উধয়রনী #লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ ||পর্ব-২৮||

0
627

#উধয়রনী
#লেখিকা_সামিয়া_বিনতে_হামিদ
||পর্ব-২৮||

৫৫।
গাড়িটা হাসপাতালের সামনে এসে থামতেই আফিফ ভাড়া মিটিয়ে আহির দিকে হাত এগিয়ে দিলো। আহি সেকেন্ড খানিক আফিফের দিকে তাকিয়ে রইলো। আফিফ ক্ষীণ কন্ঠে বললো,
“তোমার হাঁটতে অসুবিধে হচ্ছে, তাই!”

আহি আফিফের হাতটা শক্ত করে ধরলো। আজ এই হাতটা শুধু সাহায্যের জন্য এগিয়ে দেওয়া হয়েছে। যদি অধিকারের হাত হতো, আহি হয়তো কখনোই ছাড়তো না। আফিফ আহিকে পাঁজা কোলা করে নিয়ে হাসপাতালে ঢুকতেই একজন নার্স এসে একটা হুইলচেয়ার এগিয়ে দিলো। আফিফ আহিকে হুইলচেয়ারে বসিয়ে দিয়ে আহির নাম এন্ট্রি করলো। নার্স আহিকে একটা কেবিনে নিয়ে তার হাঁটু আর হাতে ব্যান্ডেজ করে দিলো। আফিফও এরপর ভেতরে এসে বসলো। কিছুক্ষণ পর ডাক্তার এসে আহিকে দেখে বলল,
“মানসিক চাপে আছেন আপনি?”

আহি ব্যস্ত হয়ে বলল, “না!”

এরপর আফিফের দিকে তাকালো। ডাক্তার আফিফকে জিজ্ঞেস করলো,
“আপনি উনার কে হোন?”

আফিফ আহির দিকে তাকালো। আহি বলল,
“আমার ফ্রেন্ডের হাসবেন্ড। আমি ঝর্ণার গিয়ে পিছলে পড়েছি, তাই আমাকে এখানে নিয়ে এসেছে।”

ডাক্তার ব্যথার ওষুধ লিখে দিয়ে বলল,
“ব্যথা না কমা পর্যন্ত খাবেন। আর একটা ওয়েনমেন্ট লিখে দিলাম, সেটা লাগাবেন যেখানে ব্যথা লেগেছে। আর আপনাকে দেখে মনে হচ্ছে, মানসিকভাবে সুস্থ নন। মানসিক চাপ নিবেন না।”

ডাক্তার চলে যেতেই আহি চুপ করে বসে রইলো। সেকেন্ড খানিক নীরবতা বিরাজ করলো রুমটিতে। আফিফ নীরবতা ভেঙে বলল,
“মানসিক চাপ কেন নিচ্ছো?”

আহি আফিফের প্রশ্নে চকিত দৃষ্টিতে তার দিকে তাকালো। আফিফ দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
“তুমি এখনো মুভ অন করতে পারো নি!”

আহি চুপ করে রইলো। আফিফ নিজেও আর কি বলবে বুঝতে পারছে না। আহি এবার মলিন মুখে উত্তর দিলো,
“পদ্ম যদি আপনার জীবনে অনেক পরে এসে থাকে, তাহলে সেদিন কেন আমাকে ফিরিয়ে দিয়েছিলেন? কেন একটা বারের জন্যও আমাকে দেখতে চান নি?”

আফিফ চুপ করে রইলো। আহি বলল,
“হয়তো আপনার উত্তর আমাকে মুক্তি দেবে।”

আফিফ মুখ ঘুরিয়ে বসলো। আহির চোখের দিকে তাকানোর সাহস পাচ্ছে না সে। আহি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
“এতোই যদি সমস্যা থাকে, তাহলে চিরকুটগুলো কেন গ্রহণ করেছিলেন? কেন ছিঁড়ে ফেলে দেন নি? কেন যত্নের সাথে বুক পকেটে রেখে দিতেন? যদি একবারের জন্য আপনার চোখে আমি বিরক্তি দেখতাম, চিরকুট তো বহুদূর, স্বপ্নও দেখতাম না। আমার অপেক্ষা, আশা এক রাতেই শেষ হয়ে গেলো। সেদিন আপনি আমাকে ফিরিয়ে দেওয়ার পর সেই আড়াইটা বছর আমার মনে আপনি একই স্থানে ছিলেন। অথচ আপনার জীবনে পদ্ম এসে গেছে।”

