#ভালোবাসার_ফোড়ন_২
#মিমি_মুসকান
#পর্ব_৫৪
রাতের বেলা, চারদিক অন্ধকার। ড্রাইভিং সিটে বসে গাড়ি ড্রাইভ করছে আহিয়ান। উনার পাশে বসে আছি আমি। গাড়ি চলছে নিজ গতিতে। তার সাথে একটা গান বাজছে। বাংলা গান উনার গাওয়া সেই গান টা। “তোমায় হৃদ মাঝারে রাখবো ছেড়ে দেবো না”!
সব মিলিয়ে ভালোই লাগছে। হয়তো আজ সারারাত উনাকে ড্রাইভ করতে হবে। বেচারার অনেক কষ্ট হবে মনে হচ্ছে। আমি কিছুক্ষণ উনার দিকে তাকিয়ে আছি। ক্লান্তিহীন ভাবে তাকিয়ে আছে সামনের দিক। একবার উপরের গ্লাসের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসল। তার ঠোঁটের কোনে হাসি দেখে আমার ঠোঁটে ও হাসি ফুটল। উনি বলে উঠেন,
“ভূতনি তুমি দেখছি নজর লাগিয়ে দিবে আমায়।
আমি মুখ ভেংচি দিয়ে বাইরের দিক তাকালাম। উনি বলে উঠেন,
“কি হলো নজর লাগানো শেষ!
আমি উনার দিকে ফিরে চোখের কাজল হাতে নিয়ে উনার কানের পিছনে লাগিয়ে দিয়ে বলি,
“নিন কাজল লাগিয়ে দিলাম, এখন আর নজর লাগবে না।
আমার এমন কান্ড তে উনি খিলখিলিয়ে হাসলেন। আমিও হেসে নিজের সিটে বসলাম। গান বাজছে নিম্ন স্বরে। শুনতে খারাপ লাগছে না। আমার চোখ গেল হাতের দুই বালার দিকে। সোনার বালা দুটি নানু নিজে আমাকে পরিয়ে দিয়েছেন। আমি তাকিয়ে ছিলাম উনার চোখের দিকে। না আজ উনার চোখে আমি হতাশা দেখি নি। বরং দেখেছি আমার জন্য থাকা সূক্ষ্ম ভালোবাসা। নানুর চোখে ভালোবাস দেখে আমার খুব ভালো লাগছিল। নানু আমার দুই হাতে বালা পড়াতে পড়াতে বলেন,
“যখন আমি এই বাড়ির বউ হয়ে এসেছিলাম তখন আমার নানি শাশুড়ি আমার হাতে দুটি সোনার বলা পরিয়ে দিয়েছিলেন। আজ সেই রীতি আমিও করলাম। আমার হাতের বালা তোমাকে পড়ালাম বুঝলে গো নাতবউ।
“জ্বি নানু !
নানু হেসে আমার মাথায় হাত রাখলেন। অতঃপর একে একে সবার কাছ থেকে বিদায় নিলাম। সবাই অনেক আদর করল আমায়। মামিরাও কিছু উপহার দিলেন।
তিন্নি আর তিথি কে খুব মনে পড়বে। খুব ভালো সময় কাটিয়ে ওদের সাথে!
গাড়ির হর্ন এর শব্দে আমার ঘোর কাটল। আমি একটু নড়েচড়ে উঠলাম। আশপাশ তাকাচ্ছিলাম। গাড়ি আসছে আর যাচ্ছে কোন সীমাবদ্ধতা নেই আশেপাশে। গানটা শেষ হয়ে গেছে। অন্য একটা গান শুরু হলো। কে জানে কি গান। সবে সুর শুরু হলো। এই সুর শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে পড়লাম আমি। তবে কেন জানি মনে হচ্ছিল গানটা তখনও আমার কানে বাজছিল।
ঘুমের মাঝে একটা স্বপ্ন দেখলাম। স্বপ্ন টা ছিল এমন যে আমি আর আহিয়ান পাশাপাশি হাটছি। ঝির ঝির বৃষ্টি পড়ছে। আমাদের মাথার উপর কোন ছাতা ছিল না। দুজনেই ভিজে একাকার হচ্ছি তবুও যেন খারাপ লাগছে। ভালোই লাগছে এভাবে হাঁটতে। এভাবেই হাঁটতে লাগলাম এর মাঝেই দু’জন দু’জনের হাতের ছোঁয়া পেলাম। আমার শরীর শিহরিত হয়ে গেল। কেঁপে উঠলাম আমি। হুট উনি আমার হাতটা আলতো ভাবে ধরলো। ঘুম ভেঙে গেল আমার। আমি চোখ খুলে আশপাশ তাকাতেই বুঝলাম আহিয়ানের ঘাড়ে আমার মাথা। স্বপ্নের কথা মাথাতে আসতেই আমার শরীর আবারো কেঁপে উঠলো। আমি দ্রুত সরে বসলাম উনার কাছ থেকে। উনি হেসে বলেন,
“ঘুম ভেঙ্গেছে তোমার ভূতনি!
