#নব_প্রেমের_সূচনা
#Sumaiya_Akter_Bristy
#পর্ব_২৩
আরভী সমুদ্রের যাওয়ার পথের দিকে তাকিয়ে বিরবির করে বললো,”অন্যের অনুভূতির সম্মান আপনি করছেন তো সমুদ্র?”
আরভী বাড়ির ভেতর প্রবেশ করে দেখলো আফিফা আফরোজ ড্রয়িং রুমে বসে আছেন।
আফিফা আফরোজ আরভীকে বাড়িতে প্রবেশ করতে দেখে ওয়াল ঘড়ির দিকে তাকালেন। দেখলেন ন’টা পেড়িয়ে গেছে। শান্ত স্বরে জিজ্ঞেস করলেন,”সমুদ্রের সাথে ছিলে?”
আফিফা আফরোজ তুমি করে সম্বোধন করছেন। তারমানে উনি প্রচুর পরিমাণে রেগে আছেন। কেননা উনি সর্বদা আরভীকে তুই সম্বোধন করলেও আরভীর উপর রেগে থাকলে আরভীকে তুমি সম্বোধন করেন।
“হ্যাঁ মা, সরি আর এমনটা হবে না।”
“তোমাকে আমি আগেই বলেছি এ বাড়িতে রাত করে ফেরা নিষেধ তারপরও তুমি আটটার দিকে আজ বাড়িতে এসেছো। আচ্ছা মেনে নিলাম তোমার অনেক বেশি কাজ ছিলো কিন্তু এতো রাতে একটা ছেলের সাথে বাহির থেকে ঘুরে আসা কোন ধরনের সভ্যতা? আমি মানছি সমুদ্রকে আমারও বেশ পছন্দ। তার মানে এই না আমি তোমাকে অনুমতি দিবো এতো রাতে অবিবাহিত একটা ছেলের সাথে বাহিরে ঘুরতে যাওয়ার জন্য। নাকি তুমি বড় হয়ে গেছো দেখে ভাবছো আমার অনুমতি নেওয়ার কোনো প্রয়োজন নেই তোমার?” অনেকটা রাগান্বিত স্বরে বললেন আফিফা আফরোজ।
“না মা এমন কিছুই না। তুমি ভুল বুঝছো আমাকে। সমুদ্র আমাকে জোর করছিলো বিধায় আমি যেতে বাধ্য হয়েছি।”
“ওহ আচ্ছা! তোমাকে কেউ কখনো জোর করতে পেরেছে? আমি পেরেছি জোর করে তোমাকে রাজনীতি থেকে ফিরিয়ে আনতে? আচ্ছা তুমি ভেতরে ভেতরে আবার সমুদ্রের প্রতি দূর্বল হয়ে পরো নি তো? এরকমটা হলে জানাও আমাকে আমি তোমাদের বিয়ের ব্যবস্থা করি। তারপর দুজনে মিলে যতো ইচ্ছে বাহিরে ঘুরাঘুরি কর, আমার কোনো সমস্যা নেই।”
“মা তুমি এসব কি বলছো? সমুদ্রকে আমার একদম পছন্দ নয়।”
“তা তো দেখতেই পাচ্ছি। তবে কি জানো তো? যারা আমাদের অপছন্দের তালিকায় থাকে তারাই কিন্তু একসময় আমাদের মনে জায়গা করে নেয়। আর তুমি ভুলে যেও না তুমি একটা মেয়ে। এভাবে রাতবিরেতে অবিবাহিত ছেলে-মেয়ে একসাথে ঘুরে বেড়ালে লোকে নিন্দা করবে। আশা করছি এরকম ভুল আর কখনো করবে না তুমি। তুমি এই জেলার মেয়র অথচ একটা ছেলের জেদের সামনে হার মানছো প্রতিবার! ব্যাপারটা আমাকে ভাবাচ্ছে, তুমি নিজেও একটু ভেবে দেখো।”
“মা!” আরভী অবাক হওয়ার স্বরে শব্দটি উচ্চারণ করলো।
“যাও ফ্রেশ হয়ে আসো আমি খাবার দিচ্ছি টেবিলে।” কথাটি বলে আফিফা আফরোজ আরভীকে এড়িয়ে রান্নাঘরের দিকে চলে গেলেন।
সমুদ্র বাইক চালিয়ে আবারো সেই ব্রিজের ধারেই এসেছে। অন্ধকারের এক কোনে বসে একের পর এক সিগারেট শেষ করে যাচ্ছে। এই নিয়ে চতুর্থ বারের মতো সিগারেটে আগুন ধরালে পাশ থেকে তন্ময় তা মুখ থেকে কেড়ে নিয়ে দূরে ছুড়ে ফেলে বলে উঠলো,”এবার থাম, আর কত?”
