#নব_প্রেমের_সূচনা
#Sumaiya_Akter_Bristy
#পর্ব_২২
আরভী চমকালো সমুদ্রের কথায়। আরভী তো ভেবেছিলো সমুদ্র আরভীকে কিছুদিন যাবত চিনে। তবে যেহেতু দুজন একই জেলায় থাকে তাই দুজনের দেখা হয়ে যাওয়াটা অস্বাভাবিক কিছু না। হয়তো আরভী নিজেও সমুদ্রকে দেখেছে তবে কখনো খেয়াল করা হয় নি সমুদ্রকে।
সমুদ্র আরভীকে কোথায় দেখেছে, কখন দেখেছে তা জানার আগ্রহ জন্মালো আরভীর মাঝে। তাই আরভী সমুদ্রকে প্রশ্ন করলো,”আপনি আমাকে কখন আর কোথায় রেখেছিলেন সমুদ্র?”
সমুদ্র চায়ের ওয়ান টাইম কাপটা ব্রিজের উপর রেখে নিজেও উঠে বসলো ব্রিজে। তারপর আকাশের দিকে তাকিয়ে চোখ বন্ধ করে ফিরে গেলো আট বছর আগের ঘটনায়। যখন সমুদ্র আরভীকে প্রথমবার দেখেছিলো।
সমুদ্র বলতে আরম্ভ করলো সে সময়কার কথা-
“গল্পটা শুরু হয় ২০১৫ সালে অর্থাৎ আজ থেকে আরো আট বছর পূর্বে।
বন্ধুরা সবাই মিলে সিলেটে যাই এক মেয়ে ফ্রেন্ড এর বিয়ে উপলক্ষে। সে সময়টাতে আবার ভোরে উঠার অভ্যাস ছিলো আমার। প্রতিদিন ভোরে উঠে প্রকৃতির মাঝে হারিয়ে যাওয়া ছিলো আমার এক ধরনের নেশা।” এইটুকু বলে সমুদ্র চোখ মেলে তাকায়। গভীর শ্বাস নিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে বাকিটা বলতে শুরু করে,”তখন ছিলো বর্ষাকাল। ঝিরিঝিরি ধারায় বৃষ্টি পড়ছিলো সেদিন। সকাল আনুমানিক ছয়টা বেজে পনেরো মিনিট। আয়রাদের বাড়ির বেলকনিতে দাঁড়িয়ে কফি খাচ্ছিলাম আমি। গরম গরম ধোয়া উঠা কফির সাথে ঝিরিঝিরি বৃষ্টি ও দমকা হাওয়া উপভোগ করছিলাম। হঠাৎ আমার চোখ যায় অদূরে মাথা উচু করে দাঁড়িয়ে থাকা বিশাল এক কদম গাছের নিচে। দেখতে পাই একটা মেয়ে এই ঝিরিঝিরি বৃষ্টিতে ভিজে হাতে একটা বড় লাঠি নিয়ে কদম ফুল পাড়ায় ব্যাস্ত। তখন জিনিসটা আমার কাছে স্বাভাবিকই লাগে। অনুভব করি নি কিছু। তবে দেখতে ভালো লাগছিলো বিধায় কফি খেতে খেতে মেয়েটার ফুল পাড়া দেখছিলাম।
কিন্তু মেয়েটা ফুল পাড়তে বিফল হয় সেদিন। তা দেখে হেসেছিলাম আমি। বিষয়টা খুব মজার লেগেছিলো আমার কাছে। পরের দিন সকালে আবার কফি হাতে বেলকনিতে দাঁড়ালে এই একই দৃশ্য চোখে পড়ে। সেদিনও মেয়েটি পারে নি কদম ফুল হাতে নিতে। এরকম করে আরো দুদিন কেটে যায়। মেয়েটার প্রতি মায়া হয়। বেচারি একটা ফুলের জন্য কত চেষ্টাই না করছে! কিন্তু কোনো ক্রমেই নিতে পারছে না।
পরের দিন ভোর পাঁচটার দিকে ঘুম ভাঙ্গলো। বেলকনিতে গিয়ে দেখলাম মেয়েটা এখনো আসে নি। ভাবলাম আজ একটু মেয়েটাকে সাহায্য করা যাক। তাই আমি বাড়ি থেকে বেড়িয়ে সেই কদম গাছটার দিকে এগিয়ে গেলাম। গাছে উঠে কয়েকটা ফুল পেড়ে গাছের গোড়ায় রেখে এলাম। রাতে প্রচুর বৃষ্টি হয়েছিলো বিধায় গাছে উঠা সহজ ছিলো না। উঠতে গিয়ে অনেক বার পিছলে পড়েছি। হাত-পা ছিলেছে। মাঝে মনে প্রশ্ন জেগেছিলো একটা অপরিচিত মেয়ের জন্য আমি কেন এতো কষ্ট করছি? পরমূহুর্তে আমার মন আমাকে উত্তর দিয়েছিলো কাউকে সাহায্য করলে তো কোনো ক্ষতি নেই। তারপর চলে এলাম আয়রাদের বাড়িতে। বেলকনিতে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতে লাগলাম মেয়েটার প্রতিক্রিয়া দেখার জন্য।
ছ’টার দিকে মেয়েটা এলো। প্রথমে খেয়াল করে নি কিছু ফুল গাছের গোড়ায় পড়ে আছে। কিন্তু যখন খেয়াল করলো তখন তার মুখে ফুটে উঠে মোহনীয় এক মুচকি হাসি। যেই হাসিতে ঘায়েল হয়েছিলো আমার বাপাশের হৃদপিণ্ডটা। এক অন্যজগতে হারিয়ে যাই আমি। বর্ষাকালে বসন্তের রঙ লাগে এ মনে।” বলে সমুদ্র ডান হাত বুকের বা-পাশে রাখলো। হৃদপিণ্ডের লাবডাব শব্দ স্পষ্ট শুনতে পেলো।
আরভীর দিকে তাকিয়ে সমুদ্র আবার বলতে শুরু করলো,”তবে সে ছিলো আমার জীবনে কাল বৈশাখী ঝড়ের মতো। হুট করে এসে দমকা হাওয়ার মতো আমার থেকে আমার মনটা কেড়ে নিয়ে যায়। সেই যে আমার মনটা কেড়ে নিয়েছে এখনো ফিরিয়ে দেয় নি। তারপর আর তার দেখা পাই নি। আমার মন নিয়ে সে অদৃশ্য হয়ে যায়। অনেক খুঁজেছি তাকে। কিন্তু কোথাও পাই নি। এক সপ্তাহের জায়গায় এক মাস থেকেছি সিলেটে। ছন্নছাড়া হয়ে পথেঘাটে ঘুরেছি তার দেখা পাওয়ার আশায় কিন্তু তার দেখা মেলে নি। শেষে তন্ময় গিয়ে আমাকে নিয়ে আসে হৃদয়পুরে। আর সবথেকে আশ্চর্যের বিষয় কি জানেন? বর্ষায় হারিয়ে যাওয়া সেই মেয়েটির দেখা মিলে শীতের এক বিকেলে। আমার মনে হয়েছিলো এই তো, আমি ফিরে পেয়েছি আমার হৃদয় হরণকারীকে। কিন্তু আফসোস! তখন অনেক দেরি হয়ে গিয়েছিলো। তার জীবনে অন্য এক পুরুষের আগমন ঘটেছিলো। সেই পুরুষের ছলের সামনে আমার বিশুদ্ধ ভালোবাসা হেরে যায়। আমি নিজেকে গুটিয়ে নেই। হৃদয়পুর ছেড়ে চলে যাই গাজীপুরে। ভেবেছিলাম ফিরবো না এই শহরে। যে শহর আমার থেকে আমার শখের নারীকে ছিনিয়ে নিয়েছে সে শহর আমার নয়। কিন্তু একবছর না পেরোতেই মায়ের আহাজারিতে আবারো পা ফেলতে হয় হৃদয়পুরে। ততোদিনে সব পরিবর্তন হয়ে যায়। আপনি চলে যান অন্য কোথাও। আবার আপনাকে খুঁজতে থাকি। কিন্তু আগের বারের মতো ব্যার্থ হই।
দেখতে দেখতে সাতবছর কেটে যায়। ভেবে নিয়েছিলাম আপনাকে আর কখনো ফিরে পাবো না। তবে প্রতিজ্ঞা করেছিলাম আপনি নন তো কেউ নয়। আমার মন চুরি হয়ে গেছে, আমার নিজের সাথে নেই। তাই আমি আর আমার জীবনে অন্য কাউকে জায়গা দিতে পারবো না। কেননা মানুষের মন একটাই। আর সেটা নিয়ে আপনি হারিয়ে গিয়েছিলেন। কি করে জায়গা দিতাম অন্য কাউকে?” শেষোক্ত প্রশ্নটা সমুদ্র আরভীর উদ্দেশ্যে ছুড়ে দিলো। কিন্তু আরভী সমুদ্রের প্রশ্নের কোনো উত্তর দিলো না। কেবল তাচ্ছিল্যের হাসি হাসলো।
