চিত্রলেখার_কাব্য পঁয়ত্রিশতম_পর্ব ~মিহি

0
556

#চিত্রলেখার_কাব্য
পঁয়ত্রিশতম_পর্ব
~মিহি

“চাচা…” সাথীর যেন মাথা ঘুরে উঠলো। তার ছোট চাচা চিত্রলেখাকে দেখতে এসেছে? আসলেই? অপর্ণার কি নূন্যতম জ্ঞানবুদ্ধি নেই? সাথী চিত্রলেখাকে ধরে ঘরে নিয়ে গেল। কাচের টুকরোগুলো মেঝেতেই পড়ে রইলো। নওশাদ কেবল অগ্নিদৃষ্টিতে সাথীর প্রস্থান দেখলো। অর্ণবও খানিকটা বিব্রতবোধ করছে। নওশাদ দেখতে বয়স্ক মনে না হলেও বয়সটা তো তার বেশিই। তাও আবার আত্মীয়তার সম্পর্ক আছে। অপর্ণা এমন প্রস্তাব কী করে আনলো ভেবে পেল না সে।

“ভাইয়া, আমার কথা আছে তোমার সাথে।” কথাটুকু বলে চিত্রলেখা আবারো ঘরের ভেতরে চলে গেল। অর্ণব মাত্র উঠেছে ঘরে যাওয়ার জন্য, নওশাদ তাকে আটকালো।

-আপনার সাথে কিছু কথা বলে রাখি। যদিও সম্পর্কটা বেমানান ঠেকবে তাও ভাই-ই ডাকলাম। চিত্রলেখা আপনাকে কিছু কথা বলার জন্য ডেকেছে। সে কী বলবে আমি জানি। চিত্রলেখা একটা ছেলেকে ভালোবাসে। ছেলেটা কে জানেন? রঙ্গন আহমেদ, আমার ভাগ্নে। চিত্রলেখাকে পছন্দ করার কথা বলেছিলাম বলে সে আমায় মেরে হাসপাতালে পাঠিয়েছিল। ছেলেটার আচরণের কথা আমি না বলি, শুধু এটা জেনে রাখুন সে আমাদের আপন কেউ না। এখন একজন জন্মপরিচয়হীন ছেলের আচরণ কেমন হবে তা আপনার অজানা নয়। এ বিয়ে আটকাতে চিত্রলেখা হয়তো আমার নামে অনেক নোংরা কথাই বলতে পারে তবে আমি রাজনীতিতে থাকলেও নিতান্তই সহজ সরল মানুষ। শত্রুর অভাব নেই তা তো জানেন, কয়েকদিন আগেও আমাকে মিথ্যে অপবাদ দেওয়া হয়েছে। চিত্রলেখাও সেরকম কোনো মিথ্যেরই আশ্রয় নিবে। আমি তাকে পছন্দ করে ফেলেছিলাম বিধায় প্রস্তাব এনেছি। আপনি চাইলেই আমাকে না করে দিতে পারেন, আমার আপত্তি নেই।

-আপনি বসুন, আমি লেখার সাথে কথা বলে আসছি। যেহেতু আপনি একা এসেছেন, আজকে বোধহয় কথা না বাড়ানোই ভালো। আপনি খাবার খান। আমি আসছি একটু পর।

_______________________

অর্ণব ঘরে প্রবেশ করতেই সাথী বেরিয়ে গেল। অর্ণব চিত্রলেখার মুখোমুখি দাঁড়ালো। চিত্রলেখার ভয় ক্রমশ বাড়ছে। লোকটার চেহারা দেখলেও তার গা গুলিয়ে আসে। তার ঐ নোংরা চাহনি আবারো মনে ভেসে উঠে চিত্রলেখার।

-বল কী বলবি।

-ভাইয়া, তুমি ঐ লোকটার সাথে আমার বিয়ের কথা ভাবছো?

-দেখতে এসেছে, বিয়ে হয়ে যায়নি। তাছাড়া বয়স একটু বেশি ছাড়া আর কীই বা দোষ আছে ওনার? তোকে পছন্দ করে বলেই প্রস্তাব দিতে এসেছে।

-ভাইয়া …ঐ লো..লোকটা..

