#দোলনচাঁপার_সুবাস
#পর্বঃ২৪
#লেখনীতে- তাসফিয়া হাসান তুরফা
নিশীথ ভার্সিটি এসেছিলো কিছু দরকারি ডকুমেন্টস জমা দিতে। সাধারণত ও ভার্সিটি এলে বন্ধুদের সাথে অনেকক্ষণ আড্ডা দিয়ে বাসায় যায়, আজকেও তার ব্যতিক্রম হলোনা। ভার্সিটির বাইরে ওদের পুরাতন টং এর দোকানে বসে চা খেয়েই ভেতরে হাঁটা দেয় সে।
এদিকে দোলা কিছুক্ষণ হতবিহ্বলের ন্যায় ঠাই দাঁড়িয়ে রয়। কি করবে না করবে চিন্তাভাবনা করতে থাকে৷ অজানা শংকায় মন ভীত হলেও মস্তিষ্ক সাহস জোগায়। এ মুহুর্তে ভয় পেলে চলবেনা, বরং ঠান্ডা মাথায় বুদ্ধি করে এ থেকে পরিত্রাণ পেতে হবে! আপাতত রাকিবের নজর থেকে বাঁচতে দোলা টং এর পেছনে একটা বড় পুরাতন বটগাছের নিচে আশ্রয় নেয়। নিজে যেতেও ভয় পাচ্ছে আবার নিশীথকে কিভাবে ডাকবে ভেবে পাচ্ছেনা। এর মাঝেই ওর হঠাৎ মনে পড়লো, মামাবাড়ির মাঝরাতে নিশীথ এর কল দেওয়ার কথা! প্রায় সাথে সাথেই দোলা কল হিস্ট্রি ঘেটে ওর নাম্বার বের করে। পরিচিত ছাড়া খুব বেশি মানুষের সাথে কথা না বলায় নিশীথের নাম্বার খুজে পেতে অতটা বেগ পেতে হয়না ওর! প্রথম প্রথম ওকে কল দিতে খানিকটা লজ্জা ও অস্বস্তি বোধ হলেও পরক্ষণে দোলা নিজের মনকে আশ্বাস দেয়। সে তো বিপদে পড়েই ফোন করছে, টাইমপাস করতে তো আর নয়! অতঃপর এক প্রকার শ্বাসবন্ধ করেই সে নিশীথ এর নাম্বারে ডায়াল করে।
ভার্সিটির করিডরে হাটতে হাটতে ফোনের শব্দে নিশীথ পকেট হাতরায়। মাত্রই এক কল কেটে ফোন রাখলো, আবার কে ফোন দিলো? বিরক্ত হয়ে ফোন বের করতেই ছেলেটা মস্ত বড় এক চমক পায়! ফোনের স্ক্রিনে জ্বলজ্বল করতে থাকা প্রিয়তমার নামটা দেখে মুহুর্তেই যেন হার্টবিট মিস করে সে! একপ্রকার ঘোরের মধ্যেই কল রিসিভ করে বরাবরের ন্যায় শুধায়,
—দোলনচাঁপা?
বহুদিন পর এই ডাক শুনে দোলা খানিকটা থমকে যায়। শব্দগুলো কণ্ঠনালিতে দলা পেকে যায় যেন। হুহু করে কান্না
—কি হয়েছে, দোলনচাঁপা? তুমি কাদছো কেন?
—আ,আমার সাহায্য করুন, নিশীথ ভাই। আমি খুব বিপদে আছি..
—মানে? কিসের বিপদ?
খানিকটা থেমে আবার শুধালো,
—তোমার ওই মামাতো ভাই কিছু করেছে নাকি? কোথায় আছো তুমি?
দোলা চমকে উঠে নিশীথের চতুরতায়! এই ছেলেটা সবসময় ওর বলার আগেই সবকিছু বুঝে যায় কিভাবে? আর সে মামাতো ভাইয়ের কথাই বা কি করে জানে? তবে সে আর কিছু ভাবতে পারলোনা। এখন এসব বলার সময় নয়। তাই প্রসঙ্গ বদলে বললো,
—আমি আপনার ভার্সিটির পাশেই আছি। ওইযে যে টং এ আপনি চা খাচ্ছিলেন একটু আগে ওর পেছনে যে বটগাছ…
—হোয়াট? ওখানে কি করছো? আমি তো এখানে একটা জরুরী কাজে এসেছি…উম, আচ্ছা ওখানেই দাড়াও। আমি আসছি দু মিনিটে?
