স্বচ্ছ_প্রেমের_পদ্মপুকুর #লেখা_চাঁদনী_ইসলাম #পর্ব_৪৫ অন্তিম পর্ব

0
809

#স্বচ্ছ_প্রেমের_পদ্মপুকুর
#লেখা_চাঁদনী_ইসলাম
#পর্ব_৪৫ অন্তিম পর্ব

আজিজুর হক ডক্টর ডেকে নিয়ে আসেন।পনেরো মিনিটের মধ্যে নিরুকে অপারেশন থিয়েটারে ঢোকানো হয়।আনাস মোল্লা অপারেশন থিয়েটারের সামনে অস্বাভাবিক ভাবে পায়চারি করছে।প্রচুর রক্ত লাগবে,আসাদ ছুটোছুটি করে র’ক্ত সংগ্রহ করছে।পরিচিতদের কাছে ফোন করছে।বিভিন্ন ফান্ডে যোগাযোগ করছে।পাগলের মতো দিক বেদিক ছুটে বেড়াচ্ছে।সীতাকুণ্ডে নিজস্ব আত্নীয়-স্বজন নেই।এই বিপদের সময় রাকিবের পরিবার,আজিজুর হকের কাছের কিছু বন্ধুরা এসেছেন,সবাই মিলে ছুটোছুটি করছেন।আসাদ একদম ভেঙে পড়েছে।মনে হচ্ছে শূন্যের উপরে দাঁড়িয়ে আছে।আসাদের চারপাশটা ঘুরছে, অপারেশন থিয়েটারের দরজার সামনে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।আধা ঘন্টা পর বাচ্চার কান্না শোনা গেল।আমিনা বেগম বসা থেকে উঠে দাঁড়ালেন, দরজার সামনে এগিয়ে এসে আসাদের পিঠে হাত রাখলেন।বাচ্চার কান্নার আওয়াজ পেয়েও আসাদের বুকের ভিতরটা ভিজলো না।ভিতরটা কাঠ হয়ে আছে।হাসফাস লাগছে,বুকের মধ্যিখানে অস্থিরতা।একজন ডক্টর এসে বাচ্চাটা আসাদের কোলে দিলেন।

“আসাদ তোমাদের পুত্র সন্তান হয়েছে।”

আসাদ নিজেদের বাচ্চাটাকে নিতে নিতে অসহায় ভাবে চেয়ে ডক্টরকে বলল, “আংকেল অনিমা!”

“চিন্তা করো না বাবা অনিমা ঠিক আছে।”

আসাদ কিছুটা স্বস্তি পেয়ে ছেলের গালে কপালে চুমু দিলো।আমিনা বেগম, আজিজুর হক, আনাস মোল্লা সবাই একে একে কোলে নিলেন।প্রায় এক ঘন্টা পর নিরুকে কেবিনে দেওয়া হলো।নিরু কথা বলার মতো অবস্থায় ছিলো না,মুখটা জরাজীর্ণ হয়ে আছে।শরীরটা ভীষণ ক্লান্ত লাগছে।নিরুর এই করুণ অবস্থার কারণ আসাদ একদিন পর জানতে পেরেছে।
পাহাড় থেকে আসার আগের দিন আসাদের হাত থেকে ফোনটা পড়ে ভেঙে যায়।ফোনের স্কিনটা খুব বাজে ভাবে ভাঙে,ফোনে কোন কাজ করে না।নেটওয়ার্কের ও সমস্যা থাকে তাই অন্যান্য বন্ধুদের ফোন থেকেও আসাদ নিরুকে কল করতে পারে না।আর আজকেই ব্যাক করবে বলে আসাদ অন্যের ফোন নিয়ে বেশি ঘাটায়নি।সুপ্তধারা ঝর্ণার চূড়া থেকে নেমে এসে রাকিবের কাছে ফোন চায়,কিন্তু রাকিব বলে,

“নিরু ভাবির সাথে একটু মজা করি দাঁড়া।”

আসাদ ঘুনাক্ষরেও ভাবেনি রাকিব এমন মজা করবে,আসাদ ভেবেছিলো রাকিব বলবে বাসায় যেতে আরও দুই একদিন দেরি হবে।কিন্তু রাকিব নিরুর এই অবস্থায় ও এমন একটা মজা করবে আসাদ ভাবেনি।রাকিব নিরুর এমন অবস্থা জানার পর অসংখ্যবার ক্ষমা চেয়েছে।রাকিব ভেবেছিলো বাসার কাছেই এসে গেছে একটু মজা করি।কিন্তু এমন হবে ভাবেনি।

