#তাহার_উম্মাদনায়_মত্ত
#লাবিবা_আল_তাসফি
২৩.
ব্যস্ত ঢাকার সড়কে আধঘন্টা যাবত আটকে রয়েছে রেজওয়ান মির্জার আলিশান গাড়িটা। গাড়ির ভেতরে বসে থাকা অবস্থায় তার কপাল থেকে টুপটাপ করে ঘাম ঝড়ছে। এসি অন থাকা সত্ত্বেও তার শরীরের তাপ যেন প্রতিনিয়ত বেড়ে উঠছে। পাশেই তার ম্যানেজার লোকটা আশপাশে বিরক্ত ভঙ্গিতে উঁকিঝুঁকি দিচ্ছে। আরো পনেরো বিশ মিনিটে জ্যাম ছাড়বে বলে মনে হচ্ছে না। চিন্তিত মুখে সে মির্জা সাহেবের দিকে তাকায়। ছোট করে বলে,
‘স্যার আরো কিছু সময় দরকার হবে। এই মুহূর্তে অন্য রুট নেওয়াও সম্ভব না। আমরা মাঝ রাস্তায় আটকে আছি।’
কপালের পাতলা চামরা কুঁচকে আসে রেজওয়ান মির্জার। পাশ থেকে পানির বোতলের মুখ খুলে ঢকঢক করে গিলে নেয় খানিক। অসম্ভব চিন্তায় হাত পায়ে কাঁপন ধরেছে তার। পুরুষকে কাঁদতে নেই তবুও কেন যেন তার চোখ বারবার ভিজে আসতে চাইছে। তৎক্ষণাৎ ফোনে কল আসে। রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে ব্যস্ত গলায় অপরিচিত কন্ঠে কেউ বলে ওঠে,
‘আপনারা আসতে এত সময় কেন নিচ্ছেন? রোগীর কন্ডিশন ভালো না। তিন ব্যাগ ব্লাড ইতিমধ্যে প্রোভাইড করা হয়েছে। আরো দু একব্যাগ লাগতে পারে। আমরা রোগীকে অপারেশন থিয়েটারে নিতে পারছি না। এটা কোনো মার্ডার কেস হতে পারে। শরীরে অসংখ্য ছুড়ির আঘাত রয়েছে। কিছু ফর্মালিটিস পূরণ করা দরকার। বুঝতে পারছেন?’
রেজওয়ান মির্জার শ্বাস আটকে আসতে চায়। কন্ঠনালি শুকিয়ে আসে। গলা থেকে শব্দ গুলো যেন বের হতে চায়না। বহু কষ্টে ঠোঁট নাড়িয়ে বলে ওঠে,
‘সকল ব্যাবস্থা করুণ। আমরা আসছি। অপারেশন শুরু করুণ। অপেক্ষা করবেন না। আপনাদের সো কলড ফর্মালিটির জন্য আমার ছেলের কিছু হলে এর ফল মোটেই ভালো হবে না।’
‘কিন্তু…’
‘যেটা বলেছি সেটাই করুণ।’
কল কেটে বড় করে শ্বাস ফেলে রেজওয়ান মির্জা। লাল হয়ে আসা চোখ নিয়ে ম্যানেজারের দিকে তাকিয়ে বলে,
‘অন্যকোনো ব্যাবস্তা করো মাহবুব। দু সেকেন্ড অপেক্ষা চাই না।’
মাহবুব নামের লোকটা দ্রুত মাথা নাড়ায়। কিভাবে কি ব্যাবস্থা করবে তা তার জানা নেই। তবে তাকে কিছু একটা করতে হবে। গাড়ি থেকে কোনোভাবে নেমে যায় সে। রাস্তার জ্যাম দীর্ঘ। তেমনি দীর্ঘ জ্যাম বর্তমানে তার মাথায়। দিক দিগন্ত শূন্য হয়ে পড়েছে তার। কপালে ভাঁজ ফেলে দ্রুত কোনো সুরহার কথা ভাবতে থাকে।
________________
ঘড়ির কাঁটা দুপুর একটার কাছে। সূর্যের তেজ বেড়েছে। সাথে ভাপসা গরমের উপস্থিত ও। অন্তি বর্তমানে একটা পার্কের বেঞ্চিতে বসে আছে। সবুজ গাছপালায় ঘেরা এক ছোট্ট পার্ক। এখানে খুব একটা মানুষজন নেই। পার্কের খোলা মাঠে ছোট ছেলেরা ক্রিকেট খেলছে। অল্প কিছু স্কুল পড়ুয়া ছাত্র ছাত্রীদের দেখা যাচ্ছে এক কোণে। জোড়ায় জোড়ায় তারা। নিঃসন্দেহে স্কুল পালিয়ে ঘুরতে এসেছে। অন্তি আগ্রহভরা দৃষ্টিতে সেদিকে তাকিয়ে থাকে। ওখানে থাকা প্রতিটা মেয়ের হাতেই একটা করে গোলাপ। তাদের প্রেমিকের তরফ থেকে পাওয়া গোলাপ। মুখে লাজুক হাসি। কি সুন্দর চোখে চোখে কথা হয় তাদের। যত্ন করে চুল গুঁজে দেওয়া হচ্ছে কানের পেছনে। অন্তির হঠাৎ করেই ভিষণ মন খারাপ হয়। ছলছল হয় চোখ। কিশোরী মনে কিছু প্রেমময় স্মৃতির অভাবে হাহাকার করে ওঠে। ব্যস্ত হাতে পুনরায় প্রেমিক পুরুষটির ইনবক্সে ম্যাসেজ পাঠানো হয়।
‘আমার একটা গোলাপ চাই। আপনার নামের গোলাপ।’
উত্তর আসবেনা জেনেই দ্বিতীয় ম্যাসেজ পাঠায়।
‘আপনি ভিষণ পাষাণ প্রেমিক। আমার কি এই মুহূর্তে রাগ করে বিচ্ছেদ ঘটানো উচিত?’
