#উধয়রনী
#লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
||বোনাস পর্ব||
৩০।
আহি ক্যাম্পাসে ঢুকার পর থেকে খুব অস্বস্তিবোধ করছিল। নিজের পোশাক নিয়ে আত্মবিশ্বাস না থাকলে যে কাউকেই বেমানান লাগবে। আহিরও নিজেকে তেমনই মনে হচ্ছে। এদিকে প্রতিটা ডিপার্টমেন্টের অরিয়েন্টেশন আলাদা জায়গায় হচ্ছে। হয়তো পুষ্প, রাদ আর লাবীব তাদের প্রোগ্রামেই ব্যস্ত আছে।
আহি নিজের টোকেন দেখিয়ে অরিয়েন্টেশন প্রোগ্রামে ঢুকতে যাবে তখনই আফিফের মুখোমুখি হলো। সে অডিটোরিয়াম রুমের সামনেই দাঁড়ানো ছিলো। আহির চোখাচোখি হতেই সে চোখ নামিয়ে নিলো। আহি ভেতরে ঢুকতেই রাদের কল এলো। সে কল রিসিভ করার জন্য তার টোকেনটা ফেরত নিয়ে বলল,
“আমি একটু পর ঢুকবো।”
আহি এই বলে অডিটোরিয়াম রুমের বাইরে এসে রাদের কল রিসিভ করে বলল,
“রাদ, কোথায় তোরা?”
“আমি আর লাবীব একটু পর প্রোগ্রামে ঢুকবো। তুই কোথায় সেটা জানার জন্যই ফোন দিলাম।”
আহি আমতা-আমতা করে বলল,
“আসলে আমি না ঝামেলায় আছি। একটা হ্যাল্প করবি?”
রাদ উদ্বিগ্ন কন্ঠে বলল, “কি, কোনো সমস্যা হয়েছে?”
“তুই এদিকে আয় না একটু।”
রাদ ফোন রেখে পাঁচ মিনিটের মধ্যেই আহির ডিপার্টমেন্টে চলে এলো। দূর থেকে আহির হাবভাব দেখে রাদ আন্দাজ করে ফেলেছে সমস্যাটা কি! সে আহির সামনে দাঁড়িয়ে সাথে সাথেই বলল,
“উড়না ছিঁড়ে গেছে?”
আহি কাঁদো কাঁদো কন্ঠে বলল,
“মিসেস লাবণি আমাকে জোর করে এভাবে পাঠিয়েছেন। গাড়িতেও উনি ছিলেন। নয়তো ড্রাইভারকে বলে একটা কিনে নিতাম। ভাই, আমার অস্বস্তি লাগছে।”
“ব্যাগে করেই নিয়ে আসতি।”
আহি তার হাতের ব্যাগটা উঠিয়ে রাদের সামনে ধরলো। রাদ ব্যাঙ্গ করে বলল,
“এই ব্যাগটা আর না আনলেও পারতি। আমি বুঝি না এতোটুকু একটা ব্যাগ নিয়ে বের হওয়ারই বা কি আছে? ফোনটা হাতে নিলেও হয়।”
আহি চোখ ছোট করে রাদের দিকে সেকেন্ড খানিক তাকিয়ে বলল,
” ব্যাগটাও সুনেহরাহর পছন্দের।”
রাদ দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
“তোর লাইফে এতো ভিলেন কেন, ভাই? আর তুই বোকা আমাকে একটা মেসেজ দিয়ে রাখতে পারতি। আমি আসার সময় কিনে নিয়ে আসতাম।”
আহি রাদের হাত ধরে বলল,
“আজকের দিনটাও আমার খারাপ করে দিয়েছে। আর কতো সহ্য করবো ওদের? ওরা আমাকে নিজেদের ইচ্ছেমতো নাচাচ্ছে। আমিও তো মানুষ! আমার কষ্ট হয়, রাদ। নিজের বাবাই যেখানে এমন, আমি আর মিসেস লাবণির আলাদাভাবে কি দোষ দেবো?”
