প্রেম_প্রার্থনা #তামান্না_আঁখি #পর্ব-৫১

0
648

#প্রেম_প্রার্থনা
#তামান্না_আঁখি
#পর্ব-৫১

ভোরের সূর্যের আলো চোখে পড়তেই চারুর ঘুম ভেঙ্গে গেলো।পিট পিট করে তাকালো। সকাল হয়ে গেছে। চারু এদিক ওদিক তাকিয়ে উঠে বসলো। সে ছাদের ছাউনির নীচে চৌকিটায় ঘুমিয়ে ছিলো। আশেপাশে তাকিয়ে রবিনকে খুজলো।ওর মনে আছে রবিন কাল রাতে তার কোলে শুয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিলো। তাহলে সে গেলো কোথায়। রবিন কি তাহলে চারুকে শুইয়ে দিয়ে চলে গেছে? চারু মুখ হা করে হাই তুললো।হাত মেলে আড়মোড়া ভাঙলো। তারপর উঠে সিড়ি বেয়ে নিচে নেমে আসলো। বসার ঘরে আসতেই মানুষজনের দেখা পেলো।সবাই ব্যস্ত কাজে। এদিক ওদিক দৌড়াচ্ছে। চারু চোখ ঘুরিয়ে তার মা চাচীদের কে খুজলো কিন্তু কাউকেই দেখতে পেলো না। হয়ত এত সকালে উঠেই রান্নাঘরে চলে গেছে সবাই। চারু রানির ঘরে এসে ঢুকলো।রানি বিছানার সামনে দাঁড়িয়ে কোমড়ে হাত দিয়ে কি যেন ভাবছিলো। চারু আসার শব্দ পেয়ে ফিরে তাকালো। চারুর দিকে কিছুক্ষন তাকিয়ে থেকে দুষ্টু হাসি দিয়ে বলল-

“ও তাইলে এই ব্যাপার! এই জন্যই মাঝরাতে ছাদে গেছিলা তুমি?”

“রবিন ভাই ডাকছে তাই গেছি।”

“হুম তা তো দেখতেই পারতাছি। মামী সকালে তোরে খুজছে তখন রনি ছাদে গিয়া দেখে তুই ভাইয়ার চৌকিতে শুইয়া ঘুমাইতাছস। ভাইয়া যে কেন ডাইকা নিয়া গেছিলো তা তো ভালোই বুঝা যাইতাছে।”

“কিসব আবল তাবল কথা কস।রবিন ভাই এম্নিই ডাকছিলো।”

“তাইলে এইগুলা কি?”

“কোনগুলা?”

“এই যে এইগুলা?”

রানি চারুর গালের দিকে ইশারা করলো।চারু গালে হাত দিলো। কিছু একটা লাগলো হাতে। হাত সামনে এনে দেখলো হলুদ শুকিয়ে আছে।তাড়াতাড়ি আয়নায় গিয়ে দাড়ালো।শুধু এক গালে না দুই গালেই হলুদ শুকিয়ে আছে। নাকেও একটু হলুদ দেয়া। শুধু তাই না তার হাত পায়ের ক্ষততেও মলম লাগানো।

রানি হেসে হেসে কুটিকুটি হয়ে গেলো। চারুর পাশে দাঁড়িয়ে চারুর কাঁধে ধাক্কা দিয়ে বলল-
“ভাইয়া তোরে হলুদ লাগাইতে ডাকছিলো তাইলে।যাক একটা কাজ তো কম্পলিট হইলো।”

তখনি দরজা খুলে সাজেদা বেগম ঢুকলেন।রানির সাথে চারুকে দেখে বললেন-

“ঘুম ভাংছে তোর? এখন আয় হলুদ লাগায় গোসল করবি।”

রানি হাসতে হাসতে বলল-
“তোমার আর হলুদ দেয়া লাগতো না মামী।যার জিনিস সে নিজ দায়িত্ব হলুদ লাগায় দিছে।”

সাজেদা চারুর দিকে ভালো করে তাকালেন।চারুর গালে নাকে হলুদ দেখে অবাক হলেন।পরক্ষনেই রানির কথার মর্ম বুঝে হাসলেন।হেসে বললেন-
“তেইলে যা গোসল কইরা আয়।একটু পর ই তোদের দুইজনরে বউ সাজাইতে আসব।আর বিয়ের আগে একদম বউ সাজে রবিনের সামনে যাবি না। বুঝছস!”

