চুপিসারে (১৮) #রেহানা_পুতুল

0
656

#চুপিসারে (১৮)
#রেহানা_পুতুল

অবিশ্বাস্য কিছু ঘটে যাওয়ায় নদী জ্ঞান হারিয়ে ফেলল। শ্রাবণের বুকে মাথা এলিয়ে ঢলে পড়লো।

নদীইই…এই নদীইই…কি হলো তোর? কথা বলছিস না কেন? প্লিজ কথা বল?
শ্রাবণ নদীকে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে বিড়বিড়িয়ে বলল,
বুঝলাম তুই আমার লাইফে একটা সিরিয়াস টাইপের আস্ত একটা অশান্তি। কেন যে উনি আমার হাড় দিয়ে তোকে সৃষ্টি করলো।

শ্রাবণ রুম থেকে বের হয়ে দাদীকে ডাকলো।
দাদী এদিকে আসো। দিলেতো আমার কাঁধে এক আপদ তুলে।

আপদ হইবো ক্যান। তোরে কামড় মারছে? চলতো দেহি।

তাদের সঙ্গে সারথি, আরুও রুমে প্রবেশ করলো। সুরমাও তাদের পিছন দিয়ে এলো। সে পিটপিট চোখে ডাক্তারের মতো নদীকে দেখলো। বলল,

হায় আল্লাহ! নদী আপাতো ফিট হইয়া রইলো। খাড়ান আমি যন্ত্র নিয়া আইতাছি।

এই বলে এক দৌড়ে সুরমা রান্নাঘরে চলে গেলো। একটা স্টিলের নাস্তার চামচ হাতে নিয়ে ফের দৌড়ে এলো শ্রাবণের রুমে।

ভাইজান এই চামচ নদী আপার দাঁতের পাটির ভিতরে দিয়া দেন। এইটা হলো টেস্ট নাম্বার ওয়ান।

আরু বলল, সুরমা আপা যেমন?

মানে নদী আপার যদি জ্ঞান থাকে ভিতরে, তাইলে দাঁত ফাঁক করন যাইবো। আর যদি দাঁত খিঁইচচা থাকে,চামচ না ঢুকান যায়, তাইলে বুঝা যাইবো পুরাই অজ্ঞান।

হাফসা বিবি বলল, তুই দুইটা লং নিয়া আয় তাত্তারি। সারথি এক ছুট দিয়ে গেলো রান্নাঘরে এবং তড়িতেই লবঙ্গ নিয়ে এলো। শ্রাবণ পায়ের উপর পা তুলে চোয়াল শক্ত করে বসে রইলো চেয়ারে। হাফসা বিবি ঝাঁঝযুক্ত দুইটা লবঙ্গ নদীর দুই নাকের সামনে ধরলো। তাতেও কোন কাজ হলো না।

আরু,সারথী একে অপরের দিকে মুখ চাওয়াচাওয়ি করলো। সবাই রুমের ভিতরে জড়ো হলো। মোরশেদা ছেলেকে বললেন,

এইসব ঘরোয়া টোটকায় কাজ হবে না। বাজারে যা। রুহুল ডাক্তাররে নিয়া আয়।

শ্রাবণ বেরিয়ে গেলো। মোরশেদার আদেশ পেয়ে সুরমা সরিষার তেলে রসুন থেঁতলে দিয়ে গরম করে নিয়ে এলো। নদীর হাতে পায়ে ঢলতে লাগলো। নদী হালকা নড়ে চড়ে উঠলো। শ্রাবণকে ফোন দিয়ে মানা করে দিলো তার মা।

বলল,
চলে আয় নদীর জ্ঞান ফিরছে।

শ্রাবণ এসে রুমে ঢুকলো। সুরমা তার কাজে বেরিয়ে গেলো। আরু ও সারথিও বেরিয়ে গেলো।

হাফসা বিবি বসে রইলো নদীর মাথার কাছে। শ্রাবণ দাদীর দিকে দৃষ্টি তাক করে বলল,
দেখলে তোমার নাতনি কি হয়রানি করাচ্ছে আমাকে।

হ দেখছি। তেল ঢলনে শরীর গরম হইলো,অমনি কাজ হইলো। হুঁশও আইলো নদীর।

তাহলে তুমি বাইরে যাও। ওর পুরাপুরি হুঁশ আসার জন্য শরীর ভালো করে গরম করে দিই। বলল শ্রাবণ।

বিতলামো থামা তুই। আচম্বিতে জীবনে তুফান আইসা পড়নে তাল সামলাইতে পারেনাই। তাই বেহুঁশ হইয়া গ্যালো নদী।