রাদ নিজের ব্যাগ আহিকে ধরিয়ে দিয়ে বলল,
“এখন আর কি করার আছে? এসব কথা এই মুহূর্তে রাখ। এখন তুই এক কাজ কর। আমার ব্যাগটা ধর, আমি আসছি।”
রাদ আহিকে ব্যাগ ধরিয়ে দিয়ে চলে গেলো। এদিকে আহি মলিন মুখে এক কোণায় দাঁড়িয়ে আছে। আফিফ অডিটোরিয়াম থেকে বের হয়ে দেখলো আহি অন্যমনস্ক হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। সে কোনো কথা না বলে আহিকে পাশ কাটিয়ে চলে গেলো। আহি দেয়ালে হেলান দিয়ে চোখ বন্ধ করে দাঁড়িয়ে আছে। রাদের কন্ঠ শুনেই সে চোখ খুললো। রাদ তার ব্যাগটা নিয়ে একটা কালো উড়না আহির গলায় ঝুলিয়ে দিলো।
আহি জিজ্ঞেস করলো, “কোথায় পেলি?”
“ভাগ্যিস ক্যাম্পাসের বাইরে একটা হিজাবের ভ্যান ছিল।”
আহি রাদের হাত ধরে বলল,
“তুই আমার সব রোগের মেডিসিন রে।”
(***)
আফিফ মায়ের সাথে ফোনে কথা বলে অডিটোরিয়ামের দিকে যেতে লাগলো। সে সামনে কয়েক পা এগিয়ে যেতেই দেখলো আহি আর রাদ মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছে। আর আহি রাদের হাত ধরে রেখেছে। আফিফ তাদের দিকে সেকেন্ড খানিক তাকিয়েই তাদের পাশ কেটে চলে যেতে লাগলো। আহি আফিফকে যেতে দেখেই রাদকে বলল,
“আমিও যাই। এন্ড থ্যাংক ইউ সো মাচ, মাই মেডিসিন।”
রাদ আহির গাল টেনে দিয়ে বলল,
“তুই আমার একমাত্র মেয়ে বান্ধবী। তোর জন্য আমি সব করতে পারি। এখন যা।”
রাদ চলে যেতেই আহি অডিটোরিয়ামে ঢুকে গেলো। আফিফও তার সিটে এসে বসলো। এদিকে আহি দেখলো আফিফের পাশের সারিতেই একটা সিট খালি আছে। আহি একবার আফিফের দিকে তাকালো, আরেকবার খালি সিটটার দিকে। তারপর আশেপাশে চোখ বুলিয়ে নিলো। আশেপাশে কোথাও সিট খালি নেই। পেছনের দিকে কয়েকটা খালি আছে। কিন্তু এই মুহূর্তে সামনে সিট পেয়েও এতো পেছনে গিয়ে বসাটা সুন্দর দেখাবে না। আর আফিফও বুঝে যাবে, আহি এখনো তার উপর দুর্বল। সে আর যাই হোক আফিফকে বুঝতে দেবে না। তাই সেই সিটেই বসে পড়লো আহি।
প্রোগ্রাম শুরু হয়ে গেছে। কেউ কেউ মনোযোগ দিয়ে অতিথিদের বক্তব্য শুনছে, আর কেউ কেউ নিজেদের মাঝেই ফিসফিস করছে। আর আহি পাথরের মতো বসে আছে। মনে হচ্ছে সে নিষ্প্রাণ। নয় বছর আগের সেই প্রথম দেখা, চারুশিল্পে একই সারিতে বসা, আফিফের দিকে তাকিয়ে থাকা, সবকিছুই চোখের সামনে ভেসে উঠছিলো আহির। এসব মনে পড়তেই চোখ দু’টি ছলছল করে উঠলো তার। একটু