#যদি_দেখার_ইচ্ছে_হয়
#আফসানা_মিমি
|পর্ব: ৩|
“ তোমার অনিশ্চিত জীবনের কথা ভুলে যেও না, অন্তিক। মেয়েটাকে এভাবে ঠকানো কী ঠিক হচ্ছে?”
চাচীর ঘরে মাথা নত অবস্থায় অন্তিক। সে তার নিস্ফল জীবনের কথা ভুলেনি। না ভুলেছে জীবনের বিশেষ বেফায়দা অংশ। গাছের অপরিপক্ব ফলের ন্যায় তার জীবন। এ জীবনে মিষ্টির আগমন তার জন্যই অনর্থক। চাচীর ঘরে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র যাচাই-বাছাইয়ের সুবাদে এসেছিল সে। মাথা নত করেই অন্তিক চাচীর উদ্দেশ্যে বলে,“ আমি আমার নিষ্প্রয়োজন জীবনের কথা ভুলিনি চাচী। দাদার ওয়াদা জন্য বিয়ে করতে বাধ্য হয়েছি। মিষ্টির কোনো ক্ষতি করব না। সঠিক সময় আসলে সম্পর্ক থেকে আমিই পিছিয়ে যাবো।”
অন্তিক এক মুহূর্তের জন্যও লায়লার ঘরে অবস্থান করে না, প্রস্থান নেওয়ার আগে পিছনে ফিরে তাকালে লায়লা বেগমের বিজয়ী হাসি দেখতে পেতো!
অন্তিকের বাবা কায়েস ঘরে শুয়ে ছিলেন। বাড়ির ছোট ছেলে হলেও একাকীত্ব ও অসুস্থতায় বার্ধক্য যেন তাকে অতি শীঘ্রই পাকড়ে ধরেছে। মিষ্টি দরজার ভেতর মাথা ঢুকিয়ে শ্বশুরের অবস্থান বুঝে নেয়। মাথা সেভাবেই রেখে অনুমতি নেয় প্রবেশের, “ বাবা আসব?”
রুনা চলে যাওয়ার পর থেকে কায়েস চুপচাপ থাকে। বিশেষ কোনো কাজ করেন না। দু বেলা দু মুঠো ভাত কপালে জুটলে খান নয়তো চিঁড়ে মুড়ি খেয়ে বসে থাকেন। চোখ খুলে মিষ্টির মাথা দেখে চিনতে না পারলেও বাবা ডাকা সম্বোধন বুঝতে পারেন ছেলের নব বঁধু এসেছে। শোয়া থেকে উঠে চোখে চশমা পরে দুর্বল স্বরে উত্তর দেন, “ এসো মা।”
মিষ্টি ভেতরে প্রবেশ করে চিন্তিত কণ্ঠে বলতে শুরু করে,“ একি বাবা, আপনার স্বর দুর্বল শোনা যাচ্ছে কেন? আপনি এখনো খাননি?”
“ এই তো যাচ্ছিলাম খেতে।”
শ্বশুরের থতমত খাওয়া মিষ্টির দৃষ্টিতে এড়ায়নি। চঞ্চল মেয়েটা তৎক্ষনাৎ শ্বশুরের কাছে এসে হাত ধরে টেনে ঘর থেকে বের হতে হতে বলে,“ আপনি এখনো অনাহারে বাবা! আমার বাবা জানেন কী বলে, ‘সকাল সকাল উঠো, শরীর মন সুস্থ রাখো।’ সকাল সকাল উঠে হাঁটাহাটি না করে শুয়ে থাকলে শরীর মন আরো অসুস্থ হয়ে যাবে। আর এক বেলা না খেলে তো শরীর থেকে একটা চড়ুই সমান গোস্তো কমে যাবে।”
কায়েস মিষ্টিকে ছবিতে একবার দেখেছিল।গতকাল ব্যস্ততায় তেমন দেখা হয়নি, কথাও হয়নি।আজ দেখে সে বুঝতে পারছে মেয়েটা চঞ্চল সাথে বুদ্ধিমতী। পাকের ঘরের সাথেই খাবার ঘর। বসার ঘর পাড় করেই সেদিকে যেতে হয়। অন্তিকদের বাড়ির আগের আমলের নিয়মে করা। দুতলা বাড়ির উপরতলায় অন্তিকরা তিন ভাইবোন থাকে আর নীচতলায় মুরুব্বীরা। নাজিমউদ্দীনকে দেখে মিষ্টি থেমে যায়। মুখে হাসির রেখা টেনে জিজ্ঞেস করে,” দাদু চা দিব?”
