ধূসর কাবিন রঙিন প্রণয়
পর্ব ৯
চৈতালীর ভোরে ওঠার অভ্যাস। কালরাতে ঘুমাতে অনেকটা দেরি হয়েছে। চৈতালী ওয়াশরুম থেকে বের হয়ে দেখেছে মাহিম আবার রুম ছেড়ে চলে গিয়েছে। না চাইলেও মনটা বিষণ্ণ হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু পরমুহূর্তেই নিজেকে সামলে নিয়েছে। মাহিম কোথায় গিয়েছে আন্দাজ করে শুয়ে পড়েছিল। ক্লান্তিতে ঘুমও নেমেছে চোখ জুড়ে। এখন ভোরের আলো মুখে পড়তে ঘুম ভাঙে। তাকিয়ে দেখে পূর্বাকাশে সূর্য উঁকি মারছে, ঘড়ির কাঁটা ছয়টা বেজে চল্লিশ মিনিটে থেমেছে। পায়ে স্যান্ডেল গলিয়ে নেয় চৈতালী। শাড়ি পরে ঘুমানোর অভ্যাস নেই। তাই ঘুমের ভেতরই এলোমেলো হয়ে গিয়েছে। কোনোরকমে ঠিকঠাক করে নিচে নেমে আসে। এখনও বাড়ির মানুষদের তেমন সাড়াশব্দ নেই। চৈতালী চট করে সদর দরজা পেরিয়ে বাড়ির পেছনের বাগানে চলে যায়। পূজো আসছে বোঝার আরেক উপায় হলো দিগন্ত জুড়ে সাদা কাশের ঢেউ, আর সবুজ ঘাসে ছড়িয়ে থাকা শিউলি ফুল। শাড়ির আঁজলা ভরে ফুল তুলবে ভাবে চৈতালী। এর আগে এইসময় একবার এবাড়িতে এসেছিল। তখন দেখেছিল এই সময় শিউলি তলায় বাগানের এই দিকটা মনোরম হয়ে ওঠে।
“চৈতালী।”
নারী কণ্ঠের ডাকে চমকে ওঠে চৈতালী।
তাকিয়ে দেখে মাহিমের হাত ধরে শিউলে তলার অদূরে দোলনায় বসে আছে চন্দ্রিমা। মাহিমের গায়ে শিউলি সাদা পাঞ্জাবি, আর চন্দ্রিমার পরনে কমলা রঙের শাড়ি। কাকতালীয় ভাবে যেন সকালের শিউলি সাজেই বসে আছে তারা। মাথার উপর নরম রোদ, শিশিরের মতো ঝিকমিক করছে।
“জ্বি আপা।”
“সবসময় ভোরে উঠো?”
“হ্যাঁ। আরও সকালে উঠি। কলেজ যাওয়ার আগে বাড়ির কাজ শেষ করে যেত হতো তো। আম্মার সাথে হাতে হাতে কাজ করতে সকালে উঠতাম।”
“তোমার মুখটা এত মলিন লাগছে কেন? রাতে ঘুম হয়নি? আসলে রাতে আমার শরীরটা খারাপ করেছিল তো। মাহিম তাই আমার সাথেই ছিল। মন খারাপ করো না, হ্যাঁ। আর শোন এমন এলোমেলো অগোছালো থেক না। আম্মি অপছন্দ করেন। বিয়ের পরদিন তোমাকে এই শিউলি ফুলের মতো ঝলমলে না দেখিয়ে কেমন শুকনো মলিন ফুলের মতো লাগছে।”
“আমার পেন্সিল বক্সে একটা বকুলের শুকনো মালা আছে। সেই কবে মালা গেঁথেছিলাম। এখনো কী চমৎকার সুবাস ছড়ায়। অথচ এই শিউলিগুলো একটা দিনও কাটবে না। আমি যে শিউলি ফুল না আপা। আমি বকুল। দেখতে মলিন। কিন্তু শিউলির মতো ক্ষণস্থায়ী না। একটুপর রোদ উঠলেই শিউলিগুলো মলিন হয়ে যাবে, গন্ধ ছড়ানো তো দূর। বকুল কিন্তু শুকিয়ে মলিন হলেও সুবাস ছড়ায়। এবাড়িতে শিউলি রূপে আপনি তো আছেনই রঙ রূপ ছড়াতে। আমি না হয় মলিন বকুল হলাম। সুবাস ছড়ালাম। আর আমি আপা মন খারাপ করি নাই। নতুন বিছানা বলে ঘুম হয়নি। না হলে মাহিম সাহেব আমাদের দু’জনেরই স্বামী। আমরা একে অন্যকে হিংসা করে লাভ নাই। আরও কত রাত আসবে একসাথে কাটানোর জন্য।”
চৈতালী কোঁচড়ে নেওয়া শিউলি ফুলগুলো নিয়ে ঘরের দিকে পা বাড়ায়।
“মাহিম, তুমি কিছু বললে না কেন? ও কী বুঝালো? শিউলির মতো আমারও জীবনও ক্ষণস্থায়ী? এমন কথা ও বলতে পারলো। দুই দিনের আগের চাকরানী, বিয়ে বসতে বা বসতে আমার সাথে সমানে সমান চোখ মিলিয়ে কথা বলে!”
“চন্দ্রিমা, প্লিজ। এসব মেয়ালী ঝগড়ায় আমাকে টেন না। পারতপক্ষে ওর সাথে কথায় জড়িয় না। শোন, ওর বাবা সব জেনেশুনে টাকাপয়সার বিনিময়ে মেয়েকে এই বাড়িতে বিয়ে দিয়েছেন। আমার মনে হয় আলাদা করে ওর সাথে ছলনা না করে বরং ক্লিয়ার করা উচিত যে ও এখানে স্ত্রীর সমঅধিকার পেতে আসেনি। আমাদের যা প্রয়োজন তা দেবে। বিনিময়ে ওর জীবন সিকিউর করার মতো টাকা ও সুযোগ সুবিধা পাবে। বরং বিয়ের ঝামেলার না গিয়ে শুরুতেই সারোগেসির বিষয়টা ক্লিয়ার করলে হতো। লিভার ডোনেশনের ব্যাপারটাও বুঝিয়ে বলা দরকার ছিল।
“বিষয়টা এত সহজ কী? এখানে এখনো অর্গান ডোনেশনের বিষয়টা নিয়ে ট্যাবু কাজ করে। মৃত মানুষের পরিবারও যেখানে মরণোত্তর অর্গান ডোনেশনকে সাপোর্ট করে না, অনুমতি দেয় না। সেখানে চৈতালী বা তার পরিবার কী করে ডোনেশনের জন্য রাজি হতো? ওর বাবার সাথে আম্মি আর দাদাজান কথা বলেছিলেন। তারা শুধু বংশধর পাওয়ার উদ্দেশ্যে বিয়ের কথাটাই বলেছেন। আমাকে লিভার ডোনেট করার কথা তো দূর, চৈতালী যে আমাদের সারোগেট মা হবে এটাই তো তারা জানেন না। জানলেও বিয়ে তোমাকে দিতেনই। সারোগেসিকে ইসলামিক দেশগুলোতে সম্পূর্ণরূপে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে বলে সারোগেসির মাধ্যমে সন্তান নেওয়া বাংলাদেশেও এখনো বৈধ নয়। টেস্টটিউব বেবি আইনগত ভাবে বৈধ হলেও সারোগেসি এখনও বৈধতা পায়নি। দাদাজান যেমন রক্ষণশীল, আম্মি আর দাদীও তেমন। আমরা যদি চৈতালীকে নিয়ে ইন্ডিয়া গিয়েও এই পদ্ধতিতে সন্তান নিতাম, কখনোই তারা মেনে নিতেন না। আমাদের বাচ্চাকে জারজ নামই দিত এই সমাজ। তাই না চাইলেও চৈতালীকে আমার তোমার পাশে মানতেই হয়েছে। কিন্তু ওকে আমি তোমার বিছানায় মানতেই পারছি না। কখনোই হয়তো পারবো না। কাল রাতে তুমি যখন ওর রুমে গেলে নিজেকে সামলানোর অনেক চেষ্টা করেছি। কিন্তু বিশ্বাস করো মনে হচ্ছিল নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে মারা যাব। এই যন্ত্রণার চেয়ে শরীরের যন্ত্রণা সহ্য করা অনেক সহজ ছিল। আমার অবস্থা দেখে ভয় পেয়ে আলেয়া তোমাকে ডেকে আনে। সত্যি তুমি গিয়ে পাশে না বসলে আজকের সূর্য আমার দেখা হতো না হয়তো।”
মাহিম অসহায় বোধ করে। এ কী পরীক্ষায় পড়লো সে। চৈতালী স্বাভাবিকভাবেই তাকে স্বামীর আসনে বসিয়ে স্ত্রীর সমান অধিকার দাবী করছে। চন্দ্রিমা স্বেচ্ছায় এই সবকিছুর আয়োজন করেও এখন মাহিমকে ছাড়তে পারছে না। দমবন্ধ এই পরিবেশ থেকে তাকে বের হতে হবে। মাথা হালকা করতে হবে। চন্দ্রিমা কাঁদছে। হাত বাড়িয়ে বুকে টেনে নেয় মাহিম। রুমের জানালায় দাঁড়িয়ে এই আলিঙ্গন দেখে চৈতালী। চন্দ্রিমা যে এখন চৈতালীকে মেনে নিতে পারছে না বোঝে চৈতালী। কেন জানে না চৈতালী নিজেও চন্দ্রিমাকে এভাবে মাহিমের সাথে দেখে কষ্ট পাচ্ছে। কতটা কাছাকাছি দু’জন। কত ভালো হতো সে যদি এদের মাঝে না থাকতো। এরা নিজেরাই নিজেদের দুনিয়া জুড়ে থাকতো চৈতলীর জীবনেও অন্য কেউ আসতো। না হতো সে মাহিমের মতো রাজপুত্র কেউ। নাই বা হতো এমন রাজবাড়ীর বৌ। তার দুই কামরার একচিলতে বাসায় এমন চমৎকার বাগান আর দোলনা থাকতো না। কিন্তু একটা খাট থাকতো। সেই খাটের একটা কোনে বসে এভাবেই সে তার মানুষটার সাথে দুঃখ ভাগাভাগি করে নিতে পারতো। কাঁধে মাথা রেখে কষ্টগুলো নোনাপানি রূপে ঝরিয়ে দিত। মানুষটা একান্ত তার নিজের হতো। অথচ এখন তাকে এখন নিজের মানুষটাকে নিজের করে পেতে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নামতে হবে। ভালোবাসা আদায় করে নিতে হবে। কেননা নিজের মানুষটা তার একার নয়। তাতে আরেকজনেরও অধিকার আছে সমান সমান, বা আরেকটু বেশি।