প্রেম_প্রার্থনা #তামান্না_আঁখি #পর্ব-১৬

0
492

#প্রেম_প্রার্থনা
#তামান্না_আঁখি
#পর্ব-১৬

চারপাশে সন্ধ্যার আধার নেমেছে। সন্ধ্যার আজানও অনেক আগেই শেষ হয়ে গেছে। তুহিন হাত পা বাঁধা অবস্থায় একটা গোয়াল ঘরে পড়ে আছে। কাপড় দিয়ে তার মুখ বাঁধা। আবছা অন্ধকার গোয়াল ঘরে। সে আবারো হাতের বাঁধন খুলতে চেষ্টা করলো। কিন্তু এবার ও হলো না। শক্ত খসখসে দড়ির আচড়ে হাতের চামড়া আরো উঠে গেলো। রক্ত জমাট বাঁধা জায়গা গুলো আবারো তাজা হয়ে উঠলো। তুহিন গুঙিয়ে উঠলো যন্ত্রনায়। আর কতক্ষন সে এখানে থাকবে? তার মাথা দুশ্চিন্তায় ভার হয়ে আসছে। রানিদের কে নিয়ে তার চিন্তা নেই। সজল আছে ওদের সাথে। সজল ওদেরকে নিরাপদে পৌছে দিবে। কিন্তু রবিন আর চারু? ওদের কি অবস্থা এখন? ওরা কি বাড়ি পৌঁছাতে পেরেছে? তুহিন ওদেরকে সাইকেলে তুলে দিয়ে রবিনের পিছনে আসা ছেলেগুলোকে আটকাতে গিয়েছিলো। কিন্তু বেশিক্ষন আটকে রাখতে পারে নি। তাকে পিছন থেকে আঘাত করে হাত পা বেঁধে এখানে ফেলে রেখে গেছে। তুহিন নিজেকে গালি দিলো, কেন সে রবিন আর চারুকে নিজে গিয়ে পৌছে দিল না? রবিন ত আহত। সে কি পেরেছে চারুকে নিয়ে নিরাপদে বাড়ি ফিরতে? রবিনের পেছনে যাওয়া ছেলেগুলো কি ওদের ধরে ফেলেছে? তুহিন মাথা ঝাঁকিয়ে খারাপ চিন্তাগুলো দূর করতে চাইল। সে নিজেকে বুঝ দিলো-

“রবিন পেরেছে। চারুকে নিয়ে বাড়ি ফিরতে পেরেছে। নিজের কথা না ভাবলেও রবিন চারুর জন্য হলেও সবার সাথে যুদ্ধ করে চারুকে নিয়ে বাড়ি ফিরে গেছে।”

তুহিন নিস্তব্ধ অন্ধকার গোয়াল ঘরে বাঁধা অবস্থায় পড়ে রইল। তখনি বাইরে কিছু লোকজনের আওয়াজ পেলো। একটা কন্ঠস্বরের আওয়াজ এলো তার কানে-

“আজকের সব পরিকল্পনা মাটি হইল এই হারা*মজাদার লাইগ্যা। মন চাইতাছে ওর গলা টা ঘাড় থাইকা নামায়া দেই। ওর বাপের লাইগ্যা পার‍তাছি না।”

তুহিন কন্ঠের মালিককে চিনলো।এটা সবুর আলীর কন্ঠ। তৎক্ষনাৎ দরজা খুলে গেলো। কয়েকটা অবয়ব এসে দাঁড়ালো দরজায়। সবার হাতেই টর্চ। টর্চের আলো ফেললো তুহিনের মুখে। তুহিন চোখ খিচে নিলো। আলোটা একটু সয়ে আসতেই চোখ খুললো। সামনে পড়লো সবুর আলীর মুখ টা। সবুর আলী পান খাওয়া দাঁত বের করে হাসলো। মুখে মধু ঢেলে বললো-

“বাবাজীর কি কষ্ট হইতাছে? হারাম*জাদারা যে তোমারে এইনে নিয়া আইছে আমি জানতাম না।”

তারপর সাথের লোকগুলোর দিকে চেয়ে বললো-

“ওই হারাম*জাদারা বাবাজীর হাত পা খুইলা দে। বাবাজিরে বাড়িত দিয়া আয়।”

_____________

তালুকদার বাড়ির পরিবেশ থমথমে। থেমে থেমে মহিলাদের কান্নার আওয়াজ আসছে। রুবিনা বেগম সদর দরজায় মাথা ঠেকিয়ে বাইরে গেটের দিকে চেয়ে আছেন। রানি তার মাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদছে।। সে ত ভেবেছিলো তার ভাই আর চারু তাদের পিছনেই আছে। কিন্তু সন্ধ্যা হয়ে গেলো এখনো ওদের দেখা নেই। কেউ খু্ঁজে পাচ্ছে না ওদের।

