#উধয়রনী
#লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
||বোনাস পর্ব||
২৬।
ভেজা বাতাসে থরথর করে কাঁপছে আহি। গ্রামের বৃষ্টি স্নাত কর্দমাক্ত রাস্তায় পা ফেলার উপায় নেই। আহির জুতা জোড়া বার-বার কাঁদায় আটকে যাচ্ছে। কিন্তু সে হেঁটে যাচ্ছে। ঘোরের মাঝেই সে সামনে এগুচ্ছে। একবারো ভাবে নি এতো রাতে সে পায়ে হেঁটে শহরে কীভাবে পৌঁছাবে? বৃষ্টিতে ভিজে যাওয়ায় আহির লেহেঙ্গাটা আরো ভারী হয়ে গেছে। কাঁধ থেকে উড়নাটা রাস্তায় ফেলে দিলো আহি। কষ্টটা ধীরে ধীরে রাগে পরিণত হতে লাগলো তার। বাসায় তো সে এমনই করে। মন মতো কিছু না হলে জিনিসপত্র ছোঁড়াছুড়ি করবে। আর এখন তো তার সবচেয়ে প্রিয় সম্পদটিই তার কাছে নেই। হাতের ব্যাগটা রাস্তায় ছুঁড়ে ফেলে দিলো সে। আর হেঁটে যাওয়ার শক্তি নেই তার। পিচ ঢালা রাস্তায় উঠেই সেখানে ধপ করে বসে পড়লো আহি। লেহেঙ্গাটা খামচে ধরেছে সে। রাগ সব সেই লেহেঙ্গার উপরই ঝাড়ছে। চিৎকার করে অনেকক্ষণ কাঁদলো আহি। ভাগ্যিস জায়গাটা নিরিবিলি ছিল। গ্রামের পথ, অন্ধকার রাত, ভারী বর্ষণ এই মুহূর্তে কাকপক্ষীরও রাস্তায় থাকার কথা না।
হঠাৎ নিজের নিরাপত্তার কথা ভেবেই দুর্বল শরীর নিয়ে উঠে দাঁড়ালো আহি। ব্যাগটা আবার রাস্তা থেকে কুঁড়িয়ে নিয়ে ফোনটা বের করলো। ফোনটা ভিজে যাচ্ছে। আহি যতোটুকু পারছে বৃষ্টির ছাঁট থেকে ফোনটাকে বাঁচিয়ে রেখেছে। কিন্তু সে অক্ষম। নিজেই যেখানে পুরোপুরি বৃষ্টিতে ভিজে গেছে, সেখানে ফোনকে রক্ষা করবে কীভাবে!
মোজাম্মেল চাচার নম্বরে ফোন দিলো আহি। ঘড়িতে রাত দশটা। শহরের মানুষ এতো তাড়াতাড়ি ঘুমাবে না। মোজাম্মেল চাচা কল ধরতে দেরী করলেন না। আহি কাঁপা কন্ঠে বললো,
“চাচা, আমাকে একটু এসে নিয়ে যাবেন প্লিজ?”
মোজাম্মেল চাচা ব্যস্ত কন্ঠে বললেন,
“মা, আমি আসতাছি। তুমি চিন্তা কইরো না। সাহেব যখন শুনছে তুমি রাতে গ্রামে থাকবা, তখনই আমারে পাঠাই দিসে।”
আহির ফোন বন্ধ হয়ে গেলো। আহি ফোনটা ব্যাগে ঢুকিয়ে রাস্তার পাশে জড়োসড়ো হয়ে বসে পড়লো। মুহূর্তটা এতো ভয়ংকর ছিল যা আহি কখনোই ভুলতে পারবে না। সেদিন প্রায় দুই ঘন্টা পর মোজাম্মেল চাচা আহিকে নিতে আসেন। রাস্তায় অচেতন অবস্থায় লেহেঙ্গা পরা একটি মেয়েকে দেখেই তিনি বুঝে ফেলেছিলেন মেয়েটিই আহি। বাসায় পৌঁছাতে দেড় ঘন্টা লেগেছে মাত্র। ড্রাইভার রাস্তা খালি থাকায় দ্রুতগতিতে গাড়ি চালিয়ে নিয়ে আসেন। পুরো রাস্তা ড্রাইভার আর মোজাম্মেল চাচা উদ্বিগ্ন ছিলেন। বাসায় আনার পর মুনিয়া খালা আহির কাপড় পালটে দেন। আহির শারীরিক অবস্থার অবনতি হতে দেখে রিজওয়ান কবির তাকে জরুরি বিভাগে নিয়ে যান। এতো রাতে হাসপাতালে কোনো ডাক্তার উপস্থিত ছিলো না। তাদের ফোন করতে হবে। রিজওয়ান কবির পরিচিত ডাক্তারকে ফোন করলেন। আর নার্সরা আপতত আহিকে দেখে নাঁড়ি পরীক্ষা করে স্যালেইন দিলো। এরপর ডাক্তার এসে চেক আপ করে গম্ভীরমুখে বলল,