আফিফ হাত মুঠো করে বসে আছে। তার গলা কাঁপছে। সে কাঁপা কন্ঠে বললো,
“আমি তোমাকে ঘৃণা কর‍তে পারতাম, কিন্তু করি নি। তোমার জন্য আমি অনেক কিছু হারিয়েছি, আহি। এতোটুকুই বলবো, তোমাকে ভালোবাসার যোগ্যতা নেই আমার। যাকে ভালোবাসার যোগ্যতা আছে, তাকে ভালোবেসেছি। আমি খুব সাধারণ মানুষ। সাধারণ জীবন যাপন করি। আমার কোনো শত্রু নেই। শত্রু চাইও নি। এতো ক্ষমতা নেই যে শত্রুর মুখোমুখি দাঁড়াবো। আমি ছাড়া আমার মায়ের আর কেউ নেই। আমাকে ক্ষমা করে দিও যদি তোমাকে কষ্ট দিয়ে থাকি।”

আফিফ কথাগুলো বলেই উঠে চলে গেলো। আহি স্তব্ধ হয়ে বসে আছে তার জায়গায়। তার চোখটা লাল হয়ে গেছে। উজ্জ্বল শ্যামলা বর্ণের গালটা মরিচা রাঙা হয়ে গেছে। কাঁদলে নাকি অনেক মেয়েকেই সুন্দর লাগে। কিন্তু আহিকে সম্পূর্ণ ব্যতিক্রম মনে হয়। আহির ঠোঁটে হাসিই মানানসই। কিন্তু তার ভাগ্যটা বড়োই করুণ! হাসি তার ঠোঁটে বেশিক্ষণ দীর্ঘস্থায়ী হয় না। হাসলেও সেই হাসিতে প্রাণ থাকে না। কারণ তার প্রাণ তো সে অনেক আগেই হারিয়ে ফেলেছে।

(***)

আফিফ কেবিনের বাইরে এসে দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে দাঁড়ালো। জোরে জোরে বার-কয়েক শ্বাস ছাড়লো সে। পুরুষ মানুষ যেখানে সেখানে কাঁদতে পারে না। তাই আফিফ দ্রুত পায়ে হেঁটে করিডোরের অন্য প্রান্তে চলে গেলো। দেয়াল আঁকড়ে ধরলো শক্ত করে। তার চোখে অশ্রু টলমল করছে। পাশে একটা পানির কল ছিল। আফিফ পানি ছেড়ে মুখে পানির ছিঁটে দিলো।

এদিকে রাদ আর পদ্ম হাসপাতালে এসে পৌঁছাতে আহিকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লো। আহি পদ্মের গালে আলতো হাত রেখে বলল,
“তুই অনেক ভালো। তোর বরও অনেক ভালো। উনাকে ধন্যবাদ দিয়ে দিস আমার পক্ষ থেকে।”

পদ্ম এদিক-ওদিক তাকিয়ে আফিফকে খুঁজতে লাগলো। আহি বলল, “বাইরে গেছে।”

পদ্ম আহিকে রাদের সাথে একা ছেড়ে বেরিয়ে পড়লো। আহি রাদের হাত ধরে বলল,
“আমার উত্তর আমি পেয়ে গেছি, রাদ।”

“কীসের উত্তর?”

“আফিফ কেন আমাকে ফিরিয়ে দিয়েছিল!”

“কেন?”

“হয়তো জেনে গেছে আমি এই সমাজের এক অভিশপ্ত মানুষ।”

“কি বলছিস এসব?”

