#স্বচ্ছ_প্রেমের_পদ্মপুকুর
#লেখা_চাঁদনী_ইসলাম
#পর্ব_২৭
‘প্রিয় স্বচ্ছতা’
“তোর ওই স্বচ্ছ টলমলে চোখে কি পরিমাণ জাদুমাখা মায়া আছে, তুই কি তা জানিস?
হয়তো জানিস না, যদি জানতিস আয়নার সামনে তোর চোখের মায়াটুকু হন্য হয়ে খুঁজতিস।”
“তোর ওই স্বচ্ছ দুটো চোখে আমার জন্য প্রথম কবে প্রেম দেখেছিলাম শুনবি? যেদিন আমি এডমিশন কোচিং করতে প্রথম ঢাকাতে যাই, সেদিন দেখেছিলাম।আমার মন বলছিলো তোর চোখের ওই জলটুকু আমার জন্য, তোর ওই চোখের জলে আমার জন্য স্বচ্ছ প্রেমের মায়া দেখেছিলাম,ঠিক ফুটন্ত পদ্মফুলের মতো,তোর চোখের দিঘিতে পদ্ম ফোটে আমার নামে,এইটা আমি যেদিন থেকে বুঝেছি তোর প্রেমে দ্বিগুণ ভাবে মজেছি।”
“নিরু রে তোর জন্য আমার মনে প্রেম জমেছে। যেই প্রেমটুকু মায়ার,এই মায়া আজন্মেও কাটবে না।তোর টলমলে চোখের দিকে তাকালে আমি নিজেই নিজেকে হারিয়ে ফেলি।আমার দিকে যখন মায়াময় দৃষ্টি নিয়ে তাকাস,নিজেকে বড্ড সৌভাগ্যবান মনে হয়। তোর পুরো প্রেমে আমি,তোর পুরো মায়ায় আমি,তোর সবকিছুতে আমি, যখন জেনেছি তখন থেকে তোকে ঠিক এই বুকের মধ্যে ঢুকিয়ে নিতে ইচ্ছে করে। শুধু পারিনা তাই, তুই যে আমার বুকপকেটেই থাকিস নিরু!”
“নিরু তুই আমার মায়া,তুই নিজেই আমার ছায়া, এই এক জীবনে তোকে যেভাবে চাই।ওইভাবে আমার পরীক্ষার রেজাল্ট ও চাইনি।তুই আমার কাছে অন্যরকম এক পাওয়া।”
“এই যে তোকে বহুদিন না দেখতে পেয়ে বুকে চিনচিনে ব্যাথা অনুভব করছি।এই ব্যাথা কি তোর হয় না নিরু?আমার মতো ছটফট করে তুই কী আমার কাছে চলে আসতে পারিস না?”
“এই ঘরে যেদিন তোকে বউ বানিয়ে নিয়ে আসবো।সেদিন দেখবি এই আসাদের আনন্দ,ইচ্ছে করে টুপ করে ঘরে এনে, ঘরের মধ্যে আটকে রাখি।তারপর তোর মামানিদের বলি কিডন্যাপ হয়ে গেছে কেউ খুঁজো না।”
“সৌভাগ্যবতী তুই?না সৌভাগ্যবান আমি নিরু?তোকে কেন এতো ভালবাসি জানিস তুই?হয়তো জানিস না,আমিও জানিনা।কিন্তু তোকে অসম্ভব ভালবাসি, এইটা জানি।একটা সেকেন্ডের জন্য তোকে মাথা থেকে বের করতে পারিনা।কবে দেখবি পাগল হয়ে ঘুরছি হা হা হা।”
“বুকটা চিড়ে বুকের মধ্যে লালন করতে ইচ্ছে করে তোকে, ইশ! কি দারুণ এক অনুভূতি রে নিরু।”
“কল্পনার মানুষটাকে অনুভবে পিষে মারা যায়। জর্জরিত করা যায়,ভালবাসা যায়।
কিন্তু বাস্তবে একটু ছুঁয়ে দেখা যায় না।এখন আমি চাইলেও তোকে ছুয়ে দেখতে পারছিনা।কি এক যন্ত্রণা দেখ তো?”
“এই যে চুয়াডাঙ্গাতে গিয়ে বসে আছিস।দিন দুনিয়া সহ আমাকে ভুলে,এইটা কী ঠিক করছিস তুই?”
“এই যে তোকে মিস করে তোর জন্য চিরকুট লিখছি।এর বিনিময়ে গুণে গুণে আমাকে চুমু দিবি।”
“নিরু রে এইভাবে যদি মাথায় চরকির মতো ঘুরতে থাকিস পড়বো কখন আমি?আমাদের ভবিষ্যৎ তো তোর চরকি ঘোরার জন্য রীতিমতো ডাউন হয়ে যাচ্ছে।বুকে তো ঘাপটি মেরে আছিস-ই,মাথায় এইভাবে চরকির মতো ঘুরলে ভবিষ্যতে বাচ্চা গুলোর ভবিষ্যৎ নষ্ট হবে।বাচ্চা গুলো বলবে বাবা কি করতে পেরেছে জীবনে,তাই আমরা করবো।অন্তত বাচ্চা গুলোর কথা ভেবে মাথা থেকে বের হয়ে একটু পড়তে দে প্লিজ!”