চিত্রলেখার শ্বাসকষ্ট অনুভব হচ্ছে। চেয়েও যেন কথাগুলি বলতে পারছে না সে। অর্ণবের সাথে দূরত্বটা যেন কদিনেই কয়েকগুণ বেড়েছে।

-তুই বলবি কিছু? এভাবে চলে আসাটা মোটেও ভালো দেখায় না।

-ভাইয়া, ঐ লোকটা আমার সাথে খারাপ ব্যবহার করেছে। আমার দিকে নোংরা…

-তুই রঙ্গনের কথায় এসব অপবাদ দিচ্ছিস ওনার নামে? তোর লজ্জা করেনা? লোকটা তো বয়সে বড় তোর! এত নোংরা চিন্তা কী করে করতে পারিস তুই? রঙ্গনের উপর খুব টান? ঐ ছেলেটা যে জন্মপরিচয়হীন তা নিশ্চয়ই বলেছে সে তোকে? বলেনি?

চিত্রলেখা চুপ হয়ে গেল। নওশাদ লোকটা নিম্নমানের তা সে জানতো কিন্তু এতটা নিচু তা সে বুঝতে পারেনি। নিজের স্বার্থে নিজের বোন কিংবা ভাগ্নে কাউকেই পরোয়া করলো না সে!

-চুপ করে আছিস কেন লেখা? তুই ভাবলিই বা কী করে ঐরকম ছেলেকে আমি মানবো? টাকা থাকলেই সব হয়না লেখা। তোর জন্য ভালো হবে ঐ ছেলের কথা ভাবা বাদ দে। আশফিনা আহমেদকে তুই ভালোমতোই চিনিস। ঐ মহিলা তোকে কোনোদিন সুখে থাকতে দিবে? নওশাদের সাথেই তোর বিয়েটা করতে হবে এমন কথা নেই তবে রঙ্গনের চিন্তা বাদ দে।

অর্ণব চিত্রলেখার কথার অপেক্ষা করলো না। ঘর ছেড়ে চুপচাপ বেরিয়ে গেল। চিত্রলেখা স্তব্ধ হয়ে বসে রইল। আসলে হচ্ছেটা কী তার সাথে? তার জীবন নিয়ে কি সিনেমা চলছে? যে যা পারছে করেই যাচ্ছে তার সাথে! এবার সিদ্ধান্তটা নিতেই হবে তার। ভালো থাকার অভিনয় অনেক করেছে, এবার ভালো থাকার সিদ্ধান্তটা নিতে হবে।

_________________________________

-লেখা, তোর কি উচিত না রঙ্গনকে সবকিছু জানিয়ে দেওয়া?

-রঙ্গন যখন সব জানতে পারবে, তখন সে এটাও জানবে যে সে আশফিনা আন্টির আসল ছেলে নয়। এ সত্যটা আন্টি লুকিয়ে রেখেছে এত বছর ধরে। আমার কারণে রঙ্গন নিজের অস্তিত্ব নিয়ে সঙ্কটে পড়ুক তা আমি চাইনা ভাবী।

-তো এখন কী করবি? অনিকের সাথেও যোগাযোগ করতে পারছি না, ফোনটা যে কী করেছে! কোন বন্ধুর ওখানে উঠেছে তাও বলেনি। অর্ণব ভাইয়ের কথাবার্তাও কেমন জানি ঠেকছে। লেখা, তুই আদৌ ভেবেছিস কী করবি?

-হুম। ঘুমাবো।

চিত্রলেখা আর কোনো কথা না বাড়িয়ে বিছানায় শুয়ে পড়লো। সাথী কথা বাড়ালো না। দুপুরের পর থেকেই চিত্রলেখা এমন করছে। অপর্ণা বেশ খুশি, অর্ণবের হাবভাব বোঝা যাচ্ছে না। সাথী কী করবে বুঝে উঠতে পারলো না। ফোন হাতে নিয়ে রঙ্গনকে কল করবে কি করবে না ভেবে দ্বিধাদ্বন্দ্বে পড়লো। চিত্রলেখা মেয়েটার জীবনে দুঃখ এত বেশি কেন ভেবে পায়না সাথী। বাবা থাকা সত্ত্বেও বাবার আদর পায়নি, এক ভাইয়ের স্নেহ যখন পেয়েছে তখন অন্যজন মুখ ফিরিয়েছে। একসাথে সুখ কখনো ধরা দেয়নি মেয়েটাকে। দীর্ঘশ্বাস ফেলল সাথী। সেও একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে।