“আমার জন্য না-কি ও অনেক কিছু হারিয়েছে। আমার জন্য সবাই সব হারিয়ে ফেলে৷ এর চেয়ে বড় অভিশাপ আর কি হতে পারে? আমি যা স্পর্শ করতে যাবো, সেটাই ঝরে যাবে। আমার জন্য মা সব হারিয়েছে, লিনু তার বাবাকে হারিয়েছে। আফিফও হয়তো কিছু একটা হারিয়েছে। আমি বিশ্বাস করেছি ওর কথা। রাদ, আমি কেন বেঁচে আছি? না আমি শান্তি পাচ্ছি, না কাউকে শান্তি দিচ্ছি। মনে হয় আমাকে হারতে হবে। আমার ভবিষ্যৎ আমার চোখের সামনে। তাজওয়ারকে বিয়ে করে ওর কাছে হেরে যাওয়া। এরপর আমি আর আমার ভবিষ্যৎ অন্ধকার৷ দিনশেষে আমি অনেক টাকার মালিক হবো। সেই টাকা দিয়ে সব কিনে নিতে পারবো। শুধু ভালোবাসা আর সুখ কিনতে পারবো না।”

“এভাবে কেন বলছিস আহি? তাজওয়ারকে বিয়ে করতে হবে না তোর।”

আহি কান্না ভেজা কন্ঠে বললো,
“তুই দূরে থাকিস আমার থেকে। কখন তুইও সব হারিয়ে ফেলিস আমার জন্য। তোর ঘৃণা নিতে পারবো না আমি, রাদ।”

আহি ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো। রাদ আহিকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো। আহি কাঁদতে কাঁদতে বলল,
“আমি এমন এক অভিশপ্ত মানুষ যে পাপ না করেও পাপী। খুন না করেও খুনী।”

আফিফ আর পদ্ম কেবিনে ঢুকেই দেখলো আহি রাদকে জড়িয়ে ধরে কাঁদছে। পদ্ম বলল,
“কি হয়েছে তোর?”

আহি রাদকে সরিয়ে দিয়ে চোখের পানি মুছে ফেললো।রাদও চোখ মুছে আহির দিকে তাকালো। আহি মাথা নিচু করে রেখেছে। আফিফ পদ্মকে বলল,
“আমরা বের হই বরং।”

পদ্ম আফিফকে উদ্দেশ্য করে বলল, “একটু দাঁড়ান।”

পদ্ম এবার আহির কাছে এসে রাদকে জিজ্ঞেস করলো, “আহি কাঁদছে কেন?”

রাদ বলল,
“ওর বাসায় ঝামেলা হবে হয়তো এই এক্সিডেন্টের কথা শুনে তাই।”

পদ্ম আহির পাশে বসে বলল,
“আমাকে বল আহি, কি হয়েছে? কেমন বাসা তোর? কিসের ঝামেলা? আংকেল কি তোকে বুঝে না?”

আহি মলিন হেসে বলল,
“কেউ বুঝে না আমাকে। আমি কাউকে বোঝাতেও চাই না। ক্লান্ত হয়ে পড়েছি আমি। তুই চলে যা তোর বরকে নিয়ে। আমি রাদের সাথে আলাদাভাবে যাবো।”

“কিন্তু…”

রাদ পদ্মকে বলল,
“যদি আমাদের একটু সময় দেওয়া যেতো!”

পদ্ম রাদের দিকে তাকালো। এরপর আহির দিকে তাকিয়ে বলল,
“তোর পাশে আমি আছি। আমরা সবাই আছি। তোকে আমি বুঝবো। আর কেউ বুঝুক না বুঝুক।”

আহি পদ্মের গালে হাত রেখে বলল,
“তুই অনেক ভালো। পৃথিবীর সব সুখ তোকে ছুঁয়ে দিয়ে যাক। এখন যা। আমি রাদের সাথে থাকি।”

পদ্ম আর আফিফ বেরিয়ে গেলো। আফিফ বের হওয়ার আগে আহির দিকে একনজর তাকালো। আহি আফিফের দিকে তাকিয়ে মলিন হাসলো। সেই হাসি দেখেই আফিফের মনটা আরো ভারী হয়ে গেলো। তারা চলে যাওয়ার পর রাদ আহিকে নিয়ে হোটেলে চলে এলো।