সমুদ্র প্রতিত্তোরে কিছু বললো না। এক ধ্যানে পানির দিকে তাকিয়ে রইলো।
তন্ময় সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে বললো,”আরভীকে ভালোবাসিস?”
“না। শুধু খেলছি ওর সাথে।” গম্ভীর স্বরে বললো সমুদ্র।
“আমি তোকে দেখলেই তোর ভেতরকার খবর জেনে যাই।”
“এতো রাতে এখানে কি করছিস? বাড়ি যা।”
“বাড়ি গিয়ে কি করবো? বউ নেই তো। বউ থাকলে না হয় তাড়াতাড়ি চলে যেতাম।” ইয়ার্কি করে বললো তন্ময়।
সমুদ্র আড়চোখে তাকালো তন্ময়ের দিকে। কন্ঠস্বর কঠিন করে বললো,”আমার বোনকে তোর সাথে বিয়ে দিবো না আমি, তাই আমার সামনে এসব বলে লাভ নেই।”
“সালা নিজে বিয়ে করবি না দেখে কি আমাকেও বিয়ে করতে দিবি না নাকি?”
“তোকে না করলাম কখন আমি?”
“তো বলছি তো তোর বোনকে আমার হাতে তুলে দে। আমি কিন্তু ছেলে হিসেবে অনেক ভালো। ভালো জব আছে, টাকা আছে, ভালো পরিবার আছে। তোর বোন অনেক সুখে থাকবে আমার সাথে মিলিয়ে নিস তুই।” মাথার চুল দুহাত দিয়ে পেছনের দিকে ঠেলে দিতে দিতে বললো তন্ময়।
তন্ময়ের এ কথা শুনে সমুদ্র বাকা হেসে বললো,”তোকে আমার থেকে ভালো আর কে চিনে?”
সমুদ্রের কথা শুনে তন্ময় দাঁত কেলিয়ে হাসলো।
“আমরা দুজন একই নৌকার মাঝি। সেটা ভুলে যাস না।”
তন্ময়ের কথা শুনে সমুদ্র এবার উচ্চস্বরে হেসে উঠলো।
সমুদ্রকে কেমন অন্যরকম দেখাচ্ছে আজ। চোখ দুটো যেনো ছলছল করে উঠছে বারেবার। তা দেখে তন্ময় দীর্ঘশ্বাস ফেললো। তন্ময় ভালো করেই জানে সমুদ্র এখন তন্ময়কে কিচ্ছুটি বলবে না। কেননা সমুদ্র এমনই। কখনো নিজের দুঃখ গুলো কারো সাথে শেয়ার করে না। শুধু খুশিগুলোই সবার সাথে শেয়ার করে। ছেলেটা নিজের দুঃখে অন্য কাউকে দুখী করতে চায় না।
অপরদিকে রাতের আধারে শরীরে একটা পাতলা চাদর জড়িয়ে ছাদের এক পাশে রেলিঙের সাথে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে আরভী। দৃষ্টি তার দূর আকাশে।
আজ প্রথমবার সমুদ্রকে এতোটা সিরিয়াস হতে দেখেছে আরভী। সমুদ্রের চোখে দেখেছে অঢেল গভীরতা। আরভী জানে না সমুদ্র সব সত্যি বলেছে নাকি মিথ্যা। তবে সমুদ্রের চোখ দেখে মনে হয় নি সমুদ্রের কথাগুলো মিথ্যে ছিলো।
সমুদ্রের কথাগুলো সত্যি হয়ে থাকলেও যে আরভীর কিছু করার নাই। আরভী যে আর কাউকে নিজের মনে জায়গা দিতে পারবে না। কেননা এখন আর কারো প্রতি কোনো অনূভুতি কাজ করে না আরভীর মনে।
আরভীর এখনো বিশ্বাস হচ্ছে না হেমন্ত আরভীর সাথে ছলনা করেছে। আচ্ছা! এভাবে একটা মেইল দেখেই বিশ্বাস করা উচিত কি? না, একদমই না। এর থেকে ভালো আরেকটু ঘেটে দেখা। যাকে এতো বছর ধরে ভালোবেসে এসেছে কি করে তাকে এতো সহজেই অবিশ্বাস করেছে আরভী? এমনও তো হতে পারে ইমতিয়াজ ভুল করে হেমন্তের ছবি পাঠিয়ে দিয়েছে। কিন্তু কথা হলো ইমতিয়াজের তো হেমন্তকে চেনার কথা না। নাহ এতো কিছু ভেবে লাভ নেই। সব থেকে ভালো হয় নাহিদ চৌধুরীর ভাগ্নের সাথে সামনা সামনি দেখা করা। তবেই সব সত্যি মিথ্যা জানা যাবে।
——–
আরভী আজ অর্কদের বস্তিতে এসেছে। সাথে ফায়াজ, অভি দত্ত ও কিছু পুলিশ কনস্টেবল রয়েছে।
অদ্ভুত ব্যাপার হলো এ বস্তিতে বিদ্যুৎ নেই। ২০২৩ সাল শেষ হলো বলে অথচ এখানে বিদু্ৎ নেই জিনিসটা সত্যিই অবাক করলো আরভীকে। বিদ্যুৎ ছাড়া সবাই এখানে থাকে কিভাবে?
