#খোলা_জানালার_দক্ষিণে
#পর্ব_৪৩
#লেখিকা_Fabiha_bushra_nimu
অর্ধবুজা আঁখিযুগল নিয়ে মুনতাসিমের দিকে দৃষ্টিপাত করে আছে মেহেভীন। দীর্ঘ সময় অতিবাহিত হয়ে গিয়েছে। মুনতাসিম কক্ষে এসে টাকা গুনছে। দু’জনের মাঝে পিনপতন নিরবতা বিরাজ করছে। মেহেভীন নিদ্রায় তলিয়ে যেতে চাইলেই, মেহেভীনের হাত ধরে তুলে বসিয়ে দিচ্ছে মুনতাসিম। বিরক্ততে ললাটে কয়েক জোড়া ভাজ পড়লো মেহেভীনের। মেহেভীন দেওয়ালের সাথে মস্তক ঠেকিয়ে আঁখিযুগল বন্ধ করল। তখনই কর্ণকুহরে এসে মুনতাসিনের কণ্ঠ স্বর পৌঁছাল। মেহেভীন আঁখিযুগল মেলে মুনতাসিমের দিকে দৃষ্টিপাত করল।
–এই নিন দেনমোহরের টাকা। এগুলো আমার কালকেই বুঝিয়ে দেওয়া উচিৎ ছিল। আমি সময় মতো দিতে পারিনি। তার জন্য আমি আন্তরিক ভাবে দুঃখিত। এগুলো গ্রহণ করুন আর আমার পরিস্থিতির কথা বিবেচনা করে, মনের অন্তরালে কোনো অভিযোগ রাখবেন না।
–এগুলো কি আমি চেয়েছি? এগুলো তো পরে-ও দিতে পারতেন। আজ কয়েকটা দিন হলো আমার ঘুম হয়নি ভালো করে। আমাকে ঘুমোতে দিলেই পারতেন।
–এগুলো চাইতে হবে কেন? এগুলো আপনার প্রাপ্য অধিকার। সেটা যথাযথ ভাবে আপনার হাতে তুলে দেওয়া আমার দায়িত্ব। এবার টাকা গুলো সব গুনে নিন দেখুন তো সবকিছু ঠিকঠাক আছে কি না?
–গুনতে হবে না রেখে দিন আপনি।
–টাকা-পয়সার ব্যাপার টা ভিষণ খারাপ ম্যাডাম। আপনার যতই কাছের মানুষ হোক না কেন? আপনি সর্বদা টাকা-পয়সা লেনদেন করার সময় গুনে নিবেন।
–এখন নিজের জীবন বাঁচানো বাদ দিয়ে টাকা গুনতে শুরু করব! পরে দেখা গেল টাকা গুনতে গুনতে আমি ক’ব’রে চলে গিয়েছি। মেহেভীনের একটা বাক্য মুনতাসিমের হৃদয় কাঁপিয়ে তুলল। অজানা যন্ত্রনায় ভেতরটা ছটফট করছে। বিষণ্ণ আঁখিযুগল মেহেভীনের দিকে দৃষ্টিপাত করে আছে। মুনতাসিমের বিষন্ন মাখা মুখশ্রীর দিকে দৃষ্টি পড়তেই মেহেভীনের নিদ্রা উবে গেল। সে আন্দাজ করতে পারছে মুনতাসিম রেগে গিয়েছে। মানুষটা তার সাথে রেগে গেলে একদম নিশ্চুপ হয়ে যায়। মেহেভীন মনে কিছুটা ভয় আর বাহিরে স্বাভাবিক মুখভঙ্গি করে মুনতাসিমের হাত থেকে দ্রুত টাকা গুলো নিয়ে নিল। সেগুলো নিজের ব্যাগে রেখে এসে বলল,