নাজিমউদ্দীন পত্রিকা পড়ছিলেন। নাত বউয়ের কথায় অবাক চোখে তাকান। ছোট ছেলেকে নিচে আসতে দেখে মনে মনে খুশি হোন। তিনি ভেবেছিলেন, নাত বউকে প্রথমদিনেই আদব কায়দা শিখিয়ে দিবেন কিন্তু তার বলা পূর্বেই মিষ্টির মিষ্টি ডাক মোটেও আশা করেননি। মনে মনে তিনি খুশি হলেন। পত্রিকা মুখের সামনে ধরে বলেন,“ বেশ ভালো, প্রথমদিন থেকেই সংসার বুঝতে চেষ্টা করছো। কড়া লিকার দিয়ে এক কাপ চা আনো, আর চিনি এক চামচ দিবে।”
বসারঘর পাড় হতেই লায়লা বেগম কামরা থেকে বের হয়ে আসেন। শ্বশুরকে বসার ঘরে পেয়ে মাথার ঘোমটা লম্বা করে টেনে খাবারঘরে প্রবেশ করে চক্ষু চড়কগাছ হয়ে যায়। কায়েস রুটির সাথে আলুভাজি মাখিয়ে খাচ্ছে। এই সময়ে লায়লা বেগম এই দৃশ্য দেখবেন তা প্রত্যাশা করেননি। দুইবেলা ভাত সে কায়েসের ঘরে পাঠালে তবেই গিলতে পারে নচেৎ অনাহারে থেকে যায়। লায়লা এই কাজটি ইচ্ছে করেই খুবই নিপুনভাবে সম্পন্ন করেন শ্বশুর ও স্বামীর আড়ালে। কায়েসও ভাবীকে দেখে ইতঃস্তত বোধ করেন মিনমিন করে বলেন, “ নতুন বউ নিয়ে আসলো।”
লায়লা বেগমের মুখটা পানসে রূপ ধারণ করে নতুন বউয়ের কথা শুনে। প্রথম দিনেই চুলারঘর দখল করে নিয়েছে ভবিষ্যতে তো তার এই সাম্রাজ্যের সাম্রাজ্ঞী হয়ে রাজ করবে। এসব ভাবনায় আসতেই লায়লার টনক নড়ে। ধাপাধপ পা ফেলে চুলারঘরে মিষ্টিকে চা বানাতে দেখে কুবুদ্ধি মাথায় আটে। নব বঁধু যদি চা আনার সময় চাচী শাশুড়ির হাত পু’ড়ে ফেলে সেটা খারাপ দেখায়! বুদ্ধিটা মাথায় আসতেই বিশ্রী হাসে লায়লা বেগম। সে দুয়ারের দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতে থাকে নতুন বউয়ের ফেরার।
“বেশি বুদ্ধি হলে পতন অনিবার্য” বাংলা ব্যাকরণে এই প্রবাদ পড়েনি এমন কেউ নেই। লায়লা বেগমের কুবুদ্ধি মিষ্টির জন্য অনিষ্ট ঝুঁকি নিয়ে আসে। মিষ্টির গগনবিদারী চিৎকারে মোল্লাবাড়ির জমিন আসমান কেঁপে উঠে। লায়লা এহেন পরিস্থিতির জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিলেন না। ফর্সা ত্বক লালচে রূপ ধারণ করেছে। নাজিমউদ্দীন ও কায়েস তাদের কাজ ফেলে দ্রুত এসে পাকঘরের দৃশ্য দেখে থমকে যান। পাকঘরের দৃশ্যটা ঠিক এরকম, ‘মিষ্টি হাত ধরে কান্না করছে আর লায়লা বেগমের হাতে চায়ের পাত্র।’ অন্তিকের দাদা ও বাবার যা বুঝার তা বুঝে গিয়েছেন। নাজিমউদ্দীন হুঙ্কার ছাড়েন,“ বুদ্ধি তোমার লোপ পাইছে, বউমা? এতটুকু বাচ্চা তোমার কী ক্ষতি করছে। আগুনে পু’ড়া’ই’তে চাইলে নিজের সন্তানগোরে পু’ড়া’ও। নাত বউয়ের ধারেকাছেও আসবা না।”
“ আব্বা,আমি তো দা,,,,,
লায়লা বেগম মুখ খুলতে নিতেই আবারো নাজিমউদ্দীনের আক্রোশের শিকার হোন, “ খবরদার বউমা, মিছা বইলা সাফাই গাইতে হইবো না। তোমার স্বভাব সম্পর্কে আমার জানা আছে।”
