#ভুলোনা_আমায়
#মেঘাদ্রিতা_মেঘা
#পর্ব_৪
সবাই মিলে এক সাথে হাসাহাসি করছে।
কত্ত খুশি সবাই।
এর মধ্যেই হঠাৎ করে কলিং বেলের আওয়াজ।
আমি গিয়ে গেইট খুলতেই দেখি কল্প স্বয়ং হাজির।
আমি দেখে অবাক হবো নাকি খুশি হবো,কিছুই বুঝতে পারছিলাম না।
_তুমি?
ও কোন কথা না বলেই আমাকে শক্ত করে ওর বুকে জড়িয়ে ধরে।
ছেলেটা এখন কাঁদবে নিশ্চিত।
বলেছিলাম না কাঁদবে,
কান্না শুরু করেছে।
_আচ্ছা এইভাবে কান্না করার জন্য এসেছো তুমি?
হুটহাট না জানিয়ে কেউ এভাবে আসে?
_জানিয়ে আসলে কি সারপ্রাইজ দিতে পারতাম?
তোমার মুখের এই অদ্ভুত সুন্দর হাসিটা দেখতে পেতাম?
_এত ভাল কিভাবে বাসতে পারে মানুষ কলিজা?
_তুমি যেভাবে বাসো,ঠিক সেভাবে।
কল্পকে দেখে সবাই অবাক হয়ে যায়।
আর খুশিও হয়।
তারপর সবাই মিলে এক সাথে বসে ফ্রেশ হয়ে গল্প করে।
আম্মুর রান্না হয়ে গেলে সবাই আমরা এক সাথে খাওয়া দাওয়া করি।
আমাদের বাসার সবাই খাওয়া দাওয়া শেষ করে কিছু ক্ষণ কথা বার্তা বলে বাসায় চলে যায়।
সন্ধ্যা হয়ে যায়।
আম্মু আমাদের রুমে এসে,কল্পকে ডেকে বলেন।
_কিরে,তুই হঠাৎ করে চলে এলি যে?কাউকে তো কিছু জানালিও না।
_এমনিই আম্মু।আমাকে ওখান থেকে একবারে পাঠিয়ে দিয়েছে।
এখন কাজ কম তো তাদের।সেই জন্য।
আবার যখন বেশি কাজ পড়বে তখন নাকি ডাকবে বলেছে।আপাতত তাদের আর লোক লাগবেনা।
_তোকে একাই পাঠিয়েছে?
_না।আরো কয়েক জনকে পাঠিয়েছে আমার সাথে।
_থাক চিন্তা করিস না।
আল্লাহ যা করেন ভালোর জন্যই করেন।
হয়তো এখানেও কিছু ভালো লুকায়িত আছে।
_হুম আম্মু।
আচ্ছা রেস্ট নে তাহলে একটু।
রাতে এসে খেয়ে যাস তোরা।
আম্মু চলে যান।
_সত্যি সত্যি তোমাকে তারা পাঠিয়ে দিয়েছেন?
_হুম দিলো তো।
_একদম মিথ্যা বলবেনা আমার সাথে।
_কি মিথ্যা বললাম?
_তোমাকে পাঠিয়ে দেয়া হয়নি।
বরং তুমি নিজ ইচ্ছায় একবারে চলে এসেছো।তাইনা?
_কে বলেছে তোমায় এসব?
_আমার জন্য চলে এসেছো তাইনা?
কল্প চুপ করে আছে।
_কেন আম্মুকে মিথ্যা বললে?
_আমি চাইনা কেউ মনের ভুলেও তোমাকে খারাপ ভাবুক,কেউ না বলুক বউ এর জন্য চাকরি ছেড়ে আমি চলে এসেছি।
আর তা শুনে তুমি কষ্ট পাও।
আম্মু না বল্লেও বাসার আর কেউ ও তো বলতে পারে তাইনা?
আর বাসা থেকে কথা বাইরে যেতে কত ক্ষণ?আর বাইরে কথা গেলে জানোই তো কি হয়।
আমি চাইনা কেউ তোমার দিকে আঙুল তুলুক।
_কেন এত ভালবাসো আমায় বলো তো?
কল্প আমাকে জড়িয়ে ধরে বলে।
ভালবাসি বলেই ভালবাসি।
তুমি না বাসলেও আমি বাসি।
_কিহ?
_জ্বীইই।
কি ভাবছো মিসেস কল্প?চুপ হয়ে গেলে যে?
_কিছুনা।
_টায়ার্ড লাগছে?
_তুমি এসেছো জার্নি করে,তুমি টায়ার্ড। তুমি রেস্ট নাও একটু।
_না আমি ঠিক আছি।
_জানো কল্প,আমার ইচ্ছে করছে আজকের দিন টা আমি যদি ফ্রেমে বন্দি করে রাখতে পারতাম।
কত ভালো হতো তাইনা।
সবাই কত খুশি ছিলো আজ।
এত খুশি আমি এর আগে কোন দিন কাউকেই দেখিনি।
আবার একদিন সবাই এ বাসায় একত্রিত হয়ে কাঁদবে তাইনা?
শুধু আমিই কাঁদবোনা।
কারণ আমি নিজেই তো থাকবোনা।
_কি সব আবোলতাবোল কথা বলছো?
এমন কথা আর যেন না শুনি।
একদম চুপ।
আচ্ছা দেখি তো আমার মা টা কি করে।
কল্প আমার পেটে কান পেতে বলে,
_আম্মাজান!আপনি কি করছেন এখন হুম?
আপনাকে আপনার বাবা কিন্তু খুব মিস করছে।
কবে আসবেন আপনি?
_এই এই তুমি কি বল্লা?আম্মাজান?
_হুম আম্মাজানই তো।
_কে বলেছে?যদি আব্বাজান হয়?
তখন কিন্তু আব্বাজান রাগ করে ফুলে থাকবে।
কথাই বলবেনা।
_এটা আমার আম্মাজানই দেখো।
তুমি মেয়ে চাও তো,আল্লাহ আমাদের মেয়েই দিয়েছেন দেখে নিও।
_ভালবাসি।
_ভালবাসি অনেক টা।
পরের দিনই কল্প আমাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যায়।জানার জন্য ডাক্তারের কাছ থেকে,আমার কি অবস্থা।
ডাক্তার বলেন,আপাতত বেবী ছোট।
তাই তেমন কোন সমস্যা হবেনা।
কিন্তু বেবী বড় হবার সাথে সাথে সমস্যা শুরু হবে।
তবুও তারা যথেষ্ট চেষ্টা করবে সমস্যার মোকাবিলা করার।
কল্প ডাক্তারকে বলেন,
আমি আমার বাচ্চা আর বউ দুজনকেই চাই প্লিজ।
ডাক্তার বলেন,আল্লাহ ভরসা।
আমরা চেষ্টা করবো।
বাকি টা আল্লাহর হাতে।
কল্প আমাকে খুব যত্ন করে।
আমার খেতে ইচ্ছে করেনা বলে,খেতে না চাইলে জোর করে খাইয়ে দেয়।
আর এই বলে ইমোশনাল ব্ল্যাকমেইল করে,
আম্মাজান কিন্তু না খেয়ে আছে।
তুমি না খেলে ও খাবার পাবে কই?
আর তখন না চাইতেও খেতেই হয়।
প্রেগন্যান্সিতে আমার মারাত্মক মুড সুইং হয়।
খিটখিটে মেজাজ,হঠাৎ রাগ।
মাঝ রাতে এটা সেটা খেতে ইচ্ছে করা।
সব অদ্ভুত কিছু ইচ্ছে করে।
একদিন রাত তিন টা বাজে তখন।
আমি কল্পকে ঘুম থেকে ডেকে তুলি।
কল্প তো ভয় পেয়ে যায়,আমার কোন সমস্যা হলো কিনা।
পরে আমি বলি,
_কল্প!আমি আইসক্রিম খাবো।
_কয়টা বাজে এখন?
_এইতো আড়াইটা তিন টা বাজবে হয়তো।
_এত রাতে আমি আইসক্রিম পাবো কই?
_আমি জানিনা।
_আর তাছাড়া এখন আইসক্রিম খেতে হবেনা।
আম্মাজানের ঠান্ডা লাগবে।
_কিচ্ছু হবেনা।
ওর ও আইসক্রিম খেতে ইচ্ছে করছে।
তুমি আমায় আইসক্রিম এনে দাও।
_এত রাতে?
সকালে এনে দেই?