সাজেদা বেগম চলে গেলেন।চারু ভীষণ লজ্জা পেয়েছে পুরো ব্যাপারটায়।রবিন তাহলে সে ঘুমিয়ে যাওয়ার পর এইসব করেছে তার সাথে? আর কি কি করেছে কে জানে? অভদ্র চিন্তা মাথায় আসতেই চারু মনেমনে নিজেকে শাসালো। রানি চারুকে টেনে এনে বিছানার সামনে দাঁড় করালো।সামনে রাখা বিয়ের শাড়ি দেখিয়ে বলল-
“দেখ তোর আর আমার বিয়ের শাড়ি গয়না এক। সুন্দর না?”

চারু বিছানায় রাখা শাড়ি গয়নাগুলোর দিকে দেখলো। এসব পড়ে বউ সেজে আর কয়েক ঘন্টার ব্যবধানে সে রবিনের বউ হয়ে যাবে। চারুর বুকের ভেতর কেমন জানি করে উঠলো।হঠাৎ রানির দিকে তাকিয়ে বলল-
“আমার না ভয় লাগতাছে।”

রানির ভ্রুদ্বয় কুচকে গেলো।জিজ্ঞেস করলো-
“কিসের ভয়?”

চারু ঢোক গিলে বলল-
“জানি না কিসের ভয়।তোর সন্ত্রাসী ভাইয়ের সাথে একঘরে কেমনে থাকবাম? ও মাগো আমার ভয় করে।”

“এহহ ন্যাকা!!!যখন আমার ভাইরে কল দিয়া ভালোবাসি কইছিলি তখন ভয় কই ছিলো?”

চারু রানির কথার কোনো উত্তর দিলো না।তার আসলেই ভয় লাগছে।রানি দুষ্টু কন্ঠে বললো-
“খালি একঘরে থাকবি না তো এক বিছানায়ও তো থাকবি।”

চারু বিস্ফোরিত দৃষ্টিতে তাকালো।হায় আল্লাহ! এটাতো ভেবে দেখেনি। এটা ভেবে দেখা উচিত ছিলো।ঝোঁকের বশে নাচতে নাচতে বিয়ে করতে যাচ্ছে সে। এমন জানলে আগেই না করে দিতো। চারু এদিক ওদিক চোখ ঘুরালো। মনে মনে নিজেকে বুঝালো সে রবিনকে কোনোদিনই ভয় পায় নি কাজেই এখন ভয় পাওয়ার কোনো কারন নেই।কিন্তু তার মন তাকে বিভিন্ন কুচিন্তা মনে করিয়ে দিলো। চারুর মনে জেঁকে বসলো এক অজানা লজ্জামিশ্রিত ভয়।

_____________

যেহেতু এক সাথে দুই বিয়ে হচ্ছে আর একরাতের ব্যবধানেই চারু আর রবিনের বিয়ে ঠিক হয়েছে তাই সৈয়দ বাড়ির সবাইকে তালুকদার বাড়িতেই রেখে দিলো শাখাওয়াত তালুকদার। শাহজাহান আলী অবশ্য এই নিয়ে ঘোর আপত্তি তুলেছিলেন।বিয়ের আগেই মেয়ে শ্বশুর বাড়িতে থাকবে আর বাপের বাড়ি থেকে মেয়ে বিদায় হবে না এরকম তিনি মানতে পারছিলেন না। সৈয়দ বাড়ির মেয়ে সৈয়দ বাড়িতে থেকেই বিয়ে করে শ্বশুর বাড়িতে যাবে।কিন্তু রুবিনা বেগম এটা সেটা বুঝিয়ে ভাইয়ের যুক্তি উড়িয়ে দিলেন। শাহজাহান আলী সহ বাকি দুই ভাই কেউই রুবিনা বেগমের সামনে আর কিছু বলতে পারলো না। তখন কথা থাকলো যে চারু আর রবিন দুজনেই এক বাড়িতেই থাকবে কিন্তু কেউ কারো সামনে যাবে না।আর বিয়ের আসর বসবে তালুকদার বাড়ির বাইরের মাঠে। সেখান থেকেই চারুকে বিদায় দিবে তার বাড়ির লোকজন।

