#দোলনচাঁপার_সুবাস
#পর্বঃ২৬
#লেখনীতে- তাসফিয়া হাসান তুরফা
পারভীন বেগম রাগী মুখে দোলার দিক চেয়ে আছেন। দোলা বাড়িতে আসার সাথে সাথেই ওকে ঘিরে বসেছেন সবাই। দোলাও সময় নষ্ট না করে রাকিবের নোংরা মতলবগুলোর ব্যাপারে দিয়েছে। ব্যস! তখন থেকেই পারভীন বেগম ফুসছেন। তবে তার রাগ রাকিবের পাশাপাশি দোলার উপরও হচ্ছে!
তার মেয়ের দোষ একটাই – সে কেন মামির কথায় রাজি হয়ে রাকিবের সাথে দেখা করতে গেছে! কেন মামিকে মুখের উপর না করতে পারেনি?
মায়ের মন নরম হলেও সন্তানের বিপদের সময় সেই মা-ই ইস্পাতের ন্যায় কঠিন হয়ে রক্ষা করেন তাদের। কিন্তু আজ তার ফুলের মতোন মেয়ের এত বড় বিপদ ঘটবার আশংকা ছিলো সে ব্যাপারে কিনা পারভীন বেগম কিছু জানতেনও না? দোলা কোন আক্কেলে শুধু শিমুলকে বলে চলে গেছেন তার মাথায় আসছেনা। যুগ-জামানা যে হারে খারাপ হয়ে গেছে, আজ যদি ওর বড়সড় কোনো বিপদ হতো, তবে? একিসাথে রেস্টুরেন্টের বাহিরে রাকিব কি করার চেষ্টা করেছিলো তা শুনেই রাগে গা কাপছে পারভীন বেগমের। উনার মন চাইছে এখনি গিয়ে ওই কুকুরটাকে জা’নে মেরে আসতে। বারবার মাথায় আসছে, যদি দোলা সঠিক সময়ে পালাতে না পারতো তবে কি হতো? মনের ভাবনাগুলো না দমিয়েই তিনি মেয়ের উদ্দেশ্যে কড়া গলায় বললেন,
—দেখেছিস নিজের ভালোমানুষির ফলাফল? আর যাবি কখনো রাকিবের সাথে দেখা করতে?
—আমি কখনোই যেতাম না, মা। যদি মামি আমাকে ব্ল্যাকমেইল না করতো, এটা তো সত্যি যে আমাদের জীবনে উনাদের উপকার অস্বীকার করার উপায় নেই, তাই তিনি যখন আমাকে অকৃতজ্ঞ বললেন তখন…
—তখন তুই আর কিছু না ভেবে রাজি হয়ে গেলি তাইতো? দোলন, আমি তোকে সবসময় নিজের আগে অন্যের ভালো করতে শিখিয়েছি, ভালো মানুষ হতে শিখিয়েছি। কিন্তু তার মানে এই নয় তুই অন্যের কথা শুনে নিজেকে বিপদের মুখে ঠেলে দিবি। এটা কিন্তু কোনো বোকামি ছাড়া আর কিছুই নয়! আল্লাহ রহম করেছেন বলে তুই আমার সামনে দাঁড়িয়ে আছিস নয়তো আজ যদি কিছু হয়ে যেতো?
দোলা নিজের ভুল বুঝলো। মায়ের কথার তাৎপর্য বুঝে ওর যাওয়াটা একদমই উচিত হয়নি উপলব্ধি করলো আরও একবার।
—সরি, মা। এমন ভুল আর কখনো করবোনা। আসলেই আমি তখন শুধু তোমার কথা ভেবে ওখানে গিয়েছি, না গেলে মামি তোমায় কথা শুনাতো এজন্য। তবে, এখন থেকে আমি আর এসব ভাববোনা। কে কি বলবে বা বললো তা না দেখে, নিজের কথাও চিন্তা করবো।
দোলার কথায় পারভীন বেগম প্রসন্নচিত্তে মাথা নাড়লেন। এদিকে কামিনি বললো,
—মামির তো স্বভাবটাই এমন। সবসময় নিজেদের সুপিরিয়র ভাবে আর আমাদের নিচু করার ধান্দায় থাকে। মা, আমার কথা শুনো আর মামিকে সবটা সত্যি বলে দাও। যার মুখে এত বড় বড় কথা, তাকে নিজের ছেলের সত্যিটা জানালে আর মুখ খোলার মতো অবস্থায় থাকবেনা!
পারভীন বেগম চুপ করে রইলেন কামিনির কথায়। তার চেহারা দেখে মনে হলো উনি কিছু ভাবছেন। কামিনি রুম থেকে চলে যেতেই উনি দোলার উদ্দেশ্যে বললেন,
—যে ছেলেটা তোর সাহায্য করেছে, তোকে বাড়িতে পৌঁছে দিয়েছে ওর নাম কি যেন বললি?
—নিশীথ।
দোলা জবাব দেয়। পারভীন বেগম শুধালেন,
—এখানে কোথায় থাকে ওরা? আর তুই ওকে চিনলি কিভাবে?