–আমি সকালে টাকা গুলো গুনে নিব। আজকে ঘুমাই টাকা কম পেলে জানাব। কথা গুলো বলেই মেহেভীনের আস্তরণের এক কোণে গিয়ে শুয়ে পড়লো। কাল রাতে নতুন জায়গায় তার ঘুম আসছিল না। আজ হঠাৎ মুনতাসিমকে দেখে রাজ্যের সমস্ত নিদ্রা এসে তার আঁখিযুগলে ধরা দিয়েছে। কিন্তু মুনতাসিমের বিষণ্ণ মুখশ্রী ভিষণ পোড়াচ্ছ তাকে। মুনতাসিম কক্ষের আলো নিভিয়ে নিজেও শুয়ে পড়লো। সে ঘন ঘন শ্বাস ফেলছে। মৃত্যুর মতো চিরন্তন সুন্দর সত্য ধরনীর বুকে দু’টো নেই। মৃত্যু হবে জেনেও আমরা ভালোবাসি। মৃত্যুর কাছে ভালোবাসার হার নিশ্চিত জেনেও, আমরা প্রিয়জনকে হারাতে ভয় পাই। প্রিয়জনকে আঁকড়ে ধরে রাখার বিথা চেষ্টা করি। প্রিয়জনের মৃত্যুর কথা কর্ণপাত হতেই আমাদের সর্বাঙ্গ কেঁপে উঠে। চিরন্তন সত্যটা মেনে নিতে বুকের ভেতরটায় অসহনীয় জ্বালা পোড়া করে। মনের গহীনে হাহাকার করে ওঠে। প্রিয়জন হারানোর ভয় মানুষকে নিরব করে তোলে। মনের অজান্তেই দীর্ঘশ্বাস বেড়িয়ে এল মুনতাসিমের। আগে যে মানুষটা মৃত্যুর পরোয়া কোনোদিন করেনি। বিপদ হবে জেনেও সেই সকল স্থানে গিয়েছে। যার না ছিল কোনো পিছুটান। আজ সেই মানুষটা কাউকে হারানোর ভয়ে কাবু হয়ে গিয়েছে। মেহেভীনের বলা বাক্য গুলো স্মরন হতেই ভেতরটা ভিষণ জ্বালাপোড়া করছে। মেহেভীনকে দু’টো কড়া কথা শুনিয়ে দিতে ইচ্ছে করছে। এত সুন্দর মুহূর্তটাকে বিষিয়ে না তুললেই হতো না। ক্রোধে চোয়াল শক্ত হয়ে এল তার। দু-হাত মুষ্টিবদ্ধ করে ক্রোধ নিয়ন্ত্রণ করছে। মুনতাসিমের জোরে জোরে শ্বাস নেওয়ার শব্দ মেহেভীন অনুভব করতে পারছে। জড়তার কারণে মুখশ্রী দিয়ে কোনো বাক্য উচ্চারন হচ্ছে না। দু’জন দুই দ্বিপের ন্যায় উল্টো দিকে শায়িত আছে। পিনপতন নিরবতার দেওয়াল ভেঙে মেহেভীন বলল,
–আপনি আমার কথায় রাগ করেছেন?
–না।
–আমি আসলে মজা করে বলেছি। আপনি সিরিয়ালি নিয়ে নিবেন ভাবতে পারিনি! তাছাড়া সবাইকেই তো একদিন চলে যেতে হবে। এটা বললে রাগ করার কি আছে?
–আপনার ঘুম পেয়েছে, আপনি ঘুমান। মেহেভীন কোনো বাক্য উচ্চারন করল না। কয়েকদিন ধরে কায়ার ওপর দিয়ে ভিষণ ধকল গিয়েছে। কিছু সময়ের ব্যবধানে মেহেভীন নিদ্রা দেশে তলিয়ে গেল। মেহেভীন নিদ্রা যাওয়ার কিছুক্ষণ পর মুনতাসিম ও নিদ্রা চলে গেল।
প্রভাতের আলো চারিদিকে ছড়িয়ে পড়েছে। গাছের মগড়াল থেকে পাখির কিচিরমিচির শব্দ কর্ণকুহরে ভেসে আসছে। সেই শব্দে নিদ্রা ভেঙে যায় মেহেভীনের। এত পাখি এল কