#স্বচ্ছ_প্রেমের_পদ্মপুকুর
#লেখা_চাঁদনী_ইসলাম
#পর্ব_২৩
গতকাল আসাদের বড় মামার ছেলে রোহানের বিয়ের যাবতীয় কাজ শেষ হলো।আজিজুল হক পুরো পরিবার নিয়ে বিয়েতে উপস্থিত হয়েছিলেন।হৈ-হুল্লোড়ে বিয়ে বাড়ির আমেজে সবাই মেতে ছিলেন একটা সপ্তাহ। সবচেয়ে বেশি খুশি ছিলো আসাদ। তার বুক থেকে বিশাল এক পাথর নেমে গেছে।স্বস্তি নিয়ে বিয়েতে খুব মজা করেছে।নিরুর দাদুদের ও নিমন্ত্রণ করা হয়েছিলো।নিরুর দাদু বিয়েতে উপস্থিত হয়েছিলেন।আসাদরা বড় মামার বাড়ি থেকে আজকেই নিজেদের বাড়ি চলে যাবে।আসাদের খালামণি মনিকা আসাদকে নিজেদের সঙ্গে ঘুরতে যাওয়ার জন্য জোড়াজুড়ি করছিলেন।আমিনা বেগম ও যেতে বললেন কিন্তু আসাদ সেমিস্টারের দোহাই দিয়ে গেল না।
বড় মামার বাড়ি থেকে আসার পরের দিনই আসাদ জ্বরে পড়লো।গা কাপিয়ে জ্বর হলো।ডক্টর দেখিয়ে ইনজেকশন করেও পুরোপুরি জ্বর নামলো না।ঔষধ খাওয়ার পর এক ঘন্টা মতো জ্বর কমে আসে,আবার গা কাঁপিয়ে জ্বর আসে।না পেরে আজিজুল হক হসপিটালে ভর্তি করেন।তিনদিন হসপিটালে ট্রিটমেন্ট করিয়ে বাসায় আনেন।জ্বরটা কমে এলেও শরীর পুরো দূর্বল হয়ে গেছে,খিদে নেই, চোখ মুখের বাজে অবস্থা।
আমিনা বেগম সারাদিন ছেলের কাছে বসে থাকেন।নিরু নিত্যনতুন খাবার বানায় আসাদের জন্য, কিন্তু আসাদ খেতে পারে না।নিরু মসুর ডালের বড়া থেকে যত মুখরোচক খাবার আছে সব গুলো একবেলা করে বানায়।
গত দু’দিন থেকে আসাদের পরিবর্তন এসেছে।এখন অনেকটা সুস্থ।
আমিনা বেগমের বড় ভাবি ছালমা অসুস্থ হয়ে যাওয়ায় ভোরের দিকে আজিজুল হক আমিনা বেগমকে রেখে আসেন।নিরু সকালের নাস্তা বানিয়ে আজিজুল হক ও আসাদকে খেতে দেয়,তারপর কলেজে যায়।আসাদ পুরোপুরি সুস্থ নয় ক্যাম্পাসে না গিয়ে রাকিবকে বাড়িতে ডেকে নিলো।রাকিব এসে বিকেল পর্যন্ত আসাদের সাথে আড্ডা দিলো।নিরু দুপুরের আগেই কলেজ থেকে বাড়ি এসে দুপুরের রান্না করে নেয়।আজিজুল হক আজ সারাদিন-ই বাড়িতে থাকেন।বিকেলের দিকে আজিজুল হক চা নিয়ে বাগানে গিয়ে বসেন।
দুপুরে ভাত ঘুম দিয়ে কিছুক্ষণ আগে নিরু ঘুম থেকে উঠেছে।আজিজুল হককে খুঁজে না পেয়ে আসাদের ঘরের সামনে গিয়ে আসাদকে বলল, “মামানি কখন আসবে একটু ফোন করে শোনেন।”
আসাদ ল্যাপটপ থেকে মুখে তুলে নিরুর দিকে তাকিয়ে বলল, “ফোন দিয়েছিলাম সন্ধ্যার পর আসবে।”
“ওহ আচ্ছা!”
“তোর ঘুম হয়নি? এখানে আয় আয়েশার বিয়ে ছবি গুলো দেখ।”
“ল্যাপটপটা ড্রয়িংরুমে নিয়ে আসেন।”
আসাদ ড্রয়িংরুমে এসে বসে নিরুকে নিরুর ছবি গুলো দেখায়।নিরু ছবি গুলো দেখে অবাক হয়ে যায়। ‘এতো গুলো ছবি কখন তুলেছিলেন?’
“ম্যাডাম আপনার কী মনে হয়? আমি লোকের ছবি তোলার জন্য মঞ্চের সামনে দাঁড়িয়ে ছিলাম?”