দোলা সায় জানিয়ে ফোন কেটে দেয়। ওর বুকের ভেতর এখনো ঢিপঢিপ করছে। ও যেখানে দাড়িয়ে আছে সে জায়গায় লক্ষণীয় মানুষ না থাকলেও টং এর ওখানে বহু পুরুষের ভীড়। ফলে মাথার ওড়না আরেকটু টেনে নিয়ে চুপচাপ নিশীথের জন্য অপেক্ষা করতে লাগলো সে। ভয়ে উত্তেজনায় ওর নিঃশ্বাস ক্রমশ ভারী হয়ে যাচ্ছে। তবু নিজের উপর সে খুশি, যে সাহস করে নিশীথকে কল দিয়ে জানাতে পেরেছে! এবার নিশীথের আসার অপেক্ষা।
নিশীথ পড়লো মহা ফ্যাসাদে। কিন্তু ক্যাম্পাসের চেনামুখ হওয়ার সুবিধাটা কাজে লাগিয়ে ক্লাসমেটকে দিয়ে ওর ডকুমেন্টস স্যারের কাছে পাঠানো ম্যানেজ করে নিলো। একিসাথে স্যারকে মেইল করে জানাতেও ভুললোনা। এসবের মাঝেই মিনিট পাঁচেক অতিক্রম হলো। যতদ্রুত সম্ভব ভার্সিটির গেটের বাইরে বেরিয়ে ও আশেপাশে তাকিয়ে দোলাকে খুজতে লাগলো। টং এর দোকান পেরিয়ে বটগাছের দিক এগোতেই মেয়েটাকে দেখতে পায় নিশীথ। জীর্ণশীর্ণ ভাবে দাঁড়িয়ে আছে গাছের পেছনে। ওর চোখেমুখে স্পষ্ট ভয়ের ছাপ। এদিক-ওদিক চাইছে একটু পরপর। নিশীথ তাড়াতাড়ি এগিয়ে যায়।
দোলা একটা বাইকের আওয়াজ শুনে পেছনে তাকিয়ে দেখার চেষ্টা করছিলো কোনোভাবে রাকিব আসছে কিনা, এমন সময় নিশীথ আলতো করে ওর বাহুতে হাত রাখতেই দোলা প্রচন্ড ভয়ে পাশ ফিরে ছোটখাটো চিৎকার দেয়। নিশীথ তৎক্ষণাত এগিয়ে এসে ওর মুখে হাত দিয়ে থামায়। অবশেষে ওকে দেখে দোলা যেন প্রাণ ফিরে পায়। এতক্ষণের চেপে রাখা ভয় হাওয়ায় মিলিয়ে যায়! যেন অকূল পাথারের মাঝে কেউ হঠাৎ ভরসার একখানা সম্বল খুজে পায়, ঠিক সেভাবেই পরিস্থিতির বশীভূত হয়ে আকড়ে ধরে নিশীথকে। ওর শক্ত-চওড়া প্রশস্ত বুকে নিজের আশ্রয় খুজে নেয়।
নিশীথ থমকে যায়, বেশ খানিকটা অবাক হয়। যে মেয়ে ওর কাছে আসতেও ভয় পেতো সেই মেয়ে কিনা আজ নিজে থেকে ওকে ফোন করে ডাকছে। আবার নিজ থেকে জড়িয়েও ধরছে? অন্যদিন হলে খুশিতে আটখানা হয়ে যেতো সে বোধহয়। তবে আজ নিশীথের মন প্রসন্ন হয়না। ঘটনার ব্যাপ্তি যে একেবারেই ছোট নয়, এ ব্যাপারে ও নিশ্চিত পুরোপুরি। এবার নিশীথের সন্দেহ তীব্র হয়। একদিকে দোলার গা কাপছে মৃদু। নিশীথ বুঝলো মেয়েটা খুব ভয় পাচ্ছে কোনো কারণে। তাই, ও আস্তে করে ওর পিঠে হাত রাখতেই আচমক দোলার সম্ভ্রম ফিরে আসে! মুহুর্তের ব্যবধানে এক ঝটকায় কয়েক হাত দূরে সরে আসে নিশীথের থেকে! একিসাথে, সে এইমাত্র কি করলো ভাবতেই লজ্জায় কান দিয়ে ধোয়া বের হবার উপক্রম প্রায়! ভয়ের চোটে বিবেকবুদ্ধি লোপ পাওয়ায় নিজের উপর ক্রুদ্ধ সে তোতলানো সুরে বলতে শুরু করে,
—আ,আমি ই,ইচ্ছা করে আপনা..
