#মন_বাড়িয়ে_ছুঁই
পর্ব-৫
লেখা: ফারজানা ফাইরুজ তানিশা
.
“রাফসান, তোর সাথে আমার কথা আছে। একটু সাইডে আয়।”
রাফসান ড্রিংকসের গ্লাসে চুমুক দিয়ে বিভোরের পিছুপিছু গেল।
“আমি জানি তোর স্বভাব কেমন! তাই তোকে আগেই পৃথুলার ব্যাপারে সাবধান করেছিলাম। তোকে বলে দিয়েছি অন্তত আমার গার্লফ্রেন্ডের দিকে তুই তোর নোংরা দৃষ্টি একদম দিবি না।”
রাগান্বিত স্বরে বলল বিভোর। গ্লাসের বাকি কৃষ্ণবর্ণ তরলটুকু মুখে ঢেলে রাফসান বলল,
“কুল ডাউন ব্রাদার। আমি তো উড বি ভাবির সাথে কিছুই করিনি।”
বিভোর দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
“পৃথুলা বলেছে আমাকে। তুই ওর শরীরে হাত দিয়েছিস কেন?”
“লিসেন ব্রো, তোর সাথে ওর বিয়ে হলে ও হয়ে যাবে আমার ভাবি। তো দেবর হিসেবে ভাবির কোমড়ে হাত দেওয়া স্বাভাবিক ব্যাপার।”
বিভোর রাগ চেপে রাখতে না পেরে রাফসানের কলার চেপে ধরল।
“তুই আমার ভাই বলে বেঁচে গেলি। নয়তো তোকে….”
রাফসান কলার ছাড়াতে ছাড়াতে বলল,
“নয়তো কি? সত্যি বলতে তোর গার্লফ্রেন্ডটা এত সেক্সি না! শুধু কোমড়ে হাত ছুঁইয়ে মন ভরছিল না। ইচ্ছে করছিল বিছানায় নিয়ে যাই।”
বাম চোখ টিপে বলল রাফসান। বিভোরের রাগ এবার তুঙ্গে উঠে গেল। সাত পাঁচ না ভেবে ঘুষি লাগাল রাফসানের মুখ বরাবর। নাক ফেটে রক্ত গড়িয়ে পড়তে লাগল নাক থেকে৷ মুহূর্তেই পরিস্থিতি থমকে গেল৷ বিভোর চেঁচিয়ে বলল,
“শালা রাসকেল, গেট আউট ফ্রম মাই হাউজ। আর কোনোদিন যেন তোকে এ বাড়ির তৃ সীমানায় না দেখি। গেট আউট।”
উপস্থিত সবাই হতভম্ব। হঠাৎ কি থেকে কি হয়ে গেল সেটা কারোই বোধগম্য হচ্ছে না। আসাদ হক বিভোরের কাছে এসে জিজ্ঞেস করলেন,
“কি হয়েছে বিভোর? তুমি রাফসানের গায়ে হাত তুলেছো কেন? এ কেমন অভদ্রতা বিভোর!”
বিভোর বাবার কথায় পাত্তা দিল না। আরো জোরে চিৎকার করে বলল,
“গেট আউট রাফসান।”
রাফসান রক্তমাখা নাকের উপর টিস্যু চেপে ডান হাতের তর্জনী আঙুল তুলে বিভোরকে বলল,
“খুব বড় ভুল করেছিস তুই বিভোর। ওই মেয়েটার জন্য তুই আমার গায়ে হাত তুলেছিস, তাইনা? এর মূল্য তোকে চুকাতে হবে। এবং সেটা খুব শীঘ্রই। মিলিয়ে নিস।”
বলে আর দাঁড়াল না। গটগট করে হেঁটে চলে গেল। আসাদ হক পুণরায় বিভোরকে জিজ্ঞেস করলেন,
“কি হয়েছে বিভোর? কথা বলছো না কেন? কি করেছে ও?”
বিভোর এবারেও জবাবে কিছু বলল না। দ্রুত পায়ে হেঁটে চলে গেল নিজের বেডরুমের দিকে।
বিভোর আসাদ হকের রুমে উঁকি দিয়ে বলল,
“আব্বু আসব?”
