পথান্তরে_প্রিয়দর্শিনী #মম_সাহা পর্বঃ একুশ

0
298

#পথান্তরে_প্রিয়দর্শিনী
#মম_সাহা

পর্বঃ একুশ

আষাঢ়ের ঝিমিয়ে আসা সকাল জানান দিচ্ছে প্রকৃতি আঁধার করে ঝড় আসছে। চারদিক কাঁপিয়ে দিয়েছে বায়ু প্রবাহ। বড় বড় গাছপালা গুলোও বাতাসের তান্ডবে টিকতে না পেরে উত্তর দিকে হেলে যাচ্ছে। টিনের চালে শব্দ করে পাঁকা আম গুলো বাতাসে ঝড়ে পড়ছে। ফসলি খোলা জমিটাতে ছোট ছোট বাচ্চারা লাফাচ্ছে। তাদের শিশু মনে তুমুল বৃষ্টিতে ভেজার আকাঙ্খা জেগে উঠেছে। তাদের হাসি সেই আকাঙ্খার বহিঃপ্রকাশ। গোয়াল ঘর থেকে শব্দ করে গরু গুলো ডাকছে। খামার থেকে সাদা মুরগী গুলোর বিশৃঙ্খলা যুক্ত চিৎকার ভেসে আসছে। তারা হয়তো ঘনিয়ে আসা প্রকৃতির ভয়ঙ্কর তান্ডবের কথা ভেবে ভয় পাচ্ছে। গাছের শুকনো পাতা জমিনে লুটাচ্ছে। এ যেন প্রকৃতি অশান্ত রূপের বহিঃপ্রকাশ। গ্রামের বাড়ির চারদিক থেকে চিৎকার চেঁচামেচি ভেসে আসছে। কেউ জোড়ে জোড়ে “আল্লাহু আকবর” বলছে। কেউবা আজান দিচ্ছে। কারো কারো বাড়ির মন্দির থেকে তুমুল শঙ্খধ্বনির শব্দ ভেসে আসছে সাথে উলুধ্বনি ও ঘন্টার শব্দ। প্রকৃতির অশান্ত রূপ দেখে গ্রামবাসীরা ভয়ার্ত। বার বার টেলিভিশন থেকে ভেসে আসছে বিপদ সংকেত। এলাকাতেও মাইকিং করে চার নাম্বার বিপদ সংকেতের আভাস দেওয়া হয়েছে। কিন্তু এসব কিছুই দর্শিনীদের উঠোনো দাঁড়িয়ে থাকা মানুষ গুলোর কর্ণকুহরে পৌঁছাচ্ছে না। কারণ প্রকৃতিতে ঝড় আসার আগেই তাদের হৃদয়ে চলছে অনাকাঙ্খিত তান্ডব। বর্তমানের সবার উৎসুক, বিষ্মিত দৃষ্টি দর্শিনীর উপর নিবদ্ধ। দর্শিনী মাথা নিচু করে মোড়ায় বসে আছে। তার পাশে তার বাবা বসা। এছাড়া সবাই দাঁড়ানো। দর্শিনীর একটা কথা’ই যথেষ্ট ছিলো সবার ভাষা কেড়ে নিতে।

অনেকক্ষণ পর প্রতাপ সাহা কুড়িয়ে পেলেন শব্দ। গুছিয়ে নিলেন বাক্য। নিস্তব্ধতাকে কাঁপিয়ে দিয়ে গম্ভীর কণ্ঠে বললেন,
“এ কথা তুমি আগে কেনো বলোনি, মা? আমাদের কী জানার অধিকার ছিলো না এটা আগে?”

দর্শিনী নিজের দু’হাতের আঁজলে মুখ লুকিয়ে আছে। ক্ষণে ক্ষণে কেঁপে উঠছে তার শরীর। এক বিরহী, করুণ ক্রন্দনরত সুর জানান দিচ্ছে দর্শিনী কাঁদছে। কাঁদতে কাঁদতে রীতিমতো তার হেঁচকি উঠে গেছে। কেউ থামাচ্ছে না, কেউ বারণ করছে না। সবার নিরবতা দেখে দর্শিনীর কান্নার দাপট আরও বেড়েছে। বার বার তার মনে হচ্ছে,আজকেই এ বাড়িতে তার শেষ দিন। হয়তো মাথা গোঁজার যে ঠাঁই সে পেয়েছিলো তার গর্ভে ভূমিষ্ট হওয়া শিশুটার জন্য সে আশ্রয়স্থল সে হারাবে।

এই নিরবতা সবার কাছেই বিষাক্ত ঠেকছে। কারও মুখে কোনো রা নেই। উপস্থিত কেউ কেউ কথা বলতে চাচ্ছে কিন্তু কোথাও এক অদৃশ্য বাঁধার জন্য তারা তাদের অব্যক্ত অনুভূতি গুলো প্রকাশ করতে পারছে না। কি শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থা!