নিরু আসাদের দেওয়া শেষ চিরকুটটা পড়তে পড়তে মুখ চেপে হাসতে লাগলো।আসাদ নিরুকে চিরকুটে স্বচ্ছতা বলেই সম্মোধন করে। ভাগ্যিস নিরু দরজাটা বন্ধ করে চিরকুট গুলো পড়তে বসেছিলো।না হলে নিরুর হাসি শুনে মামানি ছুটে আসতো।আসাদ একশত পনেরোটা চিরকুট লিখেছে।নিরুর পরীক্ষা ছিলো বলে চিরকুট গুলো এতদিন নিজের কাছেই রেখেছিলো।পরীক্ষার পর নিরুকে চিরকুট গুলো দিয়েছে।
নিরু ছাদ বাগানে গাছে জল দিচ্ছিলো।আসাদ গিয়ে ছাদের রেলিঙের উপর বসলো।আজকে নতুন কিছু গাছ লাগানো হয়েছে।কিছু গাছের গোড়া থেকে মাটি আলগা হয়ে গেছে বলে নিরু গাছ গুলোতে মাটি দিলো।কিছু গাছে ইউরিয়া দিলো।আসাদ নিরুকে ডেকে বলল,
“নিরু ভাবছি তোকে একটা নার্সারি করে দেবো।”
নিরু উৎসুক চাহনি নিয়ে বলল, “কবে দিবেন?”
“আগে চাকরিটা পেতে দে।”
“যেভাবে বললেন,মনে হলো এখনই আমার নার্সারি তৈরি। ”
“তুই বললে এখনই করে দেবো।”
নিরু জানে আসাদ তাই-ই করবে।মামাকে বলে ঠিকই নার্সারির ব্যবস্থা করে ফেলবে।তাই বলল, “এখন না আগে রেজাল্ট বের হোক।ভর্তি কোথায় হতে হয় দেখি।”
“তুই এডমিশনের জন্য কোচিং করবি না?”
“রেজাল্ট কেমন হবে সেইটাই জানিনা।”
“পরীক্ষা তো ভালো হয়েছে বললি।”
“হ্যাঁ তা তো হয়েছেই।”
“তাহলে এতো হতাশ কেন?”
“এডমিশনের জন্য কোচিং করলে, দাদু রাজশাহীতেও পরীক্ষা দেওয়াবে আমি জানি।যদি কোনভাবে রাজশাহী ভার্সিটিতে হয়ে যাই তাহলে?”
নিরুর চোখে মুখে আতঙ্ক, আসাদ অভয় দিয়ে বলল, হলে হবে সমস্যা কী?মনে কর আমার চাকরিটা হয়ে গেল।আর ভাগ্যক্রমে রাজশাহীতে পোস্টিং হলো।আর না হলেও আমি তো বাসায় থাকছি না,তাই না?”
“শুধু কি আপনি, মামা মামানিকে ছাড়া কীভাবে কি করবো?”
“ওহ তাহলে এই ব্যাপার,আপনার সমস্যা মামা মামানিকে ছেড়ে না থাকতে পারা।এইদিকে আমি হতভাগা ভাবছিলাম আমাকে মিস করবেন বলে।”
“সব মিলিয়েই তো।”
“হয়েছে কথা ঘুরাতে হবে না। কোচিং শুরু করতে হবে।”
নিরু হাত ধুয়ে আসাদের সামনে এসে দাঁড়ালো।তারপর বলল, “পড়াশোনা ভালো লাগেনা।”
“এতো বলি চল বিয়ে করে ফেলি।একটা কথা তো শুনিস না।”
“চাকরিটা হয়ে যাক।”
“সত্যি তো?”
নিরু ঘাড় নাড়িয়ে হ্যাঁ বলল, আসাদ নিরুকে নিজের দিকে টেনে নিয়ে কোমর জড়িয়ে ধরলো।তারপর নিরুর নাকের সাথে নাক ঘষা দিয়ে বলল, “তোকে এতো ভালবাসি কেন?তোর জন্য আমার বুকের মধ্যে এতো জায়গা কেন জানিস?”
নিরু চারপাশে তাকিয়ে নিয়ে আসাদের গলা জড়িয়ে ধরে বলল, “আমি এতো ভালবাসি বলে।”
আসাদ নিরুর কপালে কপাল ছুঁয়ে বলল, “আমার ভালবাসাটা কিছু না তাই না?”