—থামো!
নিশীথ বিরক্তিকর স্বরে ধমক দেয়।
—আমি কি তোমার কাছে একবারো এক্সপেন্যাশন চেয়েছি? এসব বাদ দিয়ে আসল কথা বলো। তোমায় এরকম দেখাচ্ছে কেন? হোয়াট হ্যাপেন্ড? কে কি করেছে?
খানিক থেমে আবারো বললো,
—বাট ডোন্ট টেল মি তোমার ওই মামাতো ভাই..নাম কি যেন ওর? হ্যাঁ, রাকিব রাইট? যদি ও কিছু করে থাকে, দোলনচাঁপা তবে…
—আপনি এসব কীভাবে জানলেন?
দোলা আশ্চর্যের সপ্তম আকাশে পৌঁছে শুধায়! নিশীথ তো দেখছে সবই জানে। কিন্তু কিভাবে? ঘটনা মাথায় ঢুকেনা ওর। নিশীথ রাশভারি আওয়াজে বলে,
—আমার জানার কথা বাদ দেও। আগে বলো তোমার সাহস কিভাবে হলো ওকে বিয়ের জন্য হ্যাঁ বলার? আমি প্রস্তাব দিলে তোমার উত্তর দিতে বিশদিন লাগে অথচ ওই বা’স্টা’র্ড এর সাথে বিয়েতে রাজি হতে দুদিনও লাগলোনা?
—ছি! গালি দিচ্ছেন কেন? আমি ওর সাথে বিয়েতে রাজি হইনি। আপনি পুরো ঘটনা জানেন না!
—গালি দিবোনা তো কি চুমু খাবো?
নিশীথ বিরক্তি সহিত শুধায়। পরক্ষণে স্বাভাবিকভাবে বলে,
—চুমু খেলে তোমাকে খাবো। তার আগে ওকে দেখতে হবে। শা’লার বুকের পাটা আছে বলতে হবে। ওর সাহস হয় কিভাবে তোমাকে বিয়ে করতে চাওয়ার? কোথায় ও?
দোলা বিরক্তিতে চোখমুখ কুচকে ফেলে। এজন্যই নিশীথকে কোনোকিছু বলতে চেয়েছিলোনা সে৷ কিন্তু পরিস্থিতি ওকে এমন অবস্থায় নিয়ে এসেছে যে ও আজ নিশীথের সাহায্য নিতে বাধ্য হলো। তাই আর উপায় দেখলোনা ওকে সবটা খুলে বলা ছাড়া। এজন্য একটা বড় করে শ্বাস নিয়ে যতটুকু বিষয়ে বলা সম্ভব, দ্রুত নিশীথকে শর্টকাটে বুঝিয়ে দিলো। ওর কথার তালে তালে নিশীথের চোয়াল ক্রমশ শক্ত হতে লাগলো। তা লক্ষ্য করে দোলা মিনতি করে বললো,
—আমায় ভুল বুঝবেন না। আমার আপনার বা রাকিব কারও প্রতিই কোনো অনুভুতি নেই। আজ যদি একান্তই নিরুপায় না হতাম, তবে আপনার থেকেও সাহায্য চাইতাম না। যদিও আমি আপনাকে কোনো জবাব দিইনি তবু আমি এতটুকু জানি, আপনি নিশ্চয়ই আমায় ফিরাবেন না! এখন আমায় যতদ্রুত সম্ভব বাসায় পৌছে দিন প্লিজ! রাকিব দেখলে ঝামেলা হবে!
—কিভাবে ঝামেলা করবে আমিও দেখতে চাই। আসতে দাও ওকে। আমিও আজ ওর সাথে দেখা না করে বাড়ি ফিরছিনা!