(***)

একা একা সমুদ্রের তীরে হাঁটছে আফিফ। পদ্ম হিমছড়ি থেকে ফিরেই ঘুমে আচ্ছন্ন। কিন্তু তার চোখে ঘুম নেই। সমুদ্রের ঢেউ স্পর্শ করে দিচ্ছে আফিফের পা যুগল। সে তারা ভরা আকাশের দিকে তাকিয়ে বলল,
“খেয়াল, তোমাকে হয়তো তোমার মতো করে ভালোবাসিনি, কিন্তু যতোদিন ছিলে অনুভব করেছিলাম ঠিকই। না দেখে হয়তো এতোটা ভালোবাসা যায় না। তুমি যেদিন বাস্তবে এসেছিলে, সেদিন আমার মনে শুধুই পদ্মফুল ছিল। তাই তুমি আমার খেয়াল হয়েই রয়ে গেছো। তোমার চিঠিগুলো আমাকে বিরক্ত করতো না। আমি তো উত্তর দেওয়ারই ঠিকানা পাই নি। তাই নিজেই সব উত্তর লিখে রেখেছিলাম একটা ডায়েরীতে। পদ্মকে ভালোবাসার পর মনে হয়েছিল এই অনুভূতি রাখাটাই পদ্মের সাথে ছল করা হবে। তাই ডায়েরীটা ফেলে দিতে চেয়েছিলাম। কিন্তু সাহস হয় নি। ভাগ্যিস চিঠিতে আমার নাম লিখি নি। তাই ছবি আঁকার শেষ স্যালারি দিয়ে আমি একটা নামহীন বই বের করেছিলাম। যেটা সবার কাছে বই। শুধু আমার কাছে খেয়াল। বইটির নাম দিবো ভেবেছি। কিন্তু সেই অধিকার আমার নেই। কখনো হবেও না। আমি চাই তুমি ভালো থেকো। আমাকে ভুলে যাতে সুখী হতে পারো।”

আহি বিছানায় শুয়ে আছে। তার দৃষ্টি ফ্যানের দিকে। সে মনে মনে বলছে,
“আমি শরতের পত্রঝরা বৃক্ষ। হালকা হাওয়া লেগে ধীরে ধীরে আমার স্বপ্নগুলো ঝরে যাচ্ছে। কখন যে আমিই স্বপ্নহীন, হৃদয়হীন মানুষ হয়ে পড়ি! যদি হতে পারতাম, তাহলে এতো কষ্ট হতো না। বাবা, মিসেস লাবণি, তাজওয়ার কারোই তো হৃদয় আছে বলে মনে হয় না। কিন্তু তাদের দেখে মনে হয় বেশ সুখেই আছে। হৃদয়হীন, নিষ্ঠুর মানুষগুলো বেশি সুখী হয়। আমারও এবার হৃদয়হীনা হতে হবে। আমিও এরপর সুখী হবো।”

অন্যদিকে রাদ বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে। অন্ধকার আকাশের দিকে তাকিয়ে ভাবছে,
“আমি এমন এক ভোরের সূর্যের অপেক্ষায় আছি, যেই আলোতে আহির জীবনের কুয়াশাচ্ছন্ন অতীত মুছে যাবে। এমন এক উষ্ণ বায়ুর অপেক্ষায় আছি, যেই বায়ু আহির মনের সব শীতল অনুভূতিগুলোকে বিলীন করে দেবে। আমি আহির পাশে থাকতে পারবো কি পারবো না জানি না। কিন্তু যদি নাও পারি, আহিকে তার মনঃযুদ্ধে জয়ী দেখতে চাই।”

৫৬।

রাতে ছাদে ছোট একটা পার্টি রেখেছে আহি। হোটেলে উপস্থিত অতিথিরাও সেখানে এসেছে। সুইমিংপুলের উল্টোদিকে ছোট একটা মঞ্চ করা হয়েছে। ওখানে এসে অতিথিদের মধ্যে যাদের ইচ্ছে হবে, গান গাইবে। স্লো ডান্স করছে অনেকে। আহি চুপচাপ একপাশে বসে আছে। রাদ তার পাশেই বসে আছে। পদ্ম আর আফিফ নিজেদের মতো কথা বলছে। পুষ্প আর লাবীব কি খাবে, কি খাবে না সেটাই দেখছে। রাদ আহিকে বলল,
“এখন কেমন লাগছে তোর?”