অন্তিকের বাবা ও দাদা মিলে মিষ্টিকে চুলারঘর থেকে বের করে আনেন। মিষ্টি কাঁদো কাঁদো চোখে লায়লা বেগমের দিক হাত বাড়িয়ে দিয়ে ইশারায় বলে, “ ঘুঘু দেখেছ ফাঁদ দেখোনি? নিয়ম ভেঙে প্রথম ঘুঘু তোমার ফাঁদে তোমাকেই ফেলল।”
লায়লা বেগম বিস্ফোরিত নয়নে তাকান। এতটুকু বাচ্চা মেয়ে তাঁকে কীভাবে শায়েস্তা করল সব যেন মাথার উপর দিয়ে গেলো। হাতের পাত্রখানা সজোরে জমিনে ফেলে ফুসফুস করতে থাকেন।
—————————
অফিসে মাত্রই পৌঁছেছিল অন্তিক। দাদার কল আসায় অনুমতি না নিয়েই অফিস থেকে বের হয়ে আসে সে।অবশ্য অফিসের গেইটে জিজ্ঞাসাবাদের সম্মুখীন হতে হয়েছে। সত্য মিথ্যা বানিয়ে বলে সে বের হয়ে আসে। ব্যাস্তময় শহরের যানজট ফেলে প্রায় দুই ঘণ্টা পর বাসায় ফিরে অন্তিক। দাদার কথামতো বার্ন ক্রিম নিয়ে এসেছে সে। বাড়ি প্রবেশ করে কাউকে কিছুনা বলে চাচীর ঘরে প্রবেশ করে অন্তিক। লায়লা বেগম তখন ফোনে কারো কাছে নালিশ করতে ব্যাস্ত ছিল। অন্তিককে দেখে মনের সকল ঝাল তিনি ছেড়ে দেন, “ আসছো? নতুন বউকে এখনই আমার বিরুদ্ধে ফুসলিয়ে দিয়ে কী তুমি সত্যিকে ঢেকে রাখতে পারবে? তুমি ঐ মেয়েকে আজই বাপের বাড়ি রেখে আসবে, নয়তো আমি সত্যিটা মেয়ের বাবা মাকে জানাবো। কত বড়ো সাহস! আমাকে বকা খাওয়ানো!”
অন্তিক বরাবরের মতোই নত মাথায় সবটা শুনে যায়।অন্তিকের মতো কিছু অসহায় ছেলে আজো পৃথিবীতে আছে। যাদের নিশ্বাস গ্রহণ ত্যাগ করতে গেলেও হিসাব করে নিতে হয়। নচেৎ লায়লা নামক কিছু সমাজের কিট পতঙ্গ তাদের কুরে কুরে খায়।
“ মলমটা এনেছিলাম, চাচী।”
কথাটা যেন যথেষ্ট ছিল লায়লা বেগমের গরম মাথা আরো গরম করতে। সে টগবগিয়ে জ্বলে উঠে বলে, “ এখন কী ঐ মেয়েকে আমার মলম পট্টি পরাতে হবে? পারব না। এই লায়লা বেগম বড়ো বড়ো মানুষদের জীবন জাহান্নাম বানাতে পারলে, হাঁটুর বয়সী মেয়ের জীবন শেষ করে দিতে একদিনের সময় লাগবে।”
অন্তিক বুঝতে পারে বার্ন ক্রিম কার প্রয়োজন। সে গভীর নিঃশ্বাস ত্যাগ করে নিজের ঘরের দিকে এগিয়ে যায়।
মিষ্টি তখন শাড়ির আঁচল ঠিক করছিল। এক হাতে পেরে উঠছিল না। অসহ্য হয়ে সে শাড়ির আঁচল জমিলে ফেলে দেয় ঠিকএই মুহূর্তেই অন্তিক ঘরে প্রবেশ করে। মিষ্টির অর্ধ বস্ত্রে ডাকা শরীর দেখে চোখ জোড়া বড়ে করে নেয়। মিষ্টিও অবাক সে বোকা স্বরে অন্তিকের উদ্দেশ্যে বলে, “ দাদী বলেছিল, “ বউয়ের শাড়ির আঁচল তুলে দিলে সওয়াব হয়। অন্তু আপনি কী শুনছেন, আমার কথা!”
চলবে…………
[ আজ সারাদিন প্রচুর লোডশেডিং হয়েছে।গল্প পোস্ট করার মুহূর্তেই কারেন্ট চলে গিয়েছে। দেরী হয়ে গেছে তার জন্য দুঃখিত।]
টাইপোগ্রাফি করেছে আমার নীরু @তানিয়া মহি