স্বচ্ছ_প্রেমের_পদ্মপুকুর #লেখা_চাঁদনী_ইসলাম #পর্ব_২২

0
538

#স্বচ্ছ_প্রেমের_পদ্মপুকুর
#লেখা_চাঁদনী_ইসলাম
#পর্ব_২২

আসাদ নিরুকে নিয়ে চন্দ্রনাথ পাহাড় থেকে বিকেলের মধ্যে বাড়ি চলে এলো।সবাই মিলে আজ অনেক মজা করেছে।দুজনের মনের বিষন্নতা কেটে নতুন কিছু অনুভূতির সূচনা হয়েছে।
আসাদ পরের দিন সকালে ঢাকায় চলে গেছে। কিছুদিনের মধ্যে নিরুর এস এস সি রেজাল্ট দিবে।সব সময় বাড়িতেই থাকে আর সুযোগ পেলে মামানির ফোন থেকে আসাদের সাথে মেসেজে কথা বলে।এইভাবেই নিরুর সময় যাচ্ছে।
নিরু কিছুদিন থেকে একটা জিনিস উপলব্ধি করছে।আগে কেমন ঠুনকো জিনিস নিয়ে না বুঝে অভিমান করে বসে থাকতো।আকাশ পাতাল এক করে কতো কিছু নিজের মতো করে ভেবে নিতো, কি বোকামিটাই না করতো!এখন আর ওই গুলো কিছুই হয় না। যতদিন যাচ্ছে আসাদের প্রতি মায়া গভীর ভালবাসা তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে যেন।নিরু আনমনেই হেসে আওড়ালো, ‘কিশোরী মনে প্রেম বলে কথা ওইটুকু বোকামি অভিমান করাই যায়।’
কিন্তু এখন নিরু নিজেই বুঝতে পারে আগের মতো নির্বোধ আর নেই।এখন অনেক কঠিন ভাবনা মনে আসে।যেগুলো আসাদের সাথেও বলতে পারে না।

নিরুর রেজাল্ট দেওয়ার দু’দিন আগে রাজশাহী থেকে খবর এলো নিরুর দাদী স্ট্রোক করে মারা গেছেন।আজিজুল হক আমিনা বেগম রাতেই নিরুকে নিয়ে রাজশাহীতে রওনা দিলেন।আসাদের সেমিস্টারের জন্য আসাদ যেতে পারলো না।আজিজুল হক চারদিন থেকে নিরুকে সঙ্গে করেই সীতাকুণ্ডে চলে আসলেন।

তার দশদিন পরেই আজিজুল হক জানালেন ঢাকাতে পোস্টিং হয়েছে।টুকটাক করে গোছগাছ শুরু করে দিতে বললেন।একদিকে নিরু ভীষণ খুশি হলেও অন্যদিকে বুকে চাপা ব্যাথা অনুভব করল। রাহিমা বাহারি এই দু’টো মানুষ নিরুর এতোটাই কাছের ওদের ছেড়ে যেতে হবে ভাবলেই বুক ভার হয়ে আসছে।বাহারী আর রাহিমার কাছ থেকে বিদায় নেওয়াটা নিরুর জীবনে দ্বিতীয় বারের মতো বুক পুড়ে খরা নামা।মা বাবা হারানোর পর থেকে আজকের এই দিনটাও নিরুর জন্য খুবই যন্ত্রণার।নিরু সীতাকুণ্ড থেকে বিদায় নেওয়ার সময় মনে মনে প্রতিজ্ঞা করল, ‘জীবন থাকতে আর কোথাও গিয়ে কারো সাথে অন্তত বন্ধুত্ব আর করবে না।’ এই উড়ে বেড়ানো জীবনে আর যায় হোক বন্ধুত্ব করার মতো বোকামি কিছু নেই।এই যে ছেড়ে যাওয়া, জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে ফেলা।বুক ভার হয়ে দম বন্ধ হয়ে আসা, এতো কষ্ট হবে জানলে নিরু কখনো ওই দুটো মানুষকে এতো ভালবাসতো না।ছেড়ে যাওয়া, হারিয়ে যাওয়া এই গুলো নিরু আর নিতে পারে না।