মায়ের এসব প্রশ্নে দোলা কিঞ্চিৎ ইতস্ততবোধ করে। হঠাৎ কেন এসব জিজ্ঞেস করছেন উনি? তবু সে জবাব দেয়,
—ওইতো তালুকদার বাড়ি চিনোনা? শিমুল যেখানে খেলতে যেতো। ওই বাড়ির ছেলে। শ,শিমুলকে আনতে গিয়েই দেখা হয়েছিলো, তখন থেকে চিনি।
শেষের দিকে দোলার কি হলো ও জানেনা। হুট করেই মায়ের কাছে মিথ্যা কথা বললো। কেন যেন নিশীথকে সে আগে থেকেই চিনে, এটা মা-কে জানাতে মন চাইলোনা ওর। নিজের কাণ্ডে নিজেই অবাক সে যখন নিজ ভাবনায় মত্ত তখন পারভীন বেগম সন্দিহানভাবে বললেন,
—বাহ! একদিনের পরিচয়ে তোকে মনেও রেখেছে আবার সাহায্য করলো? ভালোই তো!
মেয়েটা জোরপূর্বক হাসার চেষ্টা করলো মায়ের কথায়। নিশীথের ব্যাপারে আর বেশিকিছু বলতে মন চাইছেনা মায়ের সাথে। ও কেটে পড়ার উদ্দেশ্যে বলে,
—আমি তাহলে যাই। ফ্রেশ হই!
পারভীন বেগম আটকালেন না। দোলাও তাড়াতাড়ি রুম ছেড়ে বেরিয়ে এলো। রুমে এসে দরজা লাগিয়ে দিয়ে ধপ করে বিছানায় বসে পড়লো। মা-কে নিশীথের কথা বলার সময় এত লজ্জা লাগছিলো কেন ওর? এমন উদ্ভট আচরণ করছে কেন সে? নিজের মনকে নিজেই প্রশ্ন করে দোলা। তবু জবাব আসেনা কোনো। নিশীথের চিন্তা মাথা থেকে ঝেড়ে কাপড় নিয়ে ও বাথরুমে ঢুকবে এর আগেই টুং করে বার্তা আসে ফোনে। আননোওন নাম্বার হলেও দোলা ধারণা করতে পারে এটা কে!
খুলে দেখে ভেতরে লেখা,
“ফ্রেশ হয়ে হাতে মলম লাগিয়েছো?”
অতি সামান্য বার্তা, যাতে লেগেছিলো একটুকরো যত্ন। দোলার মন গলে যায়। নিজের অজান্তেই ঠোঁটের কোণে ফুটে উঠে সূক্ষ্ম হাসির রেখা। কিন্তু নিশীথের বার্তার বিপরীতে সে জবাব দেয়না কোন। বরং, ফোন হাত থেকে রেখে দ্রুত ফ্রেশ হয়ে জামা পালটে এসে বামহাতে মলম লাগাতে শুরু করে!
__________________
নিশীথ বাড়ি ফিরে রাত ৮টায়। আসমা বেগম ওকে দেখেই উঠে দাড়ালেন। যেন এতক্ষণ বসে অপেক্ষা করছিলেন ছেলের জন্য সেভাবেই শুধান,
—আজকে তাড়াতাড়ি ফিরলি যে, বাবা? শরীর খারাপ লাগছে?
নিশীথ জুতো খুলতে খুলতে জবাব দেয়,
—ভালো লাগছিলোনা আজ বাইরে। তাই জলদি চলে এলাম।
ও সোফায় বসতেই আসমা বেগম পানি এগিয়ে দেন। পানি খেতে খেতে নিশীথ প্রশ্ন করে,
—দাদু কই, মা? কোনো সাড়াশব্দ নেই যে?
—আজকে তোর দাদুর চেকাপ ছিল ভুলে গেছিস?তোর বাবা এসে নিয়ে গেলেন সন্ধ্যায়৷
নিশীথ কপাল চাপড়ায়। সে-ও যেতে চেয়েছিলো দাদুর সাথে ডাক্তারের কাছে। বরং পরশুদিন দাদু ঠিকমতো ওষুধ খাচ্ছিলেন না দেখে উনাকে কথাও দিয়েছিলো যে, এবার সে নিজে নিয়ে যাবে উনাকে চেকাপ করাতে। কিন্তু আজ সকাল থেকে ভার্সিটি তারপর দোলনচাঁপার সাথে দেখা, রাকিবের ঝামেলা সব মিলিয়ে সময় কোনদিক দিয়ে চলে গেছে ও টেরই পায়নি! নিশীথ মনে মনে অনুতপ্ত হয়। দাদুর নাম্বারে ফোন করলে উনার বাটন ফোন উচ্চশব্দে বেজে উঠে তার রুম থেকে। আসমা বেগম জানান,
—আব্বা তো বাসায় ফোন রেখে গেছে। তার খোজ নিবি? তোর বাবাকে ফোন দে না হয়!
