#খোলা_জানালার_দক্ষিণে
#পর্ব_০৬
#লেখিকা_Fabiha_bushra_nimu
সোনালী আলোয় চারদিক মনোমুগ্ধকর করে হয়ে উঠেছে। মেয়েকে পেয়ে রাইমা বেগমের খুশির শেষ নেই। ধরণীর সমস্ত আনন্দ রাইমা বেগমের মুখশ্রীতে রাজত্ব করছে। মায়ের ভালোবাসা পেয়ে মেহেভীনের বুকটা শীতল হয়ে গেল। বাবার ভয়ে ভেতরটা কাবু হয়ে আছে। এখনো বাবার সাথে কথা হয়নি। মেহেভীন কথা বলতে চাইলে দূরে সরে গিয়েছে। মেহেভীন অপরাধীর ন্যায় বাবার দিকে তাকিয়ে আছে। মেহেভীনের বাবা বাজারের ব্যাগ হাতে নিয়ে বাজারে চলে গেল। মেহেভীন মায়ের দিকে তাকিয়ে মলিন কণ্ঠে বলল,
–আম্মু আব্বু আমার সাথে কথা বলবে না।
–সাময়িক ভাবে রেগে আছে। তোর বাবার হাটের দিন ছাড়া বাজারে যায় না। দেখলি না তোকে দেখে বাজার গেল। নিশ্চই তোর পছন্দের সব খাবার নিয়ে আসবে।
–আমার খাবার চাই না আম্মু। আমার আব্বুর ভালোবাসা চাই।
–তুই শুধু খাবার নিয়ে আসতে যেতে দেখলি। বাবার ভালোবাসি আর দায়িত্ব দেখলি না। এতগুলো দিন আমাদের ছেড়ে দূরে ছিলি। ক’জন তোকে দায়িত্ব নিয়ে খাইয়েছে? তুই চিন্তা করিস না। আমি তোর বাবাকে সবকিছু বুঝিয়ে বলব। সারারাত জার্নি করে এসেছিস। এবার একটু ঘুমিয়ে নিবি চল।
–প্রাপ্তি আপুর কাছে থেকে একটু ঘুরে আসি।
–সে তো বাসায় নেই। তাকে গিয়ে বাসায় পাবি না। তাহলে কার কাছে যেতে চাইছিস।
–মানে?
–কেনো তোর প্রাণ প্রিয় বোন বলেনি সে বিয়ে করেছে। মায়ের কথায় বিস্ময় নয়নে মায়ের দিকে দৃষ্টিপাত করে আছে মেহেভীন। মানুষ কতটা জঘন্য হলে, দিনের পরে দিন এতগুলো মিথ্যা কথা বলতে পারে। কথা গুলো ভাবতেই ঘৃণায় পুরো শরীর রি রি করছে। তবে ভেতর থেকে অদ্ভুত এক খারাপ লাগা কাজ করছে৷ তার ভালোবাসায় কোনো খাদ ছিল না। বাস্তবতা তাকে শিখিয়ে দিল। চাচাতো বোনরা কখনো আপন বোন হতে পারে না। মেহেভীন গম্ভীর মুখশ্রী করে বলল,
–তা কার সাথে বিয়ে হয়েছে আপুর?
–আয়মানের সাথে বিয়ে হয়েছে। খবর পেয়েছি প্রাপ্তি আর আয়মানের আগে থেকেই প্রেমের সম্পর্ক ছিল। দু’জন দু’জনকে ভিষণ ভালোবাসত। কিন্তু পরিবারের ভয়ে কেউ তা প্রকাশ করতে পারেনি। মূলত আমাদের সন্মান নষ্ট করার জন্যই তারা এসব করেছে। প্রাপ্তির বাবার থেকে তোর দাদা তোর বাবাকে বেশি জমি দিয়েছে। সেজন্য প্রাপ্তির বাবার তোর বাবার ওপরে ভিষণ রাগ। মাঝেমধ্যে মনে হয় এই জমি জামার চক্করে তোর বাবাকে না হারিয়ে ফেলি।
–একদম বাজে কথা বলবে না আম্মু। ভুলে যেও না আম্মু তোমাদের মেয়ে আর আগের মতো বোকা নেই। আমি থাকতে আমার আব্বুর কেউ কোনো ক্ষতি করতে পারবে না।
–আম্মু তুমি আমার সফল হবার গল্প শুনবে না।
–না।
–কেনো?
