#তাহার_উম্মাদনায়_মত্ত
#লাবিবা_আল_তাসফি
১৪+১৫.
চেনা পরিচিত মুখ গুলোকে হঠাৎ করে বদলে যেতে দেখলে বা ভিন্ন ধর্মী আচরণ করতে দেখলে যেকোনো ব্যক্তির মস্তিষ্ক স্বাভাবিকের তুলনায় বিপরীত প্রতিক্রিয়া করবে। উক্ত পরিবর্তনের রহস্য উন্মোচনে ব্যাকুল হবে। অন্তির ব্যাপারটাও তেমন। প্লেটে বাহারি খাবার থাকা সত্ত্বেও সে তা গালে তুলতে পারছে না। তার নজর দূরে খাবারের তদারকি করা দিহানের দিকে। লোকটা হঠাৎ করেই কেমন দায়িত্ববান পুরুষের ন্যায় আচরণ করছে। ব্যাপারটা একটু রহস্যজনক ঠেকছে তার কাছে। কুকুরের লেজ হুট করে সোজা হয়ে যাওয়ার মতো কোনো প্রবাদ সে শোনেনি। তার মানে এটা দাড়ায় যে ব্যাপারটা অসম্ভব! তাহলে দিহান মির্জার মতো মানুষের লেজ কিভাবে সোজা হতে পারে?
‘দোস্ত লেগ পিস দিলো না কেন আমাদের? দেখ তুলির প্লেটে! বেছে বেছে বড় লেগ পিছটা দিছে। কেন রে? আমরা বুঝি টাকা দেইনি?’
অন্তি তার কথা শুনলো বলে মনে হলো না। বরং সে তন্নির হাত ঝাঁকিয়ে বললো,
‘দোস্ত তোর মনে হয়না কিছু একটা গোলমেলে হচ্ছে। মানে আই ফিল সামথিং ফিসি হিয়ার!’
তন্নি উৎসাহিত হয়ে বললো,
‘দ্যাটস ইট গার্ল! আমিও এটাই বলছিলাম। দেখলি তো কেমন অবিচার চলছে! শিক্ষাপ্রতিষ্ঠেনের মতো জায়গায় যদি লেগ পিছ নিয়ে এমন রাজনীতি চলে তবে দেশের অন্য সব প্রান্তে কি চলছে ক্যান ইউ এভার ইমেজিন! আমি হাইলি ডিজাপয়েন্টেড!’
ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলল তন্নি। অন্তি কটমট করে চাইলো। এখানে এত বড়ো কিছু ঘটে যাচ্ছে আর এই মেয়ে পরে আছে লেগপিছ নিয়ে!
‘ওমনে তাকাস কেন?’
অন্তি চাপা শ্বাস ফেলে উদাস ভঙ্গিতে বলল,
‘দিহান মির্জাকে লক্ষ্য করেছিস? কেমন ঘাপলা লাগছে লোকটার ভেতর। ধমকা ধমকি বাদ দিয়ে আজ এত দায়িত্ববান পুরুষের রোল কেন প্লে করছে? মনে মনে নিশ্চই চুড়ান্ত কোনো ষড়যন্ত্র কষছে। এই লোকের শিরায় শিরায় খারাপি লুকিয়ে আছে!’
অন্তির এই ওভার থিংকিং ব্যাপারটা তন্নির ঠিক পছন্দ হলো না। সে বেশ খানিকটা বিরক্ত হয়ে জবাব দিলো,
‘তোর জন্য কি মানুষ ভালো পথে চলতে পারবে না? আযব দুনিয়া! তুই না চাইতি সে ভালো হয়ে যাক, একদম মাম্মাস বয় টাইপের! তোর সেই দোয়ার প্রভাবে এমন চেঞ্জ। আরো কিছুদিন দোয়া কন্টিনিও কর ইনশাআল্লাহ সফলতা নিশ্চিত।’
অন্তির মস্তিষ্ক তন্নির যুক্তিকে পুরোপুরি ভাবে মেনে নিতে পারলো না। মাথায় চিন্তার ঘড়িটা টিক টিক করে বাজতেই লাগলো। মন বরংবার হুঁশিয়ারি বার্তা প্রেরণ করছে। কি চলছে লোকটার মাথায়?
___________
সাহেদ আজ অফিস আওয়ারেই বাড়িতে ফিরলো। নাহার তখন খিটখিটে মেজাজে কাজের মেয়েটার উপর ডিটার্জেন্ট ছাড়া ধুয়ে দিচ্ছে। এমনটা প্রায়শই দেখতে পাওয়া যায়। সাহেদ দরজার সামনে দাঁড়িয়ে থেকেই স্ত্রীর উদ্দেশ্যে বললেন,
‘আহ নাহার! এত রাগ করো কেন? কি হয়েছে?’
