করে। গ্রামে আসার পরপরই মন চাচ্ছিলো হান্নান চৌধুরীর কবরের কাছে একটু যেতে। দেখে আসতে তার বাবার কবর। কিন্তু মেহরুবার জন্য যেতে পারেনি। এখানে এসেছে তার মায়ের মন ভালো করার জন্য। সেখানে যদি তার মায়ের মনটা খারাপ হয়ে যায় তাহলে তার মোটেও ভালো লাগবে না। আজ মোক্ষম সুযোগ পেয়েছে যাওয়ার। তাই আর সুযোগটা কে হাতছাড়া করলো না।
(*)
গুটিশুটি মেরে মাটির উপর নির্বিঘ্নে বসে আছে রুয়াত। হান্নান চৌধুরীর কবরের দিকে তাকালেই বুক ছিঁড়ে কাঁদতে মন চায়। ভিতরে আর ঢুকতে পারেনি। বাহিরে বসেই দেখে যাচ্ছে তার বাবার কবর। এদিকটায় মানুষের আনাগোনা খুব কম। তাই রুয়াত নিশ্চিন্তে বসে আছে। আয়াজ তাড়াহুড়ো করে এখানটায় আসে। মায়া চৌধুরীর থেকে শুনেছে রুয়াত এসেছে এখানে। আর দেরি করতে পারেনি সে। একা একা গিয়েছে মেয়েটা। এ কথা চিন্তা করে মায়া চৌধুরী আয়াজ কে ও পাঠায় এখানে।
রুয়াতের বাহু ধরে টেনে দাঁড় করায়। বাহু চেপে মিশিয়ে নেয় বক্ষ পিঞ্জিরায়। শুভ্র রঙের পাঞ্জাবী পরিহিত লোকটার বস্র খামচে ধরে। অচেনা মনে হলো না মানুষটা কে। তার বক্ষে আবদ্ধ হলে নিজের সুখ পাখি মনেহয়। তবে এসব দিক খেয়াল নেই তার। ক্রমশ কেঁদেই যাচ্ছে। চোখের পানি যেনো উপচে পড়ছে। আয়াজ এক হাত রুয়াত মাথায় রাখে। আলতো করে চুলগুলোতে হাত বুলিয়ে দেয়। নরম স্বরে বলে-
-‘কেঁদো না। যিনি চলে গিয়েছেন এত কেঁদেও তাকে ফিরিয়ে আনা যাবে না। আমার মনেহয় একটা শিশু ও কথাটি বুঝবে। অথচ ঊনিশ বছরের অধিকারী মেয়েটি আজ পর্যন্ত এ কথাটি বোঝার চেষ্টা ও করলো না।’
দমে যায় রুয়াত। তার খেয়াল নেই কিছুতে। আয়াজের বলা কথাটিও যেনো শুনতে পাচ্ছে না। বুকের কাছে ভেজা ভেজা লাগছে আয়াজের। বুঝে গিয়েছে প্রেয়সীর চক্ষুজোড়া থেকে গড়িয়ে পড়া নোনাপানি সেগুলো। একটু ধমকের সুরে বলে-
-‘বুকে টেনে নিয়েছি বলে এটা ভেবো না যে আমার পাঞ্জাবী ভিজিয়ে দিলে কিছুই বলবো না। আমি কিন্তু তোমাকে স্বান্তনা দেওয়ার জন্য বুকে টেনে নিয়েছি। আমার পাঞ্জাবী ভেজানোর জন্য নয়।’
রুয়াত ঝটকায় সরে আসে আসে। অন্য দিকে ফিরে। হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে চোখের পানি মুছে ফেলে। মনে পড়লো সে কালকের কথা। সাথে সাথে আয়াজের দিকে তাকালো। উচ্চ স্বরে বললো,
-‘কোনো খু’নির আমাকে জড়িয়ে ধরার অধিকার নেই। কেনো ধরেছিলেন আমায়? আপনার অঙ্গের সান্নিধ্যে আমার এখন নিজেকে পাপী মনে হচ্ছে।’
কথাটি বুকে ছুরির মতো গিয়ে লাগলো। আহত হয় মন। তৎক্ষনাত নিজেকে শক্ত করে। রুয়াত সত্যিটা জানলে কখনো এমনটি বলতো না। সে টা চিন্তা করে আয়াজ গম্ভীর স্বরে শুধায়,
-‘একদিন অধিকার তৈরি করে নিবো।’
কথাটি শুনে আরও রেগে যায় রুয়াত।
-‘বা’জে কথা বন্ধ করুন। চলে যান এখান থেকে।’
-‘নিতে এসেছি চলে যেতে নয়।’
-‘আপনার মতো খু’নির সাথে কোঁথাও যেতে চাই না আমি। দয়া করে চলে যান।’
বারবার প্রেয়সীর মুখ থেকে খু’নি শব্দটি সহ্য হচ্ছে না। কোনো কিছু না করেই আজ এই উপাধি পেতে হচ্ছে। হাতের মুঠো শক্ত করে। রাগ উঠছে ভীষণ। তবুও নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করলো।
-‘খু’নি খু’নি যে বলছো। এর মানে জানো? খু’নিরা কিন্তু মানুষ খু’ন করে ভুলে যেও না। তাই সর্তক বার্তা জানাচ্ছি তোমার এই ত্যাড়ামোর জন্য ও তোমাকে খু’ন করতে বাধ্য হবো।’
রুয়াত কেঁপে ওঠে। দু পা পিছিয়ে যাবে সে মুহূর্তেই আয়াজ হাত ধরে তার সামনে বরাবর এনে দাঁড় করায়। হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করে রুয়াত। তার অতিমাত্রায় বিরক্ত লাগছে।
-‘হাত ছাড়ুন। আমার বিরক্ত লাগছে।’
-‘লাগুক।’
-‘আপনি ভুলে যাবেন না কোঁথায় দাঁড়িয়ে আছি। হাত ছাড়ুন আমার।’
-‘ভুলিনি আর হাত ছাড়বোও না।’
আয়াজের ভাবলেশহীন কথাবার্তায় বিরক্ত বোধ করে রুয়াত। আয়াজ কে আঘাত দেওয়ার জন্য বলে-
-‘জানেন আপনার মতো খু’নি আমার হাত ধরেছে বলে আমার নিজেরই নিজেকে ঘৃণা করতে ইচ্ছে করছে।’
আয়াজ রুয়াতের হাত শক্ত করে ধরে। দাঁতে দাঁত চেপে বলে-
-‘বারবার এক শব্দ উচ্চারণ করবে না। যেটা জানো না সেটা নিয়ে কথা বলবে না। কোনো টু শব্দ ছাড়া আমার সাথে এখন এই মুহুর্তে বাসায় যাবে। তবে একটা একটা কথা বলে রাখছি এই খু’নি তোমাকে ইগনোর করলে সেটা সইতে পারবে না তুমি।’
#চলবে….
[আসসালামু আলাইকুম। আমি আন্তরিক ভাবে খুবই দুঃখিত যে দু’দিন গল্প দিতে পারিনি। ব্যস্ততা সবার জীবনেই থাকে। আমরাও মানুষ ভাই। আমাদের জীবনেও ব্যস্ততা আছে। সেজন্য খুবই দুঃখিত আমি। যথাসম্ভব চেষ্টা করবো আয়াজ রুয়াতকে প্রতিদিন আপনাদের সামনে আনার। আমার উপর রাগ করে না থেকে দয়া করে রেসপন্স করার চেষ্টা করবেন। ভুলত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।]