স্বচ্ছ_প্রেমের_পদ্মপুকুর #লেখা_চাঁদনী_ইসলাম #পর্ব_৩১

0
494

#স্বচ্ছ_প্রেমের_পদ্মপুকুর
#লেখা_চাঁদনী_ইসলাম
#পর্ব_৩১

আমিনা বেগম দরজা খুলতেই নিরু আমিনা বেগমের বুকে ঝাপিয়ে পড়ে কান্না করে দিলো।নিরু নিজের মা’কে হারিয়ে,এই মানুষটাকেই তো মায়ের মতো করে ভালোবেসেছে।আদর পেয়েছে,যত্ন পেয়েছে,সেই মায়ের সান্নিধ্যে থেকেই এখন কত দূরে! একজন মা’কে চিরজীবনের জন্য হারিয়েছে,আরেকজন মা জীবনে থেকেও দূরে সরিয়ে দিয়েছে।নিরুর বুক ফেটে যায়,কাউকে কিছু বলতে পারে না।নিজের ভিতরে রেখে গুমরে মরে।
আমিনা বেগম নিরুর মাথায় হাত রাখলেন,তারপর আনাস মোল্লাকে ভিতরে আসতে বললেন।আমিনা বেগম আনাস মোল্লাকে বসতে বলেন, কিছুক্ষণ কথাবার্তা বলে হাত মুখ ধুয়ে নিতে বলে রান্না ঘরে গেলেন।আমিনাকে রান্না ঘরে যেতে দেখে নিরু আসাদের ঘরের সামনে গিয়ে দরজাটা খুলে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে ঘরটা দেখে,নিরু দরজাটা খুলে দাঁড়াতেই মনে হলো আসাদের গলা শুনলো,আসাদ যেভাবে বলে, ‘ভিতরে আয় নিরু!’
নিরু চারপাশে তাকিয়ে দরজাটা বন্ধ করে নিজের ঘরে যায়।নিরুর কাছে ঘরটা কেমন অচেনা লাগছে,ধুলোবালি পড়েছে।আগেও তো নিরু দশ থেকে পনেরো দিন করে বেড়িয়ে এসেছে,তখন তো এসে এমন অপরিষ্কার দেখতো না?আজকে নিরুর কাছে সবকিছু কেমন পর পর লাগছে।

নিরুদের পৌঁছাতে এশার আযান হয়ে গেছিলো,আমিনা বেগম টেবিলে খাবার দিয়ে নিরুদের খেতে বসতে বললেন।খেতে খেতে আনাস মোল্লার সাথে টুকিটাকি কথা বললেন।আনাস মোল্লা আজিজুল হকের জন্য অপেক্ষা করার কথা বলেছিলেন,কিন্তু অনেকটা পথ জার্নি করে আসায় আমিনা আনাস মোল্লার কথা শুনলেন না।আনাস মোল্লা খাওয়া শেষ করে ড্রয়িংরুমে গিয়ে বসেন।আমিনা থালাবাসন গুছিয়ে নিয়ে রান্না ঘরে যান।নিরু হাত মুখ ধুয়ে নিজের ঘরে গিয়ে বিছানা গোছায়, ধুলোপড়া জায়গা গুলো পরিষ্কার করে।তারপর নিরু ঘর থেকে বেরিয়ে আমিনার কাছে গিয়ে বসে, “মামা কখন আসবে মামানি?”

“রাতে আসবে।”

“তোমার কি শরীর খারাপ?”

“না তো,শরীর সুস্থ আছে।”

“মামানি তুমি আমার উপর রেগে আছো? ”

আমিনা বেগম নিরুর দিকে তাকিয়ে বললেন,”তোর উপর রেগে থাকবো কেন?

” না এমনি মনে হচ্ছে।”

“তোর উপরে রাগ করে লাভ কি আমার?যেখানে আমার ছেলেই ঠিক না।”

নিরুর বুকটা কেঁপে উঠল,’মামানি কি কিছু আঁচ করেছে,এমন কথা কেন বললো?’
নিরুর বুকটা ধড়ফড় করছে।নিরু কি উত্তর দিবে বুঝতে না পেরে চুপচাপ বসে রইল।আমিনা বেগম আবার বললেন,

“তোর কাছ থেকে এইগুলো আমি অন্তত আশা করিনি নিরু।তুই আমার সব বিশ্বাস ভেঙে দিয়েছিস।তোদের নিয়ে কি করবো বল?”