“হুম।
“ভালোই ঘুম দিলে, তা একটু চা খাওয়াতে পারবে আমায়।
“দিচ্ছি!
খানিকক্ষণ বাদেই উনি কোথায় গাড়ি থামালেন একটা বীজ্রের উপর। বোতল থেকে পানি বের করে মুখে পানি ছিটালেন। আমি ফ্লাক্স থেকে চা ঢেলে উনাকে দিলাম। উনি আমার সিটের সামনে দাঁড়িয়ে চা খেলেন। আর আমি গাড়ির ভিতর। গাড়ির দরজা টা খোলাই ছিল। তাতে হাত রেখে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে গল্প করলেন আমার সাথে। অতঃপর আবারো গাড়িতে বসে গাড়ি স্টার্ট দিলেন। রাত যতোটা গভীর হতে থাকল ততোটাই ফাঁকা হয়ে যাচ্ছিল।
.
ভোরে হয়ে গেল বাড়ি পৌঁছাতে পৌঁছাতে। গাড়িতে বসে থেকে বাইরে ভোর হওয়া দেখলাম আজ। বেশ মনোমুগ্ধকর ছিল তা। আকাশে সূর্য উঁকি দিতে না দিতেই পাখিরা নীড়ের খোঁজে দল বেঁধে বের হয়ে গেছে। মেইনরোডএ কিছু কর্মী রাস্তায় ঝাড়ু দিচ্ছে। আমিও উনার সাথে আজ সারারাত জাগলাম। মাঝখানে একবার শুধু ঘুমিয়েছিলাম। তারপর উনার সাথে চা খাবার পর আর ঘুমোলোম না।
বাড়ি পৌঁছে দেখি দরজার সামনে মা আর বাবা দাঁড়ানো। তাদের সাথে দেখা করার পর দুজনেই রুমে এলাম। ইয়ান এখনো ঘুমাচ্ছে। মজার ব্যাপার ছিল ইয়ান আমাদের ঘরে ঘুমাচ্ছিল। আমি তাকে ঘুমের মাঝেই একটা চুমু খেলাম। উনিও চলে গেলেন ফ্রেস হতে। একবারে শাওয়ার নিয়ে বের হলেন। আমি ততোক্ষণে উনার জন্য বসে ছিলাম। বজ্জাত লোক একটা। শাওয়ার নিয়ে বলে জামাকাপড় দিতে। জামাকাপড় ছাড়াই এসেছিল গোসল করতে আর এখন বলছে জামাকাপড় দিতে। দরকার ছিল না জামাকাপড় দেওয়ার। অসভ্য লোক একটা।
শাওয়ার নিয়ে এসে দেখি ইয়ান কে জরিয়ে ধরে ঘুমিয়ে আছে গোমরামুখো টা। ইচ্ছে তো করছিল তার ঘুমের মাঝে জল ঢেলে দেই কিন্তু ইয়ান ছিল বলে বেঁচে গেল।
হঠাৎ করেই দরজা নক করার আওয়াজ পেলাম। আমি তাকিয়ে দেখি মা। অতঃপর উনার সাথে কথা বললাম। উনি চাইলেন ইয়ান কে নিয়ে যেতে আমি না করে দিলাম। ভালোই লাগছে ও এখানে। আম্মু আমাকে ঘুমানোর কথা বলে চলে গেল। আমিও এসে ইয়ানের পাশে ঘুমিয়ে পড়লাম। ইয়ানের মুখটা ছিল আমার দিকে। উপুড় হয়ে শুয়ে ছিল ও। আমি ওর মাথায় কিছুক্ষণ হাত বোলানোর পর ঘুমিয়ে পড়লাম!