আদুরে কন্ঠে বলল হাফসা বিবি।

সে বেরিয়ে গেলে শ্রাবণ রুমের দরজা বন্ধ করে দিলো। নদীর পাশে চিৎ হয়ে শুয়ে পড়লো। ঘাড় কাত করে নদীকে একবার দেখলো। নদীও বিপরীত পাশের দিকে মুখ করে শুয়ে আছে। লজ্জায়,আড়ষ্টতায় তার বেহাল দশা। হৃৎপিণ্ডটা ধুকপুক করছে অস্বাভাবিক হারে। কি থেকে কি হয়ে গেলো দমকা হাওয়ার মতো। মাত্র কয়েক ঘন্টার ব্যবধানে কারো ঘরের ঘরনি হয়ে গেলো। অবিবাহিত শব্দটি তার অভিধান থেকে মুছে গেলো। বিবাহিত শব্দটা এঁটে গেলো তার জীবনে প্রতিটিক্ষণের জন্য। তার বুক ফেটে কান্না আসছে। নিজের অজান্তেই মৌনাকাশে রজত নামটা উঁকি দিলো ভোরের উদীয়মান সূর্যের মতো।

নদী মোচড় মেরে উঠে বসলো। বিছানা থেকে নেমে গেলো। শ্রাবণ তার সঙ্গে কোন কথা বলল না। নদীও কোন কথা বলল না। মুখ গোঁজ করে রুম থেকে বের হয়ে গেলো। শ্রাবণ নদীর অভিব্যক্তি লক্ষ্য করলো। পজেটিভের তুলনায় তার প্রতি নদীর নেগেটিভ ভাইব ইঙ্গিত দিচ্ছে বেশী।

সেদিন বিকেলে ঘর একা বলে নাহার বেগম বাড়ি চলে গেলো। আরু ও নীরুর স্কুল খোলা তাই তারাও চলে গেলো। হাফসা বেগমকে রেখে দিলো মোরশেদা।
রাতে সবাইর খাওয়া দাওয়ার পর্ব সেরে ঘুমাতে চলে গেলো। নদী সারথির রুমে বসে আছে। হাফসা বিবি নদীকে বললেন,

কিরে বাসর ঘরে যাসনা। তুই হইলি চেনা বউ। কেউ নিয়া দিয়া আইতে হইবো কেন?

দাদী আমি সারথির সঙ্গে ঘুমাবো। বাসর বাকি থাকুক।

ক্যান বাকি রইবি? তুই কি ল্যাদা? পিডার খাস?কুয়ারা করবি না। গা জ্বলে। স্বামীর কদর বুঝতে শিখ।

বিরক্তিকর স্বরে বলল হাফসা বিবি।

সারথি পাশ থেকে কুটকুট করে হাসতেছে।

রাত বেড়ে গভীর হয়ে যাচ্ছে। শ্রাবণ ফুলসজ্জায় বসে রইলো নদীর অপেক্ষায়। তার প্রতিক্ষার প্রহর যখন অস্বাভাবিক মাত্রায় বেড়ে যাচ্ছে। তখন সে নিজেই চলে এলো নদীকে খুঁজতে।
দেখলো নদী শুয়ে আছে সারথির পাশে। শ্রাবণ দাদীকে বলল,

তোমার নাতনি বললেই হতো যে,আমাকে কোলে করে নিতে হবে বাসরঘরে।

হাফসা বিবি ও সারথি নিরুত্তর। শ্রাবণ নদীকে পাঁজাকোলা করে নিজের কোলে তুলে নিলো। নদী হাত পা ছোঁড়াছুড়ি করতে লাগলো। শ্রাবণের পিঠে কিল ঘুষি মারতে লাগলো। শ্রাবণ রুমে ঢুকে নদীকে বিছানায় শুইয়ে দিলো। দরজা বন্ধ করে দিলো।
নদীর কাছে গিয়ে বসলো। নদী রাগে ফেটে যাচ্ছে বেলুনের মতো। শ্রাবণ নদীকে বলল,

এত ভং ধরিস কেন? বিয়ে তো ভাঙ্গলি তুই ভুয়া বদনাম রটিয়ে।

নদী ক্ষ্যাপা কুকুরের ন্যায় শ্রাবনের দিকে চাইলো।

চাইতে হবে না আমার দিকে। এটাই সত্যি। চেয়ারম্যানের সম্মানিত স্ত্রী হওয়াই ছিলো তোর কঠিন টার্গেট।

নদী হাতের মুঠি খামচে দিয়ে বলল,

যদি বলি আপনার বিয়ে দু দুবার আপনিই ভেঙ্গেছেন আমাকে বিয়ে করার জন্য।

শ্রাবণ হোহোহো করে ভিলেনের মতো করে হেসে উঠলো। বলল,

তাইনাকি মিসেস নদী। হাউ ফানি। ওক্কে মানলাম। যদি তাই হয় তাহলে আমি এখন তোমাকে নিংড়ে ফেলব। মানা নেইতো বধূ?