–কারণ আমি প্রথম থেকেই সবকিছু জানি। তোর একটা বার মনে হলো না। হুট করে একজন মহিলা তোর কাছে এল। তোর পাশে দাঁড়াল। তোর দুঃসময়ে তোকে ভরসা দিল। টাকা-পয়সা দিয়ে সাহায্য করল। এগুলো কি সে এমনি এমনি করেছে। মায়ের কথায় বাকরুদ্ধ হয়ে গেল মেহেভীন। তার মা এসব কিছু জানল কিভাবে! সে তো এসব কথা কারো সাথে গল্প করেনি। মেহেভীনের ছোট্ট হৃদয়ে সন্দেহের দানা বাঁধে। সে মায়ের মুখশ্রীর দিকে তাকিয়ে জবাব দিল,
–এতকিছু তু্মি জানলে কিভাবে?
–প্রাপ্তি তোকে আগে পিছে কখনোই পছন্দ করত না। কিন্তু সেটা বাহিরে প্রকাশ করত না। তোকে পালিয়ে যেতে সে এ-কারণে সাহায্য করেছে। যেন রাস্তার কিছু নরপিশাচ তোকে ছিঁড়ে ছিঁড়ে খায়। আমাদের সন্মান নষ্ট করে সে সুখী হতে চেয়েছিল। কিন্তু আমি যে তোর মা৷ তোকে দশ মাস দশ দিন গর্ভে ধারণ করেছি। তোর বেড়ে ওঠা, কথা বলা, হাঁটা চলা সবকিছু আমার হাত ধরে হয়েছে। সেই মেয়েকে আমি কিভাবে বিপদের মুখে ঠেলে দিতে পারি৷ সেদিন তোর চিঠিটা আমি পেয়েছিলাম। তোর ফোনের লোকেশন ট্র্যাকিং করাই আমি। তুই যেখানে গিয়েছিলি সেখানে আমি আমার বেস্ট ফ্রেন্ড সামিরাকে পাঠাই। তোর যত টাকা পয়সা সব সামিরা দিয়েছে ভেবেছিস। সবকিছু আমি দিয়েছি। তোর নানা আমাকে যে জমিটুকু দিয়েছিল। সেটা বিক্রি করে তোকে টাকা দিয়েছি৷ যেন তুই ভালো থাকিস৷ সামিরার থেকে তোর খোঁজ খবর নিয়েছি। তাই নিশ্চিন্তে থাকতে পেরেছি। তোর বাবাকে ভরসা দিয়েছি। তোর বাসার কাজের মেয়েটাকে দিয়ে রোজ আমার খবর নিতি। সেটাও আমি জানতাম। কিন্তু কখনো বুঝতে দিতাম না৷ আমি শুধু দেখতে চেয়েছিলাম। তুই কবে নিজ থেকে আমার সাথে কথা বলিস। সাফল্যের অর্জনের পরে যদি আমাদের ভুলে যেতি৷ তাহলে ভাবতাম একটা কুসন্তান জন্ম দিয়েছি। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে তোকে জন্ম দিয়ে ভুল করিনি। আমাদের মুখ তুই উজ্জ্বল করেছিস। ভাবিস না তোর টাকা পয়সা খেতে পারব জন্য এসব বলছি৷ বাবা-মা তার সন্তানের সাফল্য চায়। এতেই তাদের সুখ, শান্তি, তৃপ্তি। তোর টাকার আমার দরকার নেই মা। আমাদের যা আছে তা দিয়ে জীবন চলে যাবে। তুই আমাকে জিনিস কিনে খাওয়ার জন্য যে টাকা গুলো পাঠাতি। আমি সেগুলো জমিয়ে রাখতাম। তোর বাবার হাতের সমস্যা হলে সেগুলো দিতাম। তোর বাবাকে আজ-ও জানাতে পারিনি। তবে জানানোর সময় এসে গিয়েছে। এভাবেই জীবনে এগিয়ে যা আর সমাজের কিছু কটু লোকের মুখ বন্ধ করে দে। এখানেই আমার প্রাপ্তি। আমি জানতাম আমার মেয়েটা বড্ড বোকা আর সরল। সেজন্য আড়াল থেকে পাশে থেকেছি। তুই যেন শক্ত হয়ে আমাদের সামনে দাঁড়াতে পারিস। লক্ষ্য অর্জনের পথে আপন মানুষের দেখা পেলে মানুষ শক্তিহীন হয়ে যায়। দুর্বল হয়ে পড়ে আমি তোকে দুর্বল করতে চাইনি। মায়ের কথায় বাকরুদ্ধ হয়ে গেল মেহেভীন। কণ্ঠনালি দিয়ে এক বাক্য উচ্চারিত হচ্ছে না৷ সে আসলেই বোকা ভিষণ বোকা। স্বার্থের পৃথিবীতে কেউ এক পা লড়ে না। সেখানে একটা অচেনা মহিলা তাকে সাহায্য করল৷ সেটা সে বিশ্বাস করল। এর পেছনে মা নামক যোদ্ধার এতবড় অবদান রয়েছে। সেটা সে গুন অক্ষরেও টের পেল না। নিজের মাকে নিয়ে ভিষণ গর্ব হচ্ছে মেহেভীনের।
–সেজন্য সামিরা আন্টি আমার কাছে বেশিদিন থাকেনি। প্রয়োজন মতো থেকে ছিল। তুমি আমার জন্য এতকিছু করেছ। আমাকে জানাওনি কেন আম্মু? আমি আসলেই বোকা। প্রথমে তাকে নারী পাচারকারী ভেবেছিলাম। সব সময় ভয়ে থাকতাম। প্রাপ্তি আপু আমার সাথে এতবড় বিশ্বাসঘাতকতা করল! আমি যে তার কাছে প্রতি মাসে তোমাদের জন্য টাকা পাঠাতাম। সে টাকা গুলো কি তোমাদের দেয়নি?