পর পর জোরে জোরে শ্বাস ছাড়ছে সে। এবার আফিফ আহির দিকে তাকালো। আহি সামনে তাকিয়ে থাকলেও আফিফের তার দিকে তাকানোটা খেয়াল করলো সে। ঝাপসা মুখটি স্পষ্টভাবে দেখার জন্য আহিও এবার পাশ ফিরলো। আর আফিফ সাথে সাথেই চোখ সরিয়ে নিলো। হঠাৎ আফিফ উঠে পেছনের সারিতে চলে গেলো। আহি বুঝতে পেরে দাঁত দিয়ে নিজের ঠোঁট চেপে ধরে তার কষ্টটা দমানোর চেষ্টা করলো। এই মুহূর্তে নিজের উপরই রাগ হচ্ছে তার। মনে হচ্ছে মনটাকে আটকানো এতো সহজ হবে না। সে নিজের বুকে হাত রেখে মনে মনে বলল,
“রিল্যাক্স আহি। রিল্যাক্স।”
আহি হঠাৎ খেয়াল করলো আফিফ তার একদম পাশে এসে বসেছে। পাশে বসা মেয়েটি আপনা-আপনি উঠে চলে যাচ্ছে। আহি সিটের হাতলে হাত রাখতেই আফিফ তার হাতটা ধরে মুচকি হাসি ফেরত দিলো। আহি সামনে তাকালো। আফিফ তার কানের কাছে ফিসফিস করে বলল,
“প্রিয় অলকানন্দা, তোমাকে সুন্দর লাগছে আজ।”
আহি জানে এটা তার হ্যালুসিনেশন। এমন তার সাথে প্রায়ই হয়। সে তো অসুস্থ। সাধারণ মানুষ যেই অসুস্থতাকে পাগলামী বলে। আহি এমনই একজন পাগল প্রেমিকা, যার হুশ-জ্ঞান ঠিকই আছে, শুধু মিছেমিছি তার হারিয়ে ফেলা প্রেমিককে অনুভব করে, যে তার আশেপাশেও নেই।
(***)
অরিয়েন্টেশন প্রোগ্রাম শেষ হতেই আফিফ অডিটোরিয়াম থেকে বের হয়েই দেখলো আফিফা বেগম পদ্মকে নিয়ে তার ডিপার্টমেন্টের সামনে দাঁড়িয়ে আছেন। মাকে এখানে দেখে আফিফ রীতিমতো অবাক। সে নিচে নামতেই আফিফা বেগম বললেন,
“আফিফ, তোকে দেখতে এসেছি!”
আফিফ ভ্রূ কুঁচকে বললো,
“মা, এখানে আসার কি দরকার ছিল? আমি তো বাসায় আসবোই।”
“জানি তো। এমনিতেই তোর ভার্সিটি দেখতে এসেছি। এখন তোর ক্লাসমেটদের সাথে পরিচয় করিয়ে দে না।”
পদ্ম মলিন মুখে আফিফের দিকে তাকালো। আফিফ মায়ের এমন আচরণে ভীষণ রেগে গেলো। কিন্তু সে আজ পর্যন্ত মায়ের সাথে উচ্চবাচ্য করে নি। তাই মুখ ঘুরিয়ে কপালে আঙ্গুল ঘষতে লাগলো। পদ্ম বুঝতে পারলো আফিফ রাগ নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করছে। সে আফিফা বেগমকে বলল,
“মা, উনি আজই প্রথম এসেছেন। ক্লাসও শুরু হয় নি। হয়তো ধীরে ধীরে পরিচিত হবেন।”
তখনই আহি অডিটোরিয়াম থেকে বের হয়ে পদ্মকে দেখে দূর থেকে হাত নাড়লো। পদ্মও আহিকে দেখে ইশারা করলো। আফিফা বেগম পদ্মের দৃষ্টি অনুসরণ করে আহিকে দেখে বললেন,
“মেয়েটা কে?”