ল্যাপটপ থেকে চোখ সরিয়ে বিভোরের দিকে তাকালেন আসাদ হক। গম্ভীর কণ্ঠে বলল,
“হুম, এসো।”
ধীরপায়ে হেঁটে আসাদ হকের সামনে গিয়ে দাঁড়াল বিভোর। আসাদ হক আদেশের সুরে বললেন,
“বসো।”
বিভোর বসল বাবার পাশে৷ আসাদ হক ল্যাপটপটা বন্ধ করে সাইডে রাখলেন। তার বিভোরের দিকে তাকিয়ে বললেন,
“মেজাজ ঠাণ্ডা হয়েছে?”
বিভোর জবাব দিল না। আসাদ হক বললেন,
“কাল তোমার আর রাফসানের মধ্যে কি হয়েছে আমি জানিনা। তবে আমার আন্দাজ বলছে, পৃথুলা মেয়েটাকে নিয়েই কিছু হয়েছে। যাই-ই হোক না কেন সে ব্যাপারে জানার আগ্রহ আমার নেই। আমি কিছু কথা বলার জন্য তোমাকে ডেকেছিলাম।”
“বলো।”
“পৃথুলা মেয়েটা সুন্দরী, আহামরী সুন্দরীদেরই একজন। কিন্তু রূপ দিয়ে তো সব হয়না। ওর বাবা একটা সরকারী কলেজের টিচার। মধ্যেবিত্ত ফ্যামিলি ওদের। আমাদের সাথে কিছুতেই ওদের যায়না।”
“কি বলতে চাইছ তুমি?”
“সেটা না বোঝার মতন বোকা তুমি নও বিভোর। আমি ভেবেছিলাম তুমি আমাদের মতই উচ্চবিত্ত ফ্যামিলির কোনো মেয়েকেই পছন্দ করেছো। সে বিশ্বাস আমার তোমার উপরে ছিল। তাই তুমি পৃথুলার কথা বলার পর ওর পরিবার সম্পর্কে আমি কিছুই জানতে চাইনি। জানার প্রয়োজনও মনে করিনি। কিন্তু যখন জানলাম তখন ওই পরিবারের সাথে আত্মীয়তা করতে আমার ঘোর আপত্তি আছে।”
“আমারও আপত্তি আছে তোমার সিদ্ধান্তে।”
“বিভোর!”
“তুমি পৃথুলাকে মেনে নিবে কীনা সেটা তোমার ডিসিশন। কিন্তু তুমি মেনে না নিলেও আমি ওকেই বিয়ে করব।”
ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস ফেলে বিভোরের দিকে তাকলেন আসাদ হক। তার একমাত্র ছেলেকে বড্ড জেদী বানিয়ে তুলেছেন তিনি। এখন ছেলের সিদ্ধান্ত মেনে নেওয়া ছাড়া আর কিছু করার নেই তার।
কেটে গেছে এক সপ্তাহ। সব আগের মতই চলছিল। সকালে নাস্তা করে বাসা থেকে বেড়িয়ে টিউশনিতে গেল পৃথুলা। সেখান থেকে কলেজে যাবে। রাস্তায় দাঁড়িয়ে বাসের জন্য অপেক্ষা করছে। ক্লাসের সময় হয়ে এলো। কিন্তু বাস পাচ্ছে না। একটা বাস গেছে একটু আগে। সেটাতে মানুষ ভর্তি ছিল। দাঁড়ানোর মত জায়গাও অবশিষ্ট ছিল না। পৃথুলা হাতঘড়িতে সময় দেখল। ইতিমধ্যে ন’টা চল্লিশ বেজে গেছে। আচমকা একটা গাড়ি এসে থামে পৃথুলার সামনে। ঘড়ি থেকে মুখ তুলে সামনে তাকাল ও। গাড়ি থেকে রাফসানকে নামতে দেখে ওর শরীর রি রি করে উঠল। এই লোকটার বিচ্ছিরি চোখের চাহনি দেখলে গাঁ গুলায় পৃথুলার। রাফসান পৃথুলার সামনে এসে দাঁড়াল।
পৃথুলার ভেতরে অস্বস্তি লাগলেও বাইরে সেটা প্রকাশ করল না। ভদ্রতাসূচক স্মিত হেসে বলল,
“আসসালামু আলাইকুম ভাইয়া।”
“ওয়ালাইকুম আসসালাম। পৃথুলা, তুমি এখানে?”