নদী সিরিয়াস মুডে অধিকারসুলভ কন্ঠে বলল,

খবরদার বলছি বড় ভাইয়া। আমাকে টাচ করবেন না। বিয়ে,বাসর এসবে আমার বিন্দুমাত্র আগ্রহ নেই। পড়াশোনা, গান,ক্যারিয়ার আমার কাছে বেশি ইম্পর্ট্যান্ট। যেহেতু বিয়েটা হয়েই গিয়েছে,আমি আপনাকে অস্বীকার করছি না। তবে কাউকে নিবিড়ভাবে পেতে হলে আগে তার হৃদয়ে স্থান করে নিতে হয়। মনে রাখবেন। তার আগে আমি আপনার সাথে বেড শেয়ারেও যাব না। গুড় নাইট।

নদী চলে গেলো সারথি’র রুমে ঘুমানোর জন্য। শ্রাবণ নদীকে আটকানোর চেষ্টা করল না। বিক্ষিপ্ত মেজাজ নিয়ে শ্রাবণ সব ফুলের লতাগুলো টেনে টেনে ছিঁড়ে নিলো। উপুড় হয়ে শুয়ে রইলো বিছানার মাঝ বরাবর।

পরেরদিন রফিক দেওয়ানের পরিবারে উৎসবমুখর পরিবেশ। বাড়ির আঙিনা জুড়ে একটা মিষ্টি আমেজ খেলা করছে। রান্নাঘরে নানাপদের রান্না নিয়ে হুলুস্থুল আয়োজন চলছে। যেহেতু বিয়েটা হুট করেই হয়েছে। তাই তিনি চান নিকটজন সবাই আসুক। বিয়ে উপলক্ষে তারা আতিথেয়তা গ্রহণ করুক। শ্রাবণের নানা, নানী, মামা, মামিরা সবাই এলো। দুই ফুফু ও তাদের ছেলেমেয়েরা এলো। রান্নাঘরের সামনের উঠানে পিঁড়িতে বসে পান চিবোচ্ছে হাফসা বিবি। মেয়ে নাতনিদের কাছে পেয়েই সরব হয়ে উঠলেন। বড় মেয়ে রাফিয়াকে জিজ্ঞেস করলেন,

কিরে রজত আইলো না? বাড়িত নাই? জামাই আইলো না ক্যান?

তোমার যে জামাই। বাদ দাও কথা। রজত সকালেই বাইর হইয়া গ্যাছে। কি জরুরী কাজ আছে নাকি। কাজ সাইরাই বিকালে এই বাড়িতে চইলা আইবো কইছে।

বিকেলে রজত এলো। সবাই তাকে দেখে হতবিহ্বল আশ্চর্যজনিত চোখে চেয়ে রইলো। কারণ তারপাশে মাথায় ওড়না পরিহিত একটি সুন্দর যুবতী মেয়ে দাঁড়ানো। সে মেয়েটিকে আদেশ করলো সবাইকে সালাম করতে। মেয়েটি মাধুর্যভরা হাসি দিয়ে সবাইকে সালাম দিলো। এবং সবাইকে মেয়েটির পরিচয় দিলো তার ফ্রেন্ড বলে।

রাফিয়ার সন্দেহ হলো পুত্রের উপরে। বুঝে নিলো এই মেয়েকেই হয়তো রজত বিয়ে করবে। আরুকে বিয়ে করবে না।
পুত্রের এহেন উদ্ভট কর্মকাণ্ডে রাফিয়া নাক সিঁটকে সরে গেলো। নলকূপের সামনে গিয়ে বসলো। বালতি থেকে পানি নিয়ে মাথার তালুতে ঢালতে লাগলো।

রজত মেয়েটিকে নিয়ে ড্রয়িংরুমে বসলো। অন্যকেউ ছিল না সেখানে। নদী রজতের সামনে এলো। রজত নদীর মাথায় টোকা মেরে,

কিরে ঢেউ, বিয়ে করে ফেললি শেষমেষ আমাদের চেয়ারম্যান সাহেবকে? আয় পরিচয় করিয়ে দিই। ও হচ্ছে শিখা। আমার ফিয়ন্সে। তোর হবু ভাবি।

নদী তব্দা খেয়ে গেলো। শেষ বিকেলের মরা রোদের মতো আচমকা নদীর মলিন মুখখানি আরো মলিন হয়ে উঠলো।

জানালা দিয়ে শ্রাবণ নদীর মুখচ্ছবির পরিবর্তনটা ধরতে পারলো। মনে মনে বলল,
নদী, এমন একদিন আসবে,তখন তুমি শুধু শ্রাবণ ঢলে ভেসে যাবে ।

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here