স্বচ্ছ_প্রেমের_পদ্মপুকুর #লেখা_চাঁদনী_ইসলাম #পর্ব_০৫

0
727

#স্বচ্ছ_প্রেমের_পদ্মপুকুর
#লেখা_চাঁদনী_ইসলাম
#পর্ব_০৫

সূর্য মাথার উপরে হেলে পরছে।পথিকরা নীড়ে ফেরায় ব্যস্ত।সারাদিনের ক্লান্তিতে শরীরটা জীর্ণশীর্ণ বানিয়ে দিয়েছে যেন।এমন একটা অবস্থা,পুরো শরীর ঝারলে আধা কেজি করে বালি বের হবে।
আসাদ আজ সকালে বাসা থেকে বের হয়েছে।এখনো বাসায় যায়নি।আসলে এই গুলো আসাদ কেন করে? তার কি প্রয়োজন এই গুলো করার?এই যে ক্লাস, রাত জেগে পড়াশোনা। তার উপর দুইটা টিউশন।
আসাদের সবচেয়ে ভালো বন্ধু রাকিবের প্রশ্ন এই গুলো কেন করে আসাদ?

_ আজ তোর কি হয়েছে? আর হ্যাঁ একটা কথা বল তো, তুই কেন এই গুলো করিস?

আসাদ রাকিবের কথা শুনে মোটা একটা গাছের গোড়ায় বসে।

_ এখানে বস,বলছি।

_ বাসায় কখন যাবি? সারাদিন পেটে কিছু পরেছে?

_ স্টুডেন্টের বাসায় দাওয়াত ছিলো।ওখানে খেয়েছি।

_ নিজে পড়াশোনা করে টিউশনি করাতে ভালো লাগে তোর? তাও তুই যেই পরিবারে মানুষ, সেই পরিবার থেকে কি এই গুলো তোর সাথে যায়?

_ সবার আগে আমি একজন মানুষ, আর মানুষের শখের উপরে আর কিছু নেই।এইটা জানিস?

_ টিউশনি করানো তোর একটা শখ?

_ আমার শখ নিজের টাকায় হাত খরচ করা।নিজে ইনকাম করে নিজের জন্য খরচ করা।

_ তাই বলে টিউশনি?

_ আমাকে এখন চাকরি দিবে কে বল।দুইটা টিউশনি করাই,মাস শেষে আট হাজার টাকা পকেটে চলে আসে।ইচ্ছে মতো খরচ করি।

_ তুই শুধু টাকার জন্য এতো পরিশ্রম করিস?আংকেলের তো অনেক টাকা।

_ বাবার অনেক টাকা ঠিক আছে। কিন্তু আমি নিজের জন্য কি করছি। আমি ডি আইজি আজিজুল হকের একমাত্র সন্তান। আমি আমার বাবার পরিচয়ে না।আমার নিজের পরিচয়েও বাবাকে পরিচয় করাতে চাই।যেমন আমার দাদুকে এলাকার সবাই বলে ডি আই জি আজিজুল হকের বাবা।ঠিক তেমনটা আমিও চাই।আর এখন থেকেই সেই চেষ্টাই আছি।আমার কষ্ট হয় না।আমার ভালো লাগে।আমি নিজে যতটুকু পড়াশোনা করি।টিউশনটাও আমার পড়ার একটা অংশ।আমার প্রাকটিস হয়।আমি আরও কিছু জানার আগ্রহ পাই।

_ আংকেল আন্টি তোকে কিছু বলে না?

_ তারা জানলে তো বলবে।আর আমি সবাইকে পরিচয় দিয়ে বেড়াই না আমি ডি আইজির ছেলে।আমার খুব কাছের মানুষ ছাড়া আমার সম্পর্কে এতো কিছু কাউকে বলিনা।আমি আমার মতো করে চলতে চাই।নিজেকে নিয়ে এগোতে চাই।আমার দাদুর কিন্তু টাকা পয়সা কম ছিলো না।তবুও আব্বু টিউশনি করাতো।নিজের খরচ চালাতো।আব্বুর গল্প শুনেই অনুপ্রেরণা পেয়েছি।

_ আমাকেও দুই একটা টিউশনি খুঁজে দিস তো।

_ এবার পথে এসেছিস?

_ তোর মতো বিপথে কবে চললাম শালা।

_ শালা বলে লাভ নেই।আমার বোন টোন নেই ভাই।

_ নিরু কি তোর খালা লাগে?