নিরু এখন বিপদমুক্ত গতকাল নিরুকে বাড়িতে নিয়ে এসেছে।নিরুকে বাড়ি এনে আসাদ স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে।আসাদ, নিরু,ছেলের নাম রাখে আশফিক আসাদ।আশফিককে নিয়ে পরিবারের সবার খুশির শেষ নেই।আমিনা, আজিজুর, আশফিককে নিয়েই দিন কাটায়।প্রতিটা মুহূর্ত আশফিকের সাথে উপভোগ করে।ছোট্ট দু’টো হাত, ছোট্ট দু’টো পা,নরম তুলতুলে ছোট্ট দেহ।আশফিকের হাতের মধ্যে আসাদ নিজের একটা আঙ্গুল রেখে আশফিকের দিকে নিষ্পলক ভাবে চেয়ে থাকে।মাঝে মাঝে ঘুমের মধ্যে আশফিক হেসে উঠে।আসাদ নিরুকে আস্তে আস্তে ডাকে দেখানোর জন্য, নিরুকে দেখানোর আগেই আশফিক হাসি মুখটা স্বাভাবিক করে ফেলে।কিছু সময় দুজন এক সাথেও দেখে। আসাদ নতুন একটা পৃথিবীর সন্ধান পেয়েছে যেন।আশফিকের মুখের দিকে তাকালে পৃথিবীর সব সুখ যেন ওই মুখে দেখতে পায়।

আশফিকের বয়স এখন সাত মাস চলে।আধো আধো বুলিতে বাব বা বা বলে ডাকে।আশফিকের সর্বপ্রথম বাবা ডাক বের হয়েছে।এইটা নিয়েও আসাদের খুশির সীমা নেই।আসাদের এতো খুশি দেখে নিরু বেশ উপভোগ করে।বাবা ছেলের সুন্দর মুহূর্ত গুলো ক্যাপচার করে রাখে।আশফিক আসাদকে বের হতে দেয় না,অফিসে যেতে হয় লুকিয়ে,লুকিয়ে কর্মসূত্রে বাইরে যাওয়া লাগে।বেশির ভাগ আশফিককে লুকিয়েই বের হতে হয়।না হয় চিল্লিয়ে কান্না করে। আশফিক বেশ শান্ত বাচ্চা কিন্তু আসাদকে বের হতে দেখলেই অশান্ত হয়ে যায়।তাছাড়া নিরুকে একটুও জ্বালাতন করে না।পুরো বাড়ি আশফিক হামাগুড়ি দিয়ে বেড়ায়,সাথে পাহারা দেয় আমিনা বেগম আর নিরু।আশফিককে নিয়েই এখন সময় গুলো যাচ্ছে।

কিছুদিন থেকে আসাদ নিরুর পিছনে লেগেছে ডক্টরের কাছে যাওয়ার জন্য, যেভাবে আঘাত পেয়েছিলো চেকআপ করানোর দরকার,কিন্তু নিরু কথায় শুনছে না।শরীর ভালো আছে বলে হাজার বাহানা দেখাচ্ছে।আসাদ আজ বাড়িতে আছে।আশফিককে আমিনার কাছে রেখে নিরুকে নিয়ে ডক্টরের কাছে যায়।কিছু টেস্ট দিয়ে আসে।তারপর আমিনাকে ফোন দিয়ে শোনে আশফিক কান্না করছে কিনা,আশফিকের খোঁজ নিয়ে আসাদ বাড়ির রাস্তায় না গিয়ে বাইক নিয়ে রাবারডেমে যাওয়ার রাস্তায় যায়।

“কোথাও যাবেন?”

“বউ নিয়ে ঘুরবো।”

“আশফিককে রেখে এসেছি,কান্না করবে তো।”

“আম্মু আছে, সমস্যা নেই।”

“কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন তাহলে?”

“রাবারডেমের রাস্তায় হাঁটবো চল।”

নিরু উৎসাহ নিয়ে বলল, “সেই রাবারডেমে?”

“হ্যাঁ সেই রাবারডেমে, তোর তো খুব পছন্দ হয়েছিলো।”

“শুধু কি পছন্দ ওখানেই প্রেমের সূত্রপাত ঘটেছিলো।মনে প্রেম জেগেছিলো।”

“ইশ!তখনই যদি প্রপোজ করে দিতাম।প্রেমের বয়সটা আরও কিছুদিন বেড়ে যেতো।”

“তখন তো মাত্র অনুভূতির সাথে পরিচিত হচ্ছিলাম।ভালোলাগা,ভালবাসি এইটা বুঝেছিলাম না।”

“চলে এসেছি।”

