#প্রিয়াঙ্গন
#পার্ট_১৯
জাওয়াদ জামী জামী
পরদিন সকালে নাস্তার পর তাহমিদ বাসা থেকে বেরিয়ে যায়। শুক্রবার হওয়ায় আজ রায়হান আহমেদ বাসায় আছেন। তিনিও তাহমিদের সাথে যেতে চাইলে, তাহমিদ তাকে সাথে নেয়না। সে কোন বন্ধুর সাথে রাজশাহীর বাহিরে যাবে। ওর ফিরতে বিকেল কিংবা সন্ধ্যা হবে। তাই রায়হান আহমেদকে মানা করে দেয়। তবে তাহমিদ তাকে জানায়, রাতে সে রায়হান আহমেদের সাথে ঘুরতে বের হবে। রায়হান আহমেদও সহাস্যে তাহমিদের সিদ্ধান্ত মেনে নেন।
বেলা এগারোটা নাগাদ কলিংবেলের আওয়াজ শুনে রাজিয়া খালা দরজা খুলে দেন। দরজার বাহিরে দাঁড়ানো মানুষটাকে দেখে তার হাত-পা কাঁপতে থাকে। ততক্ষণে নায়লা আঞ্জুম ও শায়লা হাসান ড্রয়িংরুমে এসেছে। দরজার অপরপাশে দাঁড়ানো মানুষকে দেখে তারা প্রায় দৌড়ে যায় সেখানে। জড়িয়ে ধরে স্বামী-সন্তান নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা হাস্যোজ্জ্বল মহিলাকে।
রাজিয়া খালা পিছিয়ে চলে এসেছেন রান্নাঘরে। তার সর্বশরীর কাঁপছে। কোন কাজ করার শক্তি তার হাতে কিংবা শরীরে নেই। এক পর্যায়ে তিনি মাথা ঘুরে পরে যান। কুহু আর দুইজন মেইডের সাহায্য নিয়ে খালাকে নিয়ে রুমে যায়। তার মাথায় পানি ঢেলে তাকে সুস্থ করে। কিন্তু তিনি সুস্থ হওয়ার পর থেকেই মুখে কুলু পেতে বসে রয়েছেন। কুহু খালার হঠাৎ কি হয়েছে, তা অনেকবার জানতেও চেয়েও কোন উত্তর পায়নি।
অনেকক্ষণ এভাবে খালা স্বাভাবিক হয়ে রান্নাঘরে আসলেন। কিন্তু তার মুখ থমথমে হয়ে আছে।
” কুহুপু, এদিকে এস, আমার কাজিনের সাথে তোমার পরিচয় করিয়ে দিই। এরা হচ্চে আমার কাজিন নাহিয়া আর মিশাল। ওরা সুইজারল্যান্ড থেকে এসেছে। ” রিশা উচ্ছ্বসিত হয়ে কুহুর সাথে ওর কাজিনদের পরিচয় করে দেয়। এবারই ওরা প্রথমবার দেশে এসেছে।
কুহুও ওদের সাথে হাসিমুখে কথা বলে। কুহু লক্ষ্য করল মেয়েটার বয়স পনেরোর আশেপাশে। আর ছেলেটার বয়স সম্ভবত দশ বছর।
এরইমধ্যে রায়হান আহমেদ ড্রয়িংরুমে আসলে, কুহু দেখল ওর চাচা মনমরা হয়ে বসে আছেন। তার মুখে কোন হাসি নেই। তিনি একনজর কুহুর দিকে তাকিয়ে চোখ ফিরিয়ে নিলেন। কোন কিছু বললেননা তার ভাতিজীকে। অথচ ছুটির দিনে তিনি যতবারই ড্রয়িংরুমে আসেন, ততবারই কুহুর সাথে কথা বলেন। আজ তার ব্যতিক্রম দেখে কুহু কপালে চিন্তার ভাঁজ পরেছে। ও বুঝতে পারছেনা খালা আর চাচার কি হয়েছে!
