#চুপিসারে (১১)
#রেহানা_পুতুল
বড় ভাইয়া যাবে না বড়াম্মু?
নাহ। সে আগেই পাত্রীকে দেখে পছন্দ করে রেখেছে কিছুটা। আজ আমাদের পছন্দ হলেই এনগেজমেন্ট হবে।
কিরে শ্রাবণ নদীকে গানের স্কুলে ভর্তি করসনাই?
জিজ্ঞেস করলো তার মা মোরশেদা।
করছি তো মা।
এত জলদি হয়ে গেলো?
আজ অফ ডে না? ফ্রি রোড ছিলো। তোমরা বের হবে। তাই কাজ সেরেই চলে এলাম। যদি আমাকে কোন প্রয়োজন হয় তোমাদের।
ওর ক্লাস কবে থেকে?
ক্লাস সপ্তাহে দুইদিন। শুক্র ও শনি। সকাল আটটা থেকে দশটা। আজও ছিলো ক্লাস। ও করেনি। কাল থেকে করবে ক্লাস।
মা, বাবার পছন্দে শ্রাবণ একে একে বেশ কিছু পাত্রী দেখলো বিয়ের জন্য। কিন্তু তার পছন্দ হচ্ছে না৷ ব্যক্তিগতভাবেও তার কোন পছন্দ নেই জানাল। শেষমেষ একটা মেয়েকে মোটামুটি পছন্দ হলো। আজ শুক্রবার তার মা বাবা যাবে কথা ফাইনাল করতে। তারপরেই এনগেজমেন্ট হবে।
রফিক বলল,
একা কই? সুরমা আছে না? চাইলে নদী থাকতে পারবে৷ আর শ্রাবণওতো আছে।
সারথি নদীর হাত ঝাঁকিয়ে বলল,
নদীপু তুমিও আমাদের সঙ্গে চল। ভাইয়ার বউ তুমিও দেখবে।
না সারথি আমি যাব না। ভালোলাগছে না।
শ্রাবণ বলল,
এই নদী, যেতে পারিস তুই চাইলে।
না ভাইয়া। আমি বাড়ি যাবো।
আচ্ছা তোরা থাক বলে, শ্রাবণের মা,বাবা,বোন বের হয়ে গেলো। শ্রাবণ নদীকে বলল,
বাড়িতে যাওয়ার আগে আমার রুমে আসিস। কথা আছে।
শ্রাবণ রুমে গিয়ে জিন্সের প্যান্ট চেঞ্জ করে ট্রাউজার পরে বিছানায় রেস্ট নিচ্ছে।অপেক্ষা করছে নদীর জন্য।
সকাল ফুরিয়ে গেলো। উঠান জুড়ে ছড়িয়ে আছে হলদে রোদের চাদর। বসন্তের ঝিরিঝিরি হাওয়া বইছে। রূপ হারানো বির্বণ তেঁতুল পাতাগুলো দুরন্ত কিশোরের মতো বিক্ষিপ্তভাবে উড়াউড়ি করছে। নদী উম্মনা। অফুরন্ত ভালোলাগায় ভরে আছে হৃদয়টা। উপর দিয়ে শ্রাবণকে উপলব্ধি করতে দিল না। কিন্তু মনে মনে বেজায় খুশী আজ। কারণ মায়ের ও নিজের এই সুপ্ত লালিত স্বপ্নটা পূরণ হবে এবার হয়তো।
নদী খালি বাড়িতে এদিকে সেদিক হাঁটতে লাগলো। আরু মিথ্যে বলেনি। বড় চাচার এই বাড়িটা তার ভীষণ প্রিয়। কোন ঝুট ঝামেলা নেই। হিংসা বিদ্বেষ নেই। একা বাড়ি হলেও নিরিবিলি নই। রাজনৈতিক কারণে কোলাহল মুখর পরিবেশ বিরাজ করে সারাদিন। নানামুখী সমস্যা নিয়ে এলাকার মানুষের আনাগোনা লেগেই থাকে সারাক্ষণ। তবুও নদীর কেমন শান্তি শান্তি অনুভব হয় এই বাড়িতে এলে। এই পরিবারের প্রতিটি মানুষ হাসিখুশি আর গল্পগুজবে মেতে থাকে।