আহি রাদের দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বলল,
“মনটা হালকা লাগছে। ভাবছি মনটাকে আরো হালকা করবো।”

“কীভাবে?”

রাদ প্রশ্ন করতেই হোটেল ম্যানেজার আহির কাছে এসে বলল,
“ম্যাম, সব ব্যবস্থা করে দিয়েছি।”

আহি বলল,
“জিনিসগুলো সুইমিংপুলের ওই পাশটাই রাখবেন। একটা আরামদায়ক চেয়ারও যাতে থাকে।”

“জ্বি ম্যাম।”

ম্যানেজার চলে যেতেই রাদ জিজ্ঞেস করলো,
“কি করবি তুই?”

আহি বলল,
“নিজেকে নতুন ভাবে আবিষ্কার করতে চাচ্ছি।”

আহি এবার উঠে দাঁড়ালো। ম্যানেজার তার হোটেলের বয়কে দেখিয়ে দিচ্ছে কোথায় কি রাখতে হবে। বয়টি সুইমিংপুলের পাশে একটা ইজেল রাখলো। পাশে একটা টুলের উপর ক্যানভাস আর কিছু রং আর বিভিন্ন প্রকারের তুলি। সাথে একটা বসার চেয়ার। আফিফ খেয়াল করলো এসব। সে ভ্রূ কুঁচকে সেই ইজেলটির দিকে তাকিয়ে আছে। তখনই আহি সেই জায়গায় গিয়ে বসলো। সে ধীরে ধীরে ইজেলটির উপর ক্যানভাসটি বসালো। পুরো ছাদে একবার চোখ বুলিয়ে নিলো। পছন্দ মতো রং বের করে একটার সাথে আরেকটা মেশালো। তারপর তুলি গুলো বের করে টুলের উপর ছড়িয়ে রাখলো। আহি এবার চোখ বন্ধ করলো। মনে মনে বলল,
“আজ আমি আবার নিজেকে নতুন করে খুঁজে পেতে চাই। তবে এবার গল্পটা আমার আর আফিফের হবে না। এবার গল্পটা আমার আর প্রকৃতির হবে। যেখানে আফিফ রাফাত একজন অতিথি পাখি। যে হুট করে এসেই আমার মনের অনেকাংশ দখল করে নিয়েছে। অনেকাংশ কেন বলছি? পুরোটাই তো দখল করে নিয়েছে। এখন আবার ঋতুর পরিবর্তনে সে উড়াল দিয়েছে তার ঠিকানায়। সে আমার জীবনে আসা এক অতিথি পাখি।”

আহি রং মাখিয়ে সাদা ক্যানভাস রাঙিয়ে দিচ্ছে। মনের সব জানালা খুলে দিয়ে সে ছবি আঁকছে। আজ এই তুলি কাউকে ভয় পেয়ে থেমে যাবে না। আজ সে ক্যানভাস ফুটিয়ে তুলবে তার শিল্পীর মনের কথায়।

(***)

