#প্রিয়াঙ্গন
#পার্ট_৩৭
জাওয়াদ জামী জামী
” অনেক বেলা হয়েছে, এবার তো আমাকে ছাড়ুন। চাচার বাসায় যাবেননা? এখন যদি না উঠি, তবে ঐ বাসায় যেতে দেরি হবে। ”
তাহমিদ কুহুকে জাপ্টে ধরে শুয়ে আছে। কুহু অনেকক্ষণ থেকে ওকে ছাড়তে ঘ্যানঘ্যান করেই চলেছে। কিন্তু তাহমিদের কানে কুহুর সেসব কথা পৌঁছলে তো। ও দিব্যি কুহুর গলায় মুখ গুঁজে ঘুম দিচ্ছে।
” উম বউ, এত কথা বলছ কেন? তুমিও চুপচাপ ঘুমাও, আর আমাকেও ঘুমাতে দাও। চাচা শ্বশুরের বাসায় যেতে দেরি হবে। ” তাহমিদ ঘুম জড়ানো গলায় বলল।
” আপনি ঘুমান। কে মানা করেছে। আমাকে ধরে রেখেছেন কেন! আমাকে ছাড়ুন। নাস্তা বানাতে হবেনা? ”
” শ্বশুর বাড়িতে দাওয়াত আছেনা। সেখানেই গিয়ে নাস্তা করব। আমার চাচা শ্বশুর বুদ্ধিমান ব্যক্তি। তিনি সকাল সকাল তার বাসায় যেতে বলেছেন। যেহেতু নাস্তা তৈরীর ঝামেলা নেই, সেহেতু আরও এক ঘন্টা ঘুমানোই যায়। ”
কুহু চোখ পাকিয়ে তাহমিদের দিকে তাকিয়ে আছে। কিন্তু তার কোনও হেলদোল নেই। অনেক চেষ্টার পরও কুহু তাহমিদের হাতের বাঁধন ঢিলা করতে পারলনা। বাধ্য হয়ে ওকেও শুয়ে থাকতে হয়।
রায়হান আহমেদের বাসায় পৌঁছাতে পৌঁছাতে ওদের এগারোটা বেজে যায়। ওদেরকে দেখেই রায়হান আহমেদ এগিয়ে আসলেন। তিনি সরাসরি তাহমিদে নিয়ে ডাইনিং টেবিলের কাছে আসলেন। তাহমিদের খাবেন জন্য তিনি এখনও না খেয়ে আছেন।
বিকেলে কিছু সময়ের জন্য তাহমিদ বাহিরে যায়। ও কোথায় যাচ্ছে, সেটা কাউকেই জানায়না।
” নানিমা, তুমিও কি খালামনির মত আমাকে দোষী ভাব? আমিতো শুধু চেয়েছি তোমার মুখে হাসি ফোটাতে। মামাকে ছাড়া তুমি যে কতটা কষ্টে ছিলে, সেটা আর কারও চোখে না পরলে আমার চোখে পরেছে। কিন্তু কালকে যেটা হল, সেটার জন্যও কি আমিই দায়ী? ” তাহমিদ ফাতিমা খানমের হাত নিজের দু হাতের মুঠোর মধ্যে নিয়ে করুণ স্বরে কাতরতার সাথে বলল।
তাহমিদের করুণ স্বর ফাতিমা খানমের বুকে আঘাত হানে। তিনি সজোরে মাথা নাড়িয়ে নিজের অনুভূতি ব্যক্ত করলেন। তিনি একমাত্র সচল হাতটি বাড়িয়ে দিলেন নাতির দিকে। এক হাতে জড়িয়ে ধরলেন তার প্রানপ্রিয় নাতিকে।
” বাপজান, তুমি রাইতে খাইয়া যাইবানা? ” রাজিয়া খালা জিজ্ঞেস করলেন।
তাহমিদ নানিমার সাথে অনেকটা সময় কাটিয়ে ড্রয়িংরুমে এসেছে। সেখানে সে মামা-মামীর সাথে কথা বলছে। তখনই রাজিয়া খালা এসে ওকে জিজ্ঞেস করলেন।
” না খালা, আজ এখানে খেতে পারবনা। আরেকদিন এসে তোমার হাতে খেয়ে যাব। তা তুমি কি রান্না কর, নাকি মামী করে? ”
” না তাহমিদ, এখনো আমি রান্নাঘরের দ্বায়িত্ব কাঁধে নিইনি। রাজিয়া আপা সবকিছুই সামলাচ্ছে। ” তাহমিদের মামী স্মৃতি একটু অপ্রস্তুত হয়ে বলল।
” মামী, এতে লজ্জা পাওয়ার কিছুই নেই। রাজিয়া খালা রান্নাবান্নায় পটু। তার হাতের রান্না খেলে অন্য খাবার মুখে তুলতে ইচ্ছে করেনা। আপাতত আপনি খালার রান্না খেয়ে রুচি বাড়ান। ”
