#ভালোবাসার_ফোড়ন_২
#মিমি_মুসকান
#পর্ব_৬১
“হ্যালো, কোথায় আপনি?
“তুমি কোথায়?
“কোথায় মানে, যেখানে রেখে গেছিলেন সেখানেই আছি।
“ওহ আচ্ছা, বাসায় চলে যেও। আমি গাড়ি পাঠিয়ে দিচ্ছি!
“গাড়ি পাঠিয়ে দিচ্ছি মানে, আপনি কোথায়? আসবেন না আমায় নিতে!
“না, আমার কাজ এখনো শেষ হয় নি। তুমি বাসায় চলে যেও আমার আসতে অনেক রাত হবে।
“কিন্তু..
অতঃপর কানের কাছে টুং টুং শব্দ হলো। ফোন হাতে নিয়ে দেখি কল কেটে গেছে। আজব তো লাইন কেটে দিলো কেন? আমার তো কথা বলা এখনো শেষ হয় নি। কোথায় উনি, কি করছে এখন। কিসের এতো কাজ উনার এখানে আসতে পারবে না। রেখে গেল কিন্তু নিতে এলো না। ধুর!
অতঃপর ফোনটা আবারো হাতে নিলাম। উনাকে কল করব, নাম্বার ডায়াল করলাম কিন্তু.. কিন্তু ফোন দিলাম না। কেন আমি দেবো ফোন। উনি কেন আমার কল কাটলেন। কথা শেষ হয় নি কেটে দিলেন। এখন যদি আমি ফোন করার পর আবারো কেটে দেন তখন! হুহ করা লাগবে না ফোন। রেগে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলাম। এসে উঠলাম ছাদে। আমাকে দেখে ইতিও এলো আমার পিছু পিছু।
.
খানিকক্ষণ পর’ই বাইরে গাড়ির হর্ন বাজার শব্দ আসলো। আমি জানি গাড়ি উনি পাঠিয়েছেন তবুও দাঁড়িয়ে আছি। যাবো না। উনি না এলে যাবো না আমি।
গাড়ির হর্ন বেজেই যাচ্ছে কিন্তু আমি যাবো না। খানিকক্ষণ পর গাড়ির হর্ন বাজা বন্ধ হয়ে গেল। আমার ঠোঁটের কোনে হাসি ফুটল। ইতি তাকিয়ে তাকিয়ে অবস্থান বোঝার চেষ্টা করছে।
খানিকক্ষণ বাদেই আমার ফোনে টুং টুং শব্দ হলো। তাকিয়ে দেখি উনার মেসেজ। কি লোক রে বাবা, কল করলে কি হতে। উহু!
মেসেজ এ লেখা..
“ভূতনি! জলদি আসো!
উনার এই মেসেজ থেকে দ্রুত নিচে নেমে এলাম। এর মানে কি উনি এসেছেন!
ঘর থেকে ব্যাগ নিয়েই বের হতে যাবো তখন ইতি এসে দাঁড়াল। আমি ইতি কে গাল টিপে ধরে বলি,
“চলে যাচ্ছি টাঠা!
বলেই বেরিয়ে এলাম। গাড়ির কাছে এসে থমকে গেলাম। ড্রাইভার দাঁড়িয়ে আছে গাড়ির সামনে। আমার মুখটা অন্ধকার হয়ে গেল। ড্রাইভার আমাকে দেখে বলল,
“ম্যাম, স্যার গাড়ি পাঠিয়েছে। আপনাকে যেতে বলেছে!
অবাক হয়ে বলি,
“হ্যাঁ!
ফোনে আবারো টুং টুং শব্দ হলো। উনার মেসেজ,
”ভূতনি, কি ভাবো তুমি? তুমি একাই কি চালাক নাকি! চুপচাপ গাড়িতে চড়ে বাসায় চলে যাও!
অতঃপর আমি এক বস্তা বিরক্ত নিয়ে গাড়িতে উঠে বসলাম। রাগে আমার শরীর জ্বলছে। কি বোকা বানালো উনি আমায়! ধ্যাত! কতোটা বোকা আমি। কিন্তু এটা কি সত্যি বোকামি। না এটা তো বোকামি না। যাকে ভালোবাসি তাকে বিশ্বাস করা কি বোকামি নাকি। এটা তোর তার প্রতি আমার বিশ্বাস, আমার ভরসা। উনি জানতেন উনার কথা বললে আমি দ্রুত চলে আসবো এজন্য উনি এই চাল চাললেন। খুব ভালো করেই বোঝানে আমাকে উনি! তবে গাড়িটা উনার না এটা অন্য গাড়ি। তার মানে কি সত্যি উনি আজ দেরি করে বাসায় ফিরবেন। কি করছে এতো, কোথায় আছে এখন!