“আগে জানলে তো কত গুলো ভালো ছবি আসতো।একটাতেও মুখে হাসি নেই, কি বাজে লাগছে।”
আসাদ ঠোঁট কামড়ে হেসে বলল, ” আমাকে পাগল করা মতো সুন্দর!”
আসাদের কথা শুনে নিরু ও ঠোঁট টিপে হাসলো।
“এই দাঁড়ান এই ছবিটা দেখি।”
“এই ছবিটা আমার অনেক পছন্দের, এতো অভিমান করে ছিলি কেন?”
“অভিমানের পাল্লা ভারি হয়েছিলো অনেক তাই।”
“এই ছবিটা ফ্রেম বন্দী করেছি।”
“সত্যি নাকি?”
“জ্বি ম্যাডাম নিয়ে আসছি।”
আসাদ ফ্রেমটা নিয়ে এসে নিরুকে দেখায়।ফ্রেমে বন্দী ছবিটা এতো দারুণ লাগছিলো নিরু মুগ্ধ চোখে আসাদের দিকে একবার তাকাচ্ছিলো তো আরেকবার ফ্রেমটার দিকে তাকাচ্ছিলো।
“ফ্রেমে কবে বাধালেন?”
“আয়েশার বিয়ে থেকে এসে বাধাই করেছিলাম।দেয়ালে টাঙানো ছিলো।তোরা আসার আগের দিন দেয়াল থেকে সরিয়ে রেখেছিলাম।”
“আমার ছবি আপনি দেওয়ালে টাঙিয়ে রেখেছিলেন?”
“শুধু কি দেয়ালে? এই যে এইখানটাই দেখ, বুকের ঠিক এই মধ্যিখানে তোকে রেখেছি।ঘর থেকে বের হতে,ঢুকতে সব সময় দৃষ্টিতে বন্দী তুই,যার জায়গা আমার হৃদয় গহীনে তার শুধু ছবি নয়, তার প্রত্যেকটা পদক্ষেপ আমার বুকে কাঁপন তুলে দেয়।”
নিরু কাঁপা কাঁপা গলায় বলল, “এতো ভালবাসেন কেন?”
আসাদ নিরুর হাতের আঙ্গুল গুলোর ফাকে ফাকে নিজের হাতের আঙ্গুল গুলো রাখতে রাখতে নিরুর চোখে চোখ রেখে গলার স্বর খাদে নামিয়ে বলল, “আমার নিজের বলতে আমি শুধু তোকেই বুঝি,আমার সব কিছুতে শুধু তোকেই খুঁজি নিরু!তোকে কেন এতো ভালবাসি আমি জানি না। শুধু জানি তোকে ভীষণ ভালবাসি।”
আসাদের মোহময় কণ্ঠে নিরুর সর্বাঙ্গ কেপে উঠল।আসাদের মন্ত্রমুগ্ধের মতো চেয়ে থাকা দৃষ্টির দিকে নিরু বেশিক্ষণ তাকাতে পারলো না। আসাদের কাছ থেকে হাত ছাড়িয়ে ছাদে গেল।ছাদের গাছ গুলোতে পানি দিতে হবে। আসাদ ও আটকালো না।নিরুর পিছন পিছন গিয়ে ছাদের রেলিঙে বসলো।ছাদ বাগান থেকে একটা পেয়ারা নিয়ে খেতে খেতে নিরুকে বলল, “নিরু চল বিয়ে করি।”
আসাদের কথা শুনে নিরু মিটমিট করে হাসছে।
“শোন নিরু বাচ্চা কাচ্চা হতে হতে আমার চুল পেকে গেলে কিন্তু বুড়ো বয়সে বাবা হয়েছি বলতে পারবিনা।”
“বলবো না,এবার থামুন।”
“নিরু আমাদের ছেলেমেয়ের নাম কি রাখা যায় বল দেখি?”
“আপনি না থামলে কিন্তু আমি চলে যাবো।”
“তোর এই লজ্জা পাওয়াটা আমার বিয়ের ইচ্ছে দ্বিগুণ বাড়িয়ে দেয়।”
“দিন দিন এমন বিয়ে পাগল হয়ে যাচ্ছেন কেন?”
“বাচ্চার বাবা হতে হবে তাই।”
“হয়েছে এবার থামেন!আমাকে কিছু হলুদ গোলাপের চারা এনে দিয়েন তো।”
“কামিনী ফুল গাছ নিবি?”
“হুম নেবো।”
“আচ্ছা কালকেই এনে দেবো।নিরু একটা গান শুনবি?”
“হ্যাঁ দেন।”
“কোথায় দেবো?”
“এখানে তো টিভি নেই।ফোনেই তো দিবেন তাই না? ”
“আমি শোনাবো।”
“আপনি?”