“মামানি…!”

“নিরু আগে আমার কথা শোন,আমার আর কিছু অজানা নেই।তোদের তো আমি এইভাবে বড় করিনি।তারপরেও এমন একটা সম্পর্কে কীভাবে গেলি তোরা?”

নিরু মাথা নিচু করে বসে আছে, চোখে জল টলোমলো করছে।এই মুহূর্তে নিরু আসাদকে প্রচন্ড মিস করছে।মামানির এই উত্তর গুলো নিরু কীভাবে দেবে?
আমিনা আবারও বললেন, “নিরু পড়াশোনায় মনোযোগ দে,এর মধ্যে আমরা ভালো ছেলে দেখছি।”

নিরু আমিনার পায়ের কাছে বসে কাপা কাপা গলায় বলল,”মামানি আমি তোমাদের সঙ্গে থাকতে চাই।”

আমিনা কঠিন স্বরে বললেন,”এতদিন তো সঙ্গেই ছিলি,তার বিনিময়ে সম্মানটুকুও তো রাখলি না।”

নিরুর কথা আটকে আসছে,অনেক কিছু বলতে গিয়েও বলতে পারছে না।উচ্চস্বরে বলতে ইচ্ছে করছে, ‘মামানি আমরা দুজন দুজনকে খুব ভালবাসি।’
কিন্তু কিছুই বলতে পারলো না। তার আগেই আমিনা কঠোর এক সত্য বলে দিলেন।

“আসাদ ট্রেনিং শেষ করে এলেই, মাহিয়ার সাথে বিয়ে দেবো।কথাবার্তা পাকা করে ফেলেছি।”

নিরু অবাক চোখে আমিনার দিকে তাকালো,এতক্ষণের চোখের কোণে জমা জলটুকু গাল গড়িয়ে পড়লো। মস্তিষ্কে তোলপাড় ধরানো শব্দ ‘মাহিয়ার সাথে বিয়ে দেবো।’
নিরু আমিনার হাত দুটো চেপে ধরে কাতর হয়ে বললো, “মামানি আসাদ ভাই..”

“নিরু আমি কিছু জানতে চাই না,শুনতেও চাই না।তোরা এইসবে যাওয়ার আগে একটাবার জানানোর প্রয়োজন মনে করিসনি,পরিনতি কি হবে, বা কি আছে ভেবে দেখিসনি।আজ তোদের কারো কোন কথা শোনার মতো পরিস্থিতি সময় কোনটাই নেই।”

নিরুর গাল বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ছে।আমিনার হাত দুটো শক্ত করে ধরে আকুতি ভরা গলায় বলল, “মামানি শোন না,তোমার পায়ের নিচে জায়গা দাও।আমি তোমার কাছে ছাড়া কোথাও শান্তি পাই না মামানি।”

“নিরু তোর কাছে আমি অনুরোধ করছি, তুই আমাকে আমার মান সম্মান, আমার বোনকে দেওয়া কথা, এইগুলো থেকে আমাকে ছোট হতে দিস না।আমার বোন জামাইয়ের শরীর ভালো না।এতো ঝামেলা ওদের কাঁধেও দেওয়ার সাধ্যি আমার নেই।তোকে খারাপ কোথাও ফেলবো না।তোর মামা ভালো ছেলে,ভালো পরিবার দেখেই দেবে।”

নিরু কান্নাভেজা গলায় বলল,”মামানি আমি থাকতে পারবো না।”

আমিনা বেগম এবার কঠিন গলায় বললেন”তোকে এতদিন আদর যত্ন করে মানুষ করার এই প্রতিদান দিবি?তোর পায়ে পড়তে হবে?”

নিরু আর কিছু বলতে পারলো না।বুকে আসা শত কথা মুখে আসার আগেই চাপা পরে গেল।
আমিনা বেগম নিজের হাতটা নিরুর কাছ থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে,নিরুর হাতটা নিজে শক্ত করে ধরলেন তারপর বললেন, “আমার বোন মনিকা আমার হাত ধরে মাহিয়াকে আমার ঘরে নিতে বলেছে,আমিও কথা দিয়েছি।এই ওয়াদা কীভাবে ভঙ্গ করবো?”

নিরু চোখ মুছে বলল, “এই কথা আসাদ ভাই জানে মামানি?”

“আসাদ ট্রেনিংয়ে যাওয়ার আগেই জানাতে চেয়েছিলাম।তার আগেই এইসব জানতে পারি।আসাদের মানসিক চাপ পড়বে বলে, তোর মামা নিষেধ করে আসাদ কে জানাতে।তাই কোন কিছু নিয়েই আর কথা হয়নি।মাহিয়া অনেক আগে থেকেই আসাদকে পছন্দ করে,আর কথাবার্তা বলে।”

“মামানি আসাদ ভাই আমাকে ছাড়া…. ”

“তোর পা ধরতে হবে নিরু?এতোদিন কি আমি দুধ কলা দিয়ে বিষাক্ত সাপ বড় করেছি?তোর কাছে আমি জোর হাত করে অনুরোধ করছি, একদিনের জন্য হলেও মায়ের জায়গা যদি আমাকে দিয়ে থাকিস। তাহলে সেই মা তোর কাছে ভিক্ষা চাইলো।এইসব থেকে আমাকে মুক্তি দে,এতো চিন্তা আমি নিতে পারছি না।”

নিরু আমিনার পাশে আর বসতে পারলো না। দ্রুত পায়ে নিজের ঘরে চলে গেল। আজিজুল হক কিছুক্ষণ আগেই বাড়িতে এসেছেন,আনাস মোল্লাকে পেয়ে ড্রয়িংরুমেই গল্প শুরু করে ছিলেন।নিরুকে দেখে আজিজুল হক ডাকলেন,তার আগেই নিরু এতো দ্রুত নিজের ঘরে ঢুকেছে আজিজুল হকের ডাকটা আর কানে পৌছায়নি।

রাত এগারোটা বাজে আনাস মোল্লা কিছুক্ষণ আগেই শুয়েছে।নিরুর বুকের মধ্যে চিনচিন ব্যাথা করছে, বুকের ভিতরটা হাসফাস করছে।চোখ বন্ধ করতে পারছেনা,বুকটা ধড়ফড় করে উঠছে।চোখ দুটো জ্বলে যাচ্ছে।নিরুর মনে হচ্ছে, ‘মামানি তো ঠিকই বলেছে,সম্পর্কে যাওয়ার আগে পরিনতিটা কেন ভাবিনি।’ আমিনা বেগমের কথা গুলো কানে বাজছে।নিরুর সহ্য হচ্ছে না। কীভাবে ভুলবে তার আসাদকে,আর কীভাবেই বা অগ্রাহ্য করবে আমিনার স্নেহময় ভালবাসাকে? নিরু বিছানা থেকে উঠে বসলো।নিরুকে মামা মামানির সাথে কথা বলতে হবে, নিরু পারবে না আসাদকে ছাড়া ভালো থাকতে।আসাদের মতো জোর দিয়ে কেনো কোন কথা বলতে পারে না নিরু? নিজেকেই নিজে ধিক্কার দিতে লাগলো।বিছানা থেকে নেমে বেরিয়ে এলো।

আজিজুল হক বিছানায় এসে পর্যন্ত আমিনাকে জিজ্ঞেস করছে,নিরুকে কিছু বলেছে কিনা।আমিনা বেগমের কোন উত্তর নেই।নিজের কাজ নিয়েই ব্যস্ত হয়ে আছেন।নিরু আমিনাদের ঘরের দরজা নক করতে যাবে, তখনই আজিজুল হক এক প্রকার চিৎকার করে বললেন, “আমার কথা কানে যায় না, তাই না? ”

“হ্যাঁ বলেছি!তো কি হয়েছে?”

“এখনই কেন বলতে গেলে?আসাদ এলে এইসব নিয়ে কথা বলা যেতো না?কতদিন পর মেয়েটা এসেছে?”

“আমার ছেলে আসবে তখন বলে, এতো অশান্তি এক সাথে নিতে পারবো না।”

“তাই বলে নিরুকে কাঁদাবা?নিরুকে কী বলেছো?”

আমিনার কাঠ কাঠ জবাব, “আসাদের জীবন থেকে সরতে বলেছি।”

আজিজুল অবাক হয়ে বললেন,”এইটুকু মেয়েকে এতো কঠিন কথা বলেছো?”

“এইটুকু মেয়ে এখন?কাজটা কী করেছে?”

“তোমার ছেলে কিছু করেনি?”

“তুমি আমার সাথে ঝগড়া করছো কেন?”