“বৃষ্টিতে ভেজার জন্য অচেতন হয় নি। মনে হচ্ছে অন্য কিছু। আমাকে সময় দিন, আমরা আপনাকে জানাচ্ছি।”
আহিকে এরপর আইসিউতে স্থানান্তর করা হলো। রিজওয়ান কবির প্রচন্ড রেগে আছেন। আহির কিছু হলে তিনি যে বিবাহিত দম্পতির সাথে খুব একটা ভালো কিছু করবেন না তা মোজাম্মেল চাচা তার কথার ধরণেই আঁচ করতে পেরেছেন। কিন্তু এখানে তো পদ্মের কোনো দোষ ছিলো না। সে তো জানেই না আহি কেন চলে গেছে। উলটো সে বিদায়ের সময় আহিকে অনেক খুঁজেছিলো। এদিকে সালমা ফাওজিয়াও মুনিয়া খালার কাছ থেকে খবর পেয়ে মেয়েকে দেখতে এসেছেন। তিনি বার-বার রিজওয়ান কবিরকে শাসাচ্ছেন। তার জন্যই না-কি মেয়ের এই পরিণতি হয়েছে।
অনেকক্ষণ পর ডাক্তার এসে জানালো, আহি মাইল্ড স্ট্রোক করেছে। তবে এখন পুরোপুরি সুস্থ আছে। জ্ঞান ফিরতে সময় লাগবে। ডাক্তার এ-ও বলে দিয়েছেন আহিকে যাতে কোনোরকম মানসিক চাপ দেওয়া না হয়। সেদিনের পর থেকেই আহি সিজোফ্রেনিয়া নামক রোগে ভুগছে।
(***)
আহিকে হাসপাতাল থেকে বাসায় আনার পরই লিনাশা তাকে দেখতে এলো। আহি লিনাশাকে ধরে অনেক কান্নাকাটি করলো। লিনাশা আহির হাত ধরে বলল,
“আগেই বলেছি, জানিয়ে দে, জানিয়ে দে। বোকার মতো চুপ ছিলি। তুই বোকা পদ্ম আর পুষ্পকে আফিফের কথাটা জানাতে দিস নি। আজ যদি পদ্ম আফিফকে চিনতো তাহলে কি তোর ভালোবাসা কেঁড়ে নিতো? ভুল তো তুই করেছিস। আফিফ কেন মনে করবে তুই ওকে এখনো ভালোবাসিস? এটা তোর এক তরফা ভালোবাসা ছিল।”
“আমি ওকে পাগলের মতো ভালোবেসেছি, লিনু।”
লিনাশা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
“ভালোবাসা আর উন্মাদের মতো ভালোবাসা দু’টির মধ্যে যথেষ্ট পার্থক্য আছে। তুই আফিফকে ভালোবাসিস এটা হয়তো সে বুঝেছে। কোনো কারণে হয়তো তোকে মেনে নেয় নি। হয়তো তুই যখন ওর লাইফে আসতে চেয়েছিলি, তখন ও প্রস্তুত ছিল না। এরপর কি তুই আর ওর সামনে গিয়েছিলি? আড়াই বছরে একবারো তুই ওকে বলেছিস, তুই এখনো ওর অপেক্ষায় আছিস? ও কি জানতো বিষয়টা, আহি? ছেলেটা তোকে না করে দেওয়ার পর তুই আর দ্বিতীয়বার ওর সামনে যাস নি। তাহলে ও কীভাবে বুঝবে তুই ওকে এখনো ভালোবাসিস? বলতে পারিস, এটা তোর ভাগ্যের দোষ। ও তো জানতো না তোর ওর প্রতি উন্মাদনা কেমন ছিল! জানলে তোকে কখনোই ফেলতে পারতো না।”