.
গাড়ি এসে থামল বাড়ির সামনে। গাড়ি থেকে নেমে বাসার দিকে তাকিয়ে খানিকটা অবাক হলাম। ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে আছি বাড়ির দিকে। আসার সময় দেখলাম প্রত্যেক বাড়ি আলো ঝলমল করছে কিন্তু আমাদের বাড়ি পুরোই অন্ধকারে আচ্ছন! কে জানে বাড়ির আবার কি হলো। কেন জানি মনে হচ্ছে আমার ভাগ্যর মতোই আজ বাড়ির অবস্থা। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে দরজার কাছে গেলাম। কলিং বাজিয়ে লাভ নেই কারন কারেন্ট নেই। তাই দরজা কড়া নাড়তে গেলাম। কিন্তু দরজায় হাত দিতেই তা নিজ থেকে খুলে গেল। আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে আছি। বাইরে থেকে পুরো বাড়ি অন্ধকার হলেও এর ভিতরে পুরোটাই আলোকিত। বসার ঘরটা রংবেরঙের মোমবাতি দিয়ে আলোকিত করা। আমি ধীরে ধীরে ঘরের দিকে আগাতে লাগলাম। শুধু মোমবাতি না, চারদিক গোলাপ ফুল আর বেলুন দিয়ে সাজানো। আমি কাঁধের ব্যাগ টা সোফায় রেখে সামনে তাকাতেই দেখি টি টেবিলে একটা কার্ড! কার্ড টা হাতে নিলাম। কার্ডে কয়েকটা ছবি লাগানো। বেশিরভাগ ভাগ ছবি উনার আমার গায়ে হলুদে তোলা। উনি আমি পাশাপাশি বসে আছি সেই ছবি। উনি আমার হাত ধরে আছেন সেই ছবি। আমাকে কোলে তুলেছিলেন সেই ছবি! সেখানে লেখা ছিল,
“ভূতনি আমি আমার সারাটা জীবন তোমার হাত ধরেই কাটাতে চাই! যখন আমরা বুড়ো হয়ে যাবো তখনও আমি এভাবেই শক্ত করে ধরে রাখবো তোমার হাত খানা”
আমি মুচকি হেসে সিড়ির দিকে পা বাড়ালাম। ঘরের দিকে পা বাড়াতেই গিটারের শব্দ পেলাম। কিন্তু তা ঘরের ভিতর থেকে আসছে না। উপর থেকে আসছে। আমি দৌড়ে ছাদের দিকে রওনা হলাম।
ছাদে এসে বড় বড় শ্বাস নিচ্ছি। দৌড়ে আসায় হাঁপিয়ে গেছি। পুরো ছাদ টা অন্ধকার, খোলা আকাশ দেখা যাচ্ছে। শুধু দূরে একটা হারিকেন দেখতে পারছি, একটা টেবিলের উপর একটা হারিকেন! আমি হাঁটতে হাঁটতে সেই হারিকেন’র কাছে গেলাম। হারিকেন টা দেখতেই উনার আর আমার কথা মনে পড়ল। সবাই সেদিন আমায় ভূত ভেবে পালিয়ে যাচ্ছিল কিন্তু উনি পালাননি শুধু আমার দিকে তাকিয়ে বলেছিলেন ভূতনি! একথা মনে পড়তেই হেসে দিলাম।
চোখ পড়ল টেবিলে আরো কিছু আছে। হারিকেন টা টেবিলের কাছে ধরতেই দুটো চায়ের কাপ দেখতে পেলাম। গরম চা! ধোঁয়া উড়ছে কাপের উপর থেকে। এই চায়ের কাপেও আমাদের অনেক স্মৃতিজড়িত। একটা জবা ফুল ও ছিল। তার নিচে একটা কাগজ ছিল। ফুলটা সরিয়ে দেখি কাগজে লেখা..
“ভালোবাসি! আমি আমার ভূতনি বউ কে ভালোবাসি!
এটা দেখা মাত্রই আমার ঠোঁটের কোনে হাসি ফুটল। কারো হাঁটার শব্দ পেতেই পিছনে ঘুরে বুঝতে পারি দূরে উনি দাঁড়িয়ে আছেন। আমি নিজেকে সামলিয়ে হারিকেন হাতে নিয়ে হাটতে হাঁটতে উনার কাছে যাচ্ছিলাম। হারিকেন নিয়ে যত’ই উনার কাছে যাচ্ছিলাম তত’ই উনার মুখটা স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছিলাম। আমি হারিকেন উনার মুখের সামনে ধরি। ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করি,
“আপনি বাড়িতেই ছিলেন, আপনি না বললেন আপনার কাজ আছে।
“হুম কাজ’ই তো করছিলাম।
“কাজ কি বাড়িতে ছিল।
“হুম।
“তাহলে আমাকে বের করে দিলেন যে,
“হুম! তুমি থাকলে সারপ্রাইজ দিতাম কিভাবে?
