দ্বিতীয়_ফাগুন #পর্বসংখ্যা_১৯ #লেখিকা_Esrat_Ety

0
549

#দ্বিতীয়_ফাগুন
#পর্বসংখ্যা_১৯
#লেখিকা_Esrat_Ety

“ভাইয়া আপনার সাথে আমার কথা ছিলো।”
দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে আছে রোদেলা। সাদাফ হেসে বলে,”এসো, ভেতরে এসে বসো।”
রোদেলা ভেতরে ঢুকে সোফাতে বসে। অফিস থেকে সোজাসুজি এখানে এসেছে সে। সাদাফ রোদেলার মুখোমুখি সোফাতে বসে রোদেলাকে বলে,”আমারো তোমার সাথে কথা ছিলো। তোমাকে খবর পাঠাতে চেয়েছিলাম।”
রোদেলা জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকায়,”আমার সাথে? কি কথা?”

_বলবো। আগে তুমি বলো তুমি কি বলতে চাও।

কোনো রকম ভনিতা না করে রোদেলা সরাসরি বলে দেয়,”ভাইয়া আমরা তিনদিনের মধ্যে আপনার ফ্ল্যাট ছেড়ে দিতে চাচ্ছিলাম। এমাসের এডভান্স দিয়ে দিয়েছি যদিও, আপনার চিন্তা করার দরকার নেই। টাকা ফেরত দিতে হবে না। আমরা শুধু চাচ্ছি চলে যেতে।

সাদাফ রোদেলার দিকে তাকিয়ে থাকে। রোদেলা হেসে বলে,”এটাই বলতে এসেছি। উঠি তাহলে?”
উঠতে গিয়েও রোদেলা বসে পরে,সাদাফের দিকে তাকিয়ে বলে,”আপনি কিছু বলতে চেয়েছিলেন ভাইয়া। বলুন।”

সাদাফ একটা ম্লান হাসি দিয়ে বলে,”আমি বলতে চেয়েছি,আমি তোমার আপুকে বিয়ে করতে চাই রোদেলা।”

রোদেলা অবাক চোখে সাদাফের দিকে তাকিয়ে থাকে। সাদাফ বলতে থাকে,”যা বুঝলাম। তোমাদের ফ্যামিলিতে তুমিই অভিভাবক। তাই প্রস্তাবটা তোমার কাছেই রাখলাম।”

রোদেলা বিড়বিড় করে বলে,”মজা করছেন নাকি?”
_এটা মজা করার মতো কোনো বিষয় রোদেলা?

রোদেলা দুমিনিট চুপ করে থাকে। সাদাফ রোদেলার দিকে তাকিয়ে আছে। নীরবতা ভেঙে রোদেলা বলে,”আপুকে কেনো বিয়ে করতে চাইছেন?”
_তোমার আপুকে ভালো লেগেছে আমার।

রোদেলা তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বলে,”ভুল কথা। আপুকে আপনার ভালো লাগেনি। আপনি আসলে আপুর মধ্যে কিছু সুবিধা দেখতে পেয়েছেন। আপু সহজ সরল। মাদার তেরেসার মতো মন আপুর। আপনার বাচ্চা দুটিকে ভালো রাখবে। আর সবথেকে বড় কথা হচ্ছে আপুর কখনো বাচ্চা হবে না সেটা আপনার কাছে খুব বড় একটা সুবিধা। ভবিষ্যতে আপুর বাচ্চা হলে আপনার বাচ্চা দুটো অবহেলিত হবে ,আর যদি সেটা না হয় তাহলে তো লাভই। এসব ক্যালকুলেট করেই আপনি ঠিক করেছেন আপুকে বিয়ে করবেন। কিন্তু আমার আপুকে তো এরকম ক্যালকুলেট করা সম্পর্কে আমি জড়াতে দেবো না। আপুকে যে গ্রহণ করবে তাকে মন থেকে গ্রহণ করতে হবে, সুবিধা দেখে নয়।”