—ম,মানে? কেন? কি করবেন আপনি?
নিশীথ নিশ্চল ভাবে দোলার দিক তাকায়। অত্যন্ত শীতল অথচ স্বাভাবিক কণ্ঠে স্বীকারোক্তি জানায়,
—মে’রে ফেলবো ওকে। আই স্যয়ার!
ওর শান্ত গলার হুশিয়ারিতে দোলার পিলে চমকায়! নিশীথকে দেখে মোটেও মনে হচ্ছেনা ও মজা করছেনা বা মজা করার মুডে আছে। বরঞ্চ একটা মানুষ এত স্বাভাবিকভাবে কিভাবে কাউকে মেরে ফে’লার কথা বলতে পারে তাতেই দোলা অবাক হয়। মনে মনে রাকিবের ব্যাপারে নিশীথকে জানানোর জন্য খানিকটা অনুতপ্ত হয়। এরই মাঝে হাতে টান লাগায় ওর কদম নিজ থেকেই চলতে আরম্ভ করলে দোলার বোধ হয় নিশীথ ওর হাত ধরে হেটে নিয়ে যাচ্ছে মেইনরোডে। দোলা অপরহাতে মাথার ওড়না আরেকটু চেপে মুখ ঢাকার চেষ্টা করতেই নিশীথ রামধমক দেয়,
—কি সমস্যা? রাস্তা পার হচ্ছি এ সময় এত নড়াচড়া করছো কেন?
ভীত দোলা তড়িৎ গতিতে ওড়না থেকে হাত সরায়। নড়াচড়া বাদ দিয়ে স্বাভাবিকভাবে রাস্তা পার হয় দুজনে। দোলা ভাবছিলো নিশীথ এবার ওকে বাড়ি নিয়ে যাবে, ঠিক সে সময় নিশীথ ওর হাত ছেড়ে দেয়। বিস্মিত দোলা ওর পানে চাইতেই বলে,
—তুমি একটু দাড়াও। আমার বাইক নিয়ে আসছি। সামনেই পার্কিং এ রাখা আছে।
মেয়েটার মাথায় যেন বাজ পড়লো। যে কারণে নিশীথকে আশ্রয় করে এখানে আনলো সে-ই কিনা ওকে একা রেখে চলে যাচ্ছে? তবে ওর লাভটা কি হলো ওকে ডাকার? দোলা মিনতি করলো,
—আমায় রেখে যেয়েন না প্লিজ। আমার ভয় করছে! আমিও যাই সাথে।
—দেখো, এভাবে ওর ভয়ে কতক্ষণ বসে থাকবে? তোমার কি মনে হয় রাকিব এতক্ষণে তোমার জন্য বসে আছে? তুমি অকারণেই ভয় পাচ্ছো। কে জানে তোমায় না পেয়ে বাসায় চলে গিয়েছে হয়তো!
দোলার তবু বিশ্বাস হলোনা। বারকয়েক আরও মিনতি করার পরও নিশীথ শুনলোনা, ওকে একা রেখে চলে গেলো রিকশা আনার জন্য। মনে মনে আহত দোলা স্তব্ধ হয়ে চেয়ে রইলো শুধু। মিনিট পাঁচেক অতিক্রম হলো। এর মাঝে একটি বাইক এসে থামলো। নিশীথের আশায় দোলা সামনে তাকাতেই ওর দুঃস্বপ্ন সত্যি হলো। রাকিব এসেছে অবশেষে! বাইকের শব্দ তুলে সে ঠাট্টার স্বরে বললো,
—এতক্ষণ কোথায় ছিলে সুন্দরী? কতবার চক্কর দিলাম রাস্তায় ধারণা আছে?
ওর কথায় দোলার ভয় পাওয়ার কথা থাকলেও আচমকা দেখা গেলো ওর চোখমুখ উজ্জ্বল হয়ে এলো। ঠোঁটে ভর করলো অদ্ভুত হাসির রেখা। যা দেখে রাকিব মুহুর্তের জন্য অবাক হয়! দোলার তো ভয় পাওয়া উচিত ছিলো, কিন্তু সে হাসছে কেন?
#চলবে
রিচেক দেওয়া হয়নি। অসংগতি পেলে জানাবেন।