ছবি আঁকা শেষে আহি ক্যানভাস থেকে চোখ সরিয়ে সামনে তাকালো। সামনে তাকাতেই দেখলো আফিফ আর পদ্ম সুইমিংপুলে পা ডুবিয়ে কথা বলছে। পদ্ম শক্ত করে আফিফের হাত আঁকড়ে ধরেছে। আহি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
“এই অধিকারটা আমার ভাগ্যে ছিল না। তুমি আমাকে তোমার জীবনের কোন অংশে স্থান দিয়েছিলে আমি জানি না। কিন্তু আমার কাছে সেই অংশটা ভালোবাসা মনে হয় নি। যদি সত্যিই ভালোবাসা হতো, তাহলে একবার হাত এগিয়ে দিয়ে দেখতে পারতে, আমি তোমার জন্য সবার সাথে যুদ্ধ করতাম। কিন্তু তুমি পালিয়ে গেছো। হয়তো এর পেছনে কোনো বড় কারণ ছিল। যাক, আমি তো আমার কষ্টদের মুক্ত করে দিয়েছি। দেখো আফিফ, আমি হাসছি। আমার এই হাসি আজ লোক দেখানো নয়। আমার মন হাসছে। জানি না কেন? হয়তো বেশি ধাক্কা খেয়ে ফেলেছি, তাই আর নিজেকে শক্ত করা ছাড়া উপায় ছিল না। আজ থেকে আমি সজ্ঞানে মেনে নিয়েছি, আমি যাকে ভালোবাসতাম, সে তুমি নও। সে তো রাতের আকাশে জেগে থাকা তারা। যেই তারা ভূমিতে দাঁড়িয়ে স্পর্শ করা অকল্পনীয়। আবার সেই তারাটিই একদিন বিলীন হয়ে গেলো মৃত তারাদের মাঝে।”

আহি চেয়ার ছেড়ে উঠে তার ক্যানভাসটি ইজেল থেকে নামালো। তারপর হাত ধুয়ে এসে দেখলো, কয়েকজন তার আঁকা ছবির আশেপাশে জটলা পাকিয়েছে। আহি ক্যানভাসটি হাতে নিয়ে বলল,
“ছবি কেমন হয়েছে?”

সবাই মাথা নাড়িয়ে আহিকে বলতে লাগলো,
“আপনি তো ভালো ছবি আঁকেন।”

আহি প্রতিত্তোরে বলল,
“অনেক বছর পর এঁকেছি। এতেই যদি এতো ভালো হয়, তাহলে দ্বিতীয়বার আমাকে হতাশ হতে হবে না।”

আহি সৌজন্যমূলক হাসি দিয়ে রাদকে ছবিটি দেখলো। রাদ হাতের ইশারায় বলল, “দারুন।”

আহি বলল,
“এটা আমার অতীত গল্পের সমাপ্তি চিত্র। এটা আমি নিজের কাছে রাখবো না।”

রাদ আহির কথায় ভ্রূ কুঁচকালো। আহি পেছন ফিরে আফিফ আর পদ্মের দিকে তাকালো। তারপর ঠোঁটে হাসি ঝুলিয়ে সেদিকেই পা বাড়ালো। আফিফ আহিকে আসতে দেখে পদ্মের হাত ছেড়ে দিলো। পদ্ম আহিকে দেখে বলল,
“আহি, ভীষণ সুন্দর করে সাজিয়েছে ছাদটা।”

আহি বলল,
“হুম। তোকে আর আফিফকে আমার পক্ষ থেকে একটা উপহার দিতে এসেছি।”

পদ্ম আর আফিফ উঠে দাঁড়ালো। আহি ছবিটি পদ্ম আর আফিফের দিকে ঘোরাতেই পদ্ম ঠোঁটে হাসি ফুটিয়ে বলল,
“বাহ, বেশ সুন্দর।”

আফিফ শান্ত দৃষ্টিতে ছবিটির দিকে তাকিয়ে রইলো। পদ্ম ছবিটি হাতে নিয়েই আহিকে জড়িয়ে ধরলো। আহি বলল,
“অনেকদিন পর নিজের প্রতিভা প্রকাশ করলাম। একটা সময় রং তুলি আমাকে অন্য জগতে নিয়ে গিয়েছিল। এবার ভাবছি, নতুন জগতে এই প্রতিভা থাকুক নতুনত্বের সাথে।”

পদ্ম আফিফের দিকে তাকিয়ে বলল,
“আমি বলেছি না আপনাকে, আহি অনেক ভালো ছবি আঁকে? দেখেছেন?”

আহি বলল,
“আফিফ, আমরা তো শুনেছি, আপনিও ভালো ছবি আঁকেন। তাহলে এখন আঁকেন না কেন?”