কথা গুলো বলে রোদেলা থামে। সাদাফ মৃদু স্বরে বলে,”এটা তো তোমার দৃষ্টিভঙ্গি রোদেলা। তোমার দৃষ্টিভঙ্গি থেকে যেটা মনে হচ্ছে সেটা তো সত্যি নাও হতে পারে।”

_ওকে মানলাম। আপুকে বিয়ে করার পেছনে যে আপনার কোনো স্বার্থ নেই তার পক্ষে যুক্তি দেখান।
সাদাফ কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থাকে, তারপর বলে,”তোমার আপুকে বিয়ে করতে চাচ্ছি কারন,
নাম্বার এক: আমার ছেলে মেয়ে দুটো তোমার আপুকে ভীষণ পছন্দ করে ফেলেছে। এটা তোমার চোখে আমার স্বার্থ হতে পারে কিন্তু তা নয় রোদেলা,এটা অন্যকিছু।
নাম্বার দুই: তোমার আপুর চোখে আমার ছেলে মেয়ে দুটোর জন্য অগাধ মমতা দেখতে পেয়েছি আমি।
এটাকেও তুমি “আমার স্বার্থ” ভাবতে পারো। কিন্তু তা নয়। সত্যিই তা নয়।
তিন নাম্বার কারন: দেখলাম তোমার মাদার তেরেসা আপু অনেক কেয়ারিং। আর দীর্ঘদিন আমার কেউ কেয়ার করে না। হঠাৎ মন চাইলো কেউ একটু কেয়ার করুক আমার।
এটাও আমার স্বার্থ ভাবতে পারো। কিন্তু তা নয়। সত্যিই নয়।

তোমার আপুকে বিয়ে করতে চাওয়ায় চার নাম্বার ও শেষ কারনটি হচ্ছে,”তোমার আপু খুব দুঃখী মানুষ। আমিও একজন দুঃখী মানুষ।একজন দুঃখী মানুষ আরেকজন দুঃখী মানুষের দুঃখ খুব ভালো করে বুঝতে পারবে।”

এই পর্যন্ত বলে সাদাফ থামে। তারপর বলে,”জানি এইসব নড়বড়ে যুক্তি। কিন্তু কথাগুলো সত্যি। হ্যা আমি তোমার আপুর মধ্যে সিরাত,সুহার মায়ের যোগ্যতা দেখেছি,আমার সঙ্গিনী হবার যোগ্যতা দেখেছি। তবে রোদেলা আমি ক্যালকুলেট করে দেখিনি সবকিছু। হঠাৎ করে মন বললো এই একাকী জীবনে কাউকে দরকার। দেখলাম মেঘলার মতো কেউ হবে না। এই আর কি।
রোদেলা চুপচাপ সাদাফের দিকে তাকিয়ে আছে। সাদাফ রোদেলার দিকে তাকিয়ে বলে,”কি? চুপ করে আছো কেনো? ভাইভা নেওয়া হয়ে গিয়েছে? দেখো আমি নেতা মানুষ,সোজাসাপ্টা কথা বলি, শুনতেও পছন্দ করি। বলো, আমি কি পাশ?”

রোদেলা কয়েক মুহূর্ত পরে হেসে ফেলে,মুখে হাসি নিয়েই বলে,”পাশ ভাইয়া।”
***
বোনকে দেখে মেঘলা লজ্জিত ভঙ্গিতে বলে,”সিরাত সুহা পুরো রুমটা এলোমেলো করে দিয়ে গিয়েছে। তুই প্লিজ রাগ করিস না। আমি এক্ষুনি গুছিয়ে দিচ্ছি। প্রতিদিন তো করে না ওরা এমন।”

রোদেলা কাঁধ থেকে ব্যাগ নামিয়ে টেবিলে রেখে মেঘলাকে দেখে। মেঘলা বিছানার চাদর ঠিকঠাক ভাবে গুছিয়ে দিচ্ছে।
রোদেলা পেছনে দাঁড়িয়ে বলে ওঠে,”এই আপু। বিয়ে করবি?”