নিরুরা ঢাকায় এসে আসাদের জন্য নেওয়া ফ্ল্যাটটাতে শিফট হয়ে যায়।আগে আসাদ আর আসাদের দুজন বন্ধু থাকতো।আজিজুল হকরা আসার পর আসাদের বন্ধু দু’টো মেসে উঠে যায়।আমিনা বেগম আবার নতুন করে সংসার সাজাতে ব্যস্ত হয়ে গেলেন।এই এক জীবনে এই একটাই সংসার কতবার যে ভাঙলো আর সাজালো সেই হিসেব আর নেই।নিরু হাতে হাতে আমিনা বেগমকে সাহায্য করলো।আসাদ ও অনেকটা কাজ এগিয়ে দিলো।সবাই মিলেই পুরো বাড়িটা নিজেদের মতো করে সাজিয়ে নিলো।আমিনা বেগম ও খুব খুশি ছেলেকে নিয়ে কত চিন্তা হতো এখন অন্তত চিন্তামুক্ত হলো।কিন্তু সীতাকুণ্ডের বাড়িটা, বারান্দায় দাঁড়িয়ে পাহাড়ের দিকে তাকিয়ে থাকা, পাহাড়ের দিকে তাকিয়ে নিজের ব্যক্তিগত সময় কাটানো ওই গুলো খুব মিস করছে।তারপরও পুরো পরিবার নিয়ে থাকতে পারছে আমিনা বেগম এতেই অনেক বেশি খুশি।

নিরুকে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় স্কুল ও কলেজে ভর্তি করিয়ে দেয়।নিরুর এই নতুন জায়গাটা একদম পছন্দ হয়নি।পাহাড়ি এলাকায় নিরিবিলিতে থেকে এসে এই জায়গাটা নিরুর কাছে বড্ড অসহনীয় লাগছে।নিরু ক্লাস শেষ করে ক্লাস থেকে বের হচ্ছিলো।আসাদ ক্যাম্পাস থেকে সোজা নিরুর কলেজে যায়।শ্রেণি কক্ষ থেকে সামনেই আসাদকে দেখে নিরু এগিয়ে আসে।

“কখন এসেছেন?”

“এইতো মাত্রই আসলাম।ক্যাম্পাস ঘুরে দেখাবো চল।”

“বাড়ি যাবো ভালো লাগছে না।”

আসাদ নিরুকে নিয়ে বাম পাশের রাস্তাটায় হাঁটতে হাঁটতে জিজ্ঞেস করল, “মন খারাপ কেন?”

নিরু কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল, “আমার এখানে একদম ভালো লাগছে না, মন টিকছেনা।”

“নতুন বন্ধু হয়নি?”

“আমি আর নতুন বন্ধু চাই না।”

“নিরু এখানে আমি আছি তাও তোর ভালো লাগছেনা?”

“আপনি আছেন বলেই হয়তো নিঃশ্বাসটুকু এখানে এসে নিতে পারছি।আপনি সীতাকুণ্ডে না থাকলেও সব সময় আমার অনুভূতি গুলোতে মিশে থাকতেন।আপনার সব কিছু আমি অনুভব করতে পারতাম।মনে শান্তি ছিলো।এখানে এসে আমি কেমন যেন হারিয়ে ফেলছি।”

“নতুন জায়গা বলে এমন লাগছে।সব ঠিক হয়ে যাবে।”

নিরু গলার স্বর খাদে নামিয়ে বলল, “আসাদ ভাই সীতাকুণ্ডে ওই পাহাড়ি এলাকায় আমাকে একটা বাড়ি বানিয়ে দিবেন?”

“ওখানে বাড়ি বানিয়ে ওখানেই সেটেল্ড হয়ে যাবো।আব্বুকে বলবো রিটায়ার্ডের পর ওখানেই যেন সেটেল্ড হয়।”

“আমার নিজের একটা বাড়ি চাই।আব্বুর টাকা গুলো দাদু আমার নামে একাউন্ট খুলে রেখেছে।ওখান থেকে একটা বাড়ি করতে চাই।আপনি আমার এই শখটা পূরণ করবেন?”

“আমাকে কয়টা বছর সময় দিবি।আমি নিজেই তোর নিজের জন্য বাড়ি করে দেবো।তারপর ওই বাড়িতে আমাকে ভাড়াটিয়া হিসেবে রাখবি।আমি সারাদিন তোকে দেখবো।”

“শয়তানি করছেন তো?আমি কিন্তু মজা করছি না।”

“মজা করছি না। তুই আর আমি ওখানেই ঘর বাঁধবো।ক্যাম্পাসে যাবি না?”