‘কি হয়নি তাই বলো? রোজ রোজ এক জিনিস আমার ভালো লাগে না। ওকে কোনোদিন আমি একবারে কোনো কথা শুনাতে পারলাম না।’
সাহেদ স্ত্রীর রাগ সম্পর্কে জানেন। একটুতেই রেগে অসুস্থ হয়ে পড়েন। বিপি হাই কীনা! সে এগিয়ে এসে নাহারকে টেনে সোফায় বসালেন। তাকে শান্ত করতে বললেন,
‘বিশ্রাম নেও। এভাবে তো অসুস্থ হয়ে পড়বে। আমাকে বলো কি করেছে ও?’
স্বামীর এই ছোট মত্নে শান্ত হয়ে আসে নাহার। শরীর বয়স্ক হতে চললেও মন এখনো ষোড়শী কিশোরীর মতোই আদর যত্নের খোঁজ করে। স্বামী নামক ব্যক্তিটির যত্নে তৃপ্ত হয়ে আসে হৃদয়। শাড়ির আঁচলে মুখ মুছে ফোঁস করে শ্বাস ফেলে বললো,
‘ওকে আমি দোকান থেকে এক কেজি ডাল আনতে বলেছি। সে ধেই ধেই করে এক কেজি চাল নিয়ে চলে এসেছে। ফেরত পাঠিয়ে বারবার করে বলেছি মুশুর ডাল আনতে, আর ও আনছে ছোলার ডাল। এমন উল্টাপাল্টা কাজ করলে আমি ওকে দিয়ে কি করবো?’
সাহেদ ফোঁস করে শ্বাস ফেলে রান্নাঘরের দরজার সামনে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েটাকে দেখলো। মেয়েটার বয়স অন্তির মতোই হবে। বাংলা সিনেমার ভক্ত খুব। সারাদিন মুখে তার বিভিন্ন সিনেমার গান আর কাহিনী ঘোরে। সে ক্ষেত্রে এসব টুকটাক বিষয় ভুলে যাওয়াটা অস্বভাবিক নয়। প্রত্যেকটা মানুষের মাঝে আলাদা রকম ক্ষমতা থাকে। এই মেয়েটার মাঝে আছে কাজের বিষয়গুলো ভুলে যাওয়ার ক্ষমতা। সাহেদ গম্ভীর স্বরে মেয়েটাকে বলে,
‘তুমিকি এখানে থাকতে চাও নাকি চলে যেতে চাও?’
মেয়েটা মাথা নিচু করেই জবাব দিলো,
‘থাকতে চাই সাহেব।’
সাহেদ ফের বললো,
‘তাহলে আমার মিসেসকে আর এভাবে জ্বালাতন করবে না কেমন? তোমাকে আমি একটা ডায়েরি আর কলম দিবো। কিছু বলার সাথে সাথে চট করে নোট করে ফেলবে। তাহলে আর ভুল হবেনা।’
‘জ্বি আচ্ছা সাহেব।’
‘লিখতে পারো তো? পড়াশোনা করেছো?’
‘জ্বি পারি সাহেব। ফাইপ পর্যন্ত লেকাপড়া জানি সাহেব।’
‘এখন যাও কাজে লেগে পড়ো।’
কাজের মেয়ে যেতেই সাহেদ স্ত্রীর দিকে ফেরেন। চিন্তিত স্বরে বলেন,
‘তোমায় এভাবে হাইপার হতে না করেছি না? এমনটা যেন আর কখনো না দেখি নাহার। তুমি এখন কিশোরী নেই। বুঝতে হবে তোমাকে।’
নাহার এক বাক্যে স্বামীর কথা মেনে নেয়। সাহেদ গলার টাই ঢিল করতে করতে বলে,
‘মেয়ে কোথায়?’
‘কোথায় আর কলেজে।’
সাহেদকে হঠাৎ চিন্তিত দেখায়। যেন হঠাৎ করেই কোনো একটা ব্যাপার তাকে খুব ভাবাচ্ছে। নাহার বতা লক্ষ্য করে কোমল গলায় ভলে,
‘কিছু হয়েছে?’
সাহেদ মাথা নাড়ায়।
‘মেয়ের বিয়ের ব্যাপারে কিছু ভেবেছ নাহার?’
নাহার চমকে তাকায় স্বামীর দিকে। অবাক গলায় বলে,
‘মেয়েটা এখনো ছোট। বিয়ের জন্য অনেক সময় বাকি আছে। এখন ওসব নিয়ে ভাবাভাবির দরকার কি?’