আরভী এক বৃদ্ধা মহিলাকে জিজ্ঞেস করলো,”আপনাদের এখানে বিদ্যুৎ নেই থাকেন কিভাবে? কখনো এর জন্য আবেদন করেন নি?”
“করছি মা। অনেক বার আবেদন করছি হক্কলে মিল্লা। তোয় কোনো লাভ হয় নাই।”
আরভী দীর্ঘশ্বাস ফেললো। আরভীর মনে পড়ে যায় আরশাদ রায়হান মারা যাওয়ার আগে পুরো হৃদয়পুরে বিদ্যুৎ এর ব্যবস্থার জন্য চেষ্টা করে যাচ্ছিলেন। তারপর সব শেষ। নাহিদ চৌধুরী ক্ষমতায় আসেন। যার মূল উদ্দেশ্য ছিলো ক্ষমতা লাভ করা, গ্রামবাসীর ভালো করা নয়।
“আমি আপনাদের কথা দিচ্ছি। ২০২৪ সালে এ জেলার প্রতিটি ঘরে ঘরে বিদ্যুৎ থাকবে। আমি উপর মহলের সাথে এ ব্যাপার নিয়ে কথা বলবো।”
আরভীর কথা শুনে বস্তির সবাই খুশি হয়। খুশিতে সবার চোখ ছলছল করে উঠে। ঘরে বৈদ্যুতিক বাতি জ্বলবে তা শুনে সবার মাঝে এক ধরনের উত্তেজনা দেখা যায়। সবাই একসাথে করতালি দিতে থাকে।
আরভী এবার অভি দত্তের দিকে তাকিয়ে বললো,”এখানে এক দল ছেলেপেলে সবার থেকে কিসের নাকি চাঁদা তুলে। একটু দেখুন তো ব্যাপারটা।”
অভি দত্ত সম্মতি জানালে আরভী গাড়ির দিকে এগিয়ে যায়। গাড়িতে উঠে বসে ফায়াজকে উদ্দেশ্য করে বলে,”ইমতিয়াজের সাথে তোমার কোনো কথা হয়েছে?”
“হ্যাঁ আপু, শুনেছি নাহিদ চৌধুরী পালিয়েছেন জেল থেকে।”
“কোথায় আছে সেটা বলেছে?”
“এখনো হৃদয়পুরেই আছেন। কয়েকদিনের মাঝেই উনার ছেলে মিনহাজের সাথে কানাডায় পালিয়ে যাবেন। ফেক পাসপোর্ট বানাচ্ছেন এখন।”
“মিনহাজ!” নামটা কোথায় যেনো শুনেছে বলে মনে হচ্ছে আরভীর কাছে। কিন্তু কিছুতেই মনে করতে পারছে না। কিছুক্ষণ ব্রেনের উপর জোর দিতেই মনে পড়লো কাল রাতে সমুদ্রের মুখে এই নামটা শুনা হয়েছে সম্ভবত।
সমুদ্রের বলা মিনহাজ আর এই মিনহাজ আবার একজনই নয় তো? যদি এমনটা হয় তাহলে এই দুজনের মাঝে সম্পর্ক কি?