ভ্রমণ পিয়াসী নদীর প্রকৃতির মাঝে ঘুরে বেড়াতে ভালোলাগে। সে বাগানের ভিতরে গিয়ে মাথা তুলে গাছগাছালি দেখতে লাগল। গোলাপজাম গাছের ডাল টেনে কয়েকটি গোলাপজাম ফল ছিঁড়ে নিলো। খেতে খেতে এলো রসুইঘরের সামনে। রোয়াকের উপরে বসে কুরুনি দিয়ে নারকেল কুরাচ্ছে সুরমা। সে হলো সর্বদা শ্রাবণদের কাজে সাহায্যকারী মেয়ে। তাদের অনাত্মীয় বা দূরাত্মীয় বলা যায় সুরমাকে। দুই বছর ধরে সুরমা এই বাড়ির আশ্রয়ে রয়েছে।
নদী সুরমার সাথে কথা বলছে। তাকেও গোলাপজাম দিলো। সুরমার সঙ্গে একথা ওকথা বলার সময় হুট করে তার মনে পড়লো শ্রাবণ তাকে দেখা করতে বলেছে। সে শ্রাবণের কাছে যাওয়ার জন্য উদ্যত হলো। পা বাড়াতেই রজতকে দেখতে পেলো উঠানের মাঝে। হঠাৎ করে রজতকে দেখে হকচকিয়ে গেলো নদী।
বলল,
আরেহ রজত ভাই আপনি?
কিঞ্চিৎ লজ্জাবনত কন্ঠে বলল নদী।
তো কি করবো? তোর কোন খবর নেই। তুই লাপাত্তা। মামীকে ফোন দিলাম। বলল তুই চলে এসেছিস। তোদের বাড়িতে এসে নানীর কাছে শুনলাম তুই এখানে। বড় মামী, মামা,সবাই কই?
খবরদারি কন্ঠে বলল রজত।
কেউ নেই। পাত্রী দেখতে গিয়েছে। বড় ভাইয়া আছে বাড়িতে।
তাহলে খুব ভালো। আমিও পাত্রী দেখতে এলাম। কিরে শুনলাম তুই এখানেই নাকি সবসময় থাকবি? নানী বলল?
কারণ শুনেন নি?
হুম শুনলাম তো।
তো আপনি কি বলেন?
নাহ। আমার কোন আপত্তি নেই।
আমার আপন মামার বাড়ি। তোর র*ক্তের চাচার বাড়ি। সো নো আপত্তি। নো কনফিউশান।
সুরমা হেসে বলল,
রজত ভাই আপনার পাত্রী কে?
তোমার সামনেই আছে আমার পাত্রী। তা নারকেল দিয়ে কোন রেসিপি হবে সুরমা?
মনে হয় নারকেলের পুলি বা পিঠা বানাইবো খালাম্মা। আমারে কইলো কুরায়া রাখতে।
তোমার রান্না হইছে সুরমা ?
খালাম্মা রান্না কইরা গ্যাছে। দুপুরে খাইয়েন কিন্তু।
হ খাবনি বলে রজত প্লেট থেকে কিছু নারকেল কোরা নিজের মুখে পুরে দিলো। কিছু নদীকে খাওয়াতে গেলে নদী ছিটকে সরে গেলো। এভাবে সময় গড়িয়ে ভরদুপুর হয়ে গেলো। রজত নদীকে ইশারা দিয়ে ঘরের ভিতরে ডেকে নিলো। ড্রয়িংরুমে গিয়ে বসলো। নদী একটু দূরের সোফায় বসলো।
রজত নদীকে বলল,
দূরে কেন তুমি। কাছে এসো বসো। আলিঙ্গনে মাতিয়ে দাও এই প্রেমিকটাকে।
শিহরিত কন্ঠে আস্তে করে দুষ্টমির ছলে বলল রজত।
নদী নাক সিঁটকালো। বলল,
হুহ আমার বয়েই গেছে।
ওকেহ টুনির মা, কাছে আসতে হবে না। পাশে বসতে হবে না। করতে হবে না আলিঙ্গন। তুমি ওখানে বসেই এই নির্জন অলস দুপুরে আমাকে একটা গান শোনাও এখন। আমার আলস্যতা দূর করে দাও। অনভূতিটা কেমন ম্যাচম্যাচ করতেছে। চাঙ্গা হওয়া অতীব গুরুত্বপূর্ণ।
পারব না। অন্যদিন শোনাবো। বড় ভাইয়া আছে। লজ্জা করে।