সাহেদ মাথা দুলিয়ে সার জানায়। বলে,
‘আমিও তাড়াহুড়ো করতে চাচ্ছি না। কিন্তু আজিমকে তো চেনো? আমার বন্ধু ডাক্তার আজিম। ওর ছেলেটা এবার মেডিকেল শেষ করে জব এ ঢুকলো। আজিমের হস্পিটালেই জয়েন হয়েছে শুনলাম।’
‘হ্যা তো?’
‘আজিম চাচ্ছে ছেলেকে বিয়ে করাতে। আরাবের মতো হীরের টুকরো ছেলেকে আমি মেয়ের জন্য বেষ্ট বলে মনে করি। মেয়েটাকে চেনা পরিচিতের মধ্যে দিতে পারলে বুকের উপরের ভার কিছুটা নামতো আরকি।’
নাহারকে চিন্তিত দেখালো। সাহেদের উপর তার ভরসা আছে। সাহেদ যখন বলেছে নিশ্চই ছেলেটা তাদের মেয়ের জন্য উপযুক্ত। তাছাড়া তার মেয়েটা যা দস্যি! ওমন মেয়েকে কোন ভালো ছেলে বিয়ে করবে? তাছাড়া মেয়েকে বিয়েতো দিতেই হবে। আজ হোক বা কাল! আহার স্বামীর কাঁধে হাত রাখলো। সাহেদ তাকাতেই বললো,
‘তুমি আজিম ভাইয়ের সাথে কথা বলো। আমি মেয়েকে দেখছি!’
___________
সূর্য পশ্চিমে হেলে পড়েছে। রক্তিম হয়ে উঠছে আকাশ। আজ পুরোটাদিন সূর্য তার প্রখরতা বিছিয়ে বেড়িয়েছে। অন্যদিনের মতো মেঘের দল এসে তাকে রুখে দেয়নি। অন্তি আর তন্নি কলেজ গেটের সামনে দাঁড়িয়ে রিকশার জন্য অপেক্ষা করছে। কিন্তু আজ যেন রিকশা এ ধরণীর বুক থেকে ভ্যানিস হয়ে গেছে। কোথাও কোনো রিকশার খোঁজ নেই। ব্যাপারটায় অন্তি বিরক্ত হলেও তন্নি আকাশ সম উৎসাহ নিয়ে বললো,
‘দোস্ত ডোন্ট ইউ থিংক আমাদের একটা রিকশাওয়ালা বফ দরকার? চাইলেই যখন তখন রিকশা চড়ে ঘুরে বেড়াবো। আহ্! ভাবতেই সেই ফিল আসতেছে।’
আন্তি অতিষ্ঠ চিত্তে দাঁতে দাঁত চেপে খেকিয়ে ওঠে।
‘মুখা বন্ধ রাখ তন্নি। আর একবার মুখ খুলেছিস তো তোর জীবনের দা এন্ড ঘটাতে দু বার ভাববো না।’
তন্নি না চাইতেও দুঃখ প্রকাশ করে ফেললো,
‘তুই আর তুই নেইরে পাখি। দিহান ভাইয়ার মতো ডেন্জারাস হয়ে গেছোস। ভালোবাসার কি দারুণ ক্ষমতা!’
সত্যিই কি তাই? অবশ্য অন্তির ও আজকাল মনে হয় সে দিহানের মতো খিটখিটে স্বভাবের হয়ে গেছে। একটুতেই কি রাগ তার! অন্তি নিজের এসব উদ্ভট আচরণের জন্য দিহানকেই দায়ী মনে করে। তার সকল খারাপ অভ্যাসের কারণ এই লোক।
ভাবনা থেকে সে বের হলো তন্নির কথায়,
‘দোস্ত! তোদের বিয়ে হলে তো দেখছি ঘোর বিপত্তি ঘটে যাবে! দুইয়ে দুইয়ে চার, মানে তোদের বাচ্চারা…… আমারতো ভাবতেই হাত পা ঠান্ডা হয়ে আসছে।’
তন্নির এসব নাটকে অভ্যস্ত অন্তি জবাব না দিয়ে হাঁটতে শুরু করলো। রিকশার ভরসায় থাকলে রাত ফুরিয়ে দিন হয়ে যাবে তাও রিকশা পাবে কিনা সন্দেহ। তাছাড়া তন্নির ভাবনা কেবল তার বাচ্চাদের কাছে পৌঁছেছে, আরো কিছুক্ষণ পর হয়তো নাতি নাতনির কাছেও পৌঁছে যাবে। বলা যায় না!