_ ও আমার যায় লাগুক।তোর জেনে কাজ কি? খবরদার নজর দিবি না।

_ তোর বোন মানেই আমার…

_ তোর কেউ না।শোন একটু চিন্তায় আছি।

_ এই জন্যই তো প্রথমেই বললাম তোর কি হয়েছে।কোন সমস্যা দোস্ত?

_ অনিমা কে নিয়ে,ওর জন্য স্যার লাগবে।একদম পড়াশোনায় মনোযোগ নেই।

_ কেন আগের স্যার কি হয়েছে?

আসাদ রাকিবকে সেদিনের ঘটনাটা সংক্ষেপে বলল।

_ এক কাজ কর আর কাউকে ভরসা করে বাসায় নিয়ে যাস না।তুই পড়া।তোর জিনিস তুই সামলা, সামনে থেকে ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে থাক।যা করার তুই কর।

_ আমিও এইটাই ভাবছিলাম। সেদিনের পর থেকে ওর পাশে কাউকে সহ্য করতে পারছিনা।আমি কি ওই পিচ্চিটার প্রেমে পড়ছি রাকিব?

_ পড়ছিস না,পড়ে গেছিস। সে আজ থেকে না বহু দিন হলো।

_ তুই জানলি কিভাবে?

_ স্কুলে দিয়ে আসিস।স্কুল ছুটি হওয়ার আগেই যেয়ে দাঁড়িয়ে থাকিস।কোন ছেলেকে ঘেঁষতে দিস না।এই গুলো কি এমনি এমনি মামা?

_ জানিনা ওর জন্য আমার কি হয়।কিন্তু ওকে এক বেলা দেখতে না পেলে বুকের মধ্যে কেমন যেন করে।ঘুম হয় না।শান্তি পাই না।ওর হাসি মুখ দেখার জন্য অধীর আগ্রহে চেয়ে থাকি।ওর মন খারাপ দেখলে পুরো আকাশ মেঘলা লাগে।আমার বুকে আঁধার নেমে আসে।এই গুলো কেন হয়?

_ তোর এই বুকে নিরুর জন্য প্রচন্ড পরিমাণ মায়া।

_ ওই পিচ্চিকে এইসব কিভাবে বোঝাবো?

_ পিচ্চি কি আজীবন পিচ্চিই থাকবে?

_ বড় হতে অনেক দেরি।আর ও অন্য মেয়েদের মতো না।হাসে না,তেমন কারো সাথে মেশে না।শুধু আব্বুর সাথে একটু হেসে কথা বলে।তাও যখন ওর আশপাশে কেউ থাকে না।দৌড়ে এসেও সেই হাসিমাখা মুখ আর দেখতে পাই না।

_ প্রেয়সীর স্যার হয়ে যাও।তারপর প্রেমে ফেলে দাও।কেস খতম মামা।

_ যতটা সহজ ভাবে বলছিস,ততটাও সহজ না।

_ তাহলে মামা রিংকি মামির সাথে শুরু করে দাও।তোমার জন্য পাগল হয়ে আছে।

_ তোমার মামি যদি কেউ হয়, অনিমা রহমান-ই হবে।

_ রিংকি আমাকে ম্যাসেঞ্জারে মেসেজ দিয়ে তোর খোঁজ নিচ্ছে বুঝলি।

_ আমার খোঁজ কেন?

_ এডমিশন কোচিং কোথায় করবি এই গুলো জানার জন্য,

_ ওহ আচ্ছা।

_ তোকে এতো ক্লান্ত লাগছে কেন?

_ শান্তি পাচ্ছি না দোস্ত, খুব অস্থির লাগছে।

_ তোকে তো চিন্তামুক্ত করেই দিলাম।

_ হ্যাঁ বাসায় যেয়ে আব্বুকে জানাবো।কি বলে দেখি।

_ ট্রিট দিস।

_ একবারে ছাদনাতলায় দেবো।অপেক্ষা কর।

_ তোকে আর ট্রিট দিতে হবে না,বাসায় যা।

রাতের খাবার শেষ করে আসাদ নিরুর বিষয়ে বাবার সাথে কথা বলে।নিজেই বলে বাইরের কোন স্যার দরকার নেই।আসাদ বাসাতে যতদিন আছে ততদিন নিজেই পড়াবে।আর মনে মনে ভেবে নিলো, যখন বাইরে চলে যাবে।তখন নিরুর জন্য মেয়ে টিচার বাসায় রেখে যাবে।আজিজুল হক আসাদের সিদ্ধান্তে সায় দিলেন।এখন থেকে আসাদ-ই নিরুকে পড়াবে।

_ আব্বু অনিমার কি আজ খাওয়া হয়ে গেছে। খেতে এলো না যে?