“কলেজে যাব। বাসের জন্য অপেক্ষা করছিলাম।”
“ও। তুমি আমার চেয়ে বয়সে অনেক ছোট। তাই তুমি করেই বলছি। ডোন্ট মাইন্ড।”
পৃথুলা কিছু বলল না। এই অসভ্য ছেলেটার কাছ থেকে কেটে পড়তে পারলেই বাঁচে।
“বিভোরকে দেখতে গিয়েছো?”
রাফসানের কথায় অবাক হয়ে পৃথুলা জানতে চাইল,
“বিভোরকে দেখতে যাব কেন?”
“তুমি কিছু জানো না?”
“না তো। কি হয়েছে বিভোরের?”
উদ্বিগ্ন গলায় প্রশ্ন করল পৃথুলা।
“বিভোর কার এক্সিডেন্ট করেছে।”
পৃথুলা বিষ্ফোরিত দৃষ্টিতে তাকাল রাফসানের দিকে। বলল,
“একসিডেন্ট করেছে! কখন?”
“গতকাল সন্ধ্যায়। আমি অবশ্য সকালেই শুনেছি। এখন ওকে দেখতেই হসপিটালে যাচ্ছি।”
“কিন্তু কাল রাতেই তো বিভোরের সাথে কথা হয়েছে আমার। কই বিভোর তো কিছু জানালো না আমায়!”
রাফসার চতুরতার সাথে জবাব দিল,
“আসলে বিভোর তোমাকে খুব ভালবাসে তো। তাই তোমাকে টেনশন দিতে চায়নি। এ কারণেই হয়তো তোমাকে কিছু জানায় নি।”
পৃথুলা দ্রুত ব্যাগ থেকে মোবাইলটা বের করল। চৌকশ রাফসান বলল,
“তুমি এখন চাইলে বিভোরকে ফোন করে জিজ্ঞেস করতে পার। তবে আমার মনে হয় বিভোর তোমায় এখনো কিছু বলবে না। বললে তো কাল রাতেই বলত৷ ভালো হয় যদি তুমি বিভোরকে ফোন না দিয়ে ওকে দেখতে হসপিটালে যাও। আমিও ওকে দেখতেই যাচ্ছি। তুমি চাইলে আমার সাথেই যেতে পারো। যাবে?”
পৃথুলা সাতপাঁচ কিছু না ভেবে ‘হ্যাঁ’ বলে দিল। ওর মাথায় আপাতত বিভোরের চিন্তা ছাড়া আর কিছু নেই। এই মুহূর্তে অন্যকিছু ভাবার সময় তার নেই।
গাড়ি চালাচ্ছে রাফসান। পাশে বসে ছটফট করছে পৃথুলা। গাড়িতে এসি অন করা। তবু দরদর করে ঘামছে পৃথুলা। চোখে মুখে দুঃশ্চিন্তার ছাপ স্পষ্ট। রাফসান ড্রাইভিং করতে করতে শান্তনা দেওয়ার ভঙ্গিতে বলল,
“চিন্তা করো না পৃথুলা। দূর্ঘটনা তেমন গুরুতর নয়। হাত পা খানিকটা ছিলে গেছে। তবে মাথায় বেশ ইনজুড়ড হয়েছে।”
“গাড়িটা দ্রুত চালান ভাইয়া।”
“চালাচ্ছি।”
পৃথুলার মাথায় কেবল বিভোরের চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছে। বিভোর ঠিক আছে? বিভোর কতটা আঘাত পেয়েছে? এসবই এখন পৃথুলার মাথায় ঘরপাক খাচ্ছে। একবার জিজ্ঞেসও করেনি বিভোর কোন হাসপাতালে ভর্তি আছে! পৃথুলা জানেনা সে তার অজান্তেই এক নরকে পা ফেলতে যাচ্ছে। আর এই নরকের আগুন তছনছ করে দেবে তার গোটা জীবনটাকে! কেড়ে নেবে তার জীবন থেকে অনেককিছু!”