তন্নিও অন্তির পিছু পিছু চলতে শুরু করেছে। কিন্তু তার মুখ বন্ধ নেই। মাঝে মাঝে তার মুখ আউট অফ কন্ট্রোলে চলে যায়। ছুটতেই থাকে। হাজারবার ব্রেক কষলেও লাভ হয়না। আজ ও তেমন হয়েছে। সে চেয়েও তার মুখের শাটার টানতে পারছে না।
.
.
মোরে আজ ও দিহানের দেখা মিললো। জিপের দরজায় পিঠ ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। পরনের পাঞ্জাবির হাতা গুটিয়ে রেখেছে। মৃদু বাতাসের তালে ঘন চুলগুলো দোল খাচ্ছে। সাদা বলিষ্ঠ হাতে চকচকে কালো বেল্টের ঘড়িটা বড্ড মানিয়েছে। অন্তি আড় চোখে সবটা দেখলো। মন চাইলো লোকটা যেন একবার তার দৃষ্টি তুলে তাকায়। তার ভারী দৃষ্টিতে খানখান করে দিক কিশোরী হৃদয়। কিন্তু পুরুষটা যে বড্ড অবাধ্য। অন্তির মনের ব্যাকুলতাকে দূরে ছুড়ে ফেলে অন্তির দিকে একবার ও চাইলো না চোখ তুলে। জিপের দরজা খুলে চড়ে বসলো তাতে। দাম্ভীকতার সাথে প্রস্থান করলো জায়গা। পরপর তাকে অনুসরণ করে সাই সাই করে বাইক নিয়ে ছুটলো সবাই। মিনিটের মাঝে ফাঁকা হলে গেলো জায়গা।
দিহানের এমন ইগনোর করার ব্যাপারটা অন্তির পাহাড় সমান উঁচু ব্যক্তিত্বে আঘাত হানলো। নিজ মনকে দু চারটা কটু বাক্য শুনিয়ে পা বাড়ালো বাড়ির পথে। দু পা এগোতেই পাশ ঘেঁষে একটা রিকশা এসে থামলো।
‘আপা ওঠেন।’
অন্তি রিকশাওয়ালার দিকে একবার তাকিয়ে পেছন ঘুরলো। রাস্তায় গাড়ি আর অপরিচিত লোকজন ব্যাতীত পরিচিত প্রিয় মুখের মানুষটাকে সে কোথাও দেখতে পেল না। তবুও অন্তির মন বলছে দিডহান আশপাশেই কোথাও আছে। নিরবে গোপনে তাকে দেখছে। এই রিকশাটাও তার ঠিক করে দেওয়া। তন্নিও হয়তো ব্যাপারটা বুঝতে পেরেছে। এজন্য অন্তির আগেই সে রিকশায় চেপে বসেছে। অন্তি বিনা বাক্যে বিষন্ন মন নিয়ে উঠে বসলো। দিহান নামক মানুষটার প্রতি তার অভিমান গাঢ় হলো। মানুষটা এমন কেন করছে? না তাকে কাছে টানছে আর না দূরে যেতে দিচ্ছে। শূন্যের মাঝামাঝি উদ্দেশ্যহীন ভাবে ঝুলিয়ে রেখেছে তাকে। সে কি বোঝেনা এতে অন্তির কষ্ট হয়? নাকি তাকে কষ্ট দিতেই এত আয়োজন?
পুরোটা রাস্তা নিরবতায় কেটে গেলো। তন্নির গলার কাছে এতশত কথা এসে আটকে রইলো। অন্তির মনের অবস্থা বুঝতে পেরেই নিজের মুখকে বন্ধ করে রেখেছে সে। অন্তিদের বাসার সামনের রাস্তায় এসে রিকশা থামলো। এবার কোনো রকম ভয় ছাড়াই একা একা নেমে দাঁড়ালো সে রিকশা থেকে। যদিও শাড়ি অনেকটা এলোমেলো হয়েছে। কুচিতে পা লেগে কুঁচি খুলে এসেছে অনেকটা। কোনোরকম তা আঁকড়ে ধরে বাকিটা রাস্তা হেঁটে বাসায় ঢুকলো। অন্তি গেট দিয়ে ঢুকতেই তন্নি ছোট করে শ্বাস ফেলল। সামনে ফিরে বললো,
‘মামা চলেন।’
তার মনটাও কেমন বিষিয়ে এসেছে। সে কি একবার দিহান ভাইয়ার সাথে অন্তির ব্যাপারে কথা বলবে? কিন্তু তার জন্য যে পর্যাপ্ত সাহস দরকার!
চলবে……..
(ভুল ত্রুটি খবর সুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন। ভালোবাসা অবিরাম ❤️)