নব_প্রেমের_সূচনা #Sumaiya_Akter_Bristy #পর্ব_৩২

0
360

#নব_প্রেমের_সূচনা
#Sumaiya_Akter_Bristy
#পর্ব_৩২

পরের দিন অফিস থেকে ছুটি নিয়ে হৃদয়পুর যাওয়ার উদ্দেশ্যে রাতের ট্রেনে উঠে সমুদ্র। সারাদিনের ক্লান্তি চোখে ধরা দিচ্ছে। তারউপর কাল রাতেও ঠিক মতো ঘুম হয় নি। কখন হৃদয়পুর ফিরবে আর আরভীকে সামনে থেকে দেখবে এই এক্সাইটমেন্টে সারাটা রাত নির্ঘুম কেটেছে।
এই সাত বছরে সমুদ্রের জীবনের সব কিছুর পরিবর্তন ঘটেছে। আগে সমুদ্র ভোরে ঘুম থেকে উঠে প্রকৃতির মাঝে নিজেকে হারিয়ে ফেলতো। আর এখন সকাল ন’টা বেজে গেলেও ঘুম ভাঙ্গতে চায় না। তবু নিজের সাথে অনেক যুদ্ধ করে ঘুম থেকে উঠে অফিসে যেতে হয়। কখনো কখনো তো সকালের নাস্তা না করেই বের হতে হয়।

সমুদ্রের এসব ভাবনার মাঝেই সামনের সিটে বসে থাকা সাত থেকে আট বছরের এক বাচ্চা মেয়ে মোবাইলে একটা গান চালিয়ে দেয়। যে গানের সুরে সমুদ্র নিজের ভাবনা থেকে বেরিয়ে আসে। সমুদ্রের মাঝে এখনো অনেক বেশি এক্সাইটমেন্ট কাজ করছে। পুরো আট বছর পর আরভীকে সামনাসামনি দেখবে। ভাবতেই সর্বাঙ্গে প্রশান্তির ঢেউ খেলে যাচ্ছে। সমুদ্র সোজা হয়ে বসে গানটি মনোযোগ দিয়ে শুনতে থাকে। তারপর গানের সাথে সাথে নিজেও সুর মিলিয়ে গেয়ে উঠে,”tum bin main dekho to
Kya se kya ho baitha
Tumko jo khoya to
Khudko bhi kho baitha
Mujhko tu dhoonde
To khudko main paa loona
Main tere badle mein
Jannat bhi laa dunga
Tum todo na dil mera.”

সকাল সকাল হঠাৎ সমুদ্রকে দেখে সবাই অবাক হয়ে যায়। এভাবে না বলে আসার জন্য অনেকটা চিন্তাও হয় সমুদ্রের জন্য। তাই ইয়াসমিন সমুদ্রের দিকে এগিয়ে গিয়ে সমুদ্রের কাধে হাত রেখে চিন্তিত স্বরে বললেন,”বাবু! হঠাৎ না বলে আসলি যে? ঠিক আছে তো সব? না মানে কখনো তো এভাবে না বলে আসিস না।”

“এমনি মা। হঠাৎ ইচ্ছে হলো সবার সাথে দেখা করার। তাই চলে এলাম।”

“সব ঠিক আছে তো বাবু? তোর চোখ দুটো এমন ফুলে আছে কেন? অসুস্থ তুই? আর কত করে বলছি এখানে চলে আয়। তা না কোন ভীনদেশে গিয়ে পড়ে আছিস।”

“আমি একদম ঠিক আছি মা। রাতে ট্রেনে ঘুমোতে পারি নি। তাই চোখ ফুলে আছে। তুমি একদম চিন্তা করো না। বাবা আর নিলু কোথায়?”

“নিলু কলেজে গেছে একটু আগে। আর তোর বাবা বাজারে গেছে। তুই হাত-মুখ ধুয়ে টেবিলে বস আমি খাবার দিচ্ছি। খেয়ে একটু ঘুমিয়ে নে।”

সমুদ্র বাধ্য ছেলের মতো চুপচাপ নিজের ঘরে চলে যায়। ওয়াসরুমে গিয়ে চোখে-মুখে পানি ছিটায়। তারপর আয়নার দিকে তাকিয়ে নিজেকে দেখতে থাকে। আর বিরবির করে বলে,”ইউ ক্যান ডু ইট সমুদ্র।”

কথাটি বলে অদ্ভুত ভঙ্গিতে হেসে উঠে সমুদ্র। কারন সমুদ্র এবার একটা গেম খেলবে সবার সাথে। আর তার জন্য এবার নিজের প্রকৃতি বদলাতে হবে। নিজের পুরোনো সত্ত্বাকে লুকিয়ে নতুন এক সত্ত্বা নিজের মাঝে জাগ্রত করতে হবে। প্রয়োজনে এবার আরভীকে আরভীর থেকেই ছিনিয়ে নিয়ে আসবে নিজের জীবনে। তবুও তৃতীয় বারের মতো আর হারানো যাবে না। এর জন্য যা যা করা প্রয়োজন সমুদ্র সব করবে। দরকার পড়লে নাহিদ চৌধুরীর সাথে হাত মেলানোর নাটকও করবে।

সমুদ্রের মাথায় ঘুরতে থাকে কিছু পরিকল্পনা। যা সমুদ্র বাস্তবায়ন করতে যাচ্ছে সবার অগোচরে থেকেই। একটি দেহে দুটো সত্ত্বা ধারণ করা সহজ কোনো কথা নয়। এ কাজে ক্ষণে ক্ষণে গিরগিটির মতো রঙ বদলাতে হবে।

সমুদ্র আবার নিজের প্রতিচ্ছবির দিকে তাকিয়ে কন্ঠস্বর খানিকটা খাদে নামিয়ে বলতে থাকে,”এখন থেকে এই গল্পের হিরো আর ভিলেন দুটোই আমি। বাকি সবাই আমার হাতের গুটি। যাদের নিয়ে আমি দাবা খেলবো। দ্যা গেম ইজ বিগেইন। টিক টক টিক।”

সকালে কোনো রকমে হালকা খাবার মুখে দিয়েই সমুদ্র বেরিয়ে যায় আরভীর খোঁজে। আরভীকে এক নজর দেখে এতো বছরের তৃষ্ণা দূর করতে। সময়টা জানুয়ারির শুরুর দিকে বিধায় এখনো পুরো শীত বিরাজ করছে দেশজুড়ে। সমুদ্র একটা হুডি ও মাস্ক পরে বাড়ি থেকে বের হয়।

আরভীদের বাড়ির যতো কাছাকাছি যাচ্ছে ততো বুকের ভেতরকার হৃদপিণ্ডের লাবডাব শব্দ বেড়ে চলেছে।
দুরুদুরু বুক নিয়ে সমুদ্র এগিয়ে যায় আরভীদের বাড়ির সামনে। বাড়ির চারপাশ জুড়ে ঘুরঘুর করতে থাকে আরভীকে এক নজর দেখার আশায়। কিন্তু চল্লিশ মিনিট পার হয়ে যাওয়ার পরেও আরভীকে কোথাও দেখতে পায় নি।
এদিকে এতোক্ষণ যাবত সমুদ্রকে বাড়ির চারপাশে ঘুরঘুর করতে দেখে দারোয়ান সমুদ্রকে সন্দিহান নজরে দেখতে শুরু করে। শেষ পর্যন্ত সমুদ্রের সামনে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করে,”কি সমস্যা ভাই? অনেকক্ষণ যাবত দেখতাছি বাড়ির চারপাশ দিয়া ঘুরঘুর করতাছেন।”

সমুদ্র দারোয়ানের কথার উত্তর দেয় নি। উল্টো নিজে প্রশ্ন করলো,”এটা আরভী রায়হানের বাড়ি না? উনি আছেন বাড়িতে?”

“না, উনি ভোট চাইতে গেছেন সাধারণ জনগণের কাছ থেকে।”

“কোন দিকে গেছে সেটা জানেন?”

“ওইটা আমি জানমু কেমনে? আমারে কি কইয়া গেছে?”

“ধন্যবাদ ভাই।” বলে সমুদ্র প্যান্টের পকেট থেকে মোবাইল বের করে তন্ময়কে কল করে। তন্ময় নিশ্চয়ই খোঁজ নিয়ে দিতে পারবে আরভী এখন কোথায় আছে।

কিছুসময় পর তন্ময় জানায় আরভী কোথায় আছে। সমুদ্রকে লোকেশন পাঠিয়ে নিজেও চললো সেই লোকেশনের দিকে। তন্ময় ঠিক বুঝতে পারছে না সমুদ্র আরভীর খোঁজ কেন নিচ্ছে তাও হুট করে হৃদয়পুর এসে।

মিনিট দশেক পর সমুদ্র পৌছে যায় নিজের গন্তব্য স্হলে। দূর হতে দেখতে পায় আরভীকে। আরভীকে দেখার সাথে সাথে সমুদ্রের ভেতরটা হিমশীতল হয়ে আসে। এতোদিন ধরে তৃষ্ণার্ত চোখ দুটোর তৃষ্ণা নিবারণ হয়। যেদিন প্রথম আরভীর প্রেমে পড়েছিলো সমুদ্র ঠিক সেদিনের মতো অনুভূতি জাগে মনে। মনে হচ্ছে আবারও নতুন করে এই আরভীর প্রেমে পড়েছে সমুদ্র।
এখান থেকেই হয়তো নতুন প্রেমের সূচনা হবে দুজনার। এখান থেকেই হয়তো সমুদ্র ও আরভীর গল্পের নাম হবে #নব_প্রেমের_সূচনা। আর সেই গল্পের লেখক হবে সমুদ্র নিজে।

সমুদ্র আস্তেধীরে এগিয়ে যায় আরভীর দিকে। এখন যেনো দূর থেকে দেখে মন ভরছে না। কাছ থেকে দেখার ইচ্ছে জেগেছে মনে। ওই যে কথায় আছে না? মানুষ যতো পায় ততো চায়। অনেকটা ওরকম’ই।

সমুদ্র ভিড় ঠেলে আরভীর এক পাশে গিয়ে দাঁড়ায়। আরভীর সাথে পায়ে পা মিলিয়ে চলতে শুরু করে। আজ অনেক বছর পর নিজেকে হালকা মনে হচ্ছে সমুদ্রের কাছে। মনে হচ্ছে বুকের উপর থেকে ভারী পাথরটা সরে গেছে। সমুদ্র এক ধ্যানে তাকিয়ে আছে আরভীর দিকে।
হঠাৎ করে কাধে কেউ হাত রাখলে সমুদ্র দেখার চেষ্টা করে কে হাত রেখেছে। পাশ ফিরে তাকালেই তন্ময়কে দেখতে পায়। সমুদ্র ভ্রু যুগল সামান্য উপরে তুলে বিরবির করে শুধায়,”তুই এখানে?”

“আমারও একই প্রশ্ন। তুই এখানে কি করছিস?”

সমুদ্র তন্ময়কে প্রতিত্তোরে কিছু বলতে যাবে এর মাঝেই সমুদ্রের মনে হতে থাকে আরভীর পেছনের দিকে ছুরি জাতীয় কিছু একটা দেখেছে। চোখের ভুল নাকি সত্যিই দেখেছে তা জানার জন্য সমুদ্র আবারও আরভীর পেছনের দিকে তাকায়। না, এবার কিছু নেই। তবে দুটো ছেলে অদ্ভুত ভাবে আরভীকে দেখছে আর নিজেদের মধ্যে একটু পর পর কিছু একটা নিয়ে পরামর্শ করে নিচ্ছে। ছেলে দুটোকে মোটেও সুবিধের মনে হলো না সমুদ্রের কাছে। তাই তন্ময়কে ইশারায় বললো ছেলে দুটোর দিকে তাকাতে।

তন্ময় ছেলে দুটোর দিকে তাকালে চিনতে পেরে যায় এদের। এরা এলাকার নতুন ভাড়াটে গুন্ডা। মানুষের থেকে টাকা নিয়ে বিভিন্ন অনৈতিক কাজ করে বেড়ায়। কয়েকদিন আগেও পুলিশের হাতে ধরা পড়ে বেধড়ক কেলানি খেয়েছে। এখন আবার এখানে দুটো একসাথে আছে মানেই কোনো না কোনো ঝামেলা সৃষ্টি করবে।

তন্ময় আর সমুদ্র ছেলে দুটোর অগোচরে ওদের পেছনে গিয়ে দাঁড়ায় ওদের উপর নজর রাখার জন্য। প্রথম কিছু সময় ছেলে দুটো একদম শান্ত ছিলো। কিন্তু যখন আরভীর আশেপাশে লোকজনের ভিড় একটু বেড়ে যায় ও সবার ধ্যান পুরোপুরি আরভীর দেখে চলে যায় তখন ছেলে দুটোর মধ্যে একজন শার্টের নিচ থেকে ধারালো এক ছুড়ি বের করে। আরভীর পেছনে দুজন মহিলা গার্ড ছিলো। আর ডানে বামে একজন করে। অন্যদের স্পর্শ যেনো আরভীর গায়ে না লাগে তার জন্যই এই ব্যবস্থা করা।

ছেলে দুটোর মাঝে যার হাতে ধারালো ছুড়ি সে মহিলা গার্ড দুজনের মধ্যখানে গিয়ে দাঁড়ায়। গার্ড দুজন ছেলেটিকে দেখে হাত দিয়ে পথ আটকে দেয় যেনো আর সামনে না এগিয়ে যেতে পারে। ছেলেটি আর সামনে এগোয় না তা দেখে। কিন্তু গার্ড মহিলা দুজন যখন সামনের দিকে তাকায় ছেলেটি তখন সময় অপচয় না করে নিজের হাত চালিয়ে দেয়। ছুড়ি দিয়ে আঘাত করার চেষ্টা করে আরভীকে। কিন্তু ছুড়িটি আরভীকে স্পর্শ করার আগ মূহুর্তে সমুদ্র গিয়ে ছেলেটির হাত চেপে ধরে। ছেলেটির দিকে রক্তিম চোখে তাকায়।
সমুদ্র ছেলেটির যে হাত ছুড়ি সেই হাত পেছনের দিকে নিয়ে নিজেও ছেলেটির পেছনে গিয়ে দাঁড়ায় যেনো কেউ ছুড়িটি না দেখতে পায়। তারপর ছেলেটিকে নিয়ে আস্তে-আস্তে পিছিয়ে আসে। অপরদিকে তন্ময় অন্য ছেলেটির শার্টের কলার টেনে ধরে ভিড় থেকে বাহিরে নিয়ে আসে। তারপর তন্ময় ও সমুদ্র ছেলে দুটোর কলার টেনে এক বাড়ির আড়ালে নিয়ে যায়। জায়গাটি বেশ নির্জন। এখন এদিকটায় কেউ আসবে বলে মনে হয় না। কারন সবাই তো আরভীকে দেখতে ব্যাস্ত।

ছেলে দুটো নিজের দিকে চাওয়াচাওয়ি করে। কিন্তু কেউই বুঝে উঠতে পারছে না এ দুজন আসলে কে আর ওদের এভাবে ধরে এনেছে কেন। তন্ময় যাকে ধরে আছে সে হঠাৎ বলে উঠে,”এ ভাই কি সমস্যা হ্যাঁ? আমাদের এইভাবে ধইরা আনছেন কেন? কলার ছাড়েন।”

সমুদ্র এক হাত দিয়ে হাতে ছুড়ি ধরে রাখা ছেলেটির কলার ধরে অন্য হাত দিয়ে অপর ছেলেটির গালে কষে এক থাপ্পড় মারে।
সমুদ্রের থাপ্পড় খেয়ে ছেলে দুটো ক্ষেপে যায়। সমুদ্র যেই ছেলেটিকে ধরে আছে সে ছেলেটি হাতে থাকা ছুড়ি দিয়ে সমুদ্রকে আঘাত করতে যায়। কিন্তু তার আগেই সমুদ্র ছেলেটির হাত ধরে ফেলে। কলার ছেড়ে এবার এই ছেলেটির গালেও চড় বসায়। তারপর হাত মুচরে দিতেই হাতে থাকা ছুড়িটি নিচে পড়ে যায়।

চর খেয়েই ছেলে দুটো কানে ঝিঝি পোকার শব্দ শুনতে পায়। মনে হচ্ছে একটুর জন্য গাল ফেটে যায় নি। সমুদ্রের থাপ্পড়ে একদম গরম হয়ে গেছে গাল।

সমুদ্র এবার নিজের রাগ নিয়ন্ত্রণ করতে না পেরে ছেলেটিকে মারতে থাকে। ছেলেটি পাল্টা প্রহার করতে গেলে সুযোগ তো মিলেই না উল্টো সমুদ্রের মার দ্বিগুণ হয়ে যায়।

এইদিকে তন্ময়ের ধরে থাকা ছেলেটি সমুদ্রকে এভাবে মারতে দেখে বড়সড় ঢোক গিলে। তা দেখে তন্ময় হেসে বলে,”কি বাচ্চা? এখনই ভয় করছে? এই কলিজা নিয়ে এই পথে আসলি কিভাবে বল তো! এখটু অপেক্ষা কর। এখন তো ও মার খাচ্ছে। একটু পর তোর সময় আসবে।”

আরভীকে মারার চেষ্টা করেছে এ কথা যেনো সমুদ্রের সহ্য হচ্ছে না। তাই ছেলেটিকে এলোপাতাড়ি মেরে নিজের রাগ কমাচ্ছে।
সমুদ্রকে এখনো থামতে না দেখে তন্ময় সমুদ্রকে বাঁধা দিয়ে বলে”সমুদ্র এবার ছেড়ে দে। মরে যাবে ও। ছেড়ে দিয়ে জিজ্ঞেস কর কে পাঠিয়েছে ওদের।”

চলবে….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here