“আপনার জন্যই আমার পৃথিবীটা এতো সুন্দর।”
আসাদ এবার নিরুর কোমরটা আরেকটু শক্ত করে জড়িয়ে ধরল।নিরু আসাদের চুল গুলোই হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল, “এবার ছাড়ুন কাপড় গুলো তুলতে হবে।”
আসাদ নিরুকে ছেড়ে উঠে গিয়ে বলল, “এই দেখ আব্বু আর আম্মু নিচে বসে গল্প করছে।এখন সহজে উঠবে না।আম্মুকে উঠতে দেখলে আমি রুমে চলে যাবো।তুই কাপড় তুলে নিবি।”
নিরু সেখানেই দাঁড়িয়ে থেকে বলল,”হ্যাঁ এখানে দাঁড়িয়ে থেকে মনে হচ্ছে দেখতে পাবো।”
“তোকে দেখতে হবে না,তুই বসে থাক।আমি একটা করে চুমু খাবো,আর দেখে যাবো।”
“এমন করলে এক সেকেন্ড থাকবো না।”
“তোকে যে চিরকুট দিলাম, তার বিনিময়ে কিছু দিয়েছিস?”
নিরু কপাল কুচকে বলল, “দিয়েছেন কেন?”
আসাদ অসহায়ের মতো মুখ করে বলল, “এমন অন্যায় করতে পারিস না নিরু,আমি চিরকুটেই লিখে দিয়েছিলাম গুণে গুণে চুমু দিবি।”
নিরু বিস্ময় নিয়ে বলল, “কই আমি তো পাইনি।”
আসাদ অসহায়ের মতো নিরুর দিকে তাকিয়ে রইল। নিরু মুখ টিপে হাসতে হাসতে কাপড় গুলো তুলে সিড়ি ঘরের দিকে যেতে যেতে আসাদের দিকে ফিরে আসাদকে ‘হেই মিস্টার’ বলে ডেকে একটা ফ্লায়িং কিস ছুড়ে দিলো।আসাদ দ্রুত পায়ে এসে সিঁড়ি থেকেই নিরুর হাত চেপে ধরে দেয়াল ঘেঁষে দাঁড়িয়ে হ্যাচকা টানে নিরুকে নিজের দিকে টেনে নিলো।
আসাদ জেসিও অফিসার পদে সার্কুলার পাওয়ার পর অনলাইনে আবেদন করে রেখেছিলো।তার কিছুদিন পর মেসেজ পেয়ে প্রাথমিক মেডিকেল আর ভাইবা দিতে গেছিলো।প্রাথমিক মেডিকেল আর ভাইবাতে সিলেক্ট হয়।এবং লিখিত পরীক্ষাতেও উত্তীর্ণ হয়।
গত কাল আসাদ জেসিও অফিসারের চূড়ান্ত মেডিকেল আর ভাইবা পরীক্ষা দিতে গেছে।
নিরুর এইচ এস সি পরীক্ষা শেষ,এখন অবসরেই সময় কাটছে।আনাস মোল্লা নিরুকে নিয়ে যেতে চাইলে আজিজুল হক বললেন বাড়িতে কয়েকটা দিন থাকুক,তারপর না হয় গিয়ে ঘুরে আসবে।আনাস মোল্লাও আর কিছু বললেন না। আনাস মোল্লার এখন বড্ড ইচ্ছে হয়,নাতি,নাতনিদের নিয়ে থাকবেন।বাড়িটা ফাঁকা হয়ে আছে।সামনে মাসে ছোট ছেলে রাজশাহীতে চলে আসবে,তখন বাড়িটা পূর্ণ হবে।খাদিজাকে আনাস মোল্লা সবকিছু বলার পর থেকে খাদিজাও সেইভাবে আসে না।আনাস মোল্লার বাড়ির কাছেই আয়েশার বিয়ে হয়েছে।আয়েশা এসে আনাস মোল্লার রান্না করে দেয়।আনাস মোল্লার দেখাশোনা আয়েশা করে।
আমিনা বেগম রান্না ঘরে রান্না করছিলেন,আজিজুল হক আমিনাকে ডেকে আসাদের বাইকের চাবি দিতে বলেন।আমিনা বেগম রান্না ঘর থেকে বেরিয়ে বললেন, “এখন কোথায় যাবা?”
“সাইফুল ভাই ডাকছে বের হতে হবে।”
“আসাদ চাবি কোথায় রেখেছে জানি না তো,আমার কাছে দিয়ে যায়নি।গাড়ি নিয়ে বের হও।”
“এখন গাড়ি বের করছিনা,ফিরবো এখনই,আসাদের ঘরে গিয়ে দেখো।আমি চেঞ্জ করে নিই।”
আমিনা আসাদের ঘরে গিয়ে চাবিটা টেবিল এবং ওয়ারড্রবের উপরে খুঁজে পেলো না।বিছানায় বালিশের পাশেও দেখলো।টেবিলের ড্রয়ারে রাখতে পারে ভেবে ড্রয়ার খুললো।ড্রয়ার খুলে এমন কিছু দেখবে আমিনা কখনো কল্পনাও করেনি।নিরুর ছবি ফ্রেমে বাঁধায় করা?
আমিনা ফ্রেমটা উল্টে পাল্টে দেখলো।পিছনে মার্কারি কলম দিয়ে মোটা মোটা অক্ষরে লেখা “তুই একান্তই আমার স্বচ্ছতা”
আমিনা বেগম ছবিটার দিকে তাকিয়েই আজিজুল হককে আসাদের ঘরে ডাকলেন।
চলবে…