বাবাকে ফোন দেওয়ার কথা শুনে নিশীথ এর চোখমুখ শক্ত হয়। সে গম্ভীর গলায় বলে,
—দরকার নেই কাউকে ফোন দেওয়ার। দাদু এলেই সবটা শুনা যাবে!
ছেলের কথায় আসমা বেগম মনে মনে আহত হলেন। এই বাপ-ছেলের মাঝে অদৃশ্য এক দেয়াল রয়েছে যেন, যেটা তিনি যতই ভাঙার চেষ্টা করেন না কেন তা হয়ে উঠেনা। অবশ্য হবেই বা কিভাবে? যেখানে দুটো ব্যক্তি নিজ থেকে যদি নিজেদের মধ্যেকার দ্বন্দ মেটাতে না চায় তবে অন্যজনের পক্ষে কি তা সম্ভব? অবশ্যই নয়। তাই, আসমা বেগমের মুখ ছোট হয়ে এলো। সেভাবেই বললেন,
—এত কঠোর হতে হয়না, নিশীথ। তোকে কি আমি এই শিক্ষা দিয়েছি বাপ?
—তোমার শিক্ষার জন্যই আমি তার সাথে এখনো কথা বলি, মা। নয়তো…
নিশীথ আর কথা বাড়ায় না। হনহন করে নিজের রুমে চলে যায়। আসমা বেগম সেদিকে চেয়ে থাকেন ও মনে মনে দোয়া করেন বাবা-ছেলের মধ্যেকার এ দ্বিধা-দ্বন্দের দেয়াল যেন একসময় ভেঙে যায়। সে সময়টা যেন খুব দ্রুতই আসে!
এসব ভেবে নিজের রুমে চলে যেতে যেতে তিনি নিশীথের রুম থেকে কথা বলার আওয়াজ পেলেন। শুনে মনে হলো যেন সে ফোনে কারও সাথে কথা বলছে। মনের সন্দেহ দূর করতে আসমা বেগম ছেলের রুমের দরজায় কান পাতলেন।
নিশীথ বলছে,
—আপনার সাথে কথা বলার জন্য ফোন দিইনি। দাদুর সাথে জরুরি কথা ছিলো, তাকে দেন।
—হ্যালো দাদু, ডাক্তার দেখিয়েছো? কি বললো? ওহ, আচ্ছা বাসায় এসো সব শুনছি। তোমার ছেলেকে বলো, ওষুধগুলো যেন সব আজকেই কিনে। আর তোমার ওষুধের পাশাপাশি নিজের ওষুধগুলোও যেন একবারে কিনে নেয়।
খানিকটা থেমে বলে, “এ কথাটা আমি বলেছি সেটা বলবেনা। তুমি নিজের মতো মনে করিয়ে দিও”
নিশীথ ফোন কাটতেই আসমা বেগম জলদি সরে আসেন দরজার পেছন থেকে। মুখে যতই নিশীথ বাবার সাথে রাগ করে থাকুক, মনে মনে তার জন্য চিন্তা সে ঠিকি করে। মুখে হাসি, চোখে জল নিয়ে আসমা বেগম ছেলের জন্য খাবার রেডি করতে চলে যান। তার মনের একটু আগে চলতে থাকা চিন্তার ঝড় কিছুটা কমেছে বটে!
__________________
রাতে খাবার টেবিলে বসে রোজকার ন্যায় খাচ্ছিলো সবাই। অবশ্য সবাই বললে ভুল হবে। দোলা ও পারভীন বেগম টেবিলে বসে খাচ্ছিলেন। শিমুল, কামিনি খাবার নিয়েই টিভির সামনে বসে গেছে। এ সময় ওদের প্রিয় রিয়েলিটি শো হয়, ওটা দেখা মিস করা যাবেনা কোনোভাবেই! দোলা ও পারভীন বেগম চুপচাপ খাচ্ছিলেন এতক্ষণ। পারভীন বেগমের খাওয়া শেষ। উঠে যাবেন যাবেন ভাব। দোলাও প্লেট হতে শেষ নলা মুখে নিচ্ছিলো এমন মুহুর্তে আচমকা উনি বললেন,
—দোলন, বলছিলাম যে নিশীথকে একদিন বাসায় দাওয়াত দিস তো। আমার মেয়ের এতবড় উপকার করলো যে, ছেলেটার সাথে সরাসরি কথা বলে ধন্যবাদ না দিলে ব্যাপারটা কেমন বাজে দেখায়!
মায়ের কথায় দোলা প্রায় বিষম খেতে ধরলো! পারভীন বেগম চোখ পাকিয়ে পানির গ্লাস এগিয়ে দিলেন। পিঠে হাত বুলানোর মাঝেই দোলা চোখ বড় বড় করে তাকালো!
নিশীথকে বাসায় দাওয়াত দিবে? তাও নাকি ও নিজে থেকে? এসব মা কি বলছে!
#চলবে
facebook.com/groups/golpobolistorylink