আমি হারিকেন হাতে নিয়ে উনার চারদিকে ঘুরতে ঘুরতে বলি,
“ওহ আচ্ছা! তাহলে আপনি সেই মেয়েকে সারপ্রাইজ দিবেন বলে আমাকে ঘর থেকে বের করেছেন। তাই কি!
বলেই আবারো উনার সামনে দাঁড়ালাম। উনি কিঞ্চিত হেসে বলেন,
“হুম বলতে পারো।
হাসি সামলে বলে উঠি,
“তাহলে আমাকে এখানে এনেছেন কেন?
উনি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে আমার হাতের উপর হাত রেখে হারিকেন টা ধরেন। উনার ছোঁয়া পেয়ে আজ আমি রীতিমতো কেঁপে উঠি। তার সাথে সাথে আমার অস্থিরতা বাড়তে থাকে। কিছু আছে আজ উনার এই উষ্ণ ছোঁয়ায়। উনি খানিকটা আমার কাছে এসে বলেন,
“তুমি কি আদৌ ও জানো না সেই মেয়ে কে?
আমি একগাল হেসে বলি,
“কে? আমি বুঝি!
আমার দেখাদেখি উনিও একগাল হেসে বলেন,
“নাহ ভূতনি!
বলেই অন্য হাত দিয়ে আমার কোমর আঁকড়ে ধরেন। অতঃপর আমার কাছে আসতে আসতে ধীরে ধীরে বলেন,
“তুমি কি জানতে চাও সেই ভূতনি বউ টা কে?
বলেই আমার কানে কাছে এসে বলেন,
“তুমি!
উনার কথায় আমি মুচকি হাসি দিলাম। উনি আমার চোখের দিকে তাকিয়ে ঠোঁটের দিকে আগাতেই আমি বলে উঠি,
“প্রমান কি?
আমি থেমে গিয়ে বলেন,
“কিসের প্রমাণ!
“এই যে আপনি আমাকে ভালোবাসেন।
“তুমি ওই কাগজটা পাও নি।
“পেয়েছি।
“তাহলে?
“কাগজটা আপনার লেখা সেটার প্রমাণ কি? কোথায় এখানে তো আপনার নাম লেখা নেই।
উনি আমাকে ছেড়ে দিয়ে পিছিয়ে বলেন,
“ওহ আচ্ছা এই ব্যাপার?
“হুম!
( কি ভেবেছেন আপনি, এখন ভালোবাসি বলে দিলেই কি হলো নাকি। আমাকে যে এতোদিন এতো কষ্ট দিলেন তার কিছুটা কি শোধ করব না নাকি। দেখুন কি করি! )
উনি হেসে বলেন,
“আচ্ছা তো দেখি কিভাবে প্রমাণ করা যায়!
আমি হেসে মাথা নাড়ায়। তৎক্ষণাৎ আকাশ চমকে উঠে। মনে হচ্ছে বৃষ্টি হবে। আকাশ আজও মেঘে ঢাকা! মনে হচ্ছে অনেক বৃষ্টি হবে। আমি হারিকেন না নিচে রাখলাম।উনি গিটার নিয়ে আমার চারদিকে ঘুরতে ঘুরতে বলেন,
আমি প্রেমিক, আমি কবি
তুমি সিরিয়াস ভাবে দেখো সবই
আমি গেম খেলে সারারাত জাগি
তুমি পড়ুয়া মেয়ে বেজায় রাগী
আমি বিড়ি খোর, আমি আড্ডাবাজ
পড়াশোনা শুধু তোমার কাজ।
হুট করেই আমার হাত ধরে ঘুরিয়ে বলেন,
তোমার প্রিয় বিড়াল ছানা, আমার প্রিয় কুকুর
তোমার প্রিয় পাহাড়ি ঝর্ণা, আমার প্রিয় পুকুর
গোলাপ ফুলের জায়গায় আমি দিলাম তোমায় জবা
বলো তুমি এইবার কি আমার প্রেমিকা হবা.