” তুমি কিন্তু রাতে খেয়ে যেও। বউমাকেও সাথে নিয়ে আসতে। কালকে ওর সাথে গল্প করতেই পারলামনা। ”
” আজ খেতে পারবনা, মামী। আজকে আমরা চাচা শ্বশুরের বাসায় দাওয়াতে গিয়েছি। সেখান থেকেই এখানে এসেছি। রাতে সেখানেই খাব। ”
নায়লা আঞ্জুম তার বান্ধবীর বাসায় যাওয়ার উদ্দেশ্যে বের হতেই তাহমিদের কথা তার কানে পৌঁছে যায়। সে ক্ষণিকের জন্য থমকে দাঁড়ায়। তাহমিদের কথা যেন কানে বি’ষে’র ন্যায় আছড়ে পরল। তার অনুপস্থিতিতে তারই বাসায় রায়হান আহমেদ মেলা বসিয়েছে সেকথা ভেবেই তার রা’গে শরীর চিরবির করছে। সে তৎক্ষণাৎ সিদ্ধান্ত নেয়, নিজের বাসায় ফিরে গেলেই এসবের প্রতিদান রায়হান আহমেদকে হাড়েহাড়ে টের পাইয়ে দেবে। সে ধুপধাপ পা ফেলে বাসা থেকে বেরিয়ে যায়।
তাহমিদ নায়লা আঞ্জুমের দিকে তাকিয়ে আনমনেই হাসল।
” বউ, শ্বশুর বাড়িতে যেতে চাও? তোমার দেখতে ইচ্ছে করেনা তোমার এই অসহায় জামাই কোথায় থাকে? ” কুহুকে জড়িয়ে ধরে বলল তাহমিদ। মেয়েটা কয়েকদিন পর আজ কোচিং-এ গিয়েছিল। কোচিং-এ আজ পরীক্ষা ছিল। কুহু সেই খাতাগুলোই দেখছিল। হঠাৎ তাহমিদ ওকে জড়িয়ে ধরায় প্রথমে চমকে উঠেছিল। পরে তাহমিদের গলা পেয়ে মৃদু হাসল মেয়েটা।
” কে বলছে আপনি অসহায়! আপনি যদি অসহায় হন, তবে আমি কি? সারাদিন যে আমাকে আঙুলে নাচাচ্ছেন, আর আমি অসহায় বালিকা নেচে যাচ্ছি। আমি কি অসহায় নই? ” কুহু ঠোঁট টিপে হাসল।
” আচ্ছা, আমি তোমাকে আঙ্গুলে নাচাই! সত্যিই! দেখেছ আমি কত বড় অসহায়, এই যে তুমি আমার নামে মিছেমিছিই অপবাদ দিলে, আর আমি বিনাবাক্যে মেনে নিলাম? সারাজীবন এমনটাই চলতে থাকবে। এরথেকে বড় অসহায় ব্যক্তি তুমি দুনিয়া খুঁজলেও পাবেনা। ” তাহমিদ চোখমুখ অসহায়ের ন্যায় করল।
কুহু ওর দিকে তাকিয়ে না হেসে পারলনা। মানুষটা ওপরে ওপরে নিজেকে যতটা কঠোর দেখায়, আদতেই সে তা নয়।
” সত্যিই কি আমাকে শ্বশুর বাড়ি নিয়ে যাবেন! আমার বিশ্বাসই হচ্ছেনা। কবে যাবেন ঢাকা? ”
” তুমি বললে এখনই যেতে পারি। ”
” দূর ইয়ার্কি করবেননাতো। সত্যি করে বলুন না কবে আমাকে নিয়ে ঢাকা যাবেন। ”
” বাব্বাহ্ শ্বশুর বাড়িতে যাওয়ার জন্য দেখছি তর সইছেনা। আগেই বলে রাখছি, সেখানে তোমাকে আপ্যায়ন করার জন্য কেউ কিন্তু থাকবেনা। ”
” আপ্যায়ন করা লাগবেনা। সেই আশাও করিনা। কিন্তু ভয় হয়, যদি তারা আমাকে মেনে না নেয় । একে-তো আপনি তাদের না জানিয়ে বিয়ে করেছেন। তার ওপর আমি আমার শ্বাশুড়ির বোনের শ্বশুর বাড়ির আত্নীয়। ”
” তাদের মেনে নেয়া না নেয়ায় আমার কিছুই আসে যায়না। সংসার করব আমি। তারা করবেনা। তাই আমার ভালো আমাকেই বুঝতে হবে। তুমি কাপড়চোপড় গুছিয়ে রেখ। কাল দুপুরেই আমরা রওনা দেব। আমি ফুপুর সাথে কথা বলেছি, তিনি কয়েকদিন এখানেই থাকবেন। আসলে আমি সৃজনকে এখনই আমার বাবার বাড়িতে নিতে চাচ্ছিনা। সেখানে তোমাকে কিভাবে ট্রিট করা হবে, সেটা আমি জানলেও সৃজন কিন্তু জানেনা। তাই আপাতত ছেলেটাকে এসব ঝামেলা থেকে মুক্ত রাখতে চাই। ”
” আপনি এত কিছুর খেয়াল রাখেন কিভাবে! সব দিকে নজর রাখার অদ্ভুত এক ক্ষমতা আপনার ভেতর রয়েছে, সেটা কি আপনি জানেন? আপনাকে যতই দেখি ততই মুগ্ধ হই। ”
” মেয়ে, এভাবে দেখোনা। প্রেমে পরে যাবে। একবার আমার প্রেমে পরলে আজীবন আমাতেই আটকে থাকতে হবে। আমাকে ছাড়া এক মুহূর্ত বেঁচে থাকার কথা চিন্তাই করতে পারবেনা। ”
” আমি কি আপনার প্রেমে পরিনি বলতে চাচ্ছেন? আপনাতে আটকে যাইনি? ”
” তাই কি? কই আমিতো জানিনা। ”
” আবারও ইয়ার্কি করছেন! আমি আপনাতে আটকাইনি? আটকেছি বুঝলেন, ভিষণভাবে আটকে গেছি। আজ থেকে চারদিন আগেই স্থায়ীভাবে আপনাতেই আটকে গেছি। এতদিন মনে মনে আটকে ছিলাম। এখনতো দুনিয়াকে জানিয়ে আপনার বুকের মধ্যে আটকে গেছি। যেখান থেকে আমাকে সরানোর সাধ্য কারও নেই। সো এই নিয়ে কোন কথাই হবেনা। ”
কুহুর কথায়, চোখেমুখে কনফিডেন্স দেখে তাহমিদ অবাক হয়। এই মেয়েটা কত সহজে মনের গোপন কথা প্রকাশ করে দিল, ভেবেই ওর গর্ব হচ্ছে। আজ মনে হচ্ছে এই মেয়েটাকে ভালোবেসে ও ঠকেনি। এই মায়াবী কন্যা ওর জীবনে সুখের বার্তা নিয়ে এসেছে। ওকে ভাসাতে এসেছে প্রনয়ের সাগরে।
” এবার সরুন দেখি। আমাকে আবার গোছগাছ করতে হবে। প্রথমবার শ্বশুর বাড়িতে যাচ্ছি। তাই প্রস্তুতি নিতে সময় লাগবে। ” তাহমিদকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দেয় কুহু।
কুহুর আচমকা ধাক্কা খেয়ে টাল সামলাতে না পেরে বিছানায় পরে যায় তাহমিদ। মেয়েটা যে ওকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেবে সেটা ও ভাবতেই পারছেনা।
” চারদিন হতে না হতেই নির্যাতন শুরু করেছ! এখনই ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিচ্ছ? আমার হাত-পা ভেঙে গেলে কিংবা মাথা ফেটে গেলে তোমার কি কোন কষ্টই হতোনা! নিষ্ঠুর বউ, হিটলারের নাতনি। অত্যাচারী রমনী। ” তাহমিদ ব্যথা পাওয়ার ভঙ্গিতে বলল।
” আর কিছু? একে তো পরেছেন বিছানায়, তার ওপর এমন ভাব করছেন, যেন কেউ আপনাকে দশতলা থেকে ফেলে হাত-পা ভেঙে দিয়েছে! অভিনয় ভালোই জানেন দেখছি। অস্কার আপনাকে পেলে ধন্য হয়ে যাবে। ”
” হাহ্ ভাই তাহমিদ, ভবিষ্যতে তোর কপালে দুঃখ আছে বুঝলি? তুই তো বিয়ে করে বউ পাসনি, পেয়েছিস হিটলারের উৎকৃষ্ট বংশধর। যে তোকে উঠতে বসতে নাকানিচুাবানী খাওয়াবে। তার ডিকশনারিতে আদর বলে কোন ওয়ার্ড নেই। আছে শুধু অত্যাচার আর অত্যাচার। এভাবে চলতে থাকলে তোর বংশে লালবাতি জ্ব’ল’বে। তোর আর ফুটবল টিমের হওয়া হলোনা। এমন কাটখোট্টা বউয়ের ভয়েই তোকে আজীবন তটস্থ থাকতে হবে। ”
কুহু তাহমিদের কথায় কান না দিয়ে নিজের কাজ করতে থাকে। তবে ওর ঠোঁটে লেগে থাকা হাসি তাহমিদের চোখ এড়ায়না।
চলবে…