“হ্যাঁ শুনবি?”
নিরু গাছে পানি দেওয়া ঝাঁঝরি টা রেখে আসাদের সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। তারপর বলে, ‘শুনবো।’
আসাদ নিরুকে পিছন ঘুরিয়ে নিজের দিকে টেনে নিয়ে নিরুর কোমর জড়িয়ে নিরুর কাঁধে চিবুক রাখে।তারপর গান ধরে,
তোকে রাখবো খুব আদরে,
ডুবে ভাসবো মন সাগরে,
প্রেমে পড়ে…(২)
কি মায়া তোর চোখে,
ঘোর মাখা পলকে,
আমি দেখে যাই শুধু তোকে..(২)
তুই যে আমার প্রিয়তমা,
চোখ ধাঁধানো তিলোত্তমা,
রেখেছি তোর মাঝে মনটা জমা।। (২)
তোর মত পৃথিবীতে চিরচেনা,
নেই আর কেউ আমার তোর কি জানা?
ছায়া হয়ে তোকে আমি রবো যে ঘিরে,
যত দূরে যাস রবি চোখেরই নীড়ে।
কি মায়া তোর চোখে,
ঘোর মাখা পলকে,
আমি দেখে যাই শুধু তোকে..(২)
তুই যে আমার প্রিয়তমা,
চোখ ধাঁধানো তিলোত্তমা,
রেখেছি তোর মাঝে মনটা জমা।। (২)
বুকেরই মাঝে যে তোর আনাগোনা,
কান পেনে দেখ না তুই যায় কি শোনা।
ছায়া হয়ে তোকে আমি রবো যে ঘিরে,
যত দূরে যাস রবি চোখেরই নীড়ে।
কি মায়া তোর চোখে
ঘোর মাখা পলকে,
দেখে যাই আমি শুধু তোকে।।
তুই যে আমার প্রিয়তমা,
চোখ ধাঁধানো তিলোত্তমা,
রেখেছি তোর মাঝে মনটা জমা।। (২)
প্রিয়তমা…হায়…প্রিয়তমা
তুই যে আমার প্রিয়তমা,
চোখ ধাঁধানো তিলোত্তমা,
রেখেছি তোর কাছে মনটা জমা।
আসাদ গানটা শেষ করতেই নিরু বলল, “এই গানটা তো আমি মাঝে মাঝেই গাই।আপনি এতো সুন্দর গান গাইতে পারেন আমার তো জানাই ছিলো না। ”
আসাদ নিরুর কাধে চিবুক রেখেই বলল, “আমি গান গাইতে পারিনা নিরু,তোর এই গানটা পছন্দ আমি জানি।তাই শুধু এই গানটাই আমি শিখেছি তোকে শোনাবো বলে।”
নিরু আনন্দে আপ্লুত হয়ে মুখটা আসাদের দিকে ঘুরিয়ে আসাদের গালে একটা চুমু খেয়ে বসলো।আসাদ নিরুর কোমর থেকে হাত সরিয়ে নিয়ে নিরুর মুখটা দুই হাতে ধরে নিরুর ঠোঁটে ঠোঁট ছোঁয়ালো।আসাদের হঠাৎ আক্রমণে নিরু পিছিয়ে গেল।আসাদ ডান হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে ঠোঁট মুছে মুচকি হেসে বলল, ঠোঁটে কোন ব্রান্ডের মধু লাগিয়েছিস রে এতো মিষ্টি! ”
নিরু আর কোন কথা বলতে পারলো না।সর্বাঙ্গ জুড়ে শীতল একটা স্রোত বয়ে যাচ্ছে।আসাদ নিরুর হাত ধরে নিজের কাছে টেনে নিয়ে পিছন থেকে নিরুকে জড়িয়ে ধরে বসে রইল।
নিরু আঁতকে উঠা গলায় বলল, “এই আপনার কি আবার জ্বর বেশি হয়েছে?শরীর এতো গরম কেন?”
“প্রকৃতির গরম আঁচ লেগে।”
নিরু বিস্ময় নিয়ে বলল, “এখন তো রোদ নেই।আর কোন প্রকৃতি? ”
“তুই নিজেই আস্ত একটা প্রকৃতি।”
তারপর আসাদ নিরুর কানের কাছে মুখ নিয়ে ঘোরলাগা গলায় বলল, “পুরাই আগুন!”
নিরু ধ্যাত বলে সরে যাচ্ছিলো।আসাদ আরও নিরুকে নিজের কাছে টেনে নিয়ে মৃদুস্বরে বলল,
“কি মায়া তোর চোখে
ঘোর মাখা পলকে,
দেখে যাই আমি শুধু তোকে।”
চলবে……