আফিফ মায়ের প্রশ্নে পেছন ফিরে আহিকে দেখে আরো ভড়কে গেলো। সে মায়ের হাত ধরে বলল,
“মা প্লিজ, তুমি চেয়েছো আমি পড়াশুনা শেষ করি। তাই তোমার জন্য মাস্টার্সে ভর্তি হয়েছি। এখানে এমন কিছু করো না।”
“আরেহ, আমি কি করবো? আমি তো দেখতে এসেছি মাত্র।”
আফিফ মায়ের সাথে আর তর্কে জড়ালো না।
এদিকে আহি নিচে নামতেই পদ্ম আহির কাছে এসে বলল,
“কেমন আছিস?”
“ভালো। তোর কি অবস্থা?”
“হুম।”
পদ্মের মলিন মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো আহি। তখনই আফিফা বেগম বলে উঠলেন,
“কেমন আছো, মা?”
আহি সালাম দিয়ে বলল, “ভালো। আপনি?”
আফিফা বেগম সালামের উত্তর নিয়ে বললেন,
“আমিও ভালো।”
আহি একনজর আফিফের দিকে তাকালো। এই মানুষটার খবর নেওয়ার জন্যই কিছু বছর আগেও সামনে দাঁড়িয়ে থাকা ভদ্র মহিলাকে ফোন করতো আহি। ভাবতেই কেমন যেন লাগছে তার। যদিও আফিফা বেগমের হাবভাব দেখে বোঝা যাচ্ছে, তিনি আহিকে চিনতে পারেন নি। চেনার কথাও নয়। সেই স্কুল পড়ুয়া মেয়েটির সাথে বর্তমান আহির কোনো মিলই নেই।
এদিকে আফিফ মাকে আটকানোর জন্য তার হাত ধরে তাকে নিয়ে যেতে চাইলে, তিনি আহিকে জিজ্ঞেস করলেন,
“তুমি পদ্মকে কীভাবে চেনো?”
“আমরা স্কুল ফ্রেন্ড।”
“আচ্ছা? তোমার বাবা-মা কি করেন?”
আহি সেকেন্ড খানিক আফিফা বেগমের মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো। শাশুড়ির এমন উদ্ভট আচরণে পদ্ম লজ্জায় নুইয়ে পড়ছে। আহি পদ্মের দিকে তাকালো। পদ্মকে এমন বিমর্ষ ভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে আহি আন্দাজ করতে পারলো ব্যাপারটা। কারণ পুষ্পের কাছেই সে পদ্মের শাশুড়ির স্বভাব সম্পর্কে শুনেছিলো। তাই আহি হাসি ফেরত দিয়ে বললো,
“বাবা ব্যবসা করেন। আর মা কি করেন জানি না।”
“সে কি, তোমার মা কি করেন, তুমিই জানো না?”
“মায়ের সাথে আমার যোগাযোগ নেই। আমার বাবা-মা অনেক আগেই আলাদা হয়ে গেছেন। আমি বাবা ও তার দ্বিতীয় স্ত্রীর সাথে থাকি। তবে বাবার বর্তমান স্ত্রী কিছুই করেন না। তিনি শুধু বাবার টাকাই খরচ করেন।”
আহির এমন উত্তরে পদ্ম অবাক হয়ে তার দিকে তাকালো। আফিফও ভ্রূ কুঁচকে তাকিয়ে আছে। আফিফা বেগম বিষ্মিত মুখে বললেন,
“আহারে, তোমার খুব কষ্ট হয়, তাই না?”
“না। আমার ভালোই লাগে। আমি ইচ্ছেমতো বন্ধুদের সাথে ঘুরি, পার্টি করি। ওরা আমাকে যথেষ্ট ফ্রিডম দিয়েছে।”
আফিফা বেগম জোরপূর্বক হাসলেন। পদ্ম আহির হাত ধরে ইশারায় বলল, কি বলছিস এসব?
আহি মনে মনে বলল, “মিথ্যে তো আর বলি নি।”
আফিফা বেগম আবার বললেন,
“আচ্ছা, বিয়ে কবে করছো তুমি!”