সকাল সকাল অর্ণব তৈরি হচ্ছে। বন্ধুর সাথে দেখা করতে যাবে সে, ইনভেস্টমেন্ট নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা আছে। চিত্রলেখা ঘর থেকে বেরোয়নি। অর্ণবও কথা বাড়ায়নি। নওশাদের সাথে চিত্রলেখার বয়সের গ্যাপটা সেও বুঝতে পেরেছে। জেনেবুঝে এমন ছেলের হাতে তো আর মেয়ে দেওয়া যায় না। তাছাড়া সম্পর্কটাও গোলমেলে হয়ে যায়। ভাবীর চাচা হবে কিনা দুলাভাই! বলতেও অন্যরকম শোনায়। এসব নিয়ে আপাতত ভাবতেই চাইছে না অর্ণব। চিত্রলেখাকে খানিকটা ভয় দেখাতে চেয়েছিল সে যেন মেয়েটা ভালোবাসার মায়াজাল থেকে সরে আসে। জীবনের অন্যতম দুইটা বছরের মূল্য যেন বুঝতে শিখে। চিত্রলেখার বিয়ের আলাপ করে রঙ্গনের কথাটা জানতে পেরেছে সে। এতে অবশ্য সুবিধেই হলো। রঙ্গনের থেকে চিত্রলেখাকে যতটা পারা যায় দূরে রাখতে হবে। এসব ভাবনার মাঝেই কলিং বেল বেজে উঠলো। আশেপাশে কাউকে না দেখে অর্ণব নিজেই গেল দরজা খুলতে। দরজা খুলতেই অপর পাশে রঙ্গনকে দেখে খানিকটা চমকালো সে। এত সকালে রঙ্গনকে নিজের বাড়ির সামনে মোটেও আশা করেনি সে। ভালোবাসা তবে এতটাও ঠুনকো নয় দুজনের, খানিকটা জটিলই বিষয়টা!

-আসসালামু আলাইকুম ভাইয়া, ভেতরে আসতে পারি?

-কী দরকার তোমার? এখানে কেন এসেছো?

-ভাইয়া, বাইরে দাঁড়িয়ে থেকে আলাপ করলে বিষয়টা ভালো দেখাবে না।

-ভেতরে এসো।

রঙ্গন আর অপেক্ষা করলো না। দ্রুত পায়ে ভেতরে ঢুকেই চোখজোড়া যেন ব্যস্ত হয়ে পড়লো চিত্রলেখাকে খুঁজতে। বিষয়টা অর্ণবেরও নজর এড়ালো না।

-বোসো, কী দরকার বলো।

-ভাইয়া, আমি চিত্রলেখার সাথে একটু দেখা করতে চাই।

-ওর সাথে কী দরকার তোমার?

-ভাইয়া, আমি ওকে ভালোবাসি।

-তো?

-আমি বিয়ে করতে চাই ওকে। আপনার অনুমতি থাকলে..

-আমার অনুমতি নেই, তুমি আসতে পারো।

-কারণ জানতে পারি? এতটা অযোগ্য বোধহয় আমি নয়।

‘রঙ্গন!’ অর্ণব কিছু বলার আগেই চিত্রলেখা খানিকটা জোরেই চেঁচিয়ে উঠলো। রঙ্গন চাতক পাখির মতো সেদিকে তাকালো। চিত্রলেখার চোখ লাল। রঙ্গনের বুকের ভেতরে মোচড় দিয়ে উঠলো। সে ভাবতো এসব যন্ত্রণা বোধহয় কাল্পনিক তবে এ প্রথম সে অনুভব করলো অন্য কারো চোখের পানি তার বুকে যন্ত্রণা সৃষ্টি করছে।

চিত্রলেখার অর্ণবের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে রঙ্গনকে কিছু বলার সাহস না হলেও সে বাধ্য আজ। অর্ণবকে না আটকালে সে অবশ্যই রঙ্গনের জন্মপরিচয়ের কথা তুলবে যা রঙ্গনকে কোনোভাবেই জানতে দেওয়া যাবে না।

-ভাইয়া, আমি রঙ্গনের সাথে একটু কথা বলতে চাই শেষবারের মতো।

‘শেষবারের মতো’ বাক্যাংশটা রঙ্গনের কর্ণকুহরে কুৎসিত কোনো ঘণ্টার আওয়াজের ন্যায় বিশ্রি শব্দের ঝংকার তুললো। চিত্রলেখা শেষবারের মতো বলতে কী বোঝাতে চাইলো? চিত্রলেখা কি বিয়েতে রাজি? রঙ্গনের ব্যাকুলতা যেন ক্ষণিকেই বেড়ে গেল আকাশসম।

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here