গোলাপ ফুলের জায়গায় আমি দিলাম তোমায় জবা
বলো তুমি এইবার কি আমার প্রেমিকা হবা।।
এক হাত আমার কোমরে হাত রেখে অন্য হাত উনার হাতে মুষ্টিবদ্ধ করে দু’জনে নাচতে থাকি। উনি গান গাইছেন তবে গিটার বাজাচ্ছেন না। তবুও তার সুর আসছে। এটা কিভাবে সম্ভব!
আমি ফেল করেও বলি প্যারা নাই চিল
তুমি হায়েস্ট পেয়েও কেঁদে মুখ করো নীল
আমার বই খাতা সব ছিঁড়া ফাড়া
তোমার কলমটাও মলাট করা
আমি বাড়ি ফিরি মেলা রাত করে
তুমি রাতে ঘুমিয়ে ওঠো ভোরে
তোমার প্রিয় গরুর গোশত, আমার প্রিয় চিকেন
তোমার রুমে দুইটা এসি, আমার রুমে ফ্যান।
গোলাপ ফুলের জায়গায় আমি দিলাম তোমায় জবা
বলো তুমি এইবার কি আমার প্রেমিকা হবা.
গোলাপ ফুলের জায়গায় আমি দিলাম তোমায় জবা
বলো তুমি এইবার কি আমার প্রেমিকা হবা।।
নাচতে নাচতে দুজনেই টেবিলের কাছে চলে আসি। কিন্তু আধারে আমরা কেউই কাউকে দেখতে পাচ্ছিলাম না। তবুও অনুভব করছিলাম।
তোমার গল্পে আমি ভিলেন আমার তুমি রানী
যখন আমি প্রেমে সিরিয়াস তোমার কাছে ফানি
তোমার গল্পে আমি ভিলেন আমার তুমি রানী
যখন আমি প্রেমে সিরিয়াস তোমার কাছে ফানি
গোলাপ ফুলের জায়গায় আমি দিলাম তোমায় জবা
বলো তুমি এইবার কি আমার প্রেমিকা হবা.
আমার মনে হলো উনি আমার সামনে হাঁটু গেড়ে বসেন। অতঃপর বলেন,
গোলাপ ফুলের জায়গায় আমি দিলাম তোমায় জবা
বলো তুমি এইবার কি আমার প্রেমিকা হবা.. নাহ আমার ভূতনি বউ হবা…!
আমি হেসে উঠি। উনি শীতল গলায় বলে উঠেন,
“ভালোবাসি ভূতনি বউ, আমি তোমাকে ভালোবাসি! আমার সেই ভালোবাসার মানুষ টি তুমি!
আকাশ চমকে উঠলো। এই অন্ধকারে আমি উনার মুখখানা দেখলাম। হাতে জবা ফুল দিয়ে হাটু গেড়ে বসে আছেন। আমি হেসে উনার হাত থেকে ফুলটা নিয়ে উনার মাথার চুল গুলো এলোমেলো করে বলি,
“গোমরামুখো!
উনি উঠে দাঁড়িয়ে দু’হাত দিয়ে আমার কোমর জড়িয়ে ধরেন। আকাশ আবারো চমকে উঠলো। উনি বলে উঠেন,
“তা প্রমাণ পেয়েছ?
“হুম! কিন্তু একটা কথা বলুন! আপনি গান গাইছিলেন কিন্তু গিটার বাজাচ্ছিলেন না তবুও গিটার শব্দ আসছিল কোথা থেকে!
উনার গলার আওয়াজ শুনতে পাচ্ছিলাম না। সবকিছু নিস্তব্ধ হয়ে গেল। হঠাৎ করেই পিছনে কিছু পড়ে যাবার শব্দ পেলাম। হারিকেন টা পড়ে গেছে। আমি বলে উঠি,
“কে?
“ভাবী আমরা!
তাদের আওয়াজ পেয়ে আমি শিহরিত। উনি এখনো কোমর জড়িয়ে ধরে আছেন আমাকে। আমি একটা শুকনো ঢোক গিলে বলি,
“আকাশ ভাইয়া! নাহান আর আনাফ ভাইয়া আপনারাও কি..
আকাশ ভাইয়া’র গলার আওয়াজ মনে হলো,
“আমরা চলে যাচ্ছি! তোমাদের বিরক্ত করব না।
আমি দাঁত দিয়ে জিহ্বা কামড় দিয়ে চোখ বন্ধ করে মুখ ঘুরলাম। উনার বুকে মাথা রেখে আছি। ইশ কি লজ্জা কি লজ্জা! ভাইয়ারা এখানেই ছিল! আর উনি তাদের সামনেই আমাকে নিয়ে এতোক্ষণ… হায়রে কি কপাল আমার!
#চলবে….