সমুদ্র হয়তো হেমন্তকে চিনে। কেননা সমুদ্র জেনেছিলো আরভীর জীবনে কেউ একজন আছে। কাল রাতে সমুদ্রের থেকে মিনহাজ নামটা শুনেছে আরভী। অপরদিকে মিনহাজ নাহিদ চৌধুরীর ছেলে। আর হেমন্ত নাহিদ চৌধুরীর ভাগ্নে। মিনহাজকে চিনে থাকলে তো হেমন্তকেও চেনার কথা। কিন্তু সমুদ্র কালকে এতো কিছু বললো অথচ হেমন্তকে চেনে এমন কিছুই বলে নি। তবে কি সমুদ্র কোনো গেম খেলছে আরভীর সাথে? নাকি সমুদ্রের বলা মিনহাজ আর নাহিদ চৌধুরীর ছেলে মিনহাজ দুজনেই ভিন্ন দুটো মানুষ!
“আচ্ছা ফায়াজ তুমি কি নাহিদ চৌধুরীর ছেলে বা ভাগ্নেকে দেখেছো কখনো?”
“আসলে আপু নাহিদ চৌধুরী নিজের পরিবার কখনো সবার সামনে আনেন নি। উনার ওয়াইফ বা ছেলে আছে তা কেউ জানেই না। কালকে ইমতিয়াজের থেকে প্রথম শুনেছি উনার ছেলের কথা। অবাক হয়েছিলাম শুনে।”
“ইমতিয়াজকে যা বলতে বলেছিলাম বলেছো?”
“হ্যাঁ আপু, আজকে কালকের মাঝেই ও কাজটা শেষ করার চেষ্টা করবে। তবে আপু আমার কিন্তু ওর জন্য একটু ভয় হচ্ছে। যদি ধরা পড়ে যায়!”
“পজিটিভ ভাবো ফায়াজ। জয় আমাদেরই হবে। ইমতিয়াজ কাজটা ঠিক ভাবে করতে পারলে নাহিদ চৌধুরী দু’দিন পর কারাগারের চার দেওয়ালের মাঝে আটকা পড়বেন। তবে এবার আর বের হতে পারবেন না। কেননা যে প্রমাণ আমাদের হাতে আসতে চলেছে তাতে উনার মৃত্যুদণ্ড নিশ্চিত।”
নাহিদ চৌধুরী দুপুরের খাবার শেষ করে সবেমাত্র বিছানায় শুয়েছেন। এমন সময় মাথার ধারে থাকা মোবাইলটা হঠাৎ ভাইব্রেট হতে লাগলো। মোবাইলটা হাতে নিয়ে দেখলে “ভাগ্নে” নামটা জ্বলজ্বল করে ভাসছে।
ভাগ্নে এই নম্বর পেলো কোথায়? হয়তো মিনহাজ দিয়েছে। তা ভেবেই নাহিদ চৌধুরী কল রিসিভড করলেন।
“হ্যালো ভাগ্নে!”
“মামা, কেমন আছো তুমি?”
“ভালো নেই ভাগ্নে। কিভাবে কি হয়ে গেলো বুঝতে পারছি না। আমার এতোদিনের সাজানো সম্রাজ্য সব শেষ ভাগ্নে। আমি আবার রাজনীতিতে ফিরবো কি করে?”
“উফ মামা! তুমি এখনো রাজনীতি নিয়ে পড়ে আছো?”
“কি করবো ভাগ্নে? ক্ষমতা ছাড়া কিছুই ভালো লাগে না।”
“যাই হোক, সরি মামা। তোমার জন্য আমি কিছু করতে পারলাম না।”
“আরেহ সরি বলছিস কেন? তুই কিভাবে আমাকে সাহায্য করবি? তুই তো একদম সাদামাটা ভাবে চলিস। তোর হাতে ক্ষমতা থাকলে তুই আমাকে ঠিকই মিনহাজের আগে বের করে নিতি জানি আমি। তুই আর মিনহাজ ছাড়া আমার কেই-বা আছে বল।”
“সাবধানে থেকো মামা। আর সব কিছুর জন্য আমাকে মাফ করে দিও।”
“দূর পাগল ছেলে। এখানে মাফ চাওয়ার কি আছে? তুই বরং আমার সাথে একটু দেখা করে যা।”
“কোথায় আছো তুমি?”
“গোধূলি রিসোর্টের পূর্ব দিকে যে দোতলা একটা বাড়ি আছে না? সে বাড়িতেই আছি। কাল একবার আসবি ভাগ্নে? এখানে একা একা আর ভালো লাগে না।”
“চিন্তা কর না মামা। আসবো আমি।”
চলবে….