আফিফ ক্ষীণ কন্ঠে বললো, “সময় পাই না।”

“সময় করে নেবেন। নিজের প্রিয় কাজ নিজেকে যতোটা আনন্দ দেবে, আর কোনো কাজই সেই আনন্দ দেবে না।”

আহি পদ্মের থুতনিতে হাত রেখে বলল,
“কতো চমৎকার একটা মানুষ আপনার জীবনে এসেছে। তার স্বপ্ন পূরণ করুন। জীবনে শুধু টাকার পেছনে ছুটলে হয় না। স্বপ্নের পেছনেও ছুটতে হয়। দেখবেন, তখন টাকাটাও আপনার হাতে এসে ধরা দেবে।”

পদ্ম বলল,
“দেখেছেন, আহি আপনাকে ভালোই মোটিভেট করছে।”

পুষ্প পেছন থেকে এসে বলল,
“আহি কিন্তু সবাইকে অনেক মোটিভেট করে। ভাইয়া, আপনার প্রতিভা আমরা কখন দেখছি তাহলে? শুধুই তো শুনেছি আপনি ছবি আঁকেন। কখনো তো দেখি নি। আমাদের বান্ধবী দেখেছে কি-না তাও সন্দেহ।”

পদ্ম মুচকি হেসে বলল,
“দেখেছি তো। উনি আগে কতো ছবি এঁকেছেন, সব আছে। আর আমার সবচেয়ে ভালো লাগে কোনটা জানিস? সেই ছবিটা, যেটা নিয়ে ওদিন প্রশ্ন করেছিলাম!”

আফিফ পদ্মের কথায় থতমত খেয়ে গেলো। সে পদ্মকে থামিয়ে দিয়ে বলল,
“আমি চেষ্টা করবো ছবি আঁকার।”

এরপর আহির দিকে তাকিয়ে বলল,
“ধন্যবাদ এই ছবিটি উপহার দেওয়ার জন্য। তুমি ভীষণ ভালো ছবি আঁকতে পারো।”

পুষ্প ছবিটির দিকে তাকিয়ে বলল,
“আচ্ছা, ছবিটির নাম কি?”

আহি মুচকি হেসে বলল,
“অতিথি পাখির ঘরে ফেরা।”

আফিফ আহির কথা শুনে সেকেন্ড খানিক স্থির হয়ে তার দিকে তাকিয়ে রইলো। পুষ্পের কথায় তার ঘোর কাটলো। পুষ্প বলল,
“ঘরে কোথায় ফিরছে?”

আফিফ ছবিটি সরিয়ে নিয়ে বলল,
“কিছু ছবির অর্থ সবাই বুঝে না। যারা ছবি আঁকে তারাই বুঝে। দেখে অন্য কিছু মনে হলেও নামের সাথে ছবিটির বেশ মিল আছে। মানতেই হচ্ছে, আহি ভালো ছবি আঁকতে পারে।”

লাবীব বলল,
“আমাদের অর্থটা বুঝিয়ে দেবেন, ভাইয়া?”

আহি বলল,
“ধুর, সিলেবাসের বাইরে চলে যাচ্ছিস তোরা। আমার আঁকা ছবি নিয়ে তোদের রচনা লিখতে হবে না।”

(***)