বিকেল পাঁচটা পঁয়ত্রিশ। কুহু রুমে বসে পড়ছে। সৃজন নিশোর সাথে বাগানে খেলছে। সেখানে রিশা, নাহিয়া আর মিশালও আছে।
ড্রয়িংরুমে নায়লা আঞ্জুম, শায়লা হাসান বসে অতিথিদের সাথে গল্প করছিল। সেখানে রায়হান আহমেদ এবং খালেদ হাসানও রয়েছেন। তাদের সামনে হরেকরকমের নাস্তা।
” ভাইয়া, তুমি এসেছ? ভেতরে গিয়ে দেখ আমাদের বাসায় মেহমান এসেছে। ”
কুহু রুম থেকে নিশোর কথা শুনে বুঝতে পারে তাহমিদ এসেছে। রুমের জানালা খোলা থাকায় ওদের সব কথাই শুনতে পাচ্ছে কুহু। এ বই বন্ধ করে জানালার কাছে গিয়ে দাঁড়ায়। বাসায় কে এসেছে, কিংবা আসেনি সেই বিষয়ে ওর বিন্দুমাত্রও মাথাব্যথা নেই।
তাহমিদ নিশোর কথা শুনে ওর দিকে তাকায়। নিশোর পাশে দাঁড়ানো ছেলেমেয়ে দুটোকে চিনতে পারলনা। শরীর ক্লান্ত থাকায় তাহমিদ কোন বাড়ায়না। ঢুকে পরে বাসায়।
কুহু তাহমিদকে ভেতরে আসতে দেখেই রুম থেকে বেরিয়ে রান্নাঘরের দিকে যায়। সে এখন নিশ্চয়ই তার বিখ্যাত ব্ল্যাক টি চাইবে।
” আপা, এই যে তাহমিদ এসে গেছে। দেখ তোমার ছেলে কত বড় হয়ে গেছে। ” ভেতরে ঢুকেই নায়লা আঞ্জুমের কথা শুনে তাহমিদ সামনে তাকায়। সোফায় বসে থাকা মানুষটিকে দেখে ওর মাথায় আ’গু’ন ধরে গেছে। চোখদুটো র’ক্তবর্ণ হয়ে গেছে। কপালের দুইপাশের শিরা দপদপ করছে।
রান্নাঘরে দাঁড়িয়ে মুখে হাত দিয়ে তাহমিদের দিকে তাকিয়ে আছেন রাজিয়া খালা। তার চোখেমুখে ভয়ের ছাপ স্পষ্ট।
” তাহমিদ, কেমন আছ বেটা? কত বড় হয়ে গেছ তুমি! আমাকে চিনতে পেরেছ? ” সোফা ছেড়ে উঠে এসে ভেজা গলায় জিজ্ঞেস করল মিথিলা আরজুমান্দ। সে তাহমিদের গালে হাত রেখেছে।
” ডোন্ট টাচ মি। আপনার সাহস তো কম নয়, আমাকে স্পর্শ করেছেন! আমাকে স্পর্শ করার আপনি কে? হতে পারেন আপনি এই বাড়ির মেয়ে, কিন্তু আপনার সাথে আমার কোন সম্পর্ক নেই। ”
তাহমিদের চিৎকার শুনে দুই পা পিছিয়ে যায় মিথিলা আরজুমান্দ। তার চোখের কোনে পানি চিকচিক করছে।
” তাহমিদ, তুমি এভাবে আপার সাথে কথা বলছ কেন? তুমি কি ভুলে গেছ, সে তোমার মা? একজন সন্তান হয়ে মা’য়ের সাথে এভাবে কথা বলতে তোমার বিবেকে বাঁধছেনা? ছিহ্ তাহমিদ ছিহ্। ” নায়লা আঞ্জুম খেঁকিয়ে উঠল।
” বিবেকবোধ তোমার আছে! কিংবা তোমাদের আছে? যদি থাকত তবে এই মহিলাকে তোমরা বাসায় ঢুকতে দিতেনা। তোমরা আজ প্রমান করে দিলে তোমরা সবাই বিবেকবর্জিত জীব। হতে পারে এই মহিলা তোমাদের বোন। কিন্তু সে কখনোই আমার মা নয়। কোন মা নিজের সুখের জন্য তার নয় বছরের সন্তানকে ফেলে, অন্য কারো হাত ধরে চলে যেতে পারেনা। সে তোমাদের বোন হলেও, কখনো সে আমার মা হয়ে উঠতে পারেনি। ” রাগে তাহমিদ কাঁপছে। ও দিগবিদিক জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছে।
কুহু স্তব্ধ হয়ে গেছে। একি শুনছে ও!
