প্রেম_প্রার্থনা #তামান্না_আঁখি #পর্ব-৪৩

0
511

#প্রেম_প্রার্থনা
#তামান্না_আঁখি
#পর্ব-৪৩

চারু সকাল থেকে উঠে মেলায় যাওয়ার জন্য তোড়জোড় শুরু করেছে। চার বছর পর আবারো পুরোদমে মেলা শুরু হতে যাচ্ছে। এর মধ্যে গত বছর ছোট পরিসরে মেলার আয়োজন করা হয়েছিলো। গত মেলার আয়োজন ভালোভাবে সফল হওয়ায় এইবার বড় পরিসরে আয়োজন করা হয়েছে। চারু মেলায় যাওয়ার আনন্দে আত্নহারা। এইবার সে আর রানি যাবে। রনি বড় হয়েছে তাই সে আলাদা তার বন্ধুদের সাথে যাবে হয়তো।এইবার ফারহানা নেই।গত বছর ফারহানার বিয়ে হয়ে গেছে। ফারহানার স্বামীর ছুটি নেই বলে বেচারি আসতে পারলো না।এটা নিয়ে ফারহানার দুঃখের শেষ নেই।

ফারহানার কথা মনে পড়তেই চারুর মনে পড়লো ফারহানার বিয়ের কথা। এই চার বছরে রবিন কয়েকবার ই গ্রামে এসেছে,আর একবার মাত্র এসেছে সৈয়দ বাড়িতে। আর সেটা ফারহানার বিয়ের সময়। কিন্তু তখনো চারু রবিনের দেখা পায় নি। সে এদিক ওদিক খুজেছে রবিনকে।তার মনকে শাসন করলেও যখন ই কোনো জায়গা থেকে রবিনের নাম ধরে কাউকে ডাকতে শুনেছে তখনি ছুটে গেছে সেইদিকে।কিন্তু রবিনের দেখা পাওয়া তো দূরের কথা রবিনের ছায়াও দেখতে পায় নি সে। চারুর জেদ চাপতো,রাগ হতো৷ রাগে দুঃখে তার কান্না চলে আসতো। সে প্রতিজ্ঞা করতো যে রবিনকে আর খুঁজবে না।কিন্তু সেই প্রতিজ্ঞা আর রক্ষা করা হত না। চারু ভেবে পায় না একটা মানুষ সবার সাথেই যার দেখা হয় শুধু তার সাথেই কেন দেখা হয় না। রবিন কি অদৃশ্য হওয়ার মন্ত্র জানে নাকি? চারুর ভাবনার সুতো কাটে স্মৃতির ডাকে।স্মৃতি দরজায় দাঁড়িয়ে হাঁক ছাড়লো-

“তুই এখনো রেডি হইছস না? রানি গাড়ি নিয়া আইসা পড়ছে।”

স্মৃতি চারুকে তাড়া দিয়ে প্রস্থান করলো।চারু নাক কুচকালো।এই মেয়ে সব জায়গায় গাড়ি নিয়ে যায় কেন? বাপের চেয়ারম্যানির গরম দেখায় নাকি? যত্তসব। চারু আলমারি খুলে সালোয়ার কামিজ বের করে পড়লো। চুল গুলো ছেড়ে দিয়ে কানে দুল পড়লো।চোখে কাজল টানলো সাথে ঠোঁটে হালকা লিপস্টিক ও দিলো। হাতে কিছু পড়ার জন্য চুড়ির বক্স বের করলো। পছন্দ মতো একটা কাঠের চুড়ি পড়ে নিলো বামহাতে। সাজ শেষ করে চুড়ির বক্স রাখতে গিয়ে নজরে পড়লো পুরনো প্লাস্টিকের ছোট বক্সটার দিকে। বক্সটা টেনে হাতে নিলো। তারপর খুলে তাকালো ভিতরে থাকা চুড়িগুলোর দিকে।এরকম ই এক মেলার দিনে রবিন ওকে এই চুড়িগুলো পছন্দ করে কিনে দিয়েছিলো। পছন্দ বললে ভুল হবে এক প্রকার দায়সারাভাবে হাতে যা উঠেছে তাই ই চারুর হাতে ধরিয়ে দিয়েছিলো। চারু বক্সটা বন্ধ করে আগের জায়গায় রেখে দিলো। আয়নায় আরেকবার নিজেকে দেখে লাফিয়ে লাফিয়ে সিড়ি দিয়ে নামলো।নিচে নেমেই দেখলো রানি ফীহার সাথে খেলছে। চারুকে আসতে দেখে রানি ফীহার গালে লম্বা করে একটা চুমু দিয়ে চারুকে নিয়ে বেরিয়ে পড়লো।