.
ঘুম ভাঙতে ভাঙতে অনেক বেলা হয়ে গেল। ঘুম থেকে উঠে দেখি দুপুর ১ টা বাজে। বাহ ভালোই তো ঘুমিয়েছি আমি। ওপাশে তাকিয়ে দেখি উনি এখনো ঘুমিয়ে আছেন কিন্তু ইয়ান নেই। তবে এখানে আমার মনে হলো আমি কিছুটা ভুল দেখলাম। উনার মুখে কিসব আঁকা। আমি চোখ কচলিয়ে আবারো ভালো মতো দেখলাম। আসলেই উনার মুখে কিসব আঁকা। আমি হাত দিয়ে উনার চোখটা ধরতেই উনি নড়েচড়ে উঠলেন। সাথে সাথে আমি সরে গেলাম। অতঃপর উনার মুখটা ভালো মতো দেখলাম। কোন একটা সমুদ্রের ডাকাত দলের লিডার মনে হচ্ছিল উনাকে। চোখের ধারে লাল রঙের কালি দিয়ে গোল দেওয়া। এছাড়া উনার দাড়ির ওখানেও আঁকাআঁকি করা। উনার এই মুখের হাল দেখে না হেসে পারলাম না। জোরে জোরে হাসতে শুরু করলাম আমি।
আমার হাসিতে উনার ঘুম ভেঙ্গে গেল। উনি একটা কুশন দিয়ে আমার মাথায় মেরে বালিশে মুখ গুজে বলেন,
“ভূতনি পেত্নির মতো হাসা বন্ধ করো, ঘুমোতে দাও আমায়।
“আমি না হয় ভূত বা পেত্নি কিন্তু আপনাকে তো ডাকাত দলের সর্দার লাগছে।
বালিশ থেকে মুখ সরিয়ে,
“মানে…
“আয়নায় গিয়ে দেখে আসুন!
উনি উঠে একমুহূর্ত অপেক্ষা না করে আয়নায় সামনে গেল। উনার মুখ দেখেই বুঝতে পারছি মারাত্মক রেগে যাচ্ছেন উনি। উনি আয়ানার দিকে তাকিয়েই বলে উঠেন,
“ভূতনি এসব তোমার কাজ নাহ!
“কি, পাগল হয়েছেন নাকি। আমি এসব কেন করবো!
“কেন করবে, দাঁড়াও দেখাচ্ছি!
বলেই আমার দিকে তাকালেন। অতঃপর নিরব হয়ে গেলেন। আমি উনার এই নিস্তব্ধতার মানে বুঝতে পারলাম না। আচমকা উনি হেঁটে আমার কাছে আসতে লাগলেন। উনার চাহনি বেশ অদ্ভুত লাগছিল। উনি কাছে এসেই হাত বাড়িয়ে আমার ঠোঁটের দিকে ধরতে গেলেন। আমি উনার হাতে বাড়ি মেরে বলি,
“কি করছেন?
হঠাৎ করেই উনি জোরে জোরে হেসে উঠলেন। উনার হাসি মানেই আমার মুখের অবস্থা ও বেশি ভালো না। দেরি না করে আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। নিজেকে নিজে দেখেই চমকে উঠলাম। এটা আদৌও আমি নাকি। এ কি হাল আমার মুখের। ঠোঁটে থেকে নিচ অবদি লাল কালি দিয়ে রঙ করা। মনে হচ্ছে কারো রক্ত খেয়েছি। এছাড়া আমার ভ্রু গুলোতেও আঁকাআঁকি করা। গালেও কিসব আঁকা। আমি হতবাক হয়ে গেলাম। বলে উঠি,
“এসব কি হাল আমার মুখের!
পেছনে উনার হাসি যেন থামছেই না। উনি হাসতে হাসতে বলেন,
“এখন একদম ভূতনি ভূতনি লাগছে তোমায়!