চারু আয়নার সামনে এসে দাঁড়ালো। খুব ভালো করে পর্যবেক্ষন করছে নিজেকে। পা থেকে মাথা পর্যন্ত খুটিয়ে খুটিয়ে দেখলো নিজেকে। বউ সাজে তাকে দেখতে যেন অন্যরকম লাগছে।চারু আরেকটু ঘুরিয়ে ফিরিয়ে নিজেকে দেখলো। রানি বউ সেজে এক পাশে দাঁড়িয়ে হাতের চুড়ি গুলো ঠিকঠাক করছিলো।চারুকে আয়নায় দাঁড়িয়ে এত পর্যবেক্ষন করতে দেখে বলল-

“হইছে আর দেখিস না নজর লাগাইবি। আমার ভাইয়ের লাইগা কিছু রাখ।”

চারু একটা মুখ ভেংচি দিলো। আয়নার সামনে থেকে সরে বিছানায় বসতে বসতে বললো –

“তোর ভাইরে সাজ দেখানোর ঠেকা পড়ছে আমার।”

“তেইলে সাজছস কেন?খুইলা ফেল সব।”

চারু ঠোঁট কামড়ালো। মুখ ভেংগিয়ে বললো-

“এহহহ এত কষ্ট কইরা সাজছি! তোর মন চাইলে তুই খুইলা ফেল।”

“আমি খুলতাম না।যারে দেখানোর জন্য সাজছি তারে দেখাই আগে।”

“তুহিন ভাইয়ের এত ধৈর্য নাই যে তোর সাজ দেখব।তুহিন ভাই তো দেখব অন্য কিছু।”

দুষ্টু হাসি দিয়ে এই কথা বলেই চারু একটা চোখ মারলো।রানি ভ্রু কুচকে তাকালো।প্রশ্ন করলো-

“কি দেখবো?”

চারু ঠোঁটে দুষ্টু হাসি ফুটিয়ে রানির উপর দৃষ্টি ফেলে চোখ দিয়ে ইশারা করলো।রানির মুখ হা হয়ে গেলো।নতুন বউ সাজে চারু এই ধরনের অসভ্য ইংগিত দিচ্ছে।কোথায় লজ্জা পেয়ে নুইয়ে পড়বে তা না বেহায়াগিরি শুরু করেছে।এই মেয়ে কোনোদিন ভালো হবেনা। রানির কান গরম হয়ে গেলো এই ধরনের ইংগিত পেয়ে। চারু রানির হাবভাব দেখে হেসে বিছানায় লুটিয়ে পড়লো।

________

‘বর এসেছে, বর এসেছে” চিৎকারে বিয়ের আসর গরম হয়ে গেলো। মেয়েরা দৌড়ে গেলো গেটে।তারা বরকে গেটে আটকাবে।মোটা অংকের টাকা নিয়ে তারপরেই বরকে ভিতরে আসতে দিবে। চারু রানির সামনে পায়চারি করছে। রানি বসে বসে তাকে দেখছে। চারু কোমড়ে দুই হাত দিয়ে বলল-

“তোর ভাইটা একটা বিশ্ব বদমাশ। তার যদি বিয়ে করতেই হয় তেইলে অন্য একটা দিনে কি করা যাইত না? বইলা বসলো এক আসরে বিয়ে হইব। হাহ্! এখন আমি যে তোর বিয়ের গেট ধরতে পারলাম না এইটার ক্ষতিপূরণ কে দিব?”

চারুর বকবকানিতে রানির মাথা ধরে এলো। তুহিন চলে এসেছে শোনার পর থেকেই তার বুক ধুকপুক করছে।কিন্তু এই মেয়ে ওকে জ্বালিয়ে মারছে। রানি বিরক্ত হয়ে বলল-
“চারু শান্ত হয়ে বস।তুই বউ।আজকে তোর বিয়ে। কেউ দেখলে খারাপ ভাবব।”

“যা খুশি তাই ভাবুক। ইশশ আমি এখন গেট ধর‍তে পারতাম। কতগুলা টাকা পাইতাম।সব খোয়া গেলো তোর সন্ত্রাসী ভাইয়ের লাইগা। আগে এই কথা মাথায় আসলে আমি আজকে বিয়ে করতে রাজিই হইতাম না।”

“চারু আস্তে বল।কেউ শুনলে কি কইবো? আজকে আমাদের বিয়ে। চুপ কইরা বস। ”