_______

সারা সৈয়দ বাড়ির গেটে এসে নামলো। বাড়িটার দিকে তাকিয়ে ভালো করে পর্যবেক্ষণ করলো। বাড়িটা রঙ করা হয়েছে। দূর থেকে দেখেই বুঝা যাচ্ছে ছাদের বাগানে অনেক ফুল গাছ নতুন যোগ হয়েছে। সারা একটা শ্বাস ফেললো। এই বাড়িটা কবে তার শ্বশুর বাড়ি হবে? সে এই বাড়িটায় বউ হয়ে আসতে চায়।এই বাড়ির একমাত্র ছেলের বউ হতে চায়। ফাতেমা বেগম অপর পাশের গাড়ির দরজা খুলে এসে দাঁড়ালেন সারার পাশে। সারাকে তাড়া দিয়ে বললেন-

“চল ভিতরে যাই।”

সারা তার মায়ের সাথে ভিতরে এসে ঢুকলো। রুবিনা বেগম তাদেরকে দেখে হাসিমুখে এগিয়ে আসলেন। ফাতেমা বেগমের হাত ধরে নিয়ে বসালেন৷ পাশে বসে কুশলাদি জানতে চাইলেন। সারা এদিক ওদিক তাকাচ্ছে।কিন্তু রবিনের কোনো দেখাই পাচ্ছে না। শেষে আর থাকতে না পেরে জিজ্ঞেস করে বসলো রুবিনা বেগমকে-
“মামী, রানি, রবিন ভাই ওরা সবাই কোথায়?”

“রানি তো চারুরে আনতে গেছে।তারা একসাথে মেলায় যাইব। আর রবিন সকালে খাইয়া বের হইছে। আজ তো মেলা। তাই একটু ব্যস্ত সে।”

সারার মুখ টা ছোট হয়ে গেলো। আজ মেলা,নিশ্চয়ই অনেক ব্যস্ত থাকবে রবিন। যদি রাত করে আসে তাহলে তো সকালের আগে আর দেখাই হবে না। ঢাকা থাকাকালীনও গত এক মাস রবিনের সাথে দেখা হয় নি।সারা এদিক ওদিক তাকিয়ে থেকে কিছু ভাবলো।তারপর বললো-

“তাহলে আমিও মেলায় যাব। মামী ড্রাইভার কে বলো আমাকে মেলায় দিয়ে আসতে।”

ফাতেমা বেগম কড়া গলায় বললেন-
“একদম না।অনেক্ষন জার্নি করছস।এখন গিয়া ফ্রেশ হইয়া রেস্ট নে। মেলায় অনেক ভীড় হয়।আগেরবার মেলায় কি হইলো শুনছস না? একা একা আমি তোরে পাঠাইতাম না।”

“একা কোথায় মা।রবিন ভাই থাকবে তো।”

“এত ভীড়ে তুই রবিনরে খুইজা পাওয়ার আগেই যদি আবারো কোনো ঝামেলায় পড়স তখন কি হইব? না, তোর যাওয়া হইত না।”

সারার মন টা খারাপ হয়ে গেলো। কিন্তু সে হাল ছাড়লো না। ফ্রেশ হয়ে তার মা কে বুঝিয়ে সে যেভাবেই হোক মেলায় যাবে। সে তার ব্যাগ নিয়ে দুতলার দিকে চলে গেলো। রুবিনা বেগম এতক্ষন সারার সবটাই খেয়াল করলেন।তিনি বুঝতে পারলেন সারার ব্যাপারটা।সেই সাথে ফাতেমা বেগমের এই বাড়িতে আসার কারন ও বুঝতে পারলেন। রুবিনা বেগম মনে মনে প্রমাদ গুণলেন।তিনি মনে মনে প্রার্থনা করলেন যেন পরিবারের মাঝে কোনো মনোমালিন্য না হয়।