লিনাশা এর চেয়ে বেশি সান্ত্বনা দিতে পারবে না আহিকে। কিন্তু সেই সান্ত্বনা আহির কাছে তুচ্ছ। এতো বড় ধাক্কা এতো সহজে কাটিয়ে উঠতে পারবে না আহি। তার ভালোবাসা হারানোর রাগটা পদ্মের উপর ঝাড়লো সে। সব দিক থেকে ব্লক করে দিলো পদ্মকে। পদ্ম অনেকবার লিনাশাকে ফোন দিয়েছিল, আহির খবর নেওয়ার জন্য। লিনাশাও টুকটাক কথা বলেই কল রেখে দিয়েছে। আহির ব্যাপারে খোলাখুলিভাবে কিছুই বলে নি।
এদিকে আহির দিনগুলো কেমন উষ্কখুষ্ক ভাবেই কাটছে। সারাদিন তার একা একা ছাদে বসে থাকা, খাওয়া-দাওয়ার অনিয়ম, মাঝ রাতে অস্বাভাবিক আচরণ রিজওয়ান কবিরকে ভাবিয়ে তুলছে। এরপর আহিকে ডাক্তার দেখানো হলো। একমাস পরও আহির কোনো পরিবর্তন হলো না। সে সারাদিন আফিফের ভাস্কর্যটির সামনে বসে নিজে নিজে কথা বলেই সময় পার করতো।
(***)
একদিন বিকেলে কলিং বেলের শব্দ শুনে মুনিয়া খালা দরজা খুলে দিয়েই থমকে গেলেন। রিজওয়ান কবিরের পাশে দাঁড়িয়ে আছে লাবণি মেহেরা। লাবণিকে দেখে মুনিয়া খালা চমকালেন খুব। এই মেয়ে বধূ সাজে কেন? রিজওয়ান কবির আহিকে ডাকলেন। আহি নিচে নেমে লাবণিকে দেখে মুচকি হেসে বলল,
“আপু, আপনি কখন এলেন?”
মুহূর্তেই আপাদমস্তক লাবণিকে দেখে আহি ভ্রূ কুঁচকে বললো,
“আপনি বিয়ের শাড়ি পরে..!”
লাবণি আহির কাছে এসে থুতনিতে হাত রেখে বলল,
“এখন থেকে আমি তোমার আপু নই। আমি তোমার মা।”
আহি কয়েক পা পিছিয়ে গিয়ে বলল,
“আর ইউ ক্রেজি!”
রিজওয়ান কবির মেয়ের দিকে ভ্রূ কুঁচকে তাকিয়ে বললেন,
“ক্রেজি, হোয়াট? আহি, তুমি লাবণির সাথে ভদ্রভাবে কথা বলবে।”
এবার লাবণি আহিকে জড়িয়ে ধরে বলল,
“ধীরে ধীরে শিখে যাবে। আমিই আহিকে শিখিয়ে দেবো।”
আহি লাবণিকে সরিয়ে দিয়ে নিজের ঘরে চলে এলো। এরপর লিনাশার নম্বরে কল করলো। লিনাশা প্রায় সাথে সাথেই কলটা রিসিভ করলো। আহি কিছু বলতে যাবে তার আগেই লিনাশা বলল,
“আহি, তুই আমার পুরো লাইফটা এলোমেলো করে দিয়েছিস।”
আহি লিনাশার ঝাঁজালো কন্ঠের প্রতিত্তোরে বলল,
“লিনু, কি বলছিস এসব?”
লিনাশা বলল,
“বাবা হসপিটালে ভর্তি। তোর বাবা আমার বাবাকে খুন করতে চেয়েছে।”
“লিনু, আমি….”
লিনাশা আহিকে থামিয়ে দিয়ে বলল,
“চুপ, তোর সাথে বন্ধুত্ব করাই আমার ভুল সিদ্ধান্ত ছিলো। বাবা-মা আমাকে কতো বার বারণ করেছিলো, সেই ক্রিমিনালের মেয়ের সাথে বন্ধুত্ব করিস না। কিন্তু আমিই শুনি নি। এখন, কি করলো তোর বাবা? আমার আপুকে বিয়ে করে নিয়ে গেলো? তার লোক এসে আমার বাবা-মাকে মেরেছে। বাবা তাদের বিয়ে মেনে নিচ্ছিলো না দেখে মিস্টার রিজওয়ান কবির আমার বাবাকে মেরেছে। শুধু বাবাকে মারে নি। মাকেও মেরেছে। পুরো সোসাইটিতে আমাদের নাম খারাপ করে দিয়ে গেছে। আমার ভবিষ্যৎ নষ্ট করে দিয়েছে। সব কিছুর জন্য তুই দায়ী। তুই যার জীবনে যাবি, তার জীবনটাই এলোমেলো হয়ে যাবে। আফিফের কপাল ভালো ছিল, তাই তোর মতো মেয়ের কাছ থেকে বেঁচে গেছে।”