আফিফ মায়ের দিকে ভ্রূ কুঁচকে তাকালো। সে কিছু বলতে যাবে তার আগেই আহি প্রতিত্তোরে বলল,
“আন্টি, বিয়ে আর আমি? এক গ্লাস পানি নিয়েই খেতে পারি না। তবে পদ্মের মতো সংসারী হলে তো কথায় ছিলো না। আর বিয়ের সাথে দূর দূরান্তের বিচ্ছেদ।”
আফিফা বেগম হাসলেন। পদ্মও মুখ চেপে হাসলো। আহি যে তাকে বাঁচানোর জন্য এমন কথা বলছে সে বুঝতে পারলো। আফিফ এবার মায়ের হাত ধরে বলল,
“এখন চলো।”
তখনই রাদই তার ডিপার্টমেন্ট থেকে বের হয়ে আহির দিকে এগিয়ে এলো। রাদ কাছাকাছি আসার আগেই আহি নিজেই তার কাছে গিয়ে হুট করে তাকে জড়িয়ে ধরে চাপা স্বরে বলল,
“আমাকেও একটু জড়িয়ে ধর। পদ্মের শাশুড়ির সামনে বর্তমান জেনারেশানের একটা নমুনা দেখাই।”
রাদও আহিকে জড়িয়ে ধরলো। আফিফ আর পদ্ম অবাক হয়ে তাদের দিকে তাকিয়ে রইলো। আফিফা বেগম চোখ ছোট করে তাকিয়ে আছেন। এরপর তিনি নিজেই বিড়বিড় করতে করতে চলে গেলেন। আফিফও মায়ের পিছু নিলো। আফিফা বেগম বলতে লাগলেন,
“আজকাল মেয়ে-ছেলেদের লজ্জা বলতে কিছু নেই। বড়দের সামনেও কেউ এমন করে?
আফিফ মায়ের হাত ধরে বলল,
“তুমি এসবে কেন জড়াচ্ছ? মাথা থেকে আমাকে বিয়ে করানোর চিন্তাটা ফেলে দাও। আর এখানে এসে সবাইকে এমন প্রশ্ন জিজ্ঞেস করলে, দেখা যাবে আমার পড়াশুনাটা এবারও থেমে যাবে।”
আফিফা বেগম ছেলের হাত ধরে বললেন,
“এভাবে বলছিস কেন? আর আসবো না আমি।”
আফিফ মাকে জড়িয়ে ধরে বলল,
“রাগ করো না, মা।”
“তোর সাথে কি আমি রাগ করে থাকতে পারি, বল?”
(***)
আফিফা বেগম আর আফিফ চলে যেতেই আহি রাদকে ছেড়ে দিয়ে বলল,
“মাইন্ড করেছিস?”
রাদ বলল,
“এসবে ছেলেরা মাইন্ড করে না। খুশি হয়!”
আহি রাদের বাহুতে ঘুষি মেরে বলল,
“ফাজিল ছেলে।”
এরপর আহি পদ্মের কাছে এসে বলল,
“তোর শাশুড়ি এমন করছে কেন রে? এগুলো বেশি বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে।”
পদ্ম মলিন মুখে বলল,
“মা হতে পারবো না তাই। এটা হয়তো আমার কোনো কালের শাস্তি।”
“ডাক্তার দেখাস নি?”
“হুম, দেখিয়েছি। সমস্যাটা আমারই। ট্রিটমেন্ট করেও লাভ হচ্ছে না।”
“ভালো ডাক্তার দেখা।”
“ঢাকায় গিয়েছি। তাও কাজ হয় নি। আমি কখনোই সন্তান ধারণ করতে পারবো না। তাই আফিফকে আবার বিয়ে দেওয়ার কথাবার্তা চলছে।”
“তো! দ্বিতীয় বিয়ে কোনো সমাধান নয়। এখন অনেক পদ্ধতি আছে। চিকিৎসা সেবাও অনেক উন্নত হয়েছে। আইভিএফ পদ্ধতিও বাচ্চা নেওয়া যায়।”
“আহি, এসবে অনেক খরচ। এতো টাকা থাকলে তো অনেক আগেই আমরা বাবা-মা হয়ে যেতাম। আফিফের বেতন কম। কোনোভাবে আমাদের চলে যাই। এখন তো উনার চাকরিটাও চলে গেছে।”
“কেন? উনি ছবি আঁকে না এখন?”