অবশেষে ভেসে এলো এক মহিলা কণ্ঠ। কণ্ঠের অধিকারিণী হলো এ বাড়ির কর্তী, নিধির মা- রমলা। তরতাজা, স্বাস্থ্যবান মহিলা। কপালে মোটা করে সিঁদুর দিয়ে ফোঁটা দেওয়া। লাল পেড়ে সাদা শাড়ি পড়া। চকচকে লাল রাঙা ব্লাউজ তার শরীরে। চুল গুলো এই মোটা খোপা করা। বয়সের কারণে দু একটা সাদা চুল অবশ্য দেখা যাচ্ছে। পান খেয়ে লাল হয়ে থাকা টকটকে ঠোঁট। চোখ-নাক কেমন ভাসা ভাসা। সৃষ্টিকর্তা যেন পরম মমতায় সৃষ্টি করেছেন এ নারীকে। এ বয়সেই সে পুরুষ জাতীর নজর কাড়তে ব্যস্ত তাহলে যৌবন কালে সে কেমন ছিলো তা নির্দ্বিধায় ধারণা করা যায়। ভারী শরীর নিয়ে মহিলা রান্নাঘরের দাওয়া থেকে উঠোনে পা রাখলেন। একমাত্র উপস্থিত এ মহিলার মুখেই কোনো বিষ্ময়,উৎসুকভাব ছিলো না।

মহিলা এগিয়ে দর্শিনীর সামনা-সামনি এসে দাঁড়ালেন। তারপর আশেপাশে সবার দিকে তাকিয়ে তার কনিষ্ঠা আঙ্গুলের চুন টুকু মোটা জারুল গাছের বাকলে মুছে ফেললেন। পানটা দু একটা চাবান দিয়ে দর্শিনীর দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করলেন। গম্ভীর কিন্তু শান্ত কণ্ঠে বললেন,
“কত মাস চলছে? চার সাড়ে চার তো হবেই মনে হচ্ছে।”

ভদ্রমহিলার কথার ধরণে সবাই তো অবাক হয়েছে সাথে দর্শিনীও কম অবাক হয় নি। সত্যিই তার সাড়ে চারমাস চলছে। কিন্তু উনি জানলেন কীভাবে?

সবার দৃষ্টির মানে বুঝে গেলেন বুদ্ধিমতী রমলা। খুব শীতলতা বজায় রেখেই বললেন,
“কী দর্শিনী, এমন প্রশ্নে অবাক হলে নাকি?”

দর্শিনী মাথা নাড়ালো, যার অর্থ সে অবাক হয়েছে। পরক্ষণেই দর্শিনী ক্ষীণ স্বরে বললো,
“আপনি কীভাবে সঠিক আন্দাজ করলেন মাসিমা?”

“আমি কীভাবে সঠিক আন্দাজ করেছি সেটা ভাবনার বিষয় না দর্শিনী। এমনকি এটা অবাক হওয়ারও বিষয় না। অবাক হওয়ার বিষয় এখানে বাকি মেয়ে মানুষ গুলা কীভাবে এতদিন তোমাকে দেখেও সেটা বুঝতে পারে নি। ব্যাটাছেলেদের কথা না-হয় বাদই দিলাম কিন্তু মেয়ে মানুষ এমন চোখের মাথা খায় কীভাবে তা ভাববার বিষয়। স্বভাবতই তুমি চিকন, ছিমছাম গড়নের মেয়ে। তাই তোমার পেট তত ফুলে নি কিন্তু শাড়ির উপর দিয়ে পেট ভালো বোঝা যায়। আর সাথে তোমার শরীরে গঠনও বদলিয়েছে। আগের মতন শুকনো লাগে না বরং গাল মুখ ভরা ভরা লাগে। স্বাভাবিক ভাবে গর্ভাবস্থায় এমন পরিবর্তন আসে। তাছাড়া আমরা আগের কার মেয়ে মানুষ, এই হাতে কত পোয়াতির চিকিৎসা করেছি। স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ছিলাম কিনা। কিন্তু তোমার পাশের তৃণা তারপর তোমার আরও দুই ডাক্তারও কীভাবে বুঝলো না! কী পাশ করে এরা ডাক্তার হয়েছে? আর তোমার মা, মানে বেয়াইন মেয়ের পরিবর্তন ধরতে পারলো না কেনো? অদ্ভুত!”

রমলার কাঠ কাঠ জবাবে নিরুত্তর দর্শিনীর মা। এবার নিপা মুখ খুললো। সন্দিহান কণ্ঠে বললো,
“আমার তো আগেই সন্দেহ হয়েছিল কিন্তু বলি নি। আমি কিছু বললে তো দোষ হয়ে যায়। তা মা, আপনি কিছু বুঝেন নি?”