মেঘলা মাথা ঘুরিয়ে হা করে বোনের দিকে তাকায়। রোদেলার মুখ হাসিহাসি। সে মেঘলার দিকে তাকিয়ে আবার বলে,”সুহা আর সিরাতের বাবাকে বিয়ে করবি? তাহলে ওরা প্রতিদিন অগোছালো করলে তুই প্রতিদিন গোছাতে পারবি সব।”

মেঘলা চমকে ওঠে। কয়েক মুহূর্ত বোনের দিকে তাকিয়ে মেজাজ দেখিয়ে বলে,”এটা কোন ধরনের ফাজলামি রোদেলা?”

রোদেলা হাসে। বোনের হাত দুটো মুঠি করে ধরে বলে,”ফাজলামি না। সাদাফ ভাইয়া প্রস্তাব দিয়েছে। তোকে সে বিয়ে করতে চায়।”

মেঘলা হতভম্ব হয়ে রোদেলার দিকে তাকায়,কন্ঠে একরাশ বিরক্তি নিয়ে বলে,”ছিঃ ছিঃ এসব কোন ধরনের কথা। তুই বকা দিয়ে দিসনি?”
_বকবো কেনো?
রোদেলা হাসতে হাসতে বলে। তারপর বলে,”বল তুই রাজি কি না। তাহলে ওনাকে জানিয়ে দেবো।”

_অসম্ভব রোদেলা।
_কেনো? সমস্যা কি?
_সমস্যা কি মানে। সে প্রস্তাব দিলেই আমাকে রাজি হতে হবে নাকি! আশ্চর্য!
_আচ্ছা ঠিকাছে, তাহলে কালকেই এই ফ্ল্যাট আমরা ছেড়ে দেবো, এখানে আর থাকবো না।

মেঘলা অবাক হয়ে বলে,”কেনো?”
_তোকে আর সাদাফ ভাইকে নিয়ে লোকজন কেচ্ছাকাহিনী রটিয়ে বেড়াচ্ছে। বিয়ে না হলে লোকজন আরো বলতে থাকবে। তার চেয়ে এখান থেকে চলে যাওয়াই ভালো।
মেঘলা মিনমিন করে বলে,”সুহা সিরাতকে আর দেখতে পাবো না…..”
_কেনো? সুহা সিরাত তোর কে হয় যে ওদের দেখতে হবে আজীবন?
মেঘলা চুপ করে থাকে। রোদেলা বোনের কাঁধে হাত রেখে নিচুস্বরে বলে,”তোর একটা সংসারের খুব সাধ ছিলো তাইনা? সাদাফ ভাইয়ের একটা সুন্দর সংসার আছে কিন্তু সংসারটা বহুদিন হয় অগোছালো হয়ে পরে আছে। তুই একটু গুছিয়ে দিবি না হয়।”

মেঘলা চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে। রোদেলা বোনের গালে হাত রেখে বলে,”সমস্যা কি? সাদাফ ভাইকে পছন্দ না? সাদাফ ভাই কুচকুচে কালো সেজন্য? নিজে একটু সুন্দরী হয়েছিস আর অহংকারে মাটিতে পা পরছে না তাইনা?
মেঘলা চোখ গরম করে রোদেলার দিকে তাকায় কথাটি শুনে। রোদেলা হাসতে হাসতে বলে ,”তাহলে সমস্যা কি? লোকটার বাচ্চা দুটোকে ভালোবাসিস। লোকটাকে অপছন্দ কেনো?”

মেঘলা মিনমিন করে জবাব দেয়,”উনি কেমন গুন্ডা প্রকৃতির লোক।”

রোদেলা উচ্চশব্দে হেসে ফেলে। মেঘলা চুপ করে আছে। হাসি থামিয়ে রোদেলা বোনের গাল দুটো আগলে ধরে, মৃদু স্বরে বলে,”একজন পুলিশের সাথে তো সংসার করে দেখলি। এবার না হয় একটা গুন্ডার সাথে সংসার করে দেখবি।”

***
রুহুল আমিনকে খুবই আনন্দিত দেখাচ্ছে। মেয়ের বিয়ে নিয়ে যতটা না আনন্দিত সে তার চেয়েও বেশি আনন্দিত হচ্ছে সালমান সাদাফের মতো একজন লোক তার জামাই হবে এটা ভেবে।