চারু মাথার ওড়না সামলে ধপ করে বসলো রানির পাশে। তার চোখ মুখ রাগান্বিত। লজ্জা পাওয়া তো দূরের কথা মুখ দিয়ে যা নয় তাই উচ্চারন করছে সে।এমন সময় ফারহানা এসে ঢুকলো।রানিকে উদ্দেশ্য করে বলল-
“সুন্দর কইরা বস।তোর শ্বশুর বাড়ির লোকজন আসব তোরে দেখতে। বিশেষ কইরা মহিলারা।”

রানি কাঁদো কাঁদো কন্ঠে বললো-
“আপু তুমি চারুরে বুঝাও না।দেখো ও কি শুরু করছে।সে নাকি গেইটে যাইব বর আটাকাইতে।”

ফারহানা চারুর দিকে তাকালো। চারু মুখ গোমড়া করে বসে আছে।তার মাঝে নতুন বউসুলভ কোনো আচরন নেই। ফারহানা হতাশ শ্বাস ফেললো।এই মেয়ে জীবনেও শোধরাবে না।ফারহানা রাগী কন্ঠে বললো-
“চারু কোনো বেয়াদবি করবি না।আজ কিন্তু তুই বউ।ঠিক হইয়া বস।নইলে আমি চাচীরে ডাকবাম।”

মায়ের কথা শুনে চারু ঠিক হয়ে বসলো।বিয়ের দিন মায়ের হাতের মার খেতে চায় না সে।কিন্তু পুরোপুরি তার রাগ কমলো না।।সে মনে মনে রবিনকে অনেক বকলো।একদিনে বিয়ে করার কি দরকার ছিলো?আর দুটো দিন পরে করলে হতো না? রানির বিয়েতে কত মজা করবে ভেবে রেখেছিলো।এখন সব গুড়ে বালি।

_______

তুহিনকে নিয়ে স্টেজে বসানো হলো।তুহিন আশে পাশে তাকালো। রবিনকে দেখতে পেলো না। আজ তো তার আর রবিনের এক স্টেজে বসার কথা।কিছুক্ষন পরেই রবিন ঢুকলো আসরে। সাথে তার বিশাল দলবল।সবাই পাঞ্জাবি পড়েছে। রবিন সাদা শেরওয়ানি আর সাদা পায়জামা পড়েছে।শেরওয়ানির জমিনে গোল্ডেন সুতার কাজ করা।মাথায় পাগড়ি পড়ে নি আর গলায় ওরনাও ঝুলায় নি।রবিনের পাগড়ি আর ওড়না পড়েছে লিমন। রবিন সিলভার কালার ঘড়ি হাতে পড়তে পড়তে আসরে ঢুকলো।সোজা হেঁটে এলো স্টেজে। স্টেজের উপর এসে পা মুড়ে বসলো।লিমনকে ইশারা দিয়ে পানি দিতে বললো। তুহিন আরেকটু কাছে এসে রবিনের গা ঘেঁষে বসে বললো-

“তোরে তো হেব্বি লাগতাছে।চালের নাড়ু আজ অজ্ঞান ই হইয়া যাইব।”

রবিন লিমনের কাছ থেকে পানির গ্লাস নিয়ে পানি খেয়ে গ্লাস ফেরত দিয়ে বলল-
“তুই থাকিস সাথে, পানি মাইরা জ্ঞান ফিরাইস।”

“উফফ,বন্ধুর বাসর ঘরে থাকতে পারলে তো জোস হইত।কিন্তু তুই তো থাকার সুযোগ দিবি না।দিবি নাকি?”

রবিন বিরক্ত চোখে তাকালো।তুহিন চোখ টিপ দিলো রবিনকে। তারপর গলা নামিয়ে বললো –

“মেলার দিন তোর আর চারুর দেখা হওয়ার পিছনে কিন্তু আমিও সাহায্য করছি ভুইলা যাইস না।কিছু কৃতজ্ঞতা রাখ।”

“চুপ কইরা বস। বিয়ের দিন আমার হাতে মাইর খাইস না।”

তুহিন কিছুটা দূরে সরলো।রবিনকে তার বিশ্বাস নেই।তারছিড়া লোক।যখন তখন মেরে বসতে পারে। বিয়ের দিন বউ এর ভাইয়ের হাতে মার খেতে চায় না সে।

অবশেষে বিয়ে পড়ানোর সময় এলো।বিয়ে পড়ানোর সময় তুহিন আর চারুর ঝগড়া লেগে গেলো। কাজী সাহেব বিয়ে পড়াতে এলে রবিনকে দিয়ে শুরু করতে চাইলো। কিন্তু তুহিন বেঁকে বসলো আগে তার বিয়ে পড়ানো হবে তারপর অন্যেরটা। কারন এইটা বলতে গেলে তার বিয়ের আসর, রবিন আর চারুতো উড়ে এসে জুড়ে বসেছে।এই কথা সেকেন্ডের হিসাবে অন্দরমহলে চলে গেলো।চারু এই কথা শুনে রেগে বোম।সে লোক দিয়ে খবর পাঠালো আগে তার বিয়ে হবে নয়ত সে বিয়ে করবে না। তুহিন এই কথা আমলে নিলো না সে যেভাবেই হোক আগে বিয়ে করবে।জামশেদ মজুমদার তুহিনকে ধমক দিলো কিন্তু তুহিন নাছোড়বান্দা। নিজের বিয়ের আসরে সে যে রবিন আর চারুকে বিয়ে করতে দিচ্ছে এটাই তো অনেক। অন্দরমহল থেকে আবারো খবর এলো চারুর বিয়ে আগে না হলে চারু বিয়ে করবে না আর সে অলরেডি বিয়ের সাজ খোলা শুরু করে দিয়েছে।

রবিন এতসব দেখে লম্বা করে শ্বাস টানলো।নেহাত বিয়ের অনুষ্ঠান বলে নয়ত এই দুটোকে সে এক চড়ে ঠান্ডা করে দিত। রবিন তুহিনের দিকে তাকিয়ে বলল-

“চারু মেয়ে মানুষ তাই ন্যাকামি করতাছে।তুইও কি মেয়ে?”

এমন কথা শুনে তুহিনের ব্রহ্মতালু জ্বলে গেলো।এত বড় কথা!!বিয়ের আসরে না থাকলে সে ছেলে না মেয়ে এটা রবিনকে তৎক্ষনাৎ প্রমান দিত।

এমন ঝামেলায় জামশেদ মজুমদার ছেলের উপর চড়াও হলেন।অন্দরমহলে রাজিয়া বেগমও মেয়েকে আচ্ছা করে বকছেন।পারছেন না শুধু বিয়ের দিন মেয়ের গায়ে হাত তুলতে।রানি বেচারি বিছানার এক কোণে গুটিশুটি মেরে বসে আছে।চারু আর তুহিনের এইসব দেখে তার মনে হচ্ছে আজকে আর তার বিয়ে হবে না।

ঝামেলার প্রকটতা দেখে শাহজাহান আলী এগিয়ে আসলেন সমাধান দিতে। তিনি আরেকটা কাজী ডাকালেন। এতে দুইজনের একসাথে বিয়ে হবে।কারো আগপিছ হবে না। তুহিন অনেক ভেবে এই সিদ্ধান্তে রাজি হলো তাও তার মন ভরলো না। নিজের বিয়ের আসরে নিজেই আগে বিয়ে করতে পারলো না বলে খুব আফসোস হলো।

________

চারু বাসর ঘরে বিছানার উপর বসে আছে। উপরে উপরে তাকে শান্ত মনে হলেও ভিতরে ভিতরে সে অস্থির হয়ে আছে। রবিনের ঘরে ফুল দিয়ে সাজানো বিছানায় বসে থাকতে তার কেমন জানি লাগছে। চারু শুকনো ঢোক গিললো। মনের সমস্ত সাহসকে আহবান করলো কিন্তু বিধিবাম! সাহস তার ডাকে সাড়া দিলো না।উল্টো তার হালকা কম্পন আরম্ভ হলো। চারুর ইচ্ছে হচ্ছে নিজেই নিজেকে চড় দিতে। নিজেই নিজেকে বলতে ইচ্ছে হলো “এত দিন রবিন ভাই রবিন ভাই করে খুঁজে মরতি,আর আজ তাকে বিয়ে করে বাসর ঘরে বসে থেকে তোর এত ঢং কিসের।”

চারুর আর বলা হলো না খুট করে দরজা খুলে রবিন ঢুকলো।তারপর দরজা লাগিয়ে দিলো। দরজা লাগানোর শব্দে চারুর বুকের ভেতর ধ্বক করে উঠলো।

রবিন দরজা লাগিয়ে পিছন ফিরে সরাসরি চারুর দিকে তাকালো। কিছুক্ষন থম মেরে তাকিয়ে রইলো।তারপর একটা চেয়ার টেনে চারুর কাছাকাছি রেখে পায়ের উপর পা তুলে বসলো।চেয়ারের হাতলে হাত ভর দিয়ে থুতনিতে ঠেকালো।তারপর শান্ত দৃষ্টিতে চারুকে দেখতে লাগলো। চারু এমন দৃষ্টি দেখে শ্বাস নিতে ভুলে গেলো। প্রতিটি শ্বাস সে খুব সাবধানে ফেলছে।চারু উশখুশ করলো।নড়েচড়ে বসলো।কিন্তু রবিনের কোনো হেলদোল নেই।সে তর্জনী দিয়ে ঠোঁট ঘষছে আর চারুকে দেখছে। চারু রবিনের মনোযোগ ঘোরাতে গলা খাকারি দিলো। রবিন বিরক্তিতে “চ” জাতীয় শব্দ করলো। ধমক দিয়ে বলল-

“শান্ত হইয়া বস।”

চারু মিনমিন করে বলল-
“আপনি এমনে দেইখেন না আমারে।”

“আমার বউরে আমি দেখতাছি।তোর সমস্যা কি?”

চারু ঠাসকি খেয়ে গেলো।আসলেই তো, তার তো সমস্যা হওয়ার কথা না।সে অনুরোধ করে বলল-
“এমনে তাকায়েন না প্লিজ।”

“তুমি কইরা ডাক।”

চারুর গলা দিয়ে শব্দ বের করা কঠিন হয়ে গেলো যেন।তারপরেও কোনোমতে বললো-

“এমনে তাকায়ো না প্লিজ।”

রবিন হাসলো। সুন্দর সে হাসি।চারু মুগ্ধ নয়নে দেখলো।আজ থেকে এই হাসির মালিক তার।শুধুই তার।রবিন চেয়ার ছেড়ে উঠে আসলো। বিছানায় হাত রেখে চারুর কাছে এসে মোহনীয় কন্ঠে বলল-

“তোরে এত সুন্দর লাগতাছে যে আমার মন চাইতাছে তোরে সারারাত জাগায় রাখি।কিন্তু গতরাতে প্রমিস করছিলাম যে আজ তোরে ঘুমাইতে দিব, তাই ঘুমা।”

রবিন সরে গেলো।এক টানে শেরওয়ানী খুলে ফেললো। ফ্রেশ হতে ওয়াশরুম চলে গেলো।চারু কি করবে বুঝে পেলো না।এখন কি ওরা এক বিছানায় ঘুমাবে?হ্যা এক বিছানায় ই তো ঘুমাবে।ওদের তো বিয়ে হয়ে গেছে। হায় আল্লাহ! চারুর তো ভয়ে গ্যাস হয়ে যাচ্ছে পেটে। মান ইজ্জত বুঝি গেলো।

রবিন টিশার্ট পড়ে বের হয়ে হলো। টাওয়েল দিয়ে মুখ মুছলো।এর মধ্যে চারু খুব ভেবে এক সাহসী পদক্ষেপ নিলো।সে হুট করে বিছানা ছেড়ে দাঁড়িয়ে পড়লো।রবিন ভ্রু কুচকে তাকালো।চারু যতটা সম্ভব শক্ত কন্ঠে বললো-

“আমি থাকতাম না এক বিছানায় আপনার সাথে।”

রবিন টাওয়াল ছুড়ে ফেলে বলল-
“তুমি কইরা ডাক।”

চারু থতমত খেলো।গলা পরিষ্কার করে বলল-
“আমি তোমার সাথে এক বিছানায় থাকতাম না।”

রবিন চেয়ারে বসে প্রশ্ন করলো-
“তেইলে কই থাকবি?”

চারু এগিয়ে এসে বললো-

“আমি বিছানায় ই থাকব,তুমি সোফায় থাকবা।”

রবিন হাত দিয়ে মুখ ঘষলো।নিজেকে সামলে নিয়ে বললো-

“আমার তোরে সারারাত জাগায় রাখা উচিত ছিলো।তেইলে এইসব ন্যাকামি বাইর হইয়া যাইত।এইটা সিনেমা পাইছস?আর এই রুমে কোনো সোফা নাই। আমি বিছানায় ই থাকব।তোর মন চাইলে তুই ফ্লোরে ঘুমা।”