নো বাহানা। নো ফাঁকিবাজি। আজ তোর খালি গলায় গান না শুনে যাবই না আমি।
তুই একা শুনলে হবে রজত? আজ নদী আমাদের দুজনকেই একসঙ্গেই গান শোনাবে।
রজতের পিছনে দরজায় ঠেস মেরে দাঁড়িয়ে রোমাঞ্চিত হাসি দিয়ে অধিকারসুলভ ভঙ্গিতে বলল শ্রাবণ।
কিরে শ্রাবণ ভাবলাম ঘুমাচ্ছিস। আয় বোস।
বলল রজত।
আমি ঘুমিয়ে থাকলে তোর সুবিধা হতো নাকি বেশ? ফিচলে হেসে বলল শ্রাবণ।
রাজনীতি করা লোকদের এই এক বাজে দিক। এরা ইজিভাবে না কিছু বলতে পারে,না কিছু চিন্তা করতে পারে। এদের বাইরে ভিতরে সবই ডিপ্লোমেটিক।
তীর্যক হেসে বলল রজত।
ভালো বলছিস ব্রো। মে বি।
নদী শ্রাবণকে দেখেই ইতস্ততবোধ করলো। উঠে চলে যেতে লাগলো। পিছন দিয়ে হাতে টান পড়লো। মনে করলো রজত। কিন্তু ঘাড় ঘুরিয়ে দেখলো শ্রাবণের মুঠোবন্ধী তার নরম হাতখানা। শ্রাবণ নদীকে তাদের দুজনের মুখোমুখি সিঙ্গেল সোফায় বসিয়ে দিলো। নিজেও আয়েশ করে পায়ের উপর পা তুলে বসলো। নদীকে নির্দেশ দিয়ে বলল,
নদী, শুরু হোক একটা গান। তোর গান শুনেই আমরা তিনজন একসঙ্গে লাঞ্চ করবো।
ভাইয়া আমি এখন গাইতে পারব না গান। গলা দিয়ে সুর উঠবে না।
রজত নদীকে জোর করল না। হবু স্ত্রীকে জোর করা ঘোরতর অনুচিত হবে ভেবে চুপ রইলো। নয়তো নদী যদি বেঁকে বসে। যদি তাকে বিয়ে করতে রাজী না হয়।
শ্রাবণ উঠে গেলো উঠানের মাঝে। হেঁড়ে গলায় সুরমাকে শুনিয়ে বলল,
এই সুরমা, আমি পুকুরে যাচ্ছি গোসল করতে। এসেই ভাত খাবো। ক্ষুধা লাগছে।তোর হাতের কাজ শেষ করে দ্রুত।
ভাইজান সমস্যা নাই। আসেন আপনে। উঠান বাড়ি ঝাডু দিলেই আমার কাম খতম এই বেলার লাইগা।
গলা বাড়িয়ে উত্তরে বলল সুরমা।
ক্ষুধাটা মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছে। শ্রাবণ ঝটপট করে গোসল করে নিলো। পরনে তার তাওয়েলটা পেঁচিয়ে নিলো। আরেকটা তাওয়েল দিয়া মাথা মুছতে মুছতে উঠানে বরই গাছের ছায়ায় এসে দাঁড়ালো।
হঠাৎ করে তার কানে গানের সুর ভেসে এলো ঘরের ভিতর হতে।
” দূর হতে আমি তারে সাধিবো,
গোপনে বিরহডোরে বাঁধিব।
মায়াবনো বিহারীনি হরীনি,
গহন স্বপন সঞ্চারীনি,
কেন তারে ধরিবারে করি পণ,
অকারণ…”
শ্রাবণ নদীর কিন্নরী কন্ঠ শুনে যতটা না আপ্লুত হলো,তারচেয়ে অতিমাত্রায় রাগান্বিত হলো। নিজের রাগকে দমিয়ে নিলো নিমিষেই। নদী ও রজতের সামনে গেল না। বুঝতে দিল না সে যে শুনতে পেরেছে গান। সুরমা টেবিলে সব খাবার এনে দিলো। তারা তিনজন বসে একসঙ্গে খেলো। এরপর সুরমা মসলা চা বানালো। তিনজন চা খেলো।
বিকেলে শ্রাবণের মা বাবা বাড়িতে এলো। রজতকে দেখে তারা আনন্দিত হলো।
তোমাদের এতো লেট হলো কেন?