আসাদ বাইক সাইড করে রেখে নিরুর হাতের আঙ্গুলের ফাকে নিজের হাতটা রেখে নিরুর হাতটা শক্ত করে ধরলো।নিরু আসাদের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলো।নিরু হেসে বলল, “এই এতো হ্যান্ডসাম মানুষটা আমার বর তাই না।”

নিরুর কথায় আসাদ হো হো করে হেসে দিলো।আসাদ ঠোঁট কামড়ে হেসে বলল, “এতো বছর পর মনে হলো।”

“পুরাতন জায়গায় এসে, আবার সেই পুরাতন অনুভূতি নতুন করে জাগ্রত হচ্ছে।”

আসাদ ঠোঁট জোড়া প্রসারিত করে মুচকি হেসে বলল, “আমার বউটা মাথা ঘুরে যাওয়া মতো সুন্দরী সেইটা কী আপনি জানেন ম্যাডাম?”

নিরু মাথাটা নিচু করে ফেললো।আসাদ আরও কিছুটা পথ নিরুকে নিয়ে হাঁটলো।আজ একদম ভীড় নেই।নিরুকে একটা গান শোনাতে বলল,আসাদের অনেক দিনের ইচ্ছে এমন নিরিবিলি পথে হাঁটবে আর নিরুর কাছে গান শুনবে।নিরু ও আসাদের পছন্দের একটা গান ধরলো।

কিছু কিছু কথা বসে আছে ভিজে
মিছি মিছি ব্যথা হয়নি যে নিজে
ঝরে যাওয়া পাতা জুড়ে বসে ডালে
মেঘে মেঘে কথা শোনে সে আড়ালে

আকাশ যখন গাইবে বলে
আকাশ যখন গাইবে বলে বাদলেরই গান
বাতাস তখন বইতে গিয়েও দেখায় অভিমান
অভিমান
আকাশ যখন ফিরতি পথে মন খারাপের সুর
বাতাস তখন নীরব চিঠি পাঠায় বহুদূর
বহুদূর

কিছু কিছু ধুলো জমে আছে কাঁচে
ডাকনামগুলো ভীষণই ছোঁয়াচে
মরে যাওয়া জমি ভিজে গেলে জলে
চারাগাছগুলো কত কি যে বলে

তোমার এমনি আসা, এমনি যাওয়া
এমনি হাজার ছল, সাজিয়েছ যেন
তোমার এমনি খেলা খেয়ালখুশি
করছে কোলাহল, থামেনি এখনও
চুপিচুপি দেয়াল জুড়ে আঁকছি কত
মন কেমনের খাতা
চুপিচুপি জানতে পেলাম নিরুদ্দেশে
মায়ার চাদর পাতা

কিছুকিছু কথা বসে আছে ভিজে
মিছি মিছি ব্যথা হয়নি যে নিজে
ঝরে যাওয়া পাতা জুড়ে বসে ডালে
মেঘে মেঘে কথা শোনে সে আড়ালে

আকাশ যখন গাইবে বলে বাদলেরই গান
বাতাস তখন বইতে গিয়েও দেখায় অভিমান
অভিমান
আকাশ যখন ফিরতি পথে মন খারাপের সুর
বাতাস তখন নীরব চিঠি পাঠায় বহুদূর
বহুদূর,,,

নিরুর হাতটা শক্ত করে আকড়ে ধরে হাঁটতে হাঁটতে গানটা শুনে মনে হচ্ছিলো দুজন মানুষ অন্য রাজ্যে বিচরণ করছে।কিছুটা সময় নিরুকে নিয়ে রাবারডেমে ঘুরে,বাড়ি আসার পথে থানা থেকে কল আসায় নিরুকে বাড়িতে রেখে আসাদ থানায় যায়।থানার কাজ শেষ করে রাত দুইটার পর বাড়িতে আসে।

নিরু রেস্তোরাঁ নিয়ে যেই পরিকল্পনা করেছিলো,যেই স্বপ্ন বুনেছিলো তা সত্য হয়েছে।নিরুর স্বপ্ন অনুযায়ী ‘স্বচ্ছতা’ রেস্তোরাঁ এখন বিভিন্ন শহরে,নিরু এখন পুরোদমে কাজ শুরু করেছে।বাড়ির সবাই নিরুকে সাপোর্ট করে যাচ্ছে।নিরুর কাজ গুলো সবাই একত্র হয়ে করে দিচ্ছে।নিরুর বুদ্ধি,গুণ,আর পরিশ্রমের ফল আজ এই রেস্তোরাঁর এতো নাম ডাক।