” আজ না অন্যদিন যাবো। খিদে পেয়েছে খুব।”

“ক্যান্টিনে চল।”

“বাড়ি গিয়ে ভাত খাবো চলেন।”

“নিরু চল বিয়ে করে ফেলি।”

“মামানি বাড়ি থেকে আপনাকে বের করে দিবে।”

“আরও ভালো হবে।দুজনে দূর পাহাড়ে গিয়ে ঘর বাঁধবো।”

নিরু হেসে ফেলল।আসাদ নিরুর মুখের দিকে একবার তাকিয়ে বলল, “বহুদিন আগে একটা কবিতা লিখেছিলাম শুনবি?”

“হ্যাঁ বলুন!”

আসাদ নিরুকে নিয়ে ক্যাম্পাসেই বসলো বাদামওয়ালার কাছ থেকে বাদাম নিয়ে খোলা ছাড়িয়ে নিরুর হাতে বাদাম গুলো দিতে দিতে কবিতা আবৃত্তি করলো।

মনের মতো একজন মানুষ পাইলে,
দূর পাহাড়ে ঘর বাঁধিতাম।
গাছ পাখি লতা পাতা মিলিয়েই,
তোমার লাগি চড়ুইপাখির সংসার পাতিতাম।
কিসের কোলাহল,কিসের দাপট,
সবই তো বৃথা মোহ!
মন বুঝিলে মনের সনে,
তোমার লগেই আঁখি জুড়িতাম।
মানুষবিহীন পাহাড় চূড়ায়,
তোমারেই লালন করিতাম।

ওহে প্রিয় তোমারে যদি পাইয়া যাইতাম,
তোমার কানে আগলে রাখার মন্ত্র দিতাম।
বোঝায় দিতাম, এই আমিটা ভীষণ উচাটন তোমার জন্য,
তাই তো আমি তোমায় ভেবে,
দূর পাহাড়ে সঙ্গ দিতাম…!

নিরু মন্ত্রমুগ্ধের মতো আসাদের আবৃত্তি শুনছিলো।আসাদ নিরুর চোখে চোখ রেখে বলল, “মনের মতো মানুষ পেয়ে গেছি।দূর পাহাড়ে ঘর তো বাঁধতেই হয় তাই না?”

নিরু আনন্দিত হয়ে বলল, “চলুন তাহলে দূর পাহাড়ে ঘর বাধি।গাছ পাখি লতাপাতা মিলিয়েই আপনার লাগি চড়ুইপাখির সংসার পাতি।”

আসাদ নিরুর নাকটা টেনে দিয়ে বলল, “ভালবাসি হঠাৎ ম্যাচিউর হয়ে উঠা এই বোকা অভিমানিকে!”

আসাদের ভালবাসি বলার ধরণ দেখে নিরু হেসে ফেলল।নিরুদের কাছ থেকে তিন হাত মতো দূরে দু’টো পাখি এসে বসলো নিরু আসাদের হাত থেকে খোলা ছাড়িয়ে রাখা বাদাম নিয়ে দুভাগ করে পাখি দুটোর দিকে আস্তে করে এগিয়ে দিলো।নিরুকে অবাক করে দিয়ে পাখি দুটো দু’টুকরো বাদাম ঠোঁটে নিলো।নিরু আপ্লুত হয়ে পাখি গুলোকে আরও কিছু বাদাম দিলো।নিরুর চোখে মুখে হাসির রেখা চিকচিক করছে।আসাদ মুগ্ধ নয়নে নিরুর এই আনন্দ উপভোগ করছে।
দুজন দুজনের প্রতি এই মুগ্ধ দৃষ্টিটাই যেন ওদের ভালবাসা দ্বিগুণ করে তুলছে।

হঠাৎ করে প্রচন্ড মেঘ হওয়ায় আসাদ নিরুকে নিয়ে বাড়ির উদ্দেশ্য বের হলো।কয়েক মিনিটের মধ্যে আকাশে কালো মেঘের আস্তরণ পরেছে।চারপাশ অন্ধকার নেমে এসেছে, ঝড়ো বাতাস বইছে।বাড়ি পৌছানোর আগেই দমকা হাওয়ার সাথে বড় বড় ফোঁটার বৃষ্টি শুরু হয়েছে।দুজনেই অনেকটা ভিজে গেছে।বাড়ি পৌছিয়ে আসাদ বাথরুমে ঢোকে।আর নিরু সোজা ছাদে যায়।পুরো শহরটা নিরবিলি লাগছে।আজ সে ভিজবে বৃষ্টির ফোটায় নিজেকে সেই নিরিবিলি পাহাড়ি এলাকায় অনুভব করবে।আবার ফিরতে চায় ভেজা পাহাড়ি বুনোফুলের মধ্যে,বিশাল সেই পাহাড়ি গন্ধে!

চলবে…..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here