#রৌদ্রর_শহরে_রুদ্রাণী
#পর্বঃ২৩
#Saiyara_Hossain_Kayanat
“আশু কি হয়েছে তোর?? হঠাৎ করে এভাবে কান্না করছিস কেন??”
আরশিকে কোনো কথা বলতে না দেখে নীলার অস্থিরতা আরও বেড়ে যায়। নীলা আরশির পিঠে হাত বুলিয়ে দিয়ে অস্থির হয়ে চিন্তিত গলায় বললো-
“আশু আমার খুব চিন্তা হচ্ছে। প্লিজ তুই বল আমাকে কি হয়েছে!!”
আরশি বড় বড় কয়েকটা শ্বাস নিয়ে কান্না জড়িত কন্ঠে বলল-
“আমাকে মাফ করে দিস নিলু।”
নীলা আরশিকে জোর করে নিজের থেকে ছাড়িয়ে নিল। আরশি মাথা নিচু করে চোখেরজল ফেলছে। নীলা আরশির দু কাধে হাত রেখে অস্থিরতা সাথে জিজ্ঞেস করল-
“কিসব আবল-তাবল বলছিস?? কি হয়েছে আমাকে একটু বল প্লিজ। এভাবে কান্নাকাটি করছিস কেন??”
আরশি খানিকটা সময় নিয়ে জড়তার সাথে বলল-
“আমাকে মাফ করে দিস নিলু। আদ্রাফ আর কাসফিকে এক করতে গিয়ে আমি জেনে শুনেই তোকে কষ্ট দিয়ে ফেললাম। কিন্তু আমি কি করবো বল আমি তো ইচ্ছে করে তোকে কষ্ট দিতে চাইনি। ওরা দুজন একে অপরকে ভালোবেসেও আমার জন্য কষ্ট পেয়ে যাচ্ছিল তাই আমি এমনটা করেছি।”
আরশির কথায় শুনে নীলা হকচকিয়ে উঠে। নীলা তো কখনো আরশিকে এসব বলেনি। তাহলে ও কি করে জানলো!! নীলা অপ্রস্তুত হয়ে বলল-
“তুই এসব কি করে জানলি??”
আরশি হাতের উল্টো পিঠে নিজের চোখ মুছে নিলো। কিছুটা স্বাভাবিক হয়ে বলল-
“আমি ওইদিন থেকেই সব বুঝে গিয়েছিলাম যেদিন তুই আদ্রাফের কথা শুনে নিয়েছিলি। ওইদিন তোর চোখ দেখেই আমি সব বুঝে গেছি।”
নীলা মাথা নিচু করে চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে। আরশি আবারও বললো-
“তুই অস্বস্তিবোধ করবি তাই এসব নিয়ে তোকে সরাসরি কিছু বলিনি। তুই আমাকে মাফ করে দিস নিলু। আমি সব জেনেও তোর ভালোবাসার মানুষকে তোর করে দিতে পারিনি। আদ্রাফ আর কাসফি একে অপরকে ভালোবাসে তাই আমি ওদেরকে এক করে দিয়েছি। তা না হলে তোরা তিনজনই কষ্ট পেয়ে যেতি।”
কাসফিয়ার বুকটা মোচড় দিয়ে উঠলো আদ্রাফ আর কাসফিয়ার এক হয়ে যাওয়ার কথা শুনে। চিনচিনে ব্যথা অনুভব করছে নীলা। কান্না আসতে চাইছে কিন্তু এই মুহূর্তে কান্না করতে চাইছে নীলা। নিজেকে শক্ত রাখতে চাইছে ভেঙে পড়তে চায় না সে। বড় বড় কয়েকটা শ্বাস নিয়ে নীলা মাথা তুলে তাকালো। একটা মুচকি হাসি দিয়ে বলল-
“তুই একদম ঠিক করেছিস আশু। আদ্রাফ তো আমাকে ভালোই বাসে না আমিই ভুল সময়ে ভুল মানুষকে ভালোবেসে ফেলেছি। এতে অন্য কারও কোনো দোষ নেই। তোর জায়গায় আমি থাকলেও ওদের সম্পর্কটা ঠিক করে দিতাম। তাই বলছি আর কখনো যদি তোকে দেখেছি আমার কাছে মাফ চাইতে তাহলে তোর খবর আছে।”
আরশি নীলার হাসি মুখের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। মনে মনে ভাবছে নীলার এই নিখুঁত অভিনয়ের কথা। মেয়েটা কত সুন্দর করে পারছে কষ্টের মাঝেও হাসি মুখের অভিনয় করতে। আরশি নীলার দিকে তাকিয়েই শান্ত গলায় বললো-
“আমার সামনেও তুই অভিনয় করছিস নিলু!!”