পদ্ম মাথা নেড়ে বলল,
“বিয়ের পর থেকে কখনোই আঁকতে দেখি নি। বিয়ের পরই একটা চাকরি নিয়েছিলেন। পিয়নের চাকরি। উনার ছোট বোনের স্বামী অনেক বড়লোক। অনেক টাকার মালিক। সে-ই আফিফকে চাকরিটা দেয়। তারপর একদিন চাকরিটাও চলে যায়। কি হয়েছে জানি না। আমাকে বলে নি। তবে আমার ননদ আর শাশুড়ীর কাছ থেকে শুনেছিলাম, আমার ননদের স্বামীরও একজন বস ছিল, তিনিই না-কি আফিফকে বের করে দিয়েছিলেন।”
“কেন?”
“জানি না। আফিফ তো বলে নি আমাকে।”
“তুই চিন্তা করিস না। তোর শাশুড়িকে বোঝা, বল যে অন্য পদ্ধতিতেও তুই মা হতে পারবি। খরচ বেশি তাই সময় লাগছে। আর একদিন ঠিকই উনার ভালো জব হবে। তখন টাকা জমিয়ে তোদের স্বপ্ন পূরণ করিস। বিয়ে করতে দিস না। দ্বিতীয় স্ত্রীগুলো কখনোই ভালো হয় না।”
আহি কথাটি বলেই দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। হঠাৎই তার মায়ের কথা মনে পড়ে গেলো। পদ্ম চলে যেতেই আহি রাদকে বলল,
“তোদের বাড়ির পাশেই তো আমার নানার বাড়ি। তুই মায়ের খোঁজ নিয়ে আসবি, রাদ?”
রাদ আহির হাত ধরে বলল,
“তুই না বললেও আমি যেতাম। হাতে দুই সপ্তাহের ছুটি আছে। আমি বাড়িতে যাবো। অনেক বছর তো যাওয়া হয় নি।”
“আমাকেও নিয়ে যাবি?”
“তোকে যেতে দেবে?”
“ট্যুর বলে যাবো। পুষ্পের সাথে গেলে নিশ্চয় বাঁধা দেবে না।”
“তাহলে চল।”
আহির চোখে অশ্রু ভীড় করলো। সে কান্নাভেজা কন্ঠে বলল,
“মা আমাকে মনে রেখেছে তো!”
“মা কি তার সন্তানকে ভুলতে পারে?”
“আমার জন্য নানাভাইয়ের কোনো খবর নেই। নানু আমাকে পছন্দ করেন না। মামারাও করেন না হয়তো। আচ্ছা, ওরা যদি মাকে অন্য কোথাও বিয়ে দিয়ে দেয়?”
“কি বলিস এসব?”
“আজকাল তো মেয়েরাও দ্বিতীয় বিয়ে করে। মাও তো করতে পারেন। মায়ের বিয়ে হয়ে গেলে, আমাকে তো মা মেনেই নেবে না। বাবার কাছ থেকে পালাতে পারলে, আমি তখন কোথায় গিয়ে আশ্রয় নেবো? আমার মনে হয় না আমার কেউ আছে?”
“কেউ থাকুক না থাকুক, যতোক্ষণ আমি আছি তুই কখনো নিজেকে একা ভাবিস না।”
আহি হালকা হেসে অশ্রুগুলো আড়াল করে বলল,
“মেডিসিন একটা।”
রাদ আহির কথায় হাসলো। তারা দু’জনই ক্যাম্পাস থেকে বের হয়েই দেখলো তাজওয়ার গাড়ি নিয়ে ক্যাম্পাসের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। আহি রাদকে বলল,
“এই উটকো আপদটার চোখ ফাঁকি দেওয়ার কোনো উপায় আছে?”