_______

চারু একটা একটা করে দোকানে যাচ্ছে আর জিনিসপত্র কিনছে। রানিও কম যাচ্ছে না। তাদের পিছু পিছু ঝুড়ি নিয়ে ঘুরছে ড্রাইভার। দুজন ই সমান তালে শপিং করে ঝুড়ি ভর্তি করে ফেললো। ঝুড়ি ভর্তি হওয়ার পর ড্রাইভারকে ঝুড়িসহ গাড়ির কাছে পাঠিয়ে দিয়ে মেলার আনাচে কানাচে ঘুরে ঘুরে এটা ওটা খেতে লাগলো দুজন। বরই এর দোকানে দাঁড়িয়ে আচার খাওয়ার সময় কোথা থেকে তুহিন এসে দাঁড়ালো চারুর পাশে।রানির দিকে তাকিয়ে একটা মধুর হাসি দিলো সে।তারপর চারুর হাতে থাকা আচারের প্যাকেট থেকে একটা বরই নিয়ে মুখে পুরে বললো-

“তোমার আশিকের সাথে দেখা হইছে নাকি?”

চারু বিরক্ত মুখে তাকালো। বরইএর আচার এক গাল থেকে আরেক গালে নিয়ে বলল-
“আমার আশিক কেডা?”

তুহিন অবাক হওয়ার ভান করে বলল-
“হায় হায় এই কদিনে সব ভুইলা গেছো? তোমরা মেয়েরা কি এমন ই ছলনাময়ী?”

চারু বিরক্তি নিয়ে মুখ ফিরিয়ে নিলো। তুহিন আরেকটা বরই তুলে নিয়ে মুখে দিয়ে আস্তে করে বলল-
“তোমার আশিক মেলায় আইছে। একটু সুন্দর কইরা সাইজাগুইজা থাকো।দেখা হওয়া কিন্তু সেকেন্ডের ব্যাপার।”

বলেই সে রানির পাশে গিয়ে দাঁড়ালো।চারুর খাওয়া বন্ধ হয়ে গেলো।সে এদিক ওদিক দেখলো। রবিন কি মেলায় এসেছে? আসলেও মেলার কোনদিকে আছে? যদি দুজন মুখোমুখি হয়ে যায়? চারু চোখ ঘুরিয়ে ফিরিয়ে চারপাশটা দেখলো।
তুহিন রানির কানে কানে কি যেন বললো। রানিও হেসে সায় দিলো।তারপর চারুর দিকে তাকিয়ে বলল-

“চারু আমি একটু ঘুইরা আসি? তুই একা থাকতে পারবি না? এখন মেলায় চারদিকেই দলের লোক আছে। কোনো ভয় নাই।”

চারু রাগী রাগী চোখে তাকিয়ে বলল-
“যা, যেইনে মন চায় যা।প্রেম কইরা তো তুই গাছে উইঠা গেছস।এখন তো আর আমারে লাগে না।”

রানি চারুর রাগ দেখে হাসলো। চারুকে রেখে সে তুহিনের সাথে অন্যদিকে চলে গেলো।চারু কিছুক্ষন গাল ফুলিয়ে সেখানে দাঁড়িয়ে রইলো।তার আচার খাওয়া অনেক আগেই বন্ধ হয়ে গেছে, এখন দম ও বন্ধ হওয়ার জোগাড়। নাহ এভাবে আর দাঁড়িয়ে থাকা যায় না। চারু আংগুলে ওড়নার কোণা প্যাঁচাতে প্যাঁচাতে মেলার অন্যপাশে এগিয়ে গেলো। এক পাশে কয়েকটা ছেলেকে ভীড় করে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলো। এখানে কোনো ঝামেলা হচ্ছে কিনা দেখতে তার আগ্রহ জাগলো। সে অন্যপাশ হয়ে হেঁটে গিয়ে অনেকটা দূরত্ব রেখে ভীড়ের যেদিকে একটু ফাঁকা সেদিকটায় দাঁড়ালো। সামনের কয়েকটা ছেলে সরে যেতেই চারু শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে গেলো।ভীড়ের মাঝখানে চেয়ারে পায়ের উপর পা তুলে রবিন বসে আছে।চারুর ঠোঁট দুটি হালকা ফাঁক হয়ে গেলো।চার বছর যাকে দেখার জন্য তার মন এত আকুল হয়েছিলো,তার চোখ এতো তৃষ্ণার্ত হয়েছিলো আজ সে চোখের সামনে।
চারু থম মেরে দাঁড়িয়ে রইলো। পলক না ফেলা চাহনিতে সে রবিনের দিকে তাকিয়ে রইলো। রবিন আগের চেয়ে একটু মোটা হয়েছে।হাতের পেশিগুলো আরো ফুলেছে। তার পড়নে কালো পাঞ্জাবি আর সাদা পায়জামা। চেহারা আগের চেয়েও ধারালো হয়েছে। চোখে মুখে কাঠিন্যতা দৃশ্যমান।গায়ের রঙ আগের মতোই শ্যামলা। শ্যামলা মুখশ্রীতে হালকা খোচা খোচা দাড়ি। বুদ্ধিদীপ্ত দুটো চোখ দিয়ে সে স্থির চাহনীতে মাটির দিকে তাকিয়ে আছে।চারুর শ্বাস আটকে আসছে। তার দম ফেলতেও ভয় হচ্ছে পাছে রবিন সেই শব্দ শুনে ফেলে। কয়েকটা ছেলে এসে রবিনের সামনে দাঁড়িয়ে পড়ায় চারুর দৃষ্টি সীমানা থেকে রবিন আলাদা হয়ে গেলো। চারু জোরে জোরে শ্বাস ফেললো। পিছন ঘুরে হাঁটা ধরলো। তীব্র অনুভূতির জোয়ারে তার হাত পা কাঁপছে রীতিমতো।তার পানি খাওয়া দরকার। আশেপাশে তাকিয়ে পানি খাওয়ার কোনো দোকান খুজলো।পেলো না।তখন কোথা থেকে একটা ছেলে এসে দাঁড়িয়ে আংগুল দিয়ে দেখিয়ে বলল-

“ওই যে ওই দোকানে পানি আছে। যান।”

চারু মোহাবিষ্টের মতো একবার ছেলেটার দিকে আরেকবার ছেলেটার আংগুল দিয়ে দেখানো দোকানের দিকে তাকালো। তারপর কোনো কিছু না বুঝেই সেই দোকানের দিকে এগিয়ে গেলো। দোকানে ঢুকার একটা পার্টে পর্দা ফেলা অন্য পার্টের পর্দাটা একটু সরিয়ে ফাঁকা রাখা হয়েছে। চারু ফাঁকা জায়গা দিয়ে ঢুকলো।দোকানটা একটা ফুচকার দোকান। এখনো চালু হয় নি।পর্দা ফেলে রাখার কারনে ভিতরে আবছা অন্ধকার। চারু এদিক ওদিক তাকিয়ে পানি খুজলো। এক কোনায় একটা কলসি দেখতে পেয়ে সেদিকে এগিয়ে যাবে তখন তার চোখ পড়লো একটা টেবিলে। টেবিলের উপর একটা লোক মাথা নীচ দিকে দিয়ে বসে আছে।তার এক পা একটা চেয়ারে আরেক পা মাটিতে। চারু ভয়ে চমকে উঠলো। তার মনের অজান্তেই মুখ থেকে বের হয়ে আসলো-
“কে?কে আপনি?”

লোকটা মুখ তুললো। পর্দার ফাঁক দিয়ে আসা আলো পড়লো তার মুখে। কালো গভীর চোখ দিয়ে সরাসরি দৃষ্টি ফেললো চারুর উপর।চারু সেই চাহনিতে চোখ রেখে আবিষ্টের মতো উচ্চারন করলো-
“রবিন ভাই।”

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here