রোদেলার সাথে সাদাফের কথা হয়েছে। ঠিক করেছে আজ মাগরিব বাদ কাজী ডেকে বিয়ে পড়ানো হবে। ঘরোয়া ভাবে হবে সবকিছু। সালমান সাদাফ এপার্টমেন্টের প্রত্যেকটা ফ্ল্যাটে গিয়ে জানিয়ে দিয়ে এসেছে সেই কথা। সরাসরি না বললেও সবাইকে বুঝিয়ে দিয়ে এসেছে মেঘলাকে নিয়ে আর কোনো অপমান জনক কথা নয়।
সাদাফের বোন সেতু এসেছে তার স্বামীকে নিয়ে। সকাল থেকে তারা মেঘলার জন্য শপিং করতে ব্যস্ত। যতোই ঘরোয়া ভাবে হোক,ভাইয়ের বৌয়ের জন্য কোনো আয়োজন বাদ রাখা চলবে না।

রুহুল আমিন ফুরফুরে মেজাজ নিয়ে রোদেলার ঘরের সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। রোদেলা বিছানায় নতুন চাদর বিছিয়ে দিচ্ছিলো। বাবাকে দেখে বলে,”কিছু বলবে?”
_ও বাড়ির লোকদের তো জানানো উচিত রোদেলা। বৃষ্টি তার বোনের বিয়েতে আসবে না? যত যাই হোক,আদিল তো আমার জামাই? না জানালে যদি বৃষ্টিকে কথা শোনায়?

রোদেলা বিছানার বালিশ দুটো ঠিক করতে করতে বলে,”তুমি আমাকে এতোটা অসামাজিক ভাবো তা তো জানতাম না। আফতাব আংকেলকে কাল রাতেই ফোন করে বলেছি আমি। তারা আসবে বিকেলে। ”
_তাশরিফ ছেলেটাকে ফোন করেছিস আলাদা করে?
রোদেলা অবাক হয়ে বলে,”ওনাকে আলাদা করে ফোন করে বলার কি আছে?”
_ও বৃষ্টির ভাসুর। কতটা সম্মান করে বৃষ্টি ওকে। ওকে আলাদা করে বলবি না?
রোদেলা বাবার দিকে না তাকিয়ে বলে,”তোমার সব কিছুতে বাড়াবাড়ি। আচ্ছা তোমার ফোন আছে না? তুমি করতে পারো না এসব?”
রুহুল আমিন হেসে ফেলে,”তাই তো! আসলে তোর ওপর এতোটা নির্ভরশীল হয়ে গিয়েছি যে কি বলবো……তোর বিয়ে হলে যে কি হবে আল্লাহ জানে!”
রোদেলা নির্বিকার ভঙ্গিতে বলে,”বিয়েই করবো না। চিন্তা করো না তুমি।”

***

“সে কি তুমি শাড়ি পরেছো কেনো!”
বৃষ্টিকে দেখে চেঁচিয়ে বলে তাহমিনা। বৃষ্টি ঘাবড়ে যায়। সবাই তাহমিনার দিকে তাকায়। বৃষ্টি নিচু স্বরে বলে,”কেনো মা? আপুর বিয়েতে যাচ্ছি,শাড়ি পরবো না?”
_পাগল হয়েছো? একে তো শাড়ি পরার অভ্যাস নেই তার ওপর এই অবস্থায় শাড়ি পরে দৌড়াদৌড়ি,নাচানাচি করে অসুস্থ হয়ে পরবে। আর পা দেখি তো…….
তাহমিনা বৃষ্টির পায়ের দিকে তাকায়। পুনরায় চেঁচিয়ে বলে,”ওমা,তুমি হাই হিল পরেছো কেন? হায় আল্লাহ এই মেয়েকে বুঝ দাও। এই অবস্থায় এসব পরতে নেই জানো না?”
বৃষ্টি মুখ কালো করে ফেলে। আদিল বলে,”মা ওর অসুবিধে না হলেই তো হলো।”
তাহমিনা আদিলকে ঝাড়ি মেরে বলে,”তুই চুপ থাক। এসব পরে হাটবে, তারপর একটা অঘটন ঘটলে তখন কি হবে? মা হওয়া এতো সহজ নাকি। আরো কত কত যে স্যাক্রিফাইস করতে হবে দেখতে থাকো। যাও, স্লিপার পরে আসো। যাও।”
বৃষ্টি মুখ কালো করে ঘরে যায়। তাশরিফ বিরক্তি নিয়ে বলে,”মা ভালো কথাও এভাবে ওকে ধমকে বলো। ওর মন খারাপ হয় না বুঝি? বেচারী মায়ের আদর পায়নি কখনো‌।”
_তুই চুপ থাক। আমার ছেলের বৌকে আমি বকবো,ভালোবাসবো যা খুশি করবো। তুই কে কথা বলার?

তাশরিফ কিছু বলে না। মনে মনে বলে,”যত খুশি বৃষ্টির উপরেই চেঁচিয়ে নাও। তোমার বড় ছেলের বৌ আসলে তুমি,আমি দুজনেই সারাদিন মিউমিউ করতে থাকবো মা‌।”
***

আয়েশা সিদ্দিকার কাছে বসার ঘরে সবাইকে শরবত দেওয়ার কথা বলে রোদেলা মেঘলার ঘরে যায়। মেঘলার ঘরে বৃষ্টি আর সেতু মিলে মেঘলাকে সাজিয়ে দিচ্ছে। মেঘলা রোদেলার দিকে তাকিয়ে বলে,”এভাবে সাজাতে নিষেধ কর ওদের। বাড়াবাড়ি লাগছে।”

রোদেলা হাসে,”কিচ্ছু বাড়াবাড়ি লাগছে না। একটু গয়না পরে থাকা কোনো সাজের মধ্যে পরে না।”

সেতু মেঘলার কানে দুল পরিয়ে দিতে দিতে বলে,”এগুলো ভাইয়া সকালে গিয়ে নিয়ে এসেছে তোমার জন্য। সিমিন ভাবীর গয়না সব মায়ের কাছে আছে। ভাইয়া ওগুলো তোমাকে দিতে দেয়নি। বলেছে একজনের জিনিস অন্যজনকে কেনো দেবো? নতুন মানুষ, নতুন গয়না। ‌”

মেঘলা কিছু বলে না। লোকটার সাথে এই দুদিনে একবারো কথা হয়নি মেঘলার। দেখাই হয়নি তাদের। যা কথা বলার রোদেলা বলেছে। দুদিন আগেও যে লোকটা পরপুরুষ ছিলো আজ সন্ধ্যা থেকে সে স্বামী হয়ে যাবে! কি অদ্ভুত নিয়তির খেলা।

রোদেলা বৃষ্টির দিকে তাকিয়ে বলে,”কদিনেই তো মোটা হয়ে গিয়েছিস। শাশুড়ি অনেক খাতির যত্ন করে বুঝি?”

বৃষ্টি লজ্জা পাওয়া মুখ নিয়ে বলে,”হ্যা। মা তো সারাদিন এটা ওটা নিয়ে আমার পিছনে দাঁড়িয়ে থাকে।”

রোদেলা বলে,”দাঁড়িয়ে তো থাকবেই। তুই তাকে নাতী নাতনি দিবি যে, দুনিয়ায় কেউই স্বার্থ ছাড়া কিছু করে না বুঝলি! ”

মেঘলা চোখ গরম করে রোদেলাকে বলে,”তুই কখনো কোনোকিছু সহজ ভাবে দেখবি না তাইনা? ওর মন খারাপ করে দিস না। বসার ঘরে যা। আজ আদিল প্রথম এসেছে শশুর বাড়ীতে,গিয়ে দেখ ওর কিছু লাগবে কিনা।”

_ওটাকে দেখলেই তো আমার চড়াতে ইচ্ছা করে আপু।
রোদেলা নির্বিকার ভঙ্গিতে বলে। বৃষ্টি হতভম্ব হয়ে মেজো আপুর দিকে তাকায়।
রোদেলা বলে,”এভাবে তাকিয়ে থাকার কিছু নেই, সত্যি কথাই বললাম।”
কথাটি বলে রোদেলা চলে যায়। বৃষ্টি মেঘলার দিকে আহত দৃষ্টিতে তাকায়। মেঘলা ওকে শান্তনা দিয়ে বলে,”মন খারাপ করিস না। জানিসই তো,ও একটা পাগল।”

বসার ঘরে গিয়ে দাঁড়িয়ে পরে রোদেলা। আদিল সিমেন্ট আপুকে দেখতে পেয়েই গুটিয়ে নেয় নিজেকে। বিরস মুখে বসে থাকে কোনার একটা সোফায়। তাশরিফ ফোন টিপছিলো,রোদেলার অস্তিত্ব টের পেয়ে মাথা তুলে তাকায়। রোদেলা বলে,”আংকেল আন্টি আসেনি কেনো?”

_বাবার হঠাৎ একটু বরিশাল যেতে হয়েছে আর মা আসেনি কারন বাবা আসেনি।

রোদেলা আদিলের দিকে তাকিয়ে বলে,”তুমি এভাবে সবসময় চোরের মতো হাবভাব কেনো করো? তোমাকে দেখলেই মনে হয় কিছু একটা চুরি করে এসেছো।”
আদিল কি বলবে কিছু বুঝতে পারছে না। তাশরিফ বলে ওঠে,”ও আপনাকে ভয় পায়। তাই মুখটা এমন করে রাখে। কথায় কথায় আমার ভাইকে অপমান করবেন না।”

রোদেলা কিছু বলে না তাশরিফের কথার জবাবে। আদিলের দিকে তাকিয়ে বলে,”শরবত খেয়েছো?”
আদিল মাথা ঝাঁকিয়ে উত্তর দেয়। রোদেলা বলে,”নতুন জামাই, এখানে এভাবে বসে থাকতে হবে না। আমার সাথে এসো, বৃষ্টির রুমে গিয়ে বিশ্রাম করবে।”
আদিল বাধ্য ছেলের মতো উঠে দাঁড়ায়।

তাশরিফ মনে মনে বলে,”আর নিজের হবু জামাইকে এভাবে বসিয়ে রাখার মানে কি? আমারো রুম চাই।”

মাগরিবের নামাজের পরে কাজী বিয়ে পড়ানোর জন্য বসলেন। মেঘলাকে এনে সাদাফের পাশে বসিয়ে দেওয়া হলো। সাদাফ আজ শুধু একটা সাদা রঙের পাঞ্জাবি পরে আছে। উপরে মুজিব কোট নেই। সিরাত আর সুহা মেঘলা আর সাদাফের মাঝখানে গিয়ে বসে আছে। তারা দাদীর থেকে শুনেছে আজ আন্টি আর বাবার বিয়ে হবে। কিন্তু সবাই এখানে আন্টি আর বাবাকে পড়াশোনা করাতে বসিয়েছে কেনো? আন্টি আর বাবাকে দিয়ে কিসব লেখাচ্ছে একটা লোক। কাজী কে দেখে তারা ভাবছে একজন টিচার।

সেতু দুষ্টুমি করে মেঘলাকে বলে,”ভাবী তোমার বাপের বাড়ী থেকে শশুর বাড়ী যেতে কোনো গাড়ি ভাড়া লাগবে না,দেখেছো! ভাইয়া আর তোমার অনেক টাকা বেঁচে গেলো।”

কাজী বিয়ে পড়াতে শুরু করে। রোদেলা মেঘলার পাশে দাঁড়িয়ে আছে। তাশরিফ মাথা ঘুরিয়ে রোদেলার দিকে তাকিয়ে মনে মনে বলে,”পৃথিবীর সবাই বিয়ে করে নিচ্ছে। শুধু আপনি আর আমি ছাড়া।”

কবুল বলে সালমান সাদাফকে স্বামী হিসেবে গ্রহণ করে নিয়েছে মেঘলা। তার জীবনের নতুন একটা অধ্যায়ের সূচনা হয়েছে। শরীরটা একটু একটু কাঁপছে। রোদেলা বোনকে ধরে বলে,”চল তোকে রুমে নিয়ে যাই। বিশ্রাম নিবি।”

খাওয়া দাওয়ার পর্ব শেষ হতেই জাহানারা মেঘলাকে সাদাফের ফ্ল্যাটে নিয়ে যেতে তাড়া দেয়। সবাই বসার ঘরে কথা বলছে।
রোদেলার রুমে মেঘলা চুপচাপ বসে আছে। আয়েশা সিদ্দিকা দূরে দাঁড়িয়ে দেখছে তাকে। তিনি এই মেয়েটার জন্য অনেক অনেক দোয়া করছে,এই মেয়েটা যেন অনেক সুখী হয়,স্বামী সোহাগী হয়।

কিছুক্ষণ পরে রোদেলা, বৃষ্টি আর সেতু ভেতরে ঢোকে। রোদেলা বলে,”আপু ওঠ। তোর বাড়িতে যাবি না? তোর সংসারে?”

মেঘলা রোদেলার দিকে তাকায়। রোদেলার মুখ হাসিহাসি। মেঘলা ধীরে ধীরে বিছানা থেকে নামে। দুই পা সামনে দিয়ে থেমে যায়। পেছনে ঘুরে আয়েশা সিদ্দিকাকে দেখে। আয়েশা সিদ্দিকা তার দিকে তাকিয়ে আছে। মেঘলা মৃদু স্বরে বলে ওঠে,”আন্টি আমাকে শিখিয়ে দেবেন কিভাবে অনেক ভালো সৎ মা হওয়া যায়? আমিও আপনার মতো অনেক ভালো সৎমা হতে চাই।”

আয়েশা সিদ্দিকা দৌড়ে এসে মেঘলাকে জরিয়ে ধরে। কেঁদে কেঁদে মেঘলার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলে,”দেবো।”

***
মেঘলা চলে যাওয়ার পরে সবাই কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে থাকে। রোদেলার মুখ বিষন্নতায় ছেয়ে আছে। তাশরিফ রোদেলাকে একপলক দেখে পাঞ্জাবির হাতা গুটিয়ে নিয়ে আদিলকে বলে,”এতো রাতে বৃষ্টিকে নিয়ে জার্নি করা ঠিক হবে না। তুই আর বৃষ্টি বরং কাল সকালে চলে আসিস। আমি উঠছি।”

রুহুল আমিন তাশরিফকে বাঁধা দিয়ে বলে,”এতো রাতে তোমাকেও ছাড়ছি না বাবা। তুমিও আজ রাতটা থাকবে।”

তাশরিফ হেসে বলে,”না আংকেল। তা হয়না।”

রোদেলা চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। রুহুল আমিন শেষমেশ জোরাজুরি করে তাশরিফকে রেখে দেয়।

রোদেলা বৃষ্টিকে গিয়ে বলে,”তুই আর তোর স্বামী তোর রুমে থাক। আপু আর আমার রুমে তোর ভাসুরকে থাকার ব্যবস্থা করে দিচ্ছি। ওনাকে দেখিয়ে দে ঘর।”

বৃষ্টি অবাক হয়ে বলে,”আমার রুম মানে? আমার জন্য এখানেও আলাদা রুম আছে আপু?”

_হ্যা আছে। তোর সবকিছু গুছিয়ে রাখা। জামাই নিয়ে প্রথম আসবি তাই মেঘলা আপু গুছিয়ে দিয়ে গিয়েছে তোর জন্য।

_আর তুমি কোথায় থাকবে আপু?

_আমি তিনতলায় যাচ্ছি। সেতু আপুর স্বামী রাতে চলে গিয়েছে। আমি সেতু আপুর কাছে গিয়ে থাকবো।

***

“পৃথিবীতে আমিই বোধ হয় একমাত্র পুরুষ যার বিয়ের আগে হবু বৌয়ের রুমে ঘুমানোর সৌভাগ্য হয়েছে।”

বিড়বিড় করে কথাটি বলে রোদেলার বিছানায় ধপ করে বসে পরে তাশরিফ। ঘড়ির কাঁটা এখন সাড়ে বারোটার ঘরে আছে। তার ঘুম আসছে না। কিছুক্ষণ পায়চারি করে, কিছুক্ষণ শুয়ে থাকে। এভাবেই কেটেছে ঘন্টা খানেক। মাথায় একটা কথা ঘুরপাক খাচ্ছে শুধু। আর দেরী না করে রোদেলাকে প্রস্তাব দিয়ে ফেলবে নাকি সে? রোদেলাকে সে প্রচন্ড ভয় পায়,যদি তাশরিফকে ফিরিয়ে দেয়! কিন্তু এভাবে আর কতদিন ভয়ে ভয়ে কাটাবে সে। একদিন যদি হুট করে রোদেলা আমিন বিয়ে করে নেয় তাহলে তাশরিফ হাসানের তো দেবদাস হয়ে যেতে হবে!

মাথা ঘুরিয়ে রোদেলার রুমটা দেখতে থাকে তাশরিফ‌। হঠাৎ করে রোদেলার স্টাডি টেবিলের দিকে চোখ যায় তাশরিফের। টেবিলের উপরে হুমায়ূন আহমেদ এবং সিডনি শেলডনের কিছু উপন্যাস সাড়ি করে সাজিয়ে রাখা। এসব নিশ্চয়ই ওই রোদেলা আমিন পড়েন না। উপন্যাস আর রোদেলা আমিন! অবিশ্বাস্য ব্যাপার। গল্প উপন্যাস পড়া মেয়েরা কখনো হিটলারের ফিমেল ভার্সন হয় না। তারা নমনীয় হয়।তাশরিফ ঠিক করেছে বিয়ের পরে টানা তিনমাস প্রতিদিন রাতে রোদেলাকে দিয়ে একটা করে উপন্যাস পড়াবে সে। হিটলারের মতো স্বভাব চরিত্র পাল্টে মহাত্মা গান্ধীর মতো বানিয়ে ফেলবে একেবারে।

হাত বাড়িয়ে তাশরিফ বই গুলোর ভেতর থেকে সিডনি শেলডনের “রেজ অব এ্যাঞ্জেলস” বইটা তোলে। হঠাৎ তাশরিফের দৃষ্টি একটা ডায়েরীর উপর গিয়ে নিবদ্ধ হয়। কৌতুহলী হয়ে ডায়েরীতে হাত দেয় তাশরিফ। ডায়েরীর উপরে গোটা গোটা অক্ষরে লেখা “এটা রোদেলা আমিনের ডায়েরী। এই ডায়েরীতে হাত দেওয়া যাবে না।”
তাশরিফ হেসে ফেলে। কি সুন্দর কথা! উনি ডায়েরীর উপর এসব লিখে রাখবেন আর সবাই এটা দেখে ভয় পেয়ে গিয়ে হাত দেবে না ডায়েরীতে !
যতখানি বুদ্ধিমতি মেয়ে মনে হয়, রোদেলা আমিন তা নয়,মাথার স্ক্রু সামান্য ঢিলা।

তাশরিফ বিড়বিড় করে বলে,”এই যে দিলাম হাত। এখন কি করবেন রোদেলা আমিন?”
হাত দিয়ে ডায়েরীর পাতা ওল্টায় তাশরিফ। তাশরিফকে খুবই উত্তেজিত দেখাচ্ছে, খুব নিষিদ্ধ একটা কাজ করতে যাচ্ছে সে এখন । অন্যের ব্যক্তিগত ডায়েরী পড়া অপরাধ। কিন্তু তাশরিফ এই অপরাধ টা করতে পেরে আনন্দিত। এই ডায়েরী যার তার ডায়েরী নয়,রোদেলা আমিনের ডায়েরী,তার পেঁচা মুখীর ডায়েরী…।

চলমান….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here