এখন লক্ষী মেয়ের মত ঘুমাও।
_নায়ায়ায়া!তুমি আমাকে এখনই আইসক্রিম এনে দিবা।
এখনই।
নইলে আমি ঘুমাবোনা।
_আচ্ছা শোনো জান,তুমি এখন ঘুমাও একটু।
সকাল হলেই দেখবে আইসক্রিম তোমার সামনে।
_না আমি এখন খাবো।
নইলে ঘুমাবোনা না না না।
কল্প সত্যি সত্যি খু্ঁজে আমার জন্য আইসক্রিম নিয়ে আসে।
_এত রাতে আইসক্রিম পেলে কই?
_সব দোকান বন্ধ ছিলো।
একটা দোকানের মালিক দোকানের ভেতরে থাকে।
তাকে ঘুম থেকে ডেকে তুলে এনেছি।
_ওরে আমার কলিজারে।
_হয়েছে হয়েছে,এবার আইসক্রিম খেয়ে ঠান্ডা হন।
আমি এখন ঘুমাই তাহলে একটু।
_হুম ঠিক আছে।
আমার এ সময়ের অদ্ভুত ইচ্ছে গুলো কল্প চুপচাপ হাসি মুখে পূরণ করে।
তাতে ওর যতই কষ্ট হোক।
একদিন আমার খুব শাড়ী পরতে ইচ্ছে করলো।
কিন্তু আমি নিজে শাড়ী পরতে পারিনা।
তাই জেদ করলাম কল্পই আমাকে শাড়ী পরিয়ে দিবে।
ও বার বার বলছিলো,চলো আম্মুর কাছে যাই।
আম্মু তোমাকে খুব সুন্দর করে শাড়ী পরিয়ে দিবেনে।
কিন্তু আমি আমার জেদে অটল।
শাড়ী কল্পকেই পরিয়ে দিতে হবে।
তাই বেচারা দীর্ঘ দুই ঘন্টা ইউটিউব দেখে শাড়ী পরা শিখে।
তারপর আমাকে শাড়ী পরিয়ে দেয়।
এ সময় নাকি একেক জনের একেক রকম ইচ্ছে হয়।
যাদের মুড সুইং হয় আরকি।
আর যাদের মুড সুইং হয়না,তাদের তো কোন সমস্যাই নেই।
তো একদিন হঠাৎ করে আমার ডান পায়ের নূপুর টা পা থেকে ছিঁড়ে পরে গেলো।
আর আমি এই কান্না,আমার এখন নতুন নূপুর লাগবে।
এখনই লাগবে।
কল্প আমার কান্না থামাতে জুয়েলারির দোকানে যায়।
কিন্তু আমার পায়ের মাপের কোন নূপুর পায়না।
পরে দেখে একজোড়া আছে।
কিন্তু সেটা অন্য জনের অর্ডারের।
আজই সে এসে নিয়ে যাবে।
পরে কল্প জোর করে ১০০০ টাকা আরো বেশি দিয়ে সেই নূপুর আমার জন্য নিয়ে আসে।
এত জ্বালাই আমি।
বেচারা তবুও এক বিন্দু রাগ করেনা।
দেখতে দেখতে অনেক গুলো দিন কেটে যায়।
সুখের মুহূর্ত গুলো খুব তাড়াতাড়িই চলে যায়।
এদিকে আমার পেটে খুব ব্যথা হতে শুরু করে।
আমি সহ্য করার চেষ্টা করি।
কিন্তু পারিনা।
বেবী যখন নড়াচড়া করে আমার খুব কষ্ট হয়,ওই যে আমার সমস্যা আছে যে সেই জন্য। কিন্তু কল্পকে বুঝতে দেইনা।
একদিন রাতে কল্পর বুকে মাথা রেখে আমি বলি,
_আমাদের মেয়ে হলে কি নাম রাখবা হুম?
_তুমিই বলো।
_না তুমি বলো।
_না তুমি বলো।
_নীরা রাখি হুম?আমাদের মেয়ে হলে নাম হবে নীরা।
আর ছেলে হলে রাজ্য।
_আচ্ছা তাই হবে।
_কল্প,
_হুম বলো।
_আমি চলে গেলে ”ভুলোনা আমায়” হুম।
_উফ চুপ করবা তুমি?
