শুধু_তোমায়_ভালোবেসে #পর্ব_০৭ #সাদিয়া_রহমান_হাফসা

0
235

#শুধু_তোমায়_ভালোবেসে
#পর্ব_০৭
#সাদিয়া_রহমান_হাফসা

__________________

বাইরের শোরগোলের শব্দে অজানা আতংকে আঁতকে উঠে আরাধনা। তাড়াহুড়ো করে গাড়ি থেকে নেমে পড়লো সে। কিন্তু তার যাওয়ার পথে বাঁধা হয়ে দাড়ালো বন্দুক হাতে বিশাল দেহের অধিকারী কালো পোশাক পরিহিত দুইজন গার্ড। তাদের মধ্যে একজন গম্ভীর গলায় বললো,

– স্যার আপনাকে গাড়িতে অপেক্ষা করতে বলে গিয়েছে ম্যাম।

ভয়ার্ত গলায় আরাধনা হাত দিয়ে ইশারা করে বললো,

– সরুন! আমি আদনানের কাছে যাবো।

– সরি ম্যাম, স্যারের অর্ডার ফলো করাই আমাদের কাজ। আমরা তার কথার নড়চড় করতে পারবো না।

মুহুর্তেই কি যেন হয়ে গেলো আরাধনার। নিজের সমস্ত শক্তি দিয়ে এক ধাক্কায় গার্ডকে সামনে থেকে সরিয়ে দৌড়ে চলে গেলো সমাবেশের ভেতরে। গার্ড’সরা তার পিছু নিলেও ভীরের জন্যে তারা আর আটকাতে পারে না তাকে।

– তোর এতবড় হিম্মৎ! আমার আব্বাকে ধুলোয় মেশাবি!?

এই বলেই সাজিদ ইব্রাহীমের ছেলে ‘শান’ তেড়ে এসে আদনানকে ধাক্কা দিলো। রাগে আদনানের কপালের শিরা ফুলে ওঠে। শানের দিকে এগিয়ে যাওয়ার আগেই জন সম্মুখে খুব জোর আওয়াজে চড় পড়লো শানের গালে। ঘটনার আকস্মিকতায় সবার সাথে-সাথে আদনান নিজেও হতভম্ব হয়ে যায়। অপমানে চিৎকার করে ওঠে শান তার সাথে সাথে আবার সশব্দে আরেকটা চড় বসিয়ে দিলো আরাধনা। কাপছে আরাধনা, এ কম্পনের কারণ আজ ভিন্ন। ততক্ষণে দু’পক্ষের গার্ড’স আর পুলিশ তাদের মাঝে এসে উপস্থিত হয়েছে ঝামেলা আটকানোর জন্যে। কাঁপা কাঁপা পায়ে আদনানের কাছে এগিয়ে যেতে গিয়ে হোঁচট খেয়ে পড়ে যেতে নেয় আরাধনা কিন্তু তার আগেই আদনান তার হাত ধরে ফেলে। জোরে নিঃশ্বাস টেনে আদনানের গালে হাত রেখে আরাধনা বললো,

– আদনান! আমায় এখান থেকে নিয়ে চলো আমার এখানে ভীষণ..

কথা অসম্পূর্ণ রেখেই আদনানের বুকে ঢলে পড়লো সে।

– আরাধনা? ওপেন ইউর আইস! আরাধনা!

|
|

মানুষ বরাবরই ভালোবাসার কাঙাল। ভালোবাসা একটা শক্তিশালী ম্যাজিক। এই ভালোবাসা যেমন একটা মানুষের অগোছালো জীবনকে সুন্দর করে সাজিয়ে গড়ে দিতে জানে ঠিক তেমনি এই ভালোবাসা-ই একটা মানুষের সুস্থ স্বাভাবিক জীবনকে এক ঝটকায় এলোমেলো করার ক্ষমতা রাখে।

আরাধনা! যে ছোটবেলা থেকেই ভালোবাসা থেকে বঞ্চিত হয়ে এসেছে। একটা মানুষের শৈশব কাল হলো জীবনের সবচাইতে নাজুক পর্যায়। এই সময়ে তারা থাকে নরম মোলায়েম ফুলের মতো। এ সময়ে ঘটা প্রতিটি ঘটনা তাদের কোমল হৃদয়ে গভীরভাবে আঁচড় কাটে, ছাপ ফেলে যায়। খুশির মুহুর্তগুলো তাদের যতটা উৎফুল্ল করে! দুঃখ, ভয়, আতংকের মুহুর্তগুলো তাদের ঠিক ততটাই গুমরে দেয়।

আরাধনাকে তার শৈশব কালের কোনো মুহুর্ত মনে করতে বললেই সে অজানা ভয়ে চুপসে যাচ্ছে বারবার। এর মানে স্পষ্ট তার শৈশব তার জন্যে মোটেও প্রীতিকর ছিল না।

– তাহলে কি আরাধনার মেন্টাল ডিজিজ আছে ডক্টর?