আরশির কথায় নীলার হাসিটা ঠোঁটেই মিলিয়ে গেল। মুখে গাম্ভীর্যের ছাপ ফুটে উঠেছে। নীলা আরশি হাত ধরে রাস্তার দিকে হেঁটে যেতে লাগলো। আরশিও চুপচাপ নীলার সাথে হেঁটে যাচ্ছে। শহরের কোলাহলে মাঝে শুধু মাত্র এই দুটি মানুষের মাঝে এক ঝাঁক নিরবতা এসে ঝেঁকে বসেছে। ফুটপাত দিয়ে নীলা আরশির হাত ধরে হেঁটে যেতে যেতে বলল-
“জানিস আশু এই যে আমাদের আশেপাশে এতো ব্যস্ত মানুষ দেখছিস এদের সবার মনেই কিন্তু কষ্ট আছে। কারও কম আবার কারও বেশি। কেউ নিজেদের কষ্ট প্রকাশ করছে আবার কেউ নিজের মনের মধ্যে কষ্ট লুকিয়ে রেখেই হাসি মুখে ঘুরে বেরাচ্ছে। কষ্ট প্রকাশ করলেই সেটা আরও বাড়বে। নিজের সাথে সাথে আশেপাশের মানুষ গুলোও মন খারাপ করে থাকবে। এর চেয়ে বরং নিজের কষ্ট নিজের মধ্যে লুকিয়ে রেখে সবার সামনে হাসিখুশি থেকে আশেপাশের মানুষ গুলোকে ভালো রাখা টা-ই তো বুদ্ধিমানের কাজ তাই না আশু??”
আরশি চুপচাপ নীলার কথা শুনছিল। বোকাসোকা অল্পতেই গাল ফুলিয়ে বসে থাকা এই মেয়ে আজ কতটা গম্ভীর রূপ ধারন করেছে। বিজ্ঞদের মত করে কথা বলছে। নিজের মাঝেই কষ্ট লুকিয়ে রাখতে শিখে গেছে। আসলেই কষ্ট পেলে মানুষ পালটে যায়, শক্ত হয়ে যায়, আগের থেকেও বেশি জ্ঞানী হয়ে যায়। কষ্ট থেকেই হয়তো মানুষ শিক্ষা নিতে পারে। আরশি মনে মনে নিজেকেই বলতে লাগলো- “নীলা তো সত্যিই বলছে কষ্ট প্রকাশ করলেই সেটা আরও বেড়ে যায়। আমিও তো সব কষ্ট নিজের মধ্যে লুকিয়ে রাখতেই পছন্দ করি যেন অন্য কেউ বুঝতে না পারে। আমার কথা ভেবে মন খারাপ না করে সেই কারনেই তো সব সময় হাসি মুখে থাকি। তাহলে কি নিলুও আমার মতই!!” প্রচন্ড জোরে গাড়ীর হর্নের আওয়াজ কানে আসতেই আরশি ভাবনা থেকে বেরিয়ে আসলো। বিরক্তিতে চোখ মুখ খিচে আছে। শহরের এই কোলাহল আরশির একদমই ভালো লাগে না।
“একদম ঠিক বলেছিস নিলু। তুই তো দেখি খুব জ্ঞানী ব্যক্তি হয়ে গেছিস!!”
নীলা আরশির দিকে তাকিয়ে একটা হাসি দিয়ে আবারও সামনের দিকে তাকিয়ে হাঁটা শুরু করলো। কিছুটা পথ যেতেই নীলা শান্ত গলায় বলল-
“আশু আমি চাই না বাকিরা এসব ব্যাপারে কিছু জানুক। আমার ব্যাপারটা জানলে হয়তো আদ্রাফ আর কাসফি আমার সামনে আসতে অস্বস্তিবোধ করবে।”
“আর তুই???”