“আমাকে না জানিয়ে নিরুর সাথে কেন এই বিষয়ে কথা বললে আমিনা?”

“ভুল কিছু করিনি।”

“আসাদ নিরুকে পছন্দ করে, আসাদ কেমন তুমি ভালোই জানো?”

“পেটে আমি ধরেছি,তুমি নও।তাই ছেলের ভালোটা আমাকেও দেখতে দাও।”

“এখানে কিসের ভালো দেখছো?”

“তুমি আমার সাথে ঝগড়া করবা বলে ফন্দি এটে বসে আছো?”

“তা কেন হবে?”

“আমি মাহিয়ার সাথেই বিয়ে দেবো।”

“তোমার ছেলে কী মাহিয়াকে চাই?”

“আমার ছেলে কি চাই,সেইটা আমি বুঝবো।”

“জীবনটা কিন্তু আসাদের আমিনা।”

“আমি কোন এতিম মেয়েকে আমার ঘরের বউ বানিয়ে আনবো না।”

আজিজুল হক চিৎকার করেই ‘আমিনা’ বলে ধমকে উঠলেন।

“আমার বোনকে আমি কথা দিয়েছি,তোমার তো অজানা নয়?তাহলে আমার সাথে এমন করতে আসছো কেন?”

“সেই পরিস্থিতি এখন নেই,এখন পরিবর্তন হয়েছে।”

“আমার ছেলের ভবিষ্যতে কি হবে ভেবেছো?আমার ছেলে শশুর শাশুড়ীর কোন আদর যত্ন পাবে না।কপাল পোড়া হবে।আমি চাই না আমার ছেলে এতকিছু থেকে বঞ্চিত হোক।”

আজিজুল হক না চাইতেও বললেন, “তোমার বোন জামাই তো অসুস্থ হয়ে পড়ে আছেন,আল্লাহ না করুক ভাইয়ের যদি এখন কিছু হয়ে যায়।মাহিয়া এতিম হবে না? ”

আমিনা কয়েক সেকেন্ড চুপ করে থেকে বললেন, “আমার বোন থাকবে,যথেষ্ট আদর যত্ন করবে।আর সব কিছুর উর্ধ্বে আমার কথা দেওয়া।লোকেই বা কি বলবে ভেবেছো?”

“এখানে লোক কীভাবে এলো?”

“সব কিছুই আসবে।বলবে এক বাড়িতে থাকতো কিছু ঘটিয়েছে বলেই বিয়ে দিয়েছি।এখনো অনেক কারণ আছে,বড় ভাইয়ের ছেলের সাথে নিরুর বিয়ে দিইনি।আত্নীয় ঘরে দেবো না বলে,এমনকি খাদিজার ছেলের সঙ্গেও দিইনি।বুঝতে পারছো ব্যাপারটা কতটা বিশ্রী হবে?”

“লোকের কথা আমি কোনকালেই পরোয়া করিনি,আজও করছি না।আসাদ আসলে ব্যাপারটা দেখছি।”

“সংসার জ্বালিয়ে দেবো আমি,তবুও বাবা মা হারানো কপালপোড়া কোন মেয়েকে ছেলের বউ করবো না।”

আজিজুল হক আমিনার গালে থাপ্পড় দিতে গিয়েও হাত নামিয়ে নিলেন।দরজা খুলে বেরিয়ে যেতে গিয়ে দেখলেন নিরু দরজার সামনে দাঁড়িয়ে মুখ চেপে ধরে কান্না করছে।আজিজুল হক নিরুকে কাছে নিতে গেলে, নিরু নিজের ঘরে গিয়ে দরজা বন্ধ করে দেয়।আজিজুল হক নিরুকে ডাকলেন,তাও নিরু দরজা খুললো না।ফ্লোরে বসে মুখে ওড়না চেপে হাউমাউ করে কান্না করলো।নিরুর এই বদ্ধ ঘরের মধ্যে করা আর্তনাদ, তার আসাদ কখনো জানতে পারবে না।

ভোরের দিকে আজিজুল হক নামাজ আদায় করে, নিরুর ঘরে আসার জন্য নিজেদের ঘর থেকে বের হলেন।নিরুর ঘরে টোকা দিতেই দরজা খুলে গেল।নিরু বলে ডাকলেন কিন্তু ঘরে নিরু নেই,আনাস মোল্লার ঘরে গিয়ে দেখেন আনাস মোল্লাও নেই।

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here