রাজিয়া বেগমের মাথায় পানি ঢালা হচ্ছে। চারুর চিন্তায় জ্ঞান হারাচ্ছেন তিনি বারবার। মেলার ঘটনা শোনার পর সৈয়দ বাড়ির সবাই তালুকদার বাড়ি চলে এসেছিলো। রানি ফারহানা আর রনি যখন ফিরে এলো সবাই তখন নিশ্চিন্ত হয়েছিল এই ভেবে যে চারু আর রবিন ও তাড়াতাড়ি ফিরে আসবে। কিন্তু এখনো ওরা ফিরে আসে নি। সৈয়দ বাড়ি আর তালুকদার বাড়ির পুরুষরা কোনো জায়গায় খুজতে বাকি রাখছে না।

শাখাওয়াত তালুকদার গেট ঠেলে ভিতরে ঢুকলেন। বাগান পেরিয়ে সদর দরজার সিড়িতে ক্লান্ত হয়ে বসে পড়লেন।তার মাথা ঝু্ঁকে গেলো নিচ দিকে। রুবিনা বেগম স্বামীকে দেখে দরজা থেকে উঠে স্বামীর পায়ের কাছে সিড়িতে বসলেন। স্বামীর মুখের দিকে চেয়ে জিজ্ঞেদ করলেন-

“আমার রবিন কই? চারু কই? পাইছো না তুমি?”

শাখাওয়াত তালুকদার চোখ তুলে স্ত্রীর মুখপানে চাইলেন। বিষাদে ছেয়ে আছে চোখ দুটি। রুবিনা বেগম কাতর চোখে চেয়ে আছেন উত্তরের জন্য। কি উত্তর দিবেন তিনি? তিনি তো খোজার বাকি রাখেন নি। রবিন যে পথে গিয়েছে সে পথে খুঁজেছেন। জংগলে গিয়ে কয়েকটা আক্রমনকারী ছেলের দেখা পেয়ে আর মাটিতে রক্তের দাগ দেখে তার মনে আশার আলো ফুটেছিলো যে রবিন জংগলেই আছে। কিন্ত পুরো জংগল খুজেও কাউকে পেলো না। অন্ধকারে রক্তের দাগ কোনদিকে গেছে কেউ ঠাহর করতে পারলো না। ছেলেগুলোকে তৎক্ষনাৎ বন্দি করে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল কিন্তু তারাও কিছু বলতে পারে নি।

রুবিনা বেগম স্বামীর হাত ঝাঁকালেন। প্রশ্ন করলেন-

“কি হইলো? কিছু কও? আমার রবিনরে পাও নাই? রবিনের হাতে গুলি লাগছে। রবিনের সাথে চারু আছে। তুমি ওরে খুঁইজা আনো।রবিনের বাপ ওরে খুঁইজা আনো।”

রুবিনা বেগমের হাউ মাউ করে কান্না নীরবে দেখে গেলেন শাখাওয়াত তালুকদার। তিনি অসহায়। ছেলে মেয়ে গুলো যেন উবে গেছে। কোথাও ই কোনো চিহ্ন পর্যন্ত নেই।

__________

শাহজাহান আলী জংগলের বাইরে দাঁড়িয়ে আছেন। তাকিয়ে আছেন অন্ধকার জংগলের দিকে। তার মুখ চোখ শক্ত। দেখে বুঝার উপায় নেই রেগে আছেন নাকি কষ্ট পাচ্ছেন। এই জংগলেই চারু আর রবিন আশ্রয় নিয়েছিলো। জংগলের পাশে পড়ে থাকা সাইকেলটাই তার প্রমান। সারা জংগল চষে বেড়িয়েছে সবাই তারপর ও কোনো হদিশ মিলছে না চারু আর রবিনের। একটু পরেই মোস্তফা কামালকে বেরিয়ে আসতে দেখা গেলো জংগল থেকে। সাথে বেরিয়ে এলো টর্চ হাতে আরো কয়েকজন। ছোট ভাইকে দেখে শাহজাহান আলী সোজা হয়ে দাঁড়ালেন। মোস্তফা কামাল বিষাদগ্রস্ত চোখ মুখে বড় ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে বললেন-

“কোথাও নাই ভাইজান। ওদের কোনো হদিশ নাই। এই নিয়া কতবার খুঁজলাম একবারো কোনো চিহ্ন পাইলাম না।”