সরলা এক ধ্যানে মেয়ের দিকে তাকিয়ে রইলো। কারো কোনো উত্তর দিলো না। কেবল মেয়ের দিকে তাকিয়ে যান্ত্রিক কন্ঠে বললেন,
“জামাই জানে না, তাই না দর্শিনী?”

দর্শিনীর হৃদপিণ্ড ছলাৎ করে উঠলো। সে মনে মনে হাজার বার চেয়েছিলো বিপ্রতীপের কথা যেন এখানে না উঠে। কিন্তু তার মা বরাবরই যেন তার বিপরীতে যেতে পছন্দ করেন। সেটাই আরেকবার প্রমাণ হলো।

“জামাইয়ের কথা এখানে কোনো তুলছো, সরলা? তুমি যা ভাবছো তা মাথা থেকে বের করে দেও। ও ছেলে এটা জানুক আর না জানুক আমার মেয়ে সেই নরকে পা দিবে না।”

প্রতাপের ভারিক্কি কথাতেও হেলদোল হলো না সরলার। বরং কণ্ঠের কাঠিন্যতা আরেকটু বাড়িয়ে বললো,
“তুই জামাইকে এটা জানাস নি তাই না? জানালে আমি নিশ্চিত যে এমন অঘটন ঘটতো না। তুই ইচ্ছে করে বিয়েটা ভেঙেছিস তাই না?”

দর্শিনী মাথা নিচু করে রাখলো। সব জিনিসের বিপরীত দিক বের করা যেন মা আর নিপা বৌদির বিশ্রী স্বভাব।

মৃত্যুঞ্জয় এতক্ষণ কেবল সবটা দেখেই গেলো। কিছু ক্ষণের জন্য তার মনে হয়েছিলো তার হাত-পা অবশ হয়ে গিয়েছিলো। অনেকটা সময় নিয়ে নিজেকে সে সামলালো। সে দর্শিনীকে ভালোবাসে, দর্শিনীর ভালো খারাপ সবটা নিয়েই সে তাকে ভালোবাসবেই। তাহলে সামান্য কারণে এমন দমে যাওয়ার তো কোনো কারণ নেই। দৃষ্টান্ত মৃত্যুঞ্জয়ের কাঁধে হাত রেখে আশ্বাস দিলো।

দর্শিনীর মা তার দিকে এগিয়ে আসতে নিলেই দর্শিনীর সামনে ঢাল হয়ে দাঁড়ায় মৃত্যুঞ্জয়। দর্শিনী রীতিমতো বিষ্মিত। হচ্ছেটা কী তার সাথে! দর্শিনীর ভাবনার মাঝেই মৃত্যুঞ্জয়ের দাঁত কিড়মিড় করা কথা ভেসে এলো,
“একদম প্রিয়দর্শিনীর শরীরে হাত দিবেন না কাকিমা। ও ছোট্ট নেই। অন্তত ওর ভিতরের প্রাণটার কথা ভেবেও এ ভুল করতে যাবেন না, কেমন? মা হয়ে আশ্রয়স্থল হোন, সেটা না পারলে হাত গুটিয়ে রাখুন কিন্তু তবুও ক্ষতির কারণ হবেন না।”

উপস্থিত সবাই বিষ্মিত। সরলা আগের জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে। পা তার আর চলছে না। কেবল একজনের চোখ হাসছে। সে চিন্তামুক্ত একটা শ্বাস ফেললো এটা ভেবে যে তার মেয়ের আরেকটা আশ্রয়স্থল তবে তৈরী হয়ে গিয়েছে। এবার বোধহয় অংকটা মিলবে।

দর্শিনীর বুক কাঁপলো। ঝড়ের বাতাস ছুঁয়ে দিলো তার শরীর। মনের মাঝে ভর করলো শীতলতা। হঠাৎ করেই তার ভালো লাগা শুরু করলো। এমনটা তো কখনো হয়নি। তবে কী বিপ্রতীপের করা কর্মকান্ড দর্শিনীর হৃদয় থেকে মুছে দেওয়ার জন্য নতুনের আবির্ভাব!

ভাবনার মাঝেই প্রকৃতি গর্জন করে উঠলো। বাহির থেকে মাইকিং এর শব্দ ভেসে এলো। মাইকিং করা লোকটা ভয়ার্ত কণ্ঠে সাবধান করছে, পাশের এলাকার বাঁধ ভেঙে গিয়েছে। বন্যা হওয়ার সম্ভাবনা। সবাই যেন সাবধানে থাকে।

#চলবে

[গঠনমূলক মন্তব্যকারীরদের নাম দেওয়া হবে আমাদের গ্রুপে]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here