আহি আর রাদ চোখ ফাঁকি দেওয়ার পরিকল্পনা করার আগেই তাজওয়ার আহির সামনে এসে দাঁড়ালো। আহি চোখ ছোট করে তাজওয়ারের দিকে তাকালো। তাজওয়ার হালকা হেসে রাদের দিকে তাকিয়ে বলল,
“আমার গর্জিয়াস লেডিকে শুধু আমার সাথেই মানায়। উড ইউ প্লিজ এক্সকিউজ আজ?”
রাদ আহির দিকে তাকালো। আহি রাদকে ইশারায় চলে যেতে বললো। রাদ চলে যেতেই আহি ভ্রূ কুঁচকে তাজওয়ারকে বলল,
“আমি তোমার কেউ নই। আমাকে বিরক্ত করবে না।”
“আমি যতোদিন বেঁচে আছি, তুমি তো আমারই। এই স্টেটমেন্ট আমি কখনোই তুলবো না।”
“তোমার মতো ক্যারেক্টরলেস ছেলেদের স্টেটমেন্টের কোনো বিশ্বাস নেই।”
“আমি ক্যারেক্টরলেস হতে পারি, কিন্তু তোমার ব্যাপারে আমি খুবই লয়াল। তোমার জন্য আমি সব ছেড়ে দিয়েছি।”
“ফার্জিয়াকেও?”
তাজওয়ার ফার্জিয়ার নাম শুনেই বিরক্ত হলো। সে হালকা রাগ দেখিয়ে বলল,
“আহি, প্লিজ। মেয়েটাই আমার পেছনে পড়ে ছিল। আর এখন ও আমাদের মাঝে আসবেই না। ওকে আমি কড়া ভাবে বলে দিয়েছি, তুমিই আমার সব।”
“আচ্ছা? কড়াভাবে বলেছো? না-কি তোমার বন্ধুদের দিয়েই সব কাজ করিয়েছো?”
তাজওয়ার আহির কথা শুনে চুপ হয়ে গেলো। আহি রাগী কন্ঠে বলল,
“তোমার বন্ধুদের দিয়েই তো ওকে তোমার পথ থেকে সরিয়েছো। এখন ভিডিও বানিয়ে ওকে ব্ল্যাকমেইল করছো। তোমার কড়া হওয়ার ডেফিনিশন দেখে আমি রীতিমতো অবাক হয়েছি। এটাকে যদি কড়া হওয়া বলে, তাহলে তোমার আর হিংস্র পশুর মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। আর এমন পশু একদিন আমাকেও সরানোর জন্য তার বন্ধুদের সাহায্য…..”
তাজওয়ার আহিকে থামিয়ে দিয়ে তার হাত শক্ত করে চেপে ধরে বলল,
“তুমি আর বাকিরা এক নও। তুমি আমার ছাড়া আর কারো হতে পারবে না।”
“আমাকে চ্যালেঞ্জ করো না। আমি তোমাকে বিয়ে না করার জন্য সব সীমা ছাড়িয়ে যাবো। তুমি তো আমাকে কখনোই পাবে না। মিস্টার খান, কিপ ইট ইন ইউর মাইন্ড।”
তাজওয়ার বাঁকা হেসে বলল,
“তুমি আমাকে চেনোই নি, আহি। যতোটুকু চিনেছো, আমি এর চেয়ে ভয়ংকর হতে পারি। কিন্তু আমি তোমার কোনো ক্ষতি করবো না। তবে তোমার আশেপাশে যারা আছে, তাদের কিছু হলে আমি দায়ী নই।”
চলবে-
(🌻আগামীকাল ছুটি। বৃহস্পতিবার দেবো পরের পর্ব।)