আফিফ আহির আঁকা ছবিটি হোটেলে নিয়ে এলো। পদ্ম ওয়াশরুমে গেছে। এই সুযোগে ছবিটি ছুঁয়ে দেওয়া যায়, কিন্তু আফিফ ছবিটিতে হাত লাগালো না। রং নষ্ট হয়ে যাবে।
ভীষণ কষ্ট লুকিয়ে রেখেছে আহি এই ছবিতে। এই কষ্ট ছুঁয়ে দেওয়ার ক্ষমতা আফিফের নেই। ছবির একপাশে একটা ভাঙা দালান। সেই দালানের মূল দরজার রঙটা হলুদ। আর সেই হলুদ গেট ঘেঁষে লাগানো একটা বৃক্ষ। যেই বৃক্ষে একটি পাতাও নেই। পাশে একটা রাস্তা। যেটা কোথায় মিলিত হয়েছে বোঝা যাচ্ছে না। আর অন্যপাশে একটা ঝিল। যেই ছিলে একটি মাত্র পদ্মফুল উঁকি দিচ্ছে। বৃক্ষটির উপর একটা পাখি হয়তো বসে ছিল, সেটাই উড়াল দিয়ে নামছে ঝিলের দিকে। ছবি দেখে বুঝা যাচ্ছে, পাখিটি নামতে গিয়েই তার পাখার ঝাপটা লেগে গাছের শেষ পাতাটিও ঝরে পড়ছে।
আফিফ বুঝতে পারলো, এটা আহি আর তার জীবনের ক্ষুদ্র গল্প। সেই হলুদ গেটটি চারুশিল্পের গেট। যার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা গাছটি আহি নিজেই। সেই গাছে একদিন একটা অতিথি পাখি বসেছিল। যেই পাখিটি আফিফ। সেই গাছে কোনো প্রাণ নেই। কোনো স্বপ্ন নেই। একটাই স্বপ্ন ছিল, যেটা পাখিটা উড়ে যেতেই ঝরে পড়লো। আর সেই স্বপ্নটা ছিল ঝরে পড়া পাতাটি। অন্যদিকে রাস্তাটি হচ্ছে তাদের গন্তব্যহীন পথ। আর ঝিলটি আফিফের সংসার। পদ্মফুলটি পদ্মের প্রতিচ্ছবি। এক কথায় অতিথি পাখির ঘরে ফেরা ছবিটির মূল অর্থ, আফিফ তার সংসারে ডুব দিয়েছে আহির স্বপ্ন ভেঙে দিয়ে।

আফিফ শার্টের হাতায় চোখ মুছে নিলো। এই ভালোবাসা গ্রহণ করার ক্ষমতা কেন সৃষ্টিকর্তা তাকে দেয় নি, সে জানে না।

এদিকে আহি রাতে ছাদে একা একাই বসে ছিল। কিছুক্ষণ পর রাদ এসে আহির পাশে বসলো। নীরবতা ভেঙে রাদ বলল,
“জীবনটা নতুন করে কবে শুরু করবি? কখন সেই মানুষটাকে ভালোবাসা ছাড়বি?”

আহি হালকা হেসে বলল,
“আমি ভালোবাসতাম তাকে, ভালোবাসি এখনো, যতোদিন বেঁচে আছি তাকেই ভালোবাসবো। তবে এবার আমার ভালোবাসা আমার মনটা ভেঙে দিবে না। আমাকে মুক্তি দিবে। আমি ভালোবাসি বলেই তো ভালোবাসাকে মুক্ত করে দিচ্ছি। চাইলে কি পারতাম না, আমার ভালোবাসা ছিনিয়ে নিতে? কিন্তু কেন করব? এখানে তো আমারই ক্ষতি।”

আহি এবার নিজের হাতের রেখার দিকে তাকিয়ে বলল,
“ভাগ্যে কি আছে আমি জানি না। জানতে চাইও না। কিন্তু আমি ভালো থাকবো, এটা ভেবে যে, আমি দিনশেষে আমার ভালোবাসাকে হারতে দেই নি। পৃথিবীর কাছে আমি আমার ভালোবাসাকে কলঙ্কিত করি নি। আমার প্রিয় মানুষটাকে প্রতারক হতে দেই নি। আমার ভালোবাসা আমার কাছে মিষ্টি এক অনুভূতি। আর আফিফ আমার কাছে শ্রেষ্ঠ পুরুষ। আমি এই দু’টোকে কলুষিত করতে পারবো না। তাই মুক্ত করে দিয়েছি দু’টোকেই। প্রকৃতি যদি চাইতো তাহলে আমি তাকে হারাতাম না। আমাদের এক হওয়ার থাকলে, এতো অপেক্ষাও করতে হতো না। যদি সে আমার হয়, তাহলে হবেই। কিন্তু আমি হারবো না। তার বিবেককেও আমি হারতে দেবো না। পৃথিবী জানবে এক উন্মাদ প্রেমিকা তার প্রেমিককে বাঁচিয়েছে তাকে ত্যাগ করে। সুন্দর না আমার প্রেমের গল্পটা?”

চলবে-

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here