নিরু আশফিককে নিয়ে বিকেলের দিকে রেস্তোরাঁয় গেছে, সন্ধ্যার আগে আসাদ থানা থেকে আসার পথে নিরুদের নিয়ে আসবে।নিরু হালকা রঙের শাড়ি পড়েছে।মাঝখানে সিঁথি করে চুল গুলো বিনুনি করেছে।আসাদ থানা থেকে আসার পর রেস্তোরাঁর বারান্দায় এসে নিরুর সাথে বসে।বাহারি আশফিককে নিয়ে বাইরে গেছে।বাহারি না আসা পর্যন্ত নিরু বাড়ি যেতে পারছে না।নিরু নিজের হাতে চা বানিয়ে আসাদের সাথে বারান্দায় বসলো।চা খেতে খেতে দুজনে গল্পগুজব করছিলো।আসাদ সদ্য প্রেমে পড়ার মতো অপলক চোখে নিরুর মুখের দিকে বার বার তাকাচ্ছিলো।নিরু চোখ দু’টো বন্ধ করে চায়ের কাপে চুমুক দিচ্ছে। আর আসাদ নিরুর দিকে অপলক চোখে তাকিয়ে আছে।আসাদের এমন তাকিয়ে থাকা দেখে নিরু মুচকি হাসছিলো।সুন্দর সময় গুলো একটু বেশিই সুন্দর হয়।

আসাদ পনেরো দিনের জন্য ঢাকাতে হেড অফিসের যাচ্ছে।সকালের দিকেই রওনা দেবে,নিরু ভোরে উঠেই আসাদের ব্যাগ গোছাচ্ছিলো।আশফিক এখনো ঘুমিয়ে আছে।আসাদ আশফিককে উঠিয়ে কোলে নিয়ে কিছুক্ষণ হেঁটে আদর করে আমিনার কাছে দিয়ে এলো।আসাদকে বের হতে দেখলে চিল্লিয়ে কান্না করবে।ঘুমন্ত আশফিককে রেখে যেতেও ইচ্ছে করছিলো না,তাই ঘুম থেকে উঠিয়ে আদর করে দিলো।
আসাদ যাওয়ার সময় নিরুকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে নাকের সাথে নাক ঘেঁষে কপালে গালে চুমু খেলো।নিরুর দিকে আবারও যখন মুখ বাড়াতে যাবে নিরু এক পা পিছিয়ে গিয়ে বলল, “এই আপনার দেরি হয়ে যাচ্ছে না?”

“নিজে থেকে একটা অন্তত চুমু দে।”

“হবে না,যান তো।অনেক দেরি হয়ে গেছে,আশফিক আবার কান্না শুরু করবে।”

আসাদ মুখ এগিয়ে বলল, “এখানে একটা চুমু দে প্লিজ!”

নিরু আসাদের কপালে গালে ঠোঁট ছুয়ে দিলো।আসাদ নিরুর মুখটা ধরে নিরুর ঠোঁটের সাথে নিজের ঠোঁট ছোয়ালো।নিরু কোনমতে নিজেকে ছাড়িয়ে বলল, “এবার তো যান।”

“তাড়িয়ে দিচ্ছিস তো,তোকে আর কখনো চুমু দেব না যা।”

“দিয়েন না।”

“শোন নিরু পরে যেন বাচ্চাদের কিন্তু বলতে পারবিনা,তোমাদের বাবা আমাকে চুমু দেয় না।”

নিরু আসাদের দিকে চোখ কটমট করে তাকালো।আসাদ আবার নিরুর গালে গাঢ় করে একটা চুমু খেয়ে চলে গেল,নিরু আসাদের কর্মকাণ্ডে হেসে ফেললো।

শত বাধা, বিপত্তি, ভালো সময়,খারাপ সময় পেড়িয়ে আজ এই দিনে দুজন দম্পতি।খারাপ সময় পার করে আজ এই সুখের ছোঁয়ায় প্রতিটা মুহূর্ত কাটাচ্ছে,একে উপরের পরিপূরক হয়ে।দুজন আজ ভীষণ সুখী দম্পতি।ভালবাসায় প্রশান্তিতে দিন গুলো বয়ে চলেছে স্বচ্ছ এক প্রেমের স্রোতধারায়!

__________ সমাপ্ত ___________

আসসালামু আলাইকুম!
গল্পটা আমি আমার মনের মতো করে শেষ করতে পারলাম না। পরীক্ষা আবার কিছু সমস্যার জন্য আপনাদের রেগুলার গল্পটা দিতে পারিনি।এই জন্য আমি সত্যি দুঃখিত! গ্যাপের জন্যও গল্পটার সৌন্দর্য ধরে রাখতে পারিনি।তার উপর লেখালেখির জগতে নতুন।আশা করছি আমার ভুল গুলো ধরিয়ে দিবেন।আর ছোট বোন হিসেবে ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here