গাড়ির ব্রেক কষায় ভাবনার সুতো ছিঁড়ল পৃথুলার। সামনে তাকাতেই ওর মুখের রঙ পালটে গেল। একটা পুরনো বাংলোর সাসনে এসে গাড়ি থেমেছে। এখানে হসপিটাল তো দূরে থাক বাংলো টা ছাড়া একটা বাড়িও নেই। নেই মানুষজনের চিহ্নমাত্র।
“এসে গেছি সুইটহার্ট, নামো।”
পৃথুলা রাফসানের দিকে তাকাল। তার ঠোঁটের কোণে নোংরা হাসি। পৃথুলার হাত পা ঠান্ডা হয়ে এলো। কাঁপা কণ্ঠে বলল,
“ভাইয়া প্লিজ মজা করবেন না। আমাদের হসপিটালে যাওয়ার কথা ছিল। আপনি এখানে কেন নিয়ে এসেছেন?”
রাফসান পৃথুলার কথায় পাত্তা দিল না৷ নিজে গাড়ি থেকে নেমে জোর করে পৃথুলাকে নামাল। পৃথুলা বুঝে গেছে সে ফাঁদে পা দিয়ে ফেলেছে। তবু আপ্রাণ চেষ্টা করল রাফসানের হাত থেকে বাঁচার। গলা ফাটিয়ে চিৎকার করেছে। ফলাফল শূণ্য। বাংলো টা লোকালয় থেকে কিছুটা দূরে। এখানে জনমানবের চিহ্নমাত্র নেই। সুতরাং এখানে এমন কেউ নেই যে পৃথুলাকে রক্ষা করবে। রাফসান পৃথুলাকে টেনে হিঁচড়ে বাংলোর ভেতরে নিয়ে গেল। পৃথুলার বুঝতে বাকি নেই তার সাথে কি হতে চলেছে। নিরূপায় পৃথুলা কান্না করে দিল। কাঁদতে কাঁদতেই বলল,
“ভাইয়া প্লিজ ছেড়ে দিন আমাকে। আমি তো আপনার কোনো ক্ষতি করেনি। প্লিজ এমনটা করবেন না আমার সাথে। প্লিজ ছেড়ে দিন।”
“ছাড়ার তো কোনো প্রশ্নই আসে না। এতদিন পর সুযোগটা পেলাম। হাতছাড়া করার মত ওতো ভালমানুষ আমি নই। বিভোর সেদিন তোমার জন্য এতগুলো লোকের সামনে আমার গায়ে হাত তুলেছে। আর আমি ওকে ছেড়ে দেব? নেভার। আমি রাফসান৷ আমাকে কেউ ইট মারলে আমি তাকে পাটকেল ছুঁড়তে ভুলিনা। এবার ওকে শিক্ষা দেওয়ার সময় এসেছে। তোমার কোমড়ে হাত দিয়েছি বলে ও আমার নাক ফাঁটিয়েছে৷ এবার তোমার সর্বাঙ্গে আমার হাত বিচরণ করবে৷ আর এটাই হবে বিভোরের উচিত শিক্ষা।”
রাফসানের চোখে মুখে হিংস্রতা। হিংস্র দানবের মত ঝাঁপিয়ে পড়ল পৃথুলার উপর। দানবের নিচে চাপা পড়ে ছটফট করছে পৃথুলার কোমল শরীরটা। চিৎকারের শব্দে রাফসানের কাজে অসুবিধা হয় বলে পৃথুলার ওড়না দিয়ে ওর মুখ বেঁধে দিল। অসহ্য যন্ত্রনায় পৃথুলার মুখ দিয়ে বের হচ্ছে গোঙানির শব্দ আর চোখ ফেটে ঝড়ছে জলের ফোঁয়ারা।
.
চলবে__