আহি ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো। লিনাশা আহির কান্নার শব্দ পেয়েই কল কেটে দিলো।
(***)
রিজওয়ান কবির আর লিনাশার বড় আপু লাবণি মেহেরার অনেক দিনের সম্পর্ক ছিলো। লাবণিকে পছন্দ করতেন বিধায় সালমা ফাওজিয়াকে তালাক দিয়েছিলেন তিনি। আহির চেয়ে মাত্র চার বছরের বড় লাবণি। এ বছরেই অনার্স শেষ করে রিজওয়ান কবিরের কোম্পানিতে চাকরি নিয়েছে। তাদের সম্পর্কের কথা লিনাশার মা রুনা খানম জেনে যান। লাবণিকে শাসন করার জন্য তার গায়ে হাত তুলেছিলেন তিনি। কারণ প্রথমত রিজওয়ান কবির তার বাবার বয়সী, দ্বিতীয়ত রিজওয়ান কবির একজন অসৎ চরিত্রের লোক, যেটা চট্টগ্রামের প্রায় সবারই জানা। এমন একটা লোকের সাথে সম্পর্ক মেনে নেওয়ার কোনো প্রশ্নই আসে না। কিন্তু লাবণি সেই শাসনের প্রতিশোধ নিয়েছে রিজওয়ানের লোকেদের দিয়ে নিজের বাবা-মাকে মার খাইয়ে।
সম্ভ্রান্ত পরিবারের মহিলা রুনা খানম। আপন স্বামী যেখানে কখনো তার গায়ে হাত তুলে নি, সেখানে বাইরের কিছু লোক এসে তাকে মারছে, এটা মেনে নিতে পারেন না। এখন তিনি অস্বাভাবিক আচরণ করছেন। লিনাশা মাকে একা সামলাতে পারছে না। নিকট আত্মীয়রা এসে মিসেস রুনাকে গ্রামের বাড়ি নিয়ে যান। এদিকে লিনাশার বাবা, ফখরুল হক মেয়ের সম্পর্কের কথা জেনে যাওয়ার পর মেয়েকে কিছুই বলেন নি। শুধু শান্তভাবে বুঝিয়েছিলেন। কিন্তু লাবণি বাবার কথার অমান্য হয়ে রিজওয়ান কবিরকে বিয়ে করে ফেললো। ফখরুল হক লাবণির বিয়ের খবর শুনে রিজওয়ান কবিরকে গালিগালাজ করলেন। এ জন্যই রিজওয়ান কবির তাকে মারার জন্য লোক পাঠিয়েছিলেন। এরপর গুরুতর অবস্থায় ফখরুল হককে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। বর্তমানে তাকে লাইফ সাপোর্টে রাখা হয়েছে। স্ট্রোক করেছিলেন তিনি। তার মস্তিষ্ক একদমই কাজ করছে না। ডাক্তাররা জানিয়ে দিয়েছে চব্বিশ ঘন্টার মধ্যে তার সাড়া না পেলে তাকে মৃত ঘোষণা করা হবে।
(***)
রাত এগারোটায় পুষ্পের কল দেখে আহি চমকে উঠলো। কল রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে পুষ্প বলল,
“আহি, লিনুর বাবা আর নেই।”
আহি খবর পেয়েই হাসপাতালে চলে এলো। এখান থেকেই লিনাশার বাবাকে গ্রামের বাড়িতে নিয়ে যাওয়া হবে। আহি লিনাশাকে দেখে তার কাছে এসে বলল,
“লিনু, পুষ্প আমাকে ফোন দিয়ে বলল….”
লিনাশা আহিকে থামিয়ে দিয়ে বলল,
“আমার বাবা মারা গেছে। এটাই তো বললো, তাই না? শুনেছিস? খুশি হয়েছিস?”
“কি বলছিস এসব তুই?”
“তোর বাবা একজন খুনী। তুই খুনীর মেয়ে।”
আহি লিনাশার হাত ধরতে যাবে, তার আগেই লিনাশা আহির গালে চড় বসিয়ে দিলো। আহি গালে হাত দিয়ে লিনাশার দিকে তাকালো। লিনাশা আঙ্গুল তাক করে বলল,
“আই হেইট ইউ, আহি। তোর সাথে বন্ধুত্ব করার পরিণাম এতো খারাপ হবে জানলে, আমি তোর দিকে কখনো ফিরেও তাকাতাম না। আমি আজ আমার বাবাকে হারিয়েছি তোর জন্য। একটা জলজ্যান্ত সুস্থ মানুষ এক রাতেই শেষ হয়ে গেছে, তোর জন্য। আমার মায়ের গায়ে হাত তুলেছে তোর বাবার লোকেরা। আমার সব শেষ হয়ে গেছে, শুধু তোর জন্য। তুই একটা অশুভ। তোর ভাগ্য যেমন, তুইও তেমন। আর কখনো আমার সামনে এসে দাঁড়াবি না। তোর সাথে আমার সব সম্পর্ক শেষ।”
আহি মাথা নিচু করে কাঁদছে। সে লিনাশার কাছে এসে বলল,
“তুইও আমাকে একা করে দিচ্ছিস, লিনু। প্লিজ…”
লিনাশা গম্ভীর সুরে বলল,
“আরেকটা কথা। আমি আর মা এই শহরে আর থাকবো না। থাকার মতো অবস্থায় আর নেই। পুষ্প এগুলো জানে না। আল্লাহর দোহাই লাগে, এই কথা আর কাউকে বলিস না। স্কুল গ্রুপ, কলেজ গ্রুপের কোনো বন্ধুরা যাতে না জানে আমার আপু তোর বাবাকে বিয়ে করেছে। অন্তত এটা সিক্রেট রেখে আমাকে উদ্ধার করিস।”
(***)
প্রথমে মা, তারপর ভালোবাসা আর আজ প্রিয় বান্ধবীকেও হারিয়ে ফেলেছে আহি। নিজেকে এর চেয়ে বেশি নিঃস্ব কখনোই মনে হয় নি তার। বেশিই সুখ পেয়েছিল এতোদিন। অতি সুখ তার জীবনের কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে।
আহি বাসায় ফিরে দেখলো লাবণি হাত ভর্তি চুড়ি পরে বসে আছে। তার সামনে আংটির বক্স। সে বক্সটি থেকে এক একটি আংটি বের করে আঙ্গুলে পরে দেখছে। আহি ক্ষুব্ধ কন্ঠে বলল,
“আপনি কি জানেন আংকেল মারা গেছেন?”
আহির কথা শুনে কিছুক্ষণের জন্য স্থির হয়ে বসে রইলো লাবণি। তারপর আহির দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বলল,
“বাবার আয়ু যদি কম থাকে, আমার কি করার আছে?”
“আমি আপনাকে দেখে অবাক হচ্ছি। আপনার মতো জঘন্য মেয়ে আমি একটাও দেখি নি।”
লাবণি এক গাল হেসে বলল,
“আমি এখন আর লাবণি মেহেরা নই। মিসেস লাবণি রিজওয়ান কবির। দেখো, তোমার বাবা আমার জন্য কতোগুলো ডায়মন্ডের রিং এনেছে! আমার বিয়ের গিফট। তুমি একটা পছন্দ করো। এতোগুলো দিয়ে আমি কি করবো? একটা তুমিও নাও।”
আহি ডায়মন্ডের বক্সটি হাতে নিয়ে মেঝেতে ফেলে দিলো। আর সাথে সাথেই আংটিগুলো পুরো ঘরে ছড়িয়ে পড়লো। লাবণি চেঁচিয়ে বলল,
“কতো লাখ টাকার রিং ছিল, জানো?”
আহি বলল,
“জানি, বরং দেখতে দেখতেই বড় হয়েছি। আপনি হয়তো হঠাৎ দেখেছেন। তাই হজম করতে পারছেন না। হজম করার জন্য নিচে বসে আংটিগুলো কুড়িয়ে নিন। এন্ড ফার্দার, আপনার আদিখ্যেতা আমাকে দেখাবেন না। আর আমার মা হওয়ার চেষ্টা তো কখনোই করবেন না। আই হেইট ইউ মিসেস লাবণি।”
লাবণি আহির কথায় অট্টহাসি দিয়ে বলল,
“তুমি একটু আগে আমাকে জঘন্য মেয়ে বলেছিলে। আমি তোমাকে শীগ্রই আমার সেই জঘন্য রূপটা দেখাবো।”
(***)
আহির দিন কাটছে যন্ত্রের মতো। বেলা করে ঘুম ভাঙছে। দুপুরে নাস্তা করে, আবার ঘুমাচ্ছে। সন্ধ্যায় ঘুম ভাঙলে আফিফের ভাস্কর্যের সাথে কথা বলে সময় কাটাচ্ছে। রাতে খোলা চুলে ছাদের মেঝেতে শুয়ে আকাশ দেখছে। মুনিয়া খালা আহির চিন্তায় অস্থির। চুনি আহিকে দেখলেই পালিয়ে যায়। চোখগুলো ফুলে থাকে তার। চুনির মনে হয় তার ভেতরে লিনাশার বাবার আত্মা ঢুকে গেছে। সে লাবণিকে এই কথা বলতে বলতে তার মাথা খেয়ে ফেলছে। লাবণি নিজেও আহির ব্যবহারে বিরক্ত।
আজ সে আহির ঘরে বিনা অনুমতিতেই ঢুকে গেলো। রুমে ঢুকে দেখলো আহি একটা ভাস্কর্য জড়িয়ে ধরে রেখেছে। আহিকে এই অবস্থায় দেখে লাবণি বলল,
“তুমি কি পাগল হয়ে গেছো, আহি?”
আহি লাবণির কথায় চমকে উঠলো। লাবণি বলল,
“কার ভাস্কর্য এটা!”
আহি ভাস্কর্যটিকে আড়াল করে দাঁড়ালো। লাবণি বাঁকা হেসে বলল,
“নিশ্চয় এই ভাস্কর্যে তোমার প্রাণ আটকে আছে। যদি তোমার এই প্রাণটা কেঁড়ে নেই, তাহলে তুমি আমার জঘন্য রূপ সম্পর্কে জানতে পারবে।”
আহি ভ্রূ কুঁচকে তাকিয়ে আছে লাবণির দিকে। লাবণি রুম থেকে বেরিয়ে গেলো। আহি সাথে সাথেই দরজাটা বন্ধ করে দিলো। আফিফকে নিয়ে আঁকা ছবি, জিনিসপত্র সবকিছুই সে লুকিয়ে ফেললো। শুধু ভাস্কর্যটি লুকোনোর স্থান খুঁজে পেলো না। লাবণি একটু পর দরজায় জোরে জোরে ধাক্কা দিতে লাগলো। আহি তা দেখে মুখ চেপে কাঁদছে। এই ভাস্কর্যটি যদি তার কাছ থেকে সরিয়ে নেয়, তাহলে সে পাগল হয়ে যাবে। এটাই তো আফিফের প্রতিচ্ছবি।
(***)
দরজা ভেঙে রুমে ঢুকলেন রিজওয়ান কবির। আহির রুমে সেই ভাস্কর্যটি দেখে আহির কাছে জিজ্ঞেস করলেন,
“কার ভাস্কর্য এটা?”
আহি কাঁপা কন্ঠে বললো,
“আমি ভালোবাসি একটা ছেলেকে। ওর ভাস্কর্য বানিয়েছিলাম।”
“কি করে ছেলেটা?”
আহি মাথা নেড়ে বলল, “বলবো না।”
রিজওয়ান কবির চিৎকার দিয়ে বললেন,
“নাম কি সেই ছেলের?”
আহি কাঁপা কন্ঠে বললো,
“ও জানেই না, আমি ওকে ভালোবাসি।”
লাবণি রিজওয়ান কবিরের কাছে এসে নিজ হাতে স্বামীর কোমরের বেল্টটা খুলে তার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলল,
“মেয়েকে শাসন করতে শেখো। বেশি আস্কারা দিয়ে মাথায় তুলে ফেলেছো।”
আহি দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। মুনিয়া খালা দৌঁড়ে ঘরে ঢুকে রিজওয়ান কবিরের পা ধরে বললেন,
“স্যার, ছাইড়া দেন ওরে। বুঝে নাই মাইয়াডা। ছোড মানুষ।”
লাবণি বলল,
“একটা রাস্তার ছেলেকে ভালোবেসে তার প্রতিমূর্তি বানিয়ে ঘরে তুলেছে, আর তুমি বলছো ছোট মানুষ?”
আহি চেঁচিয়ে বলল,
“ও রাস্তার ছেলে না। আপনি রাস্তার মেয়ে।”
আহির কথাটি মুখ থেকে বের করতে দেরী, রিজওয়ান কবিরের বেল্টের আঘাত তার শরীরে পড়তে দেরী হলো না।
২৬।
জীবনে প্রথম আহির বাবা মেয়ের গায়ে হাত তুলেছেন, তাও আবার বেল্ট দিয়ে মেরেই সেই অত্যাচারের সূচনা ঘটিয়েছেন। এই মুহূর্তে আহির শরীর জ্বলে যাচ্ছে। রিজওয়ান কবির আহির দিকে আঙ্গুল তাক করে বললেন,
“একবার এই ছেলের পরিচয় জানতে পারলে, তার লাশ তোমার সামনে এনে রাখবো। ভুলেও সেই ছেলে তোমার মনে যাতে বেঁচে না থাকে। তোমার জন্য আমি অনেক আগেই তাজওয়ারকে পছন্দ করে রেখেছি। তোমার বর্তমান, ভবিষ্যৎ, ভালোবাসা, সবটাই যেন তাজওয়ার হয়।”
রিজওয়ান কবির কথাটি বলেই চলে গেলেন। লাবণি আহির দিকে ঝুঁকে দাঁড়িয়ে বলল,
“আমার জঘন্য রূপ কেমন লেগেছে, আহি? মারটা হজম হয়েছে? না-কি হজম করার জন্য এই ভাস্কর্যটা ভেঙে দেবো?”
আহি কাঁপা শরীর নিয়ে বিছানা ছেড়ে উঠে ভাস্কর্যটির সামনে দাঁড়িয়ে বলল,
“প্লিজ ও এমনিতেই কখনো আমার হবে না। অন্তত এটা আমার সাথে থাকুক। আপনি যা বলবেন, আমি সব মেনে নেবো। এই ভাস্কর্যটার সাথে আমার অনেক স্মৃতি জড়িয়ে আছে। প্লিজ, এটা ভাঙবেন না।”
লাবণি লোহার গরাদ নিয়ে এসেছিলো সাথে করে। সেটা হাতে নিয়েই ভাস্কর্যের এক হাত ভেঙে দিলো।
আহি তাকে আটকাতে যাবে, তখনই লাবণি বলল,
“সবে তো শুরু আহি। আমার আরো জঘন্য রূপ তুমি দেখবে।”
আহি লাবণির পায়ের কাছে বসে বলল,
“প্লিজ। আমি আর কখনো আপনার সাথে খারাপ ব্যবহার করবো না। আমি ওকে হারিয়ে ফেলেছি। এটা ভেঙে গেলে, আমি কীভাবে বাঁচবো?”
“তো মরে যাও।”
লাবণি নিজের সর্বশক্তি দিয়ে ভাস্কর্যটিতে কয়েকটা আঘাত করল। ভাস্কর্যটি আহির চোখের সামনে গুঁড়িয়ে গেলো। লাবণিও চলে গেল। আহি অঝোর ধারায় কাঁদছে। চিৎকার করে কাঁদছে। তার কান্নার শব্দ নিচ তলা পর্যন্ত পৌঁছে গেছে। মুনিয়া খালা চুনিকে বুকে জড়িয়ে ধরে কাঁদছেন আর মিনমিনিয়ে বলছেন,
“আল্লাহ, মেয়েডারে বাঁচাও। এই জানোয়ারগুলা থেকে মুক্তি দাও।”
(***)
আহি রাতে কাঁদতে কাঁদতেই ঘুমিয়ে পড়েছে। লাবণি সকালে ঘরে এসে দেখলেন, আহি মেঝে হাতড়াতে হাতড়াতে কাঁদছে। আহির পাগলামো দেখে লাবণি লিনাশাকে কল করলো। লিনাশা বোনের সাথে কথা বলতে আগ্রহী ছিলো না। কিন্তু আহির শোচনীয় অবস্থার কথা শুনে আহিদের বাসায় আসতে বাধ্য হলো। লিনাশা এসেই আহিকে শান্ত করালো। আহি লিনাশার হাত ধরে বলল,
“তুই ঠিক বলেছিস, লিনু। আমি অশুভ। সব হারিয়ে ফেলেছি আমি। আমার বেঁচে থাকার কোনো দরকার নেই। এখন আমি কীভাবে মরবো, বল? ফ্যানে ঝুলে যাবো? ছাদ থেকে পড়ে যাবো? কোনটা করবো!”
লিনাশা আহির হাত ঝাঁকিয়ে বলল,
“তুই কি পাগল হয়ে যাবি নাকি? শোন আহি, যেই ভালোবাসা তোর জন্য নিষিদ্ধ হয়ে গেছে, তাকে আর কারো সামনে প্রকাশ করতে যাবি না। এটাই তোর জন্য ভালো হবে। সবকিছুর একটা সীমা থাকে৷ তোর ভালোবাসা সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছে। বেহায়া হয়ে যাস না। এমন বেহায়াদের কেউ ভালোবাসে না। আর মরে গিয়ে কি লাভ হবে? আফিফ ঠিকই পদ্মের সাথে সুখে সংসার করবে। দহন হবে তোর।”
“এটা কি দহন না?”
“একদিন ঠিকই সব মায়া কেটে যাবে। মানুষ কেউ কাউকে বেশিদিন মনে রাখে না। এটা তোর আবেগ। আমি আসতাম না আজ। কিন্তু বাধ্য হয়ে এসেছি। প্লিজ আহি, আমাকে আর বাধ্য করিস না। আমার তোকে দেখলে মায়াও হয়, আবার ঘৃণাও হয়। আমাকে শক্ত হতে দে। আমি আমার বাবাকে হারিয়েছি। মা জানে না তোর বাসায় এসেছি। জানলে অনেক সমস্যা হবে। তুই নতুন বন্ধু পাবি, ভালোবাসাও পাবি। সুন্দর তুই। একটা না একটা চলেই আসবে।”
আহি কাঁপা কন্ঠে বললো,
“আমার বিন্দু বিন্দু গড়া ভালোবাসার মূল্য তোদের কারো কাছে নেই। কি চমৎকার ভাবে বললি, একটা না একটা চলেই আসবে। দেখতে মনে হচ্ছে এটা আবেগ। কিন্তু আমার আবেগ আমাকেই খেয়ে ফেলছে। আমার কি পরিমাণ কষ্ট হচ্ছে তোরা বুঝবি না। আমি আর কাউকে বলবও না। এটাই শেষ। আমার ভালোবাসা, আমার অনুভূতি আমার মৃত্যুতেই এই পৃথিবী ছাড়বে। আমি শেষ মুহূর্ত অব্ধি আফিফকে ভালোবাসা ছাড়বো না। যেদিন আমার মৃত্যু হবে, আফিফ পৃথিবীর সবচেয়ে দামি জিনিস হারাবে। আফিফকে ভালোবাসার জন্য আমার কারো অনুমতির প্রয়োজন নেই। কারো চাওয়া না চাওয়া আমার ভালোবাসার সমাপ্তি ঘটাতে পারবে না। আমি বেহায়া হই, আর যাই হই। আমি কখনো ওর সামনে দাঁড়াবো না। ওর কাছে অধিকার চাইবো না। কিন্তু ভালোবাসার অধিকার আমারই আছে। পদ্মও পারবে না আমার চেয়ে বেশি ভালোবাসতে।”
“তোর বাবা অন্যের সংসার ভেঙেছে। এখন তুইও ভাঙবি?”
“ছিঃ লিনু। পদ্মকে আমি কষ্ট দিতে পারবো না। পদ্মের জায়গায় অন্য কেউ হলে, আমি হয়তো জোর করেই আফিফকে নিজের করে নিতাম। হয়তো বা নিতাম না। জানি না কি করতাম। মাথায় ঠিক নেই আমার। কিন্তু পদ্ম আমার বান্ধবী। আমি ওকে ভীষণ ভালোবাসি। এজন্যই তো আমি ওর সাথে যোগাযোগ বন্ধ করে দিয়েছি। না হবে কথা, না হবে দেখা, না মরণ যন্ত্রণার সুযোগ পাবো। দূরত্বই আমাদের ভাগ্যে আছে। আমি কাঁদবো, ভালোও বাসবো। কিন্তু পদ্ম-আফিফের সংসারে ঝামেলা করবো না।”
…………………………………….
আহি বারান্দায় এসে দাঁড়িয়েছে। আজ সে অলকানন্দার চারা কিনে এনেছে। মানুষটা তার না হোক, কিন্তু তার ভালোলাগাগুলো তো তার সাথেই থাকবে। এভাবেই মিষ্টিভাবে দূর থেকে ভালোবাসে সে আফিফকে। ছোট ছোট অলকানন্দা ফুল ফুটেছে চারায়। আহি সেগুলো আলতো হাতে ছুঁয়ে দিতে দিতে বলল,
“প্রিয় অলকানন্দ, আমি তোমাকে ভালোবাসতে এতোটাই মগ্ন ছিলাম যে তোমাকে বলার সুযোগটা হাতছাড়া করে ফেলেছি। আমি তোমাকে দেখতে এতোটাই ব্যস্ত ছিলাম যে তোমাকে চোখের সামনে বসিয়ে রাখার সুযোগটাই হারিয়ে ফেলেছি। আমি তোমাতে ডুব দিয়েছিলাম। খেয়াল করি নি তুমি এতোটা গভীর হবে। তোমার এই গভীরতা আমাকে সাঁতার ভুলিয়ে দিয়েছিল। আর আমি তলিয়ে গেলাম। তুমি কি কখনোই আমার প্রেমে পড়ো নি? আমার কৌতূহলী আবেগ, তোমাতে আটকে থাকা মন, আমার ব্যস্ত চোখ, কিছুই কি তোমাকে আকর্ষণ করে নি? আমি কি তোমার কিছুই ছিলাম না? আমি তবে কাকে ভালোবেসেছি, যার মনে কখনো আমিই ছিলাম না!”
চলবে-
(আজ থেকে এখানেই অতীতের অংশ শেষ। এখন গল্পের মূল অংশ শুরু হবে। যারা বিচ্ছেদ দেখে কষ্ট পাচ্ছেন, তাদের বলছি, ধৈর্য রাখুন। হয়তো ভালো কিছু পাবেন।)