বলেই হাসতে হাসতে উনি বিছানায় শুয়ে পড়েন। তবুও হাসি থামে না। আমি উনার সামনে এসে কোমরে হাত দিয়ে বলি,
“এভাবে হাসবেন না আপনার মুখের অবস্থাও কিন্তু বেশি একটা ভালো না।
উনি উঠে বসে বলেন,
“তোমার থেকে বেটার।
মুখ ভেংচি কেটে বলি,
“রাখুন তো আপনার সাথে কথা বলাই বেকার। আজ ইয়ান কে পাই তখন বোঝাব।
বলেই যেতে নিলাম। তখন’ই শাড়িতে টান খেলাম। বুঝে গেলাম উনি ধরেছেন। পিছনে ফিরে জিজ্ঞেস করি,
“কি হয়েছে এখন আবার।
“এভাবে বাইরে যেও না প্লিজ।
“এমন ভাবে বলছেন যে অনেক কষ্ট হচ্ছে আমার।
“আরে কষ্ট তো হবেই..
“কেন হবে, সবাই আপনার বউ কে নিয়ে হাসবে বলে।
” সেটা কোন ব্যাপার না কিন্তু কথা হলো তুমি এভাবে গেলে তারা ভয় পেয়ে হার্ট অ্যাটাক করবে তখন ক্ষতি তো আমার’ই হবে না বল।
বলেই দাঁত বের করে হেসে দিলেন। আমি দাঁতে দাঁত চেপে বলি,
“আপনাকে আমি…
উনি দৌড়ে সেখান থেকে পালিয়ে গেলেন। আবারো লাগলো তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ !
.
নানু বিয়ের কথা মুখ দিয়ে বের করতে দেরি কিন্তু মা’র বিয়ের কাজ শুরু করতে একটুও দেরি করেন নি। সন্ধ্যা বেলা নিচে এসে দেখি তিনি অলরেডি বিয়ের তারিখ থেকে শুরু করে কার্ড অবদি বানিয়ে ফেলেছেন। তার এমন কর্মকান্ডে আমি আর উনি দুজনেই অবাক। অতঃপর বিয়ের কার্ড মেহমানদের দেওয়াও শুরু হয়ে গেল। এমনকি কেনা কাটাও শুরু হয়ে গেল। বিয়ের শাড়ি মা’র কিনলেন তার পছন্দ মতো। ধরতে গেলে সবকিছু তিনি নিজের হাতেই করেছেন। আমার মা বাবা চাচা আর উনার নানুদের ও আসতে বলা হলো। সপ্তাহ খানিক এর মধ্যে তারা চলেও এলো। এমনকি মিতু আর মুন্নি আপু , দাদা দাদি তাদেরও নিমন্ত্রণ করা হলো।
মা নিজেই এসব দায়িত্ব নিয়েছিলেন। তিনি আহিয়ানের প্রত্যেক বন্ধুদের নিজে দাওয়াত করলেন। আর এদের মধ্যে নিতিও ছিল। তারা বিয়ের দুদিন আগে বাড়িতে চলে আসল। পুরো বাড়িতে একটা জমজমাট ব্যাপার শুরু হলো। মেহমান এ ভর্তি চারদিক। কোথাও গিয়ে এক দন্ড বসে থাকার জো নেই। এর মাঝে শুধু একটু শান্তি ছিল নিজের ঘর। কিন্তু তাও ছেড়ে দিতে হলো। ইতি আর আকাশ ভাইয়ার এক করা আমরা দু’জন বিয়ের আগে এক ঘরে থাকতে পারবো না। তারা শুধু সুর তুলল এরপর যা হবার এমনে এমনেই হয়ে গেল।
শুধু গায়ে হলুদ আর বিয়ের অনুষ্ঠান হবে বলে ঠিক করে করা হলো। বিয়ের সব অনুষ্ঠান ছাদেই হবে। তাই সেখানে সাজানো শুরু হয়ে গেল। রাতে আমি ইতি আর আপু একসাথে ঘুমাতাম। আর আমাদের সাথে ইয়ান ও ছিল। ভালোই লাগতো বেশ রাত অবদি সবাই গল্প করতাম। অতঃপর গায়ে হলুদের দিন..
#চলবে….