অন্তি নিজেও জানে তার দ্বারা বিচ্ছেদ কখনোই সম্ভব নয়। যাকে ছাড়া থাকার কথা ভাবতেই তার দম বন্ধ লাগে তাকে পেয়েও ছেড়ে দেওয়া যায়? কখনোই না। দিহান যেতে চাইলেও অন্তি যেতে দিবে না। সেখানে ছেড়ে দেওয়ার কথা নিতান্তই বোকামি। অন্তি ফোন রেখে চুপটি করে বসে থাকে। পেটে ক্ষুদা অনুভব হয়। দিহানের সাথে দেখা করার উত্তজনায় সকালে খাওয়া হয়নি। আর এখন মন খারাপের ভারে খাওয়া হচ্ছে না। তার আনা বাটির খাবারটাও নিশ্চই ঠান্ডা হয়ে এসেছে? হোক ঠান্ডা। এই ঠান্ডা খাবারই খেতে হবে লোকটাকে। দেরী করার শাস্তি এটা।
পার্কের এক সাইডে কিছু ছোট দোকান বসেছে। ঝালমুড়ি, ফুচকা বিক্রি হচ্ছে। খালি পেটে এসব তেলযুক্ত খাবার ভয়ংকর পতিক্রিয়া করবে যেনেও অন্তি সেদিকে পা বাড়ায়। আজ সে নিষিদ্ধ ভয়ংকর কাজ গুলোই করবে। হলে হোক কিছু ক্ষতি!
অন্তির মন খারাপের কথাগুলো কিভাবেই যেন তন্নি যেনে যায়। তার একা লাগা সময়গুলোতেই হুট করে কল করে বসে মেয়েটা। অন্যসময় তন্নির অযথা আলাপ বিরক্ত ঠেকলেও তখন কোনো বিরক্ত কাজ করে না। অন্তি খুব মনোযোগী স্রোতার মতো তন্নির প্রতিটা শব্দ মন দিয়ে শোনে। আজ ও হলো তাই। ফুচকা খেয়ে বিল মিটিয়ে পূর্বের জায়গায় এসে বসতেই কল আসে তন্নির। ঠোঁট চিড়ে হাসি ফুটে ওঠে অন্তির। কল রিসিভ করতেই তন্নি হামলে পড়ে।
‘কোথায় তুই? আমার বাড়ি কখোন আসছোস? বাই এনি চান্স পালায় যাসনিতো দোস্ত? কি ভয়ংকর কথা! আমাকে একবার ও জানানোর প্রয়োজন মনে করলি না?’
‘না।’
‘মিরজাফোর! যাই হোক বিয়ে টিয়ে করে ফেলেছিস? দিহান ভাইয়ের মতো মানুষ আসলেই এমন চমৎকার কান্ড ঘটিয়ে ফেলেছে?’
অন্তি হাসে। জবাব দেয়না। তার নিরবতা অনেক কিছুই প্রকাশ করে। ফোনের ওপাশ থেকে তন্নি বলে ওঠে,
‘কোথায় তুই? আন্টি কল করেছিলো। হয়তো সন্দেহ করেছে তোকে। আমি হঠাৎ করেই ভয় পেয়ে গেছিলাম। আমাকে বলে যাবি তো যেখানেই যাস!’
‘স্যরি। মাথায় ছিলো না।’
‘হুম। এখন ঘটনা কি? কথা এমন ভার কেন? ঝগড়া হয়েছে?’