–তিন মাসের মতো আমাদের টাকা দিয়েছিল। কিসের টাকা বলেনি। রোজ বলতাম তোর সাথে কথা বলিয়ে দিতে। কিন্তু সে আজেবাজে কথা বলত। আমি যে তোর বিষয়ে সবকিছু জানি। এটা কাউকে বুঝতে দিতাম না৷ সবার সাথে অভিনয় করে যেতাম। তুই আমার নিজের মেয়ে। তোকে রেখে নিশ্চয়ই প্রাপ্তিকে বেশি বিশ্বাস করব না।
–মাঝেমধ্যে প্রাপ্তি আপুকে আমার সন্দেহ হতো। কিন্তু কাজের চাপে সেগুলোকে গুরুত্ব দিতাম না। এবার বাসায় এসেছি। প্রাপ্তি আপুকে সামনে বসিয়ে নিয়ে সবকিছু ফায়সালা হবে।
–সে এখন অনেক বড় বাড়ির বউ। তাকে কিছু বলার সাধ্য আমাদের আছে। এসব বিষয়কে ইস্যু করে তোকে হারাতে চাইনা। উপরে একজন আছে। সবকিছু দেখছেন বিচার করে দিবেন। কিন্তু তুই প্রাপ্তির কাছে টাকার হিসাব চাইবি। তোর পরিশ্রমে ফল সৎ মানুষকে খেতে দিস। অসৎ মানুষকে ভোগ করতে দিস না। কথা গুলো বলতে গিয়ে বুকটা ভারি হয়ে আসলে রাইমা বেগমের৷ তিনি আর কোনো কথা বলতে পারলেন না৷ মনের গহীনে বহু ব্যাথা লুকিয়ে আছে। দুঃখ কষ্ট দিয়ে ভেতরটা ভিষণ ভারি হয়ে আছে।
মুনতাসিম নিজের কাজে মনযোগ দিয়ে আছে। তখনই শেহনাজ মুনতাসিমের কক্ষে প্রবেশ করে। শেহনাজের উপস্তিতি টের পেয়ে মুনতাসিম গম্ভীর কণ্ঠে বলল,
–কারো কক্ষে প্রবেশ করার আগে অনুমতি নিতে হয়। এটা কি তুমি জানো না। তোমাকে আবার নতুন করে শিখাতে হবে।
–সেটা অন্য মানুষের কক্ষে প্রবেশ করার আগে অনুমতি নিতে হয়। নিজের ভাইয়ের কক্ষে না। সে তুমি আমাকে আপন বোন ভাবতে না-ই পারো। কিন্তু আমি তোমাকে মনে প্রাণে নিজের ভাই মনে করি।
–আজকাল ভার্সিটিতে একটা ছেলের সাথে তোমাকে বেশি দেখা যাচ্ছে। ছেলেটা কে শেহনাজ?