আরাম করে চেয়ারে বসলেন ডক্টর হিমেল রেজওয়ান, যে পেশায় একজন সুনামধন্য সাইকিয়াট্রিস্ট।

– না মিস্টার সাখাওয়াত। আপনার ওয়াইফ মেন্টালি অ্যাবজুটেটলি ফাইন। তার কোনো মানসিক রোগ নেই তবে সে স্বাভাবিকও নয় বটে।

চোখের ডান পাশের ভ্রু খানিক উঁচু করে তীক্ষ্ম চোখে তাকায় আদনান। ডক্টর হিমেল একটা ফাইল সামনে বাড়িয়ে দিয়ে বললেন,

– সঠিক খাবারের অভাবে যেমন মানুষ পুষ্টিহীনতায় ভোগে এবং এই সমস্যার সমাধানের জন্য চাই সুষম খাদ্য। তেমনি গুড বিহেভিয়ারের অভাবে মানব মস্তিষ্কে একটা প্রভাব পড়ে। আরাধনার দৈহিক অবকাঠামো প্রাপ্তবয়স্কের হলেও তার মস্তিষ্ক এখনো বাচ্চাদের মতোন রয়ে গেছে। এর মানে এই না যে সে মেন্টালি সিক! তার এমন অস্বাভাবিক আচরণের কারণ হলো তাকে তার শৈশবে সঠিক শিক্ষা দেওয়া হয়নি যা একটা বাচ্চাকে তার মা-বাবা ছোটবেলায় শেখায়। মার্জিত ভঙ্গিতে কথা বলা, খাবার খাওয়া, চালচলন, একাডেমিক শিক্ষা এসব কিছু ওকে শেখানো হয়নি তাই সে এসব বিষয়ের সাথে অপরিচিত। ওকে পরিচয় করিয়ে দিন সব ঠিক হয়ে যাবে। তবে মনে রাখবেন ওর সাথে তেমন ব্যবহার করতে হবে যেমনটা একটা বাচ্চার সাথে করা হয়। যেমন:- নরম স্বরে কথা বলা, ভালোবাসা দেওয়া, যত্ন নেওয়া। মনে রাখতে হবে কখনোই ওর সাথে রুড হওয়া যাবে না। রাফ বিহেভিয়ার ওর উপর বাজে ইফেক্ট করবে।

– থ্যাঙ্ক ইউ ডক্টর।

আদনান উঠে হাত বাড়িয়ে হ্যান্ডশেক করে চলে যেতে নিলে ডক্টর হিমেল কিছু ভেবে পিছু ডাকলেন,

– মিস্টার সাখাওয়াত।

পেছন ফিরে আদনান। ডক্টর হিমেল চশমা খুলে টেবিলের উপর হাত রেখে বললেন,

– আরাধনা তার জীবনে শুধু দুইজন মানুষের সফট্ কর্ণার দেখেছে। একজন তার মা, যার কোনো অস্তিত্ব-ই এখন আর পৃথিবীতে নেই। অপরজন তার হাসবেন্ড মানে আপনি। হ্যাঁ বর্তমানে আপনি তাকে একটা সুস্থ পরিবেশ দিয়েছেন তবুও তার কাছে আপনি বরাবরই স্পেশাল। সে যদি আমার সঙ্গে একশোটা কথা বলে থাকে তাহলে তার মাঝে ষাট বারই সে আপনার নাম উচ্চারণ করেছে। এর মানে দাঁড়ায় আরাধনার ভরসা কেন্দ্র আপনি। জীবনের অনেকটা সময় কিন্তু আপনার স্ত্রীকে দিতে হবে! বলতে গেলে আরাধনার ট্রিটমেন্ট টাই আপনি। আশা করি আমি আপনাকে কি বলতে চাইছি তা আপনার বোধগম্য হয়েছে?