“কাল বৈশাখী ঝড়ের মতো আমার জীবন থেকে সব কিছু কেড়ে নিয়ে আপনি আবারো দমকা হাওয়ার মতো আবির্ভুত হোন এই হৃদয়পুরে। আপনাকে আবারো হৃদয়পুরে দেখে বুকের ভেতরে লুকিয়ে রাখা পুরোনো অনুভূতি জাগ্রত হয়ে উঠে। তবে এবার আপনার জীবন একদম শূন্য ছিলো। চঞ্চল সেই মেয়েটা হয়ে যায় গম্ভীর। অথচ বাহিরে শক্ত আবরণ ধারণ করা ভেতরের ক্ষতবিক্ষত আরভী রায়হানকে আমি দেখতে পাই। তখন আমার মনে হয়েছে সৃষ্টিকর্তা আমাকে সুযোগ দিয়েছেন। তাই কোনো রকমের না ভেবে আমি এই সুযোগ লুফে নেই। প্রথমে ভেবেছিলাম আপনি পুরোপুরি অনুভূতি শুন্য হয়ে পড়েছেন। কিন্তু যেদিন আপনাকে প্রথম রাস্তার ধারে বাচ্চাদের সাথে দেখি সেদিন বুঝতে পারি এখনো আপনার মাঝে আট বছর আগের সেই পুরোনো আরভী রায়হান বেঁচে আছে। শুধু সুযোগ ও পরিস্থিতির চাপে তা প্রকাশ করতে পারছেন না। ব্যাস, আমি পুরো প্রস্তুতির সাথে মাঠে নেমে পড়ি আপনার মন জয় করতে।” কথা শেষ করে সমুদ্র আরভীর থেকে দৃষ্টি সরিয়ে নেয়। দূরের ল্যাম্পপোস্টের সোডিয়ামের আলোর দিকে তাকিয়ে নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা করে। এখনো সমুদ্র অনুভব করতে পারে জীবনের প্রথম অনুভূতির কথা। তা ভাবলে পুরো শরীর জুড়ে অদ্ভুত এক শিহরণ বয়ে যায়। হৃদপিণ্ডের হৃদস্পন্দন বেড়ে যায়। পরক্ষণেই আবার মনে পড়ে যায় আরভীকে দু দুবার হারিয়ে ফেলার কথা। যা ভাবলে ভয়ে সর্বাঙ্গ কেঁপে উঠে। কেমন পাগল পাগল মনে হয় নিজেকে।
আরভী সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে এবার উচ্চস্বরে হেসে উঠলো। আরভীর হাসির শব্দে সমুদ্র আরভীর দিকে তাকায়। আরভীকে এই মূহুর্তে কেমন অস্বাভাবিক লাগছে। হাসতে হাসতে আরভীর চোখে পানি চলে এসেছে।
আরভী কোনো রকমে নিজের হাসি থামিয়ে বললো,”সরি বাট আমি আমার হাসি কন্ট্রোল করতে পারছি না।”
সমুদ্র বুঝলো না আরভীর এভাবে হাসার কারন। আরভী কি সমুদ্রের অনুভূতির প্রতি হাসলো নাকি অন্য কোনো কারনে! তাই জানতে সমুদ্র আরভীকে শুধালো,”আপনি হাসছেন কেন?”
“আপনি একটু আগে আমাকে প্রশ্ন করলেন না? মানুষের মন একটাই, সেখানে আপনি অন্য কাউকে কি করে জায়গা দিবেন। আমারও আপনার কাছে একটা প্রশ্ন, আমি কিভাবে আমার মনে আপনাকে জায়গা দিবো? আমার মনও তো আট বছর আগে একজন কেড়ে নিয়ে চূর্ণবিচূর্ণ করে দিয়েছে।”
“সেই চূর্ণবিচূর্ণ মনটাকে যদি আমি জোড়া লাগিয়ে দেই তাহলে ক্ষতি নেই তো! এছাড়া মনটা যেহেতু আপনার সাথেই আছে সেহেতু তা নতুন করে জোড়া লাগানো সম্ভব। আর এমনটা হলে জায়গা দিবেন আমাকে?”
“এখানে কোনো সিনেমা চলছে না সমুদ্র। এসব ডায়ালগ কেবল সিনেমাতেই ভালো লাগে। বাস্তব জীবনে নয়।”
সমুদ্র হাসলো, বিষাদের হাসি। সমুদ্র ভেবেছিলো হয়তো আজ আরভী বুঝবে সমুদ্রকে। কিন্তু আরভী বুঝে নি।
সমুদ্র দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো,”চলুন আপনাকে বাড়ি পৌছে দেই। অনেক রাত হয়ে গেছে।”
“আশা করছি এর পর থেকে কখনো আমার সামনে এসে দাঁড়াবেন না সমুদ্র মুনতাসিন। আমাদের মাঝে দেখা-সাক্ষাৎ না হওয়াটাই শ্রেয়।”
সমুদ্র প্রতিত্তোরে কিছু বললো না। চুপ করে নিজের ভেতরকার যন্ত্রণা নেভানোর প্রয়াস চালালো। কেন আরভী বুঝলো না সমুদ্রকে? তবে কি এবার আরভীকে চিরতরে হারিয়ে ফেলবে সমুদ্র? এসব ভেবেই ভেতরটায় কেমন চিনচিন ব্যাথা অনুভূত হচ্ছে সমুদ্রের।
কোনো রকমে নিজেকে সামলিয়ে বাইক চালিয়ে আরভীদের বাড়ির সামনে বাইক থামালো সমুদ্র। আরভী বাইক থেকে নেমে যেতেই সমুদ্র অনুনয়ের স্বরে বললো,”দাঁড়ান, শেষবারের মতো আমি কিছু বলতে চাই আপনাকে।”
আরভী দাঁড়ালো। শেষবারের মতো! তারমানে সমুদ্র আর সামনে আসবে না। যাক গে, তাতে আরভীর কি? আরভী তো এটাই চায়।
“আপনার কাছে কারো অনুভূতির কোনো দাম নেই তাই না? নিজের অনুভূতি ছাড়া কখনো কারো অনুভূতির পরোয়া করেছেন? একটু ভেবে দেখুন তো। আপনার বাবা আরশাদ রায়হান সবসময় আপনাকে এই রাজনীতি থেকে দূরে রেখেছেন ও রাখতে চেয়েছেন। অথচ আপনি নিজের জেদের সামনে আপনার বাবার ইচ্ছে, স্বপ্ন বিসর্জন দিয়েছেন। আপনার মা চাইছেন আপনি এই রাজনীতি থেকে সরে আসুন। কিন্তু আপনি আন্টির কথারও কোনো দাম দিচ্ছেন না। সেদিন থেকে আপনার কাছে আমি বারবার অপমানিত হয়ে এসেছি তাও হার মানি নি। অথচ আজ আমার অনুভূতি গুলোকে মিথ্যে মনে হলো আপনার কাছে। আপনি হেসেছেন আমার অনুভূতির উপর। সরি, আমি এসব আপনাকে কেন বলছি? আমারই তো ভুল ছিলো। আমার উচিত হয় নি আপনাকে এতো কিছু জানানো। আসলে কি জানেন তো? কথাগুলো অনেক বছর ধরে নিজের ভেতরে চেপে রেখেছি। তন্ময়, মিনহাজ, মা-বাবা, বোন কাউকে জানতে দেই নি এসব। আজ কেন যেনো আমার মনে হয়েছিলো যেহেতু আপনি এক সময় একজনকে ভালোবেসেছিলেন সেহেতু হয়তো আমার অনুভূতির সম্মান করবেন। অথচ আপনি! এ কথা থাক, একটা কথা সাজেস্ট করতে চাই আপনাকে। কখনো কারো অনুভূতির সম্মান করতে না পারলে অসম্মান করবেন না প্লিজ। এখানটায় অনেক লাগে।” হাত মুঠোবন্দি করে তর্জনী আঙুল দিয়ে হৃদপিণ্ডের উপর বারতিনেক আঘাত করে বললো সমুদ্র। তারপর আরভীর প্রতিত্তোরের অপেক্ষা না করে বাইক স্টার্ট দিয়ে চলে গেলো। আর আরভী সেখানেই ‘থ’ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। সত্যিই কি তাই? আরভী কি কখনোই কারো অনুভূতির মূল্য দেয় নি?
চলবে….
বি.দ্র. : এই পর্ব পড়ে কিছু প্রশ্ন জাগতে পারে আপনাদের মনে। এসব প্রশ্নের উত্তর আস্তে-ধীরে দেওয়া হবে। ধন্যবাদ সবাইকে❤️