–ভাইয়া তুমি যেমনটা ভাবছ আসলে তেমনটা না। সে আসলে আমার জাস্ট ফ্রেন্ড।
–শেহনাজ তুমি ভুলে যাচ্ছ তুমি কার সাথে কথা বলছ? আমাকে তোমার বাচ্চা ছেলে মনে হয়। আমাকে দায়িত্বহীন ভাই বা ছেলে মনে করবে না। কে কোথায় যাচ্ছে কে কোন পয়েন্টে চলছে। সেটা আমার থেকে ভালো কেউ জানে না। আমি চুপ করে থাকি তার মানে এই না যে আমি কথা বলতে জানিনা। পরবর্তীতে ঐ ছেলের সাথে তোমাকে দেখলে ছেলের জান যাবেই। সাথে তোমার অবস্থাও আমি খারাপ করে দিব।
–আহির অনেক ভালো ছেলে ভাইয়া। আমি আহিরকে অনেক ভালোবাসি। আহিরকে ছাড়া অন্য কাউকে ভালোবাসা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। মুনতাসিম রক্তিম চোখে শেহনাজের দিকে দৃষ্টিপাত করল। বোনকে সে ভিষণ ভালোবাসে শেহনাজের জায়গায় অন্য কেউ থাকলে, তাকে এখনই ধংস করে ফেলত। শেহনাজ ভীত হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ভাইয়ের সামনে গলা উঁচু করে কথা বলার সাহস নেই। কথায় আছে মানুষ প্রেমে পড়লে তার সাহস দিগুন বেড়ে যায়। শেহনাজ তার জলজ্যান্ত প্রমান। মুনতাসিম চোয়াল শক্ত করে বলল,
–তুমি আমার থেকে মানুষ বেশি চিনো? তুমি যদি একজন সৎ রিকশাওয়ালাকে ভালোবাসতে, তাহলে আমি নিরদ্বিধায় তোমাকে তার হাতে তুলে দিতাম। কিন্তু তুমি এমন একজনকে ভালোবেসেছ। যার হাতে তোমাকে তুলে দেওয়া কখনোই আমার পক্ষে সম্ভব না। মস্তিষ্ক গরম হয়ে যাচ্ছে। আমি রেগে যাবার আগে আমার কক্ষ থেকে বের হয়ে যাও শেহনাজ। ভাইয়ের কথার ওপরে কথা বলার সাহস হয়ে উঠলো না শেহনাজের। সে নিঃশব্দে কক্ষ থেকে বেয় হয়ে গেল। তার ভাই কারন ছাড়া কোনো কথা বলে না। তাহলে কি আহিরের মধ্যে কোনো সমস্যা আছে। কিন্তু আহিরকে যে আমি ভিষণ ভালোবাসি। আমি আহিরকে ছাড়া থাকব কিভাবে। কথা গুলো ভাবতেই শেহনাজের বুকটা ভারি হয়ে আসতে শুরু করল। ভেতরটা হাহাকারে ভরে উঠছে। মনটা ভিষণ করে জ্বলে উঠলো। তবে তাকে সারাজীবনের জন্য আহিরকে হারাতে হবে। কথা গুলো ভাবতেই দম বন্ধ হয়ে আসছে শেহনাজের।
সূর্য বিদায় নিয়েছে। চারিদিকে আঁধার ঘনিয়ে আসছে। দূর থেকে ঝিঁঝি পোকার ডাক কর্ণকুহরে এসে পৌঁছাচ্ছে। চারদিক মৃদু হাওয়া বইছে। শীতল হাওয়া এসে মেহেভীনের শরীর স্পর্শ করে যাচ্ছে। মেহেভীন মায়ের অনুমতি নিয়ে প্রাপ্তির সাথে দেখা করতে যাচ্ছে। দীর্ঘসময় হাঁটার পরে অবশেষে চৌধুরী বাড়িতে এসে পৌঁছালো। রাজপ্রাসাদের মতো দেখতে বাড়িটা। বাড়ির চারপাশে বলিষ্ঠ দেহের কালো পোশাক পড়া লোক ঘিরে রেখেছে। বাড়ির চারপাশে এত গার্ড দেখে মেহেভীনের মুখশ্রী কুঁচকে এল। মেহেভীন পরিচয় দিয়ে চৌধুরী বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করল। প্রাপ্তি সবার জন্য চা নিয়ে আসছিল। হাত কাঁপছে প্রাপ্তির কাজের মেয়েটাকে একটা কাজে বাহিরের পাঠানো হয়েছে। এতগুলো চায়ের কাপ কেউ একসাথে নেয়। এখনই সব পড়ে যাবে। মেহেভীন বিলম্ব করল না। দ্রুত পায়ে প্রাপ্তির দিকে অগ্রসর হলো। মুনতাসিম বাহিরে যাবার জন্য বের হয়েছিল। মেহেভীনকে দেখেই দেওয়ালের আড়ালে লুকিয়ে পড়লো। তার হৃদস্পন্দনের গতিবেগ বেড়ে গিয়েছে। মেহেভীন প্রাপ্তি হাত ধরতেই প্রাপ্তি মেহেভীনের দিকে দৃষ্টিপাত করল। ভয়ে পুরো শরীর অবশ হয়ে আসছে। হাত-পা শীতল হতে শুরু করেছে। প্রাপ্তিকে ভয় পেতে দেখে মেহেভীনের বুকটা প্রশান্তিতে ভরে উঠছে। অজানা আনন্দে অনুভূতিরা মেতে উঠেছে।
চলবে…..
পরের পর্বটি সবার আগে পড়তে পেইজটি ফলো করে সাথে থাকুন👉 গল্পের ভান্ডার
আরো সুন্দর সুন্দর গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন হতে ভুলবেন না👉 লেখক-লেখিকার গল্পের ভান্ডার