অন্তির চোখ ঝাপসা হয়ে আসে। টুপ করে জল গড়িয়ে পড়ে। বাচ্চাদের মতো করে কেঁদে উঠে জানায়,
‘সে আসেনি। আমি অপেক্ষা করছি। এমন পাষাণ লোককে কেন আমি এত ভালোবাসি? আমার একদম তাকে ভালোবাসা উচিত না।’
তন্নি অবাক হয়। সাথে চিন্তিতও। বলে,
‘তুই এখন কোথায় পাখি?’
‘গুলশান। এক্সাক্ট লোকেশন জানিনা।’
‘পাগল তুই? ওদিকে কেন গেছিস? ভাইয়া জানে?’
‘ম্যাসেজ করেছি।’
‘আযব! কল করিসনি কেন? ম্যাসেজতো সে না ও দেখতে পারে। কল কাট। ভাইয়াকে কল কর কুইক। এমন বোকামি কেন করিস পাখি? দ্রুত আপডেট জানা। ওয়েট করছি আমি।’
দিহানকে কল করার কথা অন্তির মাথায় একবারের জন্যও আসেনি। নিজের এমন ছোট একটা ব্যাপারে এতবড় বোকামির জন্য আফসোস হয়। এই তন্নিটা কল না করলে হয়তো তার মাথায় এই অতি সাধারণ কথাটা কখনোই আসতো না। নিশ্চই মানুষটা ব্যাস্ততার জন্য ম্যাসেজ খেয়াল করেনি। অন্তি নিজ মাথায় চাপড় কাটে। কেঁদে কেটে লাল করে ফেলা মুখটা হঠাৎ করেই উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। কিন্তু এটা খানিকের জন্য। দিহানের নম্বর অফ। মুখ শুকিয়ে আসে অন্তির। সাথে এভাবে হুট করে এতদূর একা চলে আসার জন্য ও আফসোস হচ্ছে। দীর্ঘ এক ঘন্টা বাস জার্নি করে এখানে আসা মোটেই তার জন্য সহজ ছিলো না। তার উপর সবটা অপরিচিত। নিজের উপর রাগ হওয়ার সাথে দিহানের উপর ও চাপা অভিমান জমে। সে জানে না আজ অন্তি তাকে কল দিতে পারে? তবুও কেন ফোন বন্ধ রাখবে?
দিহানের জন্য কেনা এক পাউন্ডের ছোট কেকটা অন্তি মাঠে খেলা বাচ্চাদের মাঝে বিলিয়ে দেয়। তার রান্না করা খাবারের প্রথম স্বাদটাও বাচ্চারাই পায়। কিন্তু এতে তাদের রিয়্যাকশন মোটেই ভালো ছিলো না। রান্নাটা কি একটু বেশিই খারাপ হয়েছে?
দিহান আসবেনা যেনেও অন্তি তিনটা পর্যন্ত ওখানে বসে থাকে। একা একা রাস্তার পাশ ধরে হেঁটে বেড়ায়। নিজের জন্য একটা গোলাপ কিনে কানে গুঁজে নেয়। সবশেষে বাড়ি ফেরার পথে পুনরায় দিহানের নম্বরে একটা টেক্সট পাঠায়।
‘আজ দিনটা সুন্দর। ঝলমলে। ঠিক আপনার মতো। এতো সুন্দর একটা দিনে পৃথিবীতে আগমনের জন্য আপনাকে সুভেচ্ছা প্রিয়।’
পরপর দিহানের জন্য কেনা কেকটার একটা ছবি পাঠায়। সাথে বাচ্চাগুলোর ও।
‘আপনাকে ছাড়াই আপনার জন্মদিন উদযাপন করে ফেলেছি। রাগ করবেন না। রাগ করলেও আমি রাগ ভাঙাবোনা একদম। আপনি জানেন কতো অপেক্ষা করেছি?’
অন্তির হাত থামে। বাসের জানালা থেকে বাহিরে উদাস দৃষ্টি ফেলে তাকিয়ে রয়। মন তার হাহাকার করে বলে ওঠে,
‘আমি ভিষণ দুঃখি প্রিয়। আপনায় পাশে না পাওয়ার কষ্ট আমার গ্রাস করে নিচ্ছে। আমার বড্ড দুঃখ! বুঝলেন?’
চলবে…….
(হঠাৎ করেই ভাবলাম একটা সারপ্রাইজ দিলে কেমন হয়! তবুও দু ঘন্টা সময়! আপনাদের অল্প খুশির জন্য এতটুকু সময় কিছুই না। ভালোবাসা নিবেন ❤️
ভুলত্রুটি মার্জনা করবেন।)