রাজিয়া খালা কাঁদছেন।
” বেটা, তুমি এভাবে বলছ কেন! আমি তোমার মা। তোমাকে দেখার জন্য আমি এতদূর ছুটে এসেছি। তুমি…… ।
মিথিলা আরজুমান্দ কথা শেষ করতে পারলনা। তার আগেই তাহমিদের হুংকারে তাকে থামতে হয়।
” জাস্ট শাট-আপ। আমি আগেই বলেছি, আপনি আমার কেউ নন। আপনি আমাকে দেখতে মোটেও আসেননি। আপনি এসেছেন এখানকার সবাইকে নিজের সুখের সংসার দেখাতে। আমাকে যদি এতই ভালোবাসতেন তবে ফেলে রেখে যেতে পারতেননা। একটাবারও আপনি ভাবেননি, আপনি চলে যাবার পর আমার কি হতে পারে। যে ছেলে একা ঘুমাতে ভয় পেত, অন্ধকারে ভয় পেত, আপনি চলে যাবার পর সেই ছেলের প্রতিটা রাত কেমন কেটেছে, সেটা যদি জানতেন তবে আপনি নিজের মুখ কখনোই তাকে দেখাতেননা। সমাজের চোখে তাকে প্রতিনিয়ত কতটা হেয় হতে হয়েছে, সেটা যদি আপনি জানতেন তবে আজ নিজের অস্তিত্ব জানান দিতে আসতেননা। আজ এত বছর পর হঠাৎ করে ভালোবাসা দেখাতে হাজির হয়েছেন কেন? কেন নিজেকে মা বলে দাবী করছেন? আমার মা এই যে রাজিয়া খালা। যিনি আমাকে আগলে রেখেছেন আজ অব্দি। ”
তাহমিদ রাজিয়া খালাকে টেনে মিথিলা আরজুমান্দের সামনে নিয়ে আসল। ও কাউকে বলতে না দিয়ে নিজেই বলে চলেছে।
” জানেনতো, আপনি যাবার পর বাবা আমাকে পর করে দিয়েছে। সে আমাকে ঘৃ’ণা করতে শুরু করে। এরপর সে আরেকটা বিয়ে করল। সৎমায়ের হাত ধরে আরেকবার নরক দর্শন করলাম আমি। উঠতে বসতে বাবা আর সৎমা মিলে অপমান করতে শুরু করল। যদি দাদু না থাকত আমি বোধহয় শেষ হয়ে যেতাম। সে আমাকে সব কটু কথা থেকে রক্ষা করেছে। আমার যখন আপনাকে সবথেকে বেশি দরকার ছিল, তখন আপনি আমার পাশে ছিলেননা। ক্লাসের সবাই যখন বিভিন্ন অনুষ্ঠানে তাদের মা’কে নিয়ে আসত, তখন আমি দূরে থেকে তাদেরকে দেখতাম। যখন প্রতি পরীক্ষায় টপার হতাম, তখন আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়ার জন্য আপনি ছিলেননা। আপনার অভাবে আমার জীবন এলোমেলো হয়ে গেল। আমি ছন্নছাড়া হয়ে এদিকসেদিক ঘুরতে থাকলাম। এতকিছুর পর আজ আপনি এসেছেন মাতৃত্বের দাবী নিয়ে! শুধু জন্ম দিলেই মা হওয়া যায়না। আপনি জন্ম দিয়েও আমার মা হতে পারেননি, যেমনটা হয়েছে রাজিয়া খালা। আমার পুরোনো ক্ষ’তে আঘাত করতে কেন আবার আসলেন? কেন আসলেন? কেন? কেন? কেন আসলেন? ” তাহমিদ উন্মাদের মত করছে। ও দুই হাত দিয়ে নিজের চুল টানছে। চোখ দিয়ে অনর্গল অশ্রু ঝরছে।
তাহমিদের এরূপ আচরনে সবাই ভয় পেয়ে গেছে। কুহু অসহায় চোখে তাকিয়ে আছে তাহমিদের দিকে। একটা মানুষ কতটা কষ্ট পেলে এরূপ আচরন করতে তা কুহু অনুধাবন করতে পারছে। তাহমিদের কষ্ট দেখে ওর বুকের ভেতর হাহাকার করছে।