আরশির প্রশ্নে নীলা থমকে দাঁড়িয়ে গেল। একই জায়গায় স্থির হয়ে আছে। আরশি নীলার কাধে হাত রাখতেই নিম্ন স্বরে বলে উঠলো-
“আমার কিছু হবে না আশু। প্রথম প্রথম খারাপ লাগবে তারপর আস্তেধীরে সব ঠিক হয়ে যাবে। আজ না হোক কাল তো সত্যিটা মেনে নিতেই হবে।”
আরশি পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে বলল-
“আচ্ছা এসব বাদ দে। তুই নিশ্চিন্তে থাক আমি এমনিতেও আমাদের মাঝের কথা কাউকে কিছু বলতাম না। তাই এখন এসব বাদ দিয়ে চল ফুচকা খেতে যাই।”
আরশি নীলার হাত ধরে একপ্রকার টেনে ফুচকার দোকানের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। নীলাও মুচকি হেসে আরশির সাথে যাচ্ছে।
—————————
আরশি একদৃষ্টিতে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে। কিছুক্ষণ আগেই আদ্রাফ আরশিকে ফোন দিয়ে অনেক গুলো ধন্যবাদ জানিয়েছে। সবাইকে ট্রিট দিবে বলে প্রমিজ করেছে আর আরশির জন্য স্পেশাল ভাবে ট্রিট দিবে আরশি যা যা চায় সব আদ্রাফ মেনে নিবে। আরও নানারকম কথা বলেছে আদ্রাফ যেন খুশিতে আত্মহারা হয়ে গেছে আজ। কাসফিয়ার চোখে মুখেও খুশির ঝলক দেখা যাচ্ছে। একই গল্পের দুই চরিত্র খুশিতে মেতে উঠেছে আর অন্য দিকে আরেকজন এদের খুশি দেখেই হয়তো চোখেরজল ফেলছে। নিজের না পাওয়া ভালোবাসার মানুষটা কথা ভেবেই হয়তো একা একা ডুকরে কেঁদে উঠছে। আরশি একটা দীর্ঘশ্বা ফেললো। আরশি বুঝতে পারছে না এখন তার আদ্রাফদের কথা ভেবে খুশি থাকা উচিত নাকি নীলার জন্য কষ্ট পাওয়া উচিত। আরশি আকাশের দিকে তাকিয়েই নিজের ভাবনার জগৎতে নানারকম চিন্তাভাবনায় ব্যস্ত হয়ে আছে। কিন্তু অপর বারান্দা থেকে এক জোড়া তৃষ্ণাতুর চোখ অপলকভাবে তাকিয়ে আছে তার দিকে সেদিকে আরশির কোনো খেয়াল নেই। আজ সারাদিন আরশিকে না দেখে রৌদ্রর মন বড্ড বেশিই ছটফট করছিল। কখন আরশিকে এক নজরের জন্য দেখতে পাবে সেই অপেক্ষাতেই সারাদিন কাটিয়েছে। হাজার ব্যস্ত সময়ের মধ্যেও হুটহাট আরশির চিন্তা তীরের মতো রৌদ্রর মন মস্তিষ্কে এসে আঘাত হানে। এই মুহূর্তে আরশির এই মলিন মুখটাই রৌদ্রর কাছে মোহনীয় লাগছে। অন্ধাকারের মধ্যে চাঁদের আলোতে আরশির মুখে যেন মুগ্ধতা উপচে পরছে। আরশির চোখে জমে থাকা টলমল করা অশ্রুজল মনে হচ্ছে মুক্তার মতো চিকচিক করছে। এতেই যেন প্রচন্ড মায়াবী লাগছে আরশিকে। রৌদ্র মনে হচ্ছে আরশির দিকে এভাবে তাকিয়ে থেকেই হাজারো নির্ঘুম রাত কাটিয়ে দিতে পারবে। হঠাৎ করেই রৌদ্রর চোখ পরলো আরশির চোখে আটকে রাখা নোনাজলের এক ফোটাজল গাল বেয়ে গড়িয়ে পরলো। সেই সাথে রৌদ্রর বুকটাও ছ্যাঁত করে জ্বলে উঠেছে। খানিকটা উত্তেজিত হয়েই আরশিকে জিজ্ঞেস করে বসলো-
“মিস আরু আপনার কি কিছু হয়েছে??”
আরশির কোনো উত্তর পেলো না। আরশি এখনো আগের মতোই গভীর চিন্তা মগ্ন হয়ে আছে। রৌদ্র এবার খানিকটা উচ্চস্বরেই আরশিকে ডাক দিল-
“মিস আরু।”
রৌদ্রর এমন আকর্ষণ কাড়া ডাকে আরশির হুশ ফিরলো। তৎক্ষনাৎ পাশের বারান্দায় তাকিয়ে রৌদ্রকে দেখেই আরশি চমকে উঠলো। রেলিঙের উপর দুহাত দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে রৌদ্র। কপালে চিন্তার রেখা ভেসে উঠেছে। আরশি অন্য দিকে ফিরে রৌদ্রর চোখের আড়ালে চোখের পানি মুছে নিল। নিজেকে স্বাভাবিক করে বলল-
“জ্বি, আপনি ঠিক আছেন তো ডক্টর?? আপনাকে চিন্তিত মনে হচ্ছে।”
রৌদ্র ভ্রু কুচকে সন্দিহান কন্ঠে বললো-
“আমি ঠিক আছি কিন্তু আপনাকেই ঠিক মনে হচ্ছে না। কিছু হয়েছে আপনার?? কি নিয়ে এতোক্ষন ধরে গভীর চিন্তায় মগ্ন ছিলেন??”
চলবে….
(রিচেক করা হয়নি তাই কোনো ভুল-ত্রুটি হলে ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন। ধন্যবাদ আর ভালোবাসা সবাকে।❤️)