চারু চোখ বড় বড় করে তাকালো।নতুন বউকে এসব বলে কেউ? নতুন বউ কত কিছুই তো বলতে পারে তাই বলে তাকে একটু নরম সুরে বুঝানোর চেষ্টা করবে না? দুম করে বলে দিলো ফ্লোরে ঘুমা।

রবিন চেয়ার ছেড়ে উঠে বিছানায় যেতে যেতে বললো –
“ফ্লোরে শুইতে চাইলে পাটি বিছায়া শুইবি।আর তাড়াতাড়ি লাইট অফ কর।”

বলেই রবিন শুয়ে পড়লো।চারু বিস্ফোরিত চোখে দেখলো। এত আনরোমান্টিক!!একটু জোর করে হাত টেনে কি বিছানায় শোয়ানো যেত না তাকে?সে সৈয়দ বাড়ির মেয়ে হয়ে কি ফ্লোরে ঘুমাবে? চারু মাথার ওড়না এক টানে খুলে ফেললো তারপর ভারী সাজ নিয়েই বিছানায় উঠে রবিনের পাশে শুয়ে পড়লো।

_______

রানি বাসর ঘরে বসে আছে সেই কখন থেকে।কিন্তু তুহিনের আসার নাম নেই।প্রথম প্রথম রানির লজ্জা লাগলেও তুহিনের দেরিতে তার লজ্জা বিরক্তিতে পরিণত হয়েছে।এতক্ষন বসে থেকে কোমড় ধরে এসছে। শুয়ে যে পড়বে সেটাও তো করা যাবে না।রানির চিন্তার মাঝেই তুহিন ধরাম করে দরজা খুলে ঢুকলো।রানি চমকে তাকালো।তুহিন হাঁপাচ্ছে।তার মুখে হাসি। দরজা লাগিয়ে রানির পাশে এসে বসলো। পাঞ্জাবির হাতা দিয়ে কপালের ঘাম মুছলো।রানি বিস্ময় নিয়ে প্রশ্ন করলো-

“কি হইছে আপনার?এরকম হাপাইতাছেন কেন?”

“বাজারে গেছিলাম তোমার লাইগা উপহার আনতে।আসার সময় গাড়ি গেলো নষ্ট হইয়া তাই দৌড়ায়া আসছি।”

রানি খুশি হবে নাকি রাগ করবে বুঝলো না।উপহার কিনতে কোন লোক বাসরে আসতে লেট করে।তুহিন তার পকেট থেকে একটা লাল মখমলের বক্স বের করলো।বক্স খুলে এক জোড়া রূপার নুপুর হাতে নিলো।রানির পা টেনে সামনে আনলো।আকস্মিক কান্ডে রানি চমকে গেলো।পরক্ষনেই লজ্জা ঘিরে ধরলো।তুহিন খুব যত্ন নিয়ে নুপুর পড়িয়ে দিলো।তারপর বুঝে উঠার আগেই পায়ের পাতায় গভীরভাবে ঠোঁট ছুয়ালো।রানির সারা অস্তিত্ব কেঁপে উঠলো যেন।সে বিছানার চাদর খামছে ধরলো।তুহিন মুখ তুলে রানির দিকে তাকিয়ে বলল-

“এইবারের নুপুর টা আর হারাইয়ো না।তোমার পায়ের রিনঝিন শব্দ না শুনলে আমার ঘুম আসবে না।”

রানি লজ্জায় মিইয়ে গেলো।তুহিন তড়াক করে দাঁড়িয়ে গেলো।এক টানে পাঞ্জাবি খুলে ফেললো।তারপর বললো –

“এই নুপুরের চক্করে এম্নিই অনেক দেরি হয়ে গেছে।আর দেরি করা উচিত না।”

রানি কিছু বুঝলো না।সে ভ্যাবলার মতো চেয়ে রইলো।তুহিন সুইচবোর্ডের দিকে এগিয়ে গেলো।মুহুর্তে রানি বুঝে ফেললো কি হতে যাচ্ছে।সে মৃদু চিৎকার করে বলল-

“লা-লাইট অফ করেন কে-কেন?”

তুহিন ঘাড় ঘুরিয়ে বললো-

“সেটা লাইট অফ করলেই বুঝবা।”

বলেই সে এক হাসি দিয়ে সুইচ টিপে লাইট অফ করে দিলো।আজ কোনো ছাড়াছাড়ি নাই।কোনো ছাড় দিবে না তুহিন। বিয়ের রাতেই বিড়াল মারবে সে।

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here