রাজিয়া খালা তাহমিদকে শক্ত করে ধরে রেখেছেন। তিনি ওকে শান্ত করার চেষ্টা করছেন।
” ও বাপজান, তুমি ইকটু শান্ত হও। এম্নে কাঁন্দেনা, বাপ। তোমারে এইভাবে দেখবার পারতাছিনা আমি। ও বাপ, তুমি শান্ত হও। ” রাজিয়া খালা তাহমিদের মাথায়, চোখেমুখে হাত বুলিয়ে তাকে শান্ত করার চেষ্টা করছে।
” এরা সবাই খারাপ, খালা। এরা একজোট হয়ে ঐ মহিলাকে এখানে নিয়ে এসেছে। এরা কেউ আমাকে পছন্দ করেনা, এটা আমি ভালো করেই জানতাম। কিন্তু নানিমার টানে এদের অবহেলা উপেক্ষা করে আমি এখানে আসতাম। আজ এরা এদের রূপ দেখিয়েই দিল। একজন আমার সুখ কেড়ে নিয়ে নিজের সংসার সাজিয়েছে। গত উনিশ বছর ধরে আমি আমি সেই দহনে নিঃশেষ হচ্ছি। আজ আবার এরা নতুনভাবে আমার সেই দহনে অনলের প্রলেপ দিয়েছে। এখন বাকিটা জীবন আমি বাঁচব কি নিয়ে? দুনিয়াটা এত নিষ্ঠুর কেন, খালা? নাকি দুনিয়ার সব নিষ্ঠুরতা শুধু আমার জন্যই বরাদ্দ! ” তাহমিদ রাজিয়া খালার হাত ছাড়িয়ে ওপরে যেতে চাইলে, খালা ওকে আটকায়।
” কই যাও, বাপ? তুমি এখানে বস, আমি তোমার জন্য শরবত নিয়া আসতাছি। ”
” আমি চলে যাব, খালা। এই বাড়ি থেকে চিরতরে চলে যাব। এখানে আর এক মুহুর্ত থাকলে আমি পা’গ’ল হয়ে যাব। ” তাহমিদ চোখ মুছে বলল। এরপর ও সোজা নিজের রুমে চলে গেল।
ড্রয়িংরুমের সবাই স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। মিথিলা আরজুমান্দ ভাবতেই পারেনি, তাহমিদের মনে তার জন্য এত ঘৃ’ণা জমেছে। সে হতভম্ব হয়ে তার মেয়ে নাহিয়ার দিকে তাকিয়ে আছে। বাসার ভেতরের চিৎকার শুনে ওরা বাগান থেকে ভেতরে এসে সবকিছু শুনে ঠাঁয় দাঁড়িয়ে আছে।
রিশা এতকিছু জানতনা। সে-ও সবার মত হতবাক।
রাজিয়া খালা দৌড়ে ওপরে চলে আসে। তাহমিদ ব্যাগে ওর কাপড় তুলছিল। রাজিয়া খালা এসে ছোঁ মেরে ওর হাত থেকে ব্যাগ কেড়ে নেয়।
” ও বাপজান, তুমি এভাবে কোন সিদ্ধান্ত নিওনা। তুমি কোথাও যাইবানা। ”
” খালা, তুমি আমাকে আটকিওনা প্লিজ। আমি এখানে থাকলে খারাপ কিছু ঘটিয়ে ফেলব। ” তাহমিদ খালার কাছ থেকে ব্যাগ নেয়ার জন্য জোড়াজুড়ি করছে।
” বাপজান, তুমি চইলা গেলে কুহু মা’য়ের কি হইব ? তুমি ছাড়া তারে নিরাপত্তা কে দিব? এতিম মাইয়াডার ভবিষ্যৎ কি হইব? তুমি না তাকে ভালোবাস। তাইলে তারে ফেইলা রাইখা যাইবা কেম্নে! ” এবার তাহমিদের হাত থেমে যায়। ও এতক্ষণ কুহুর কথা ভুলেই গিয়েছিল।
ও ধপ করে বিছানায় বসে পরল। দুহাত দিয়ে খামচে ধরল নিজের চুল। এ কোন পরীক্ষা উপনীত হয়েছে ওর সামনে?
বিঃদ্রঃ গত তিনদিন থেকে আমি অসুস্থ। এর ওপর বাসায় মেহমান। মেহমানদারী করে, অসুস্থ শরীর নিয়ে এতটুকুই লিখতে পেরেছি। আপনারা কেউ মনঃক্ষুণ্ন হবেননা।
চলবে…….