_ নিরু তো বাসায় নেই।ওর ফুপিরা চাচিরা সবাই এক জায়গায় হয়েছে। তাই নিরুর চাচা এসে দুপুরে নিয়ে গেছে।

_ ওর তো কয়দিন পর পরীক্ষা।

_ আমি যাবো পরশু নিয়ে আসবো।

আসাদ নিরুর রুম থেকে গণিত বইটা নিয়ে নিজের রুমে গেল।এই দুইদিনে পুরো বইটা আয়ত্ত করে নিতে হবে। নিরুর কাছে বেস্ট টিচার তো হতেই হবে। ধ্যাত,ওর ফুপিরা আর একত্র হওয়ার দিন পেল না।দুই দু’টো দিন কি, না দেখে থাকা যায়?

আসাদ লাইব্রেরি ভবনের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। রাকিব সেই কখন বলেছে আসছি।এখনও খোঁজ নেই।মেয়ে মানুষের কার্বন কপি, দশ মিনিট বলেছে আধা ঘন্টা তো লাগবেই।

_ এই আসাদ তুমি ক্লাসে যাওনি?

_ হ্যাঁ ক্লাস করলাম তো।

_ আমি মাত্র আসলাম।প্রথম ক্লাসটা করতে পারলাম না।

_ ওহ আচ্ছা।

_ তুমি কি আমাকে একটা সাহায্য করতে পারবে?

_ হ্যাঁ বলো।

_ আমার আইসিটি ম্যাথে সমস্যা হচ্ছে।আমাকে আজ বিকেলে একটু সময় দিতে পারবে?

_ বিকেলে তো আমার কাজ আছে।

_ খুব গুরুত্বপূর্ণ কাজ?

_ হ্যাঁ গুরুত্বপূর্ণ কাজ,অনিমাকে পড়াতে হবে।তুমি বরং এক কাজ করো ক্লাস টাইমে বুঝে নিও।আর হ্যাঁ তুমি ক্লাসে স্যারের কাছ থেকেও সাহায্য নিতে পারো।

_ রিংকি আর কথা এগোলো না।সোজা চলে গেল।

পিছন থেকে রাকিব এসে আসাদের কাঁধ চাপড়িয়ে বলল।

_ তুই সকালে বললি অনিমা বাসায় নেই।এখন রিংকিকে বললি অনিমাকে পড়াবি।অনিমা কি চলে এসেছে?

_ না রে, অনিমা তো কাল আসবে।

_ তাহলে রিংকি সুন্দরীকে মিথ্যা বললি কেন?

_ অনিমাকে আজ হোক বা কাল, বিকেল থেকে তো পড়াতে হবে তাই না। আর অনিমা আছে কি নেই এইটা ফ্যাক্ট নয়।আমার অন্য কারো সঙ্গ ভালো লাগে না। কোন মেয়ে আমার আশেপাশে থাকলে মনে হয়। অনিমা কাঁদো কাঁদো মুখে আমার দিকে তাকিয়ে আছে।

রাকিব শব্দ করে হেসে ফেলল।আসাদকে টানতে টানতে ক্যান্টিনের দিকে নিয়ে গেল।এখন গরম গরম সিঙ্গারা খেতে হবে,আর সাথে আড্ডা!

অনিমা সীতাকুণ্ডে এসে আসাদের কাছে পড়া শুরু করেছে।সকালে অনিমা বার বার ঘুমে নেতিয়ে পরলেও আসাদ কিছু বলে না। চুপচাপ ওর দিকে মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। নিরু সাদা ফর্সা না।হলদে বরণ গায়ের রঙ,মুখটা গলুমলু। কি পরিমাণ যে মায়া ওই মুখে,ঘন ভ্রু জোড়ার নিচে চোখ দু’টোতে যেন এক সাগর জল,সময়ে অসময়ে চোখ দু’টো টলমল করে ওঠে।নিরুর ত্বকটা অসম্ভব সুন্দর, ভোরের মোলায়েম আলোয় নিরুর এক গোছা চুল যখন গালে এসে পড়ে, আসাদের বুকটা ধড়ফড়িয়ে উঠে। এই মেয়ের আশেপাশে থাকা সম্ভব নয়!একদমই সম্ভব নয়।

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here