কোথাও যাবেনা তুমি আমাকে ছেড়ে।
কোথাও না।
_আচ্ছা যাবোনা।
এবার কান্না বন্ধ করো তো।
_জানো কল্প!আমার না অনেক শখ ছিলো,আমাদের একটা মেয়ে হবে।
ছোট্ট ছোট্ট হাত,ছোট্ট ছোট্ট পা।
ছোট্ট একটা পুতুল।
ওকে আমরা অনেক সুন্দর করে সাজিয়ে রাখবো।
ওর না চুল কাটবোনা আমরা।
অনেক অনেক চুলের ক্লিপ কিনে দিবো,অনেক সুন্দর সুন্দর ড্রেস।
কত স্বপ্ন আমার।
_সব হবে কলিজা।
তুমি একদম চিন্তা করোনা।
_আমার কিছু হয়ে গেলে আমার মেয়েটাকে দেখে রেখো হুম?আম্মুর খেয়াল রেখো।
_উফ চুপ করবে তুমি?
তোমার কিছু হলে আমি কি নিয়ে বাঁচবো ভেবেছো একবার?
কিছু হবেনা তোমার।ঘুমাও এখন।
একদম চুপ করে ঘুমাবা।
এরপর হঠাৎ একদিন রাতে আমি ঘুমের মধ্যেই অনুভব করি,আমার পেটে ব্যথা হচ্ছে।আর এতই ব্যথা হচ্ছে যা সহ্য করার মত না।
আমি কল্পকে ডাকতেই কল্প আমাকে দ্রুত হসপিটালে নিয়ে যায়।
আমি যেই ডাক্তারের আন্ডারে আছি তাকে ফোন দেয়।
সে দ্রুত হসপিটালে চলে আসেন।
এসে বলেন,
এখন তো এমন ব্যথা হবার কথা না।
এখনো তো অনেক সময় বাকি ওর।
যাইহোক,
এখনই যা করার করতে হবে।
দেরি হলে সমস্যা হয়ে যাবে।
আর বেবীকে কিন্তু আই সি ইউ তে রাখতে হবে আগেই বলে দিলাম।
_আর দ্রিতা?(কল্প)
_আল্লাহ কে ডাকুন।
আমি একটা পেপার পাঠাচ্ছি।
সেখানে সই করে দিবেন কেমন?
আমাদের বাসায় খবর দেয়া হয়েছে।
আমার সাথে কল্প,আম্মু(শাশুড়ী মা)আর ছোট ভাই(দেবর) এসেছে।
কল্প আমার হাত ধরে আছে।
_কল্প!আমাকে একটু জড়িয়ে ধরবে?
কল্প আমাকে বুকের সাথে জড়িয়ে নেয়।
ওর চোখের পানি টপ টপ করে আমার গায়ে পড়ছে।
_আমি না তোমায় অনেক ভালবাসি কলিজা।
অনেক ভালবাসি।
_আমিও কলিজা।
একটা নার্স এসে বলেন,
পেশেন্টকে নিয়ে যেতে হবে।
চলুন।
_কিন্তু ওর বাবা মা কেউ তো এখনো আসেনি।
_পেশেন্টের অবস্থা সিরিয়াস তাই লেইট করা যাবেনা।
আম্মু(শাশুড়ী মা)
আমাকে জড়িয়ে ধরে বলেন,ভয় পেও না মা।
আল্লাহ ভরসা।
কল্প আমার হাত ধরে আছে।
নার্স আমাকে নিয়ে যাবার সময় কল্প আমার সাথে সাথে যাচ্ছে।
যখনই আমাকে অপারেশন থিয়েটারে ঢোকানো হবে তখন কল্প ডাক্তারকে বলে,
_আমি ভেতরে আসি প্লিজ?
_সরি।আপনাকে বাইরেই থাকতে হবে।
_ডাক্তার,আমার আমার ওয়াইফকে চাই প্লিজ!যে কোন কিছুর বিনিময়ে।
প্লিজ।
কল্প আমার হাত ছাড়েনা,
ডাক্তার বলেন,
ওকে ভেতরে আসতে দিন প্লিজ।
আমাদের হাত দুটো একটু একটু করে ছুটতে থাকে,
আমি কল্পের চোখের দিকে তাকিয়ে বলি,
“ভুলোনা আমায়”
চলবে?
#শেষের লাইন গুলো লিখার সময় খেয়াল করলাম চোখ ভিজে গেছে আমার।লিখার ভেতর এতটাই ডুবে গিয়েছিলাম আমি।
এরপরের পর্বে কি চান আপনারা?
মতামত জানাতে পারেন।ধন্যবাদ।