আদনান জবাবে মুচকি হাসি ফেরত দিয়ে বললো,

– শিউর ডক্টর!

|
|

দৌড়ে এসে ছেলেটার সাথে ধাক্কা খেয়ে পড়ে যেতে নিলে দ্রুত মেয়েটিকে আগলে ধরে ছেলেটি। ভয়ে চোখ খিঁচে বন্ধ করে ফেলেছে মেয়েটি। তার ভয়ে তটস্থ চেহারা দেখে ছেলেটা ব্যস্ত হয়ে বললো,

– কায়নাত! এতো রাতে এখানে কি করছো তুমি?

পরিচিত মানুষের কন্ঠস্বর শুনেই যেন ধরে প্রাণ ফিরে পেলো কায়নাত। সে চটজলদি সোজা হয়ে দাড়ায় তারপর আফসানের হাত খামচে ধরে কাঁদোকাঁদো হয়ে বললো,

– ওখানে খারাপ লোক আছে আফসান! ওরা খারাপ কাজ করছিলো। এখান থেকে চলুন তাড়াতাড়ি!

আফসান বাঁধা দিয়ে বললো,

– আরে আস্তে হাঁটো। পড়ে যাবে তো!

– আপনি তাড়াতাড়ি আসেন না!

হঠাৎ কায়নাতের হাত ধরে তার চলার গতি আঁটকে দেয় কেউ। চমকে উঠে কায়নাত। আফসান পেছন ফিরে কপাল কুঁচকে লোকটির উদ্দেশ্যে বললো,

– লীভ হার।

লোকটা গলা খাঁকারি দিয়ে বললো,

– ঐ যা এইখান থাইকা।

– ওর হাত ছাড়ুন।

– ঐ তোরে যাইতে কইছি নাই? ভাগলি এইখান থাইকা!

– ওর হাত ছাড়তে বলেছি। নাহলে যা হবে খুব খারাপ হবে বলে রাখছি।

– ছাড়বো না। কি করবি তুই?

আফসান কায়নাতের থেকে নিজের হাত ছাড়িয়ে গুরুগম্ভীর গলায় বললো,

– কায়নাত এখন কোনো প্রশ্ন করবে না। যা বলার পরে বলবে আপাতত চোখ বন্ধ করো।

কথামতো চোখ বন্ধ করে হাত দিয়ে ঢেকে নিলো কায়নাত। ওমনি আফসান চোখের পলকে লোকটির লুঙ্গি ধরে হেঁচকা টান দিয়ে খুলে তার মাথায় পেচিয়ে দিলো। তার এমন কান্ডে ভেবাচেকা খেয়ে লোকটি কিছুক্ষণ থম মেরে থেকে হাত ছেড়ে চেচিয়ে ওঠে আর সেই চিৎকার শুনে চোখ খুলে ফেলে কায়নাত। কিছু বুঝে ওঠার আগেই আফসান দ্রুত কায়নাতের হাত ধরে দিলো ভোঁ দৌড়। নির্জন জায়গা পাড় করে লোকালয়ে চলে আসার পর কায়নাত মুখে হাত চেপে বললো,

– নাউজুবিল্লাহ! আসতাগফিরুল্লাহ! তওবা তওবা! জঘন্য, বেশরম, বেহায়া লোক! আপনার লজ্জা করলো না পুরুষ হয়ে আরেক পুরুষের লজ্জাহরণ করতে!?

আফসান মুখ ভেঙচিয়ে বললো,

– ওরে আমার জনদরদি রে! যার জন্যে করি চুরি সে-ই বলে চোর তাই না?

– আমি কি আপনাকে বলছিলাম ওনার..ছি ছি ছিহ্!

– হেই হেই হেই মিস কাউয়াঠুঁটি! হোয়াট তুমি থিংকিং আমি তোমারে ফিল্মের হিরোর মতো ঐ আফ্রিকানের সাথে কুস্তি লড়ে সেভ করবো? শশুর বাড়ির আবদার তাই না?

– মামাবাড়ির আবদার হবে। অশিক্ষিত একটা!

– ওও হ্যাল্লো! তোমার বাবা আমার মামা লাগে না। তবে তুমি চাইলে তাকে আমার শশুড় বানাতে কোনো আপত্তি নেই। আর ইউ কবুল!?

শেষ কথাটা কায়নাতের দিকে ঝুঁকে খুব স্লো ভয়েসে বলে আফসান। কায়নাত নিজের পার্স আফসানের উপর ছুড়ে মেরে আঙুল উঁচিয়ে বললো,

– বেডা ভাঁওতাবাজ! আপনি দুনিয়ার আখেরি বেডা হলেও আমি আপনারে বিয়ে করবো নাহ্।

হোহো শব্দে হেসে উঠলো আফসান। কোনোরকমে হাসি থামিয়ে কায়নাতের উঁচু করে বাধা চুলের ঝুঁটি ধরে বললো,

– তোমারে ওয়ার্ল্ডের শেষ ম্যানও ডোন্ট বিয়া করতো। কেউ জেনেশুনে জোঁক ভর্তি পুকুরে ঝাপ দিবো না বইন। তুমি হইলা সেই জোঁক যে রক্তের একবিন্দুও ছাড় দিবে নাহ্। সব শুষে শুষে খাবে।

– আফসাইন্না! (চেঁচিয়ে)

আফসান দাঁত কিড়মিড় করে বললো,

– দেখ কাউয়া এখানে এলাকার সব ভদ্র কুকুরেরা আরাম করে ঘুমচ্ছে। তোমার কা কা শব্দে যদি ওরা বিরক্ত হয়ে তোমারে লাভ বাইট দিতে আসে না! তখন কিন্তু আমার কিচ্ছু করার থাকবে না।

– ছিহ্!

– হোয়াট ছিহ্?

|
|

– ওমন করে কি দেখছো?

আদনানের ঠোঁটের নিচের বাম পাশের তিলটা আলতো স্পর্শ করে বললো,

– এই কালো দাগ টার জন্যে তোমাকে অনেক বেশি সুন্দর লাগে। কি সুন্দর তুমি! (মুগ্ধ হয়ে)

গাড়ি থামিয়ে আরাধনার দিকে তাকায় আদনান।

– সুন্দর তোমার ঐ কাজল কালো ডাগরআঁখি দু’টি। ঘনপল্লবিত চোখের পাতা খুলে বাদামী নয়নমণি যেদিকে তাকায় তা-ই তার কাছে সুন্দর হয়ে ওঠে। তারথেকেও সুন্দর আমার তুমি।

আরাধনা দুইবার চোখের পলক ফেলে অবাক হয়ে বললো,

– তোমার আমি! সুন্দর আমি?

– আমার চোখে নিজেকে দেখে নাও।

অতঃপর দু’জনই দু’জনের চোখের গভীরে হারিয়ে যায়। কয়েক মুহুর্ত অতিবাহিত হওয়ার পর আরাধনা উৎফুল্ল হয়ে হাত বাড়িয়ে বাইরে ইশারা করে বললো,

– আদনান ওখানে নিয়ে চলো না আমায়!

কচি ঘাসে আবরিত সরু পথের দু’ধারে বিশাল সরিষা ক্ষেত। ফুলের ওপর লাল শাড়ির আঁচল মেলে ঘাস আবরিত পথের উপর নগ্ন পায়ে দৌড়ে যাচ্ছে আরাধনা। তার হাসির রিনঝিন ছন্দে মুখরিত হচ্ছে চারপাশ। পকেটে হাত গুঁজে ধীর পায়ে তার দিকে এগুচ্ছে আদনান। গোধূলির আলোমাখা আকাশপটে গাঙচিলেরা হেলেদুলে উড়ছে। আদনানের চোখে বিরাজমান একরাশ মুগ্ধতা। তার কর্ণধারে রঙিন প্রজাপতির মতো উড়ছে একটু আগে বলা আরাধনার বলা প্রথম প্রেমাবুলি। লাজুক চোখে চেয়ে আদনানের কানের কাছে ঠোঁট এনে তপ্ত শ্বাসের ঝড় বইয়ে সে বলেছিল,

– তোমায় আমি দেখেছিলাম বলে
তুমি আমার পদ্মপাতা হলে,
আমার মনে অনেক জন্ম ধরে ছিলো ব্যথা
বুঝে তুমি এই জন্মে হয়েছো পদ্মপাতা,
এই জীবনের সত্য তবু পেয়েছি এক তিল
পদ্মপাতায় তোমার আমার মিল!
[কথাঃজীবনানন্দ দাশ]



চলবে…

(শব্দসংখ্যা~১৩৫৭। কেমন হয়েছে জানাতে ভুলবেন না যেন! সাথে ভুলগুলিও ধরিয়ে দিবেন আমি সুধরে নেওয়ার চেষ্টা করবো। বানান সংক্রান্ত ভুলত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন। হ্যাপি রিডিং🐚🐌)

গল্পটি সম্পর্কে রিভিউ, আলোচনা, সমালোচনা করুন আমাদের গ্রুপে। গ্রুপ লিংক নিচে দেওয়া হলোঃ
https://facebook.com/groups/holde.khamer.valobasa/

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here