একদিন কাটিয়ে দিলে?
জিজ্ঞেস করলো শ্রাবণ।
সারথি বলল,
ইসসরে আমরা কি তোমার শ্বশুর বাড়ির আম জাম সব খেয়ে ফেলেছি নাকি? নানুদের বাড়িতে গিয়েছি না?
এই পাকনা বুড়ি? তোকে বলছি আমি?
রফিক দেওয়ান বলল,
তোর নানু অসুস্থ। তোর মা বলল,চলো দেখে আসি আব্বাকে। তাই গেলাম।
রজত কখন এলে?
মামা আমি দুপুরের আগেই এসেছি। ভাত খেলাম। চা খেলাম। চলে যেতাম। কিন্তু আপনাদের জন্যই অপেক্ষা করছি।
মোরশেদা বলল,
ভালো করছিস বাজান। সুখবরটা শুনে যা। শ্রাবণের জন্য পাত্রী পছন্দ করে এলাম। আলহামদুলিল্লাহ। এখন সময় সুযোগমতে তুইসহ গিয়েইতো আমরা এনগেজমেন্ট করবো।
বাহ! সহসা একটা আমোদ ফূর্তি করবার উপলক্ষ পাবো দেখা যাচ্ছে।
উৎফুল্ল স্বরে বলল রজত।
এর কিছুক্ষণ বাদেই রজত চলে গেলো নদী ও সবার থেকে বিদায় নিয়ে।
শ্রাবণ নদীকে বলল,
বিকেল হয়ে গেলো। সারথিকে নিয়ে বাড়িতে যা। তোর যা কিছু আছে সব নিয়ে একবারে চলে আয়। কাল সকালে তোর গানের ক্লাস আছে।
নদী অনুগত হয়ে তাই করলো। বাড়িতে গিয়ে সবকিছু নিয়ে চলে এলো। সারথির সাথে সে ঘুমালো রাতে। রাতে বিছানার ও গল্প বলার সঙ্গী পেয়ে সারথি দারুণ উচ্ছ্বসিত।
পরেরদিন ঘুমঘুম চোখে শ্রাবণ নদীকে বাইকে করে নিয়ে গেলো গানের স্কুলে। নদী বসতে পারছে না বলে বলল,
গতকালের মতো আমাকে ধরে বোস। বারবার যেন না বলে দিতে হয়। যখন থেকে সাপোর্ট লাগবে না,তখন একা বসিস নিজের মত করে।
শ্রাবণের কন্ঠ ভারী। রসকষহীন। রাতে বোধ হয় ভালো ঘুম হয়নি। তাই চোখ দুটো নেশাখোরের মতো লাল হয়ে আছে। নদী শ্রাবণের পেট পেঁচিয়ে ধরে বসলো। তাকে নামিয়ে দিয়ে শ্রাবণ
চলে গেলো বোর্ড অফিসে। সেখানে জরুরী মিটিং আছে কাঁচা রাস্তা মেরামত নিয়ে।
দুইঘন্টা পর ফিরে এসে নদীকে বাইকে তুলে নিলো শ্রাবণ।
বলল,
বাইক ছেড়ে দিলে একটা গান শুনাবি আমাকে। আস্তে করে গুনগুনিয়ে। কেবল আমিই শুনব। বাইরে হৈচৈ র শব্দে অচেনা কেউই শুনবে না। সুতরাং সংকোচ ফিল হওয়ার কোন কারণ নেই।
নদী নিচু মাথায় ভীত স্বরে বলল,
আমারতো আপনাকেই বেশ সংকোচ হয় বড় ভাইয়া।
শ্রাবণ খোলা রাস্তায় নদীর দুবাহুতে হাত দিয়ে জেদী কন্ঠে টেনে টেনে বলল,
তুই এখন বাইকে যেতে যেতে আমাকে একটা রোমান্টিক গান শুনাবি। ঠিক যেমনটি কাল রজতকে শুনিয়েছিস।
চলবে