বলতে বলতে মোস্তফা কামাল মাটিতে বসে পড়লেন। দুই হাত দিয়ে মাথা চেপে ধরলেন। শাহজাহান আলী শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন। যেই সৈয়দ বাড়ির মেয়েদের গায়ে তিনি ফুলের টোকা দেয়াও বরদাস্ত করেন না সেই বাড়ির মেয়ে এখন পর্যন্ত নিখোঁজ। কোথায় আছে কিভাবে আছে তিনি জানেন না। তার সাথে নিখোঁজ তার আদরের একমাত্র ভাগিনাও। ওদের সাথে কি হয়েছে? ওরা কি অবস্থায় আছে? শাহজাহান আলী আর ভাবতে পারলেন না তিনি আকাশের দিকে তাকিয়ে সর্বশক্তিমানের কাছে সাহায্য চাইলেন। এছাড়া আর কিছুই করার নেই তার।

চারুর বাবা সৈয়দ কামরুজ্জামান বিধ্বস্ত অবস্থায় গেট ঠেলে তালুকদার বাড়ির উঠানে এসে দাঁড়ালেন। দুই তলা বাড়িটা বিষাদময় অন্ধকারে ডুবে আছে। শুধু বাগান আর সদর ঘরের আলো জ্বলছে। সেই আলোই রুবিনা বেগম আর শাখাওয়াত তালুকদারকে সিড়িতে বসে থাকতে দেখলেন। তিনি টলমল পায়ে দু পা এগিয়ে গেলেন। শাখাওয়াত তালুকদারকে উদ্দেশ্য করে বললেন-

“ভাইজান, আমার মেয়েটারে পান নাই? আপনি চেয়ারম্যান,আপনার এত লোকবল। তারপরেও দুইটা ছেলেমেয়েরে খুইজা পাইতাছেন না কেন ভাইজান।”

শাখাওয়াত তালুকদার মুখ তুলে কামরুজ্জামান এর দিকে তাকালেন।মেয়েকে পাগলের মতো খুঁজেছে এই মানুষটা। কোথাও পায় নি। বিধ্বস্ত অবস্থায় ফিরে এসেছে। কামরুজ্জামান আহাজারি করে বললেন-

“আমার ফুলের মতো মেয়েটা কই গেলো? ও যে এখনো অনেক ছোট। ও এই বিপদ থাইকা কেমনে বাইর হইব? আমার চারু! আমার কলিজার টুকরা!”

বলতে বলতে হাঁটু ভেংগে মাটিতে বসে পড়লেন কামরুজ্জামান।

সাজেদা বেগম আর সামিরা রাজিয়া বেগমের মাথায় পানি ঢালছিলো। একটু আগেই রাজিয়া বেগমের জ্ঞান ফিরেছে। কিন্তু শরির এখনো দুর্বল। কামরুজ্জামানের আহাজারি শুনে সাজেদা বেগম দৌড়ে সদর দরজায় এসে দাঁড়ালেন। এখনো চারু আর রবিনকে পাওয়া যায় নি শুনে মুখে আঁচল চেপে কেঁদে দিলেন।

রাজিয়া বেগম স্বামীর আহাজারি শুনেছেন। তিনি ভিজা চুল নিয়েই বিছানা থেকে উঠে দাঁড়ালেন। সামিরা এগিয়ে এসে বড় জা কে ধরল কিন্তু রাজিয়া বেগম সরিয়ে দিলেন। টলতে টলতে সদর দরজার দিকে এগিয়ে গেলেন। তার আঁচল মাটিতে লুটিয়ে আছে। সদর দরজা পার হয়ে উঠোনে বসে থাকা স্বামীর সামনে গিয়ে বসলেন। করুন কন্ঠে বললেন-

“আমার চারুর কিছু হইত না চারুর বাপ। আমার মেয়ে অনেক সাহসী। কি তেজ আমার মেয়ের!! ও ঠিক ফিইরা আসব। ”

কামরুজ্জামান স্ত্রীর দিকে অশ্রুসজল চোখে চেয়ে রইলে। তার ও বিশ্বাস করতে ইচ্ছে হচ্ছে যে তার মেয়ে রবিনকে নিয়ে সুস্থভাবে ফিরে আসবে।

_______

বিশাল মাঠ জুড়ে ধানক্ষেত সহ বিভিন্ন ফসলের চাষ। জায়গায় জায়গায় কাঁদা হয়ে আছে। গত রাতে বৃষ্টি হয়েছিলো কিনা। সেই কাঁদামাটিতে শব্দ তুলে হেঁটে যাচ্ছে একটি মেয়ে, সাথে একটি আহত যুবক। ওইতো বড় মাটির রাস্তা দেখা যাচ্ছে। আর একটু গেলেই, এই ক্ষেত টা পেরোলেই রাস্তা।

চারু রবিনকে নিয়ে রাস্তায় উঠে এলো। বিস্তীর্ণ ক্ষেতের মাঝখানে মাটি ফেলে উঁচু করে রাস্তা বানানো হয়েছে। দূর দূরান্তে একটা মানুষের ও চিহ্ন নেই, যেন এই পৃথিবীতে সে আর রবিন ছাড়া কেউ নেই।চারপাশে ঝি ঝি পোকার ডাক, রাতের নিস্তব্ধতা ভেংগে ভেসে আসছে শিয়ালের ডাক। অন্যসময় হলে হয়ত চারু ভয়ে মরেই যেত কিন্ত আজ যেন তার সমস্ত অনুভূতি ভোঁতা হয়ে গেছে। কোনো ভয়, যন্ত্রনা কোনো কিছুই যেন সে অনুভব করছে না। সে আরেকটু শক্ত করে রবিনের হাত আকড়ে ধরলো। চারুর গায়ের ওড়না নেই। রবিনের হাত থেকে পড়া রক্তের দাগ অনুসরণ করে শত্রুরা পিছু নিচ্ছিলো বলে চারু তার ওড়না খুলে রবিনের হাতে পেঁচিয়ে দিয়েছে । চারু রবিনের ডান হাত তার কাঁধে পেচিয়ে হাঁটছে। জংগল পাড়ি দেয়ার সময় রবিন কিছুটা সচল থাকলেও ক্রমেই রবিনের অবস্থা খারাপের দিকে গিয়েছে। যন্ত্রনায় গোঙিয়েছে, বিড়বিড় করে চারুর কাছে পানি চেয়েছে, চারুকে তাকে ফেলে রেখে চলে যেতে বলেছে।

রবিন চারুর কাঁধে ভর দিয়ে পা টেনে টেনে হাঁটছে। মুখে কিছু একটা বিড়বিড় করে বলছে। তার মাথা ঝুঁকে আছে নিচের দিকে। চোখ আধবোজা, কখনো কখনো পুরোপুরি বন্ধ ও হয়ে যাচ্ছে। সে জোর করে টেনে চোখ খোলা রাখার চেষ্টা করছে। এই যেন মনে হচ্ছে জ্ঞান হারাবে। চারু পা টেনে টেনে সামনে এগোতে লাগলো। আরেকটু গেলেই গ্রাম।তারপর তালুকদার বাড়ি। পেছনে ছেলেগুলো আসছে কিনা সে জানে না। সে জানতেও চায় না। সে শুধু জানে রবিনকে নিয়ে বাড়ি ফিরতে হবে। তাদের দুজনের ই শরিরে জায়গায় জায়গায় চামড়া উঠে গেছে। রবিন কে নিয়ে হাঁটতে গিয়ে সে অনেকবার ই মাটিতে পড়ে গিয়ে আঘাত পেয়েছে। চারুর শরির ভেংগে আসছে, আর পারছে না তাও সে সবটুকু শক্তি এক করে হাঁটতে লাগল। হাটতে গিয়ে আবারো পড়ে গেলো।রবিনের হাত ছুটে গেলো ওর কাঁধ থেকে। রবিন উপুড় হয়ে পড়ে গেলো মাটিতে। পড়ে গিয়ে গোঙানোর মতো শব্দ করলো । চারু দমলো না আবারো টেনে তুললো রবিনকে। বড় বড় শ্বাস ফেলে সামনে আগালো। রবিন বিড় বিড় করছে। থেমে থেমে বলছে-

“চারু, দৌড়ে চইলা যা।” “এইখান থাইকা যা।” “চারু, পানি দে।” “ওরা আসতাছে চারু, দৌড় দে।”

চারু কান পেতে শুনলো। নিস্তব্ধ অন্ধকার পরিবেশে চারুর কানে পৌছালো সেই শব্দগুলো।

ধরাম করে তালুকদার বাড়ির লোহার গেটটা খুলে গেলো। সেই গেট দিয়ে প্রবেশ করলো চারু আর রবিন। রবিন মাথাটা হালকা উঁচু করে চোখ টেনে চারপাশে দেখলো।নিরাপদ আশ্রয়ের আভাস পেয়ে সে নিশ্চিন্ত হলো। তারপর চারুর কাঁধেই পুরোপুরি জ্ঞান হারালো। চারু আর ধরে রাখতে পারলো না রবিনকে। তার হাত আচমকাই আলগা হয়ে গেলো। রবিন হাঁটু ভেংগে কাত হয়ে মাটিতে পড়ে গেলো। পর পর চারুও লুটিয়ে পড়লো মাটিতে। জ্ঞান হারানোর আগে চারু আধবোজা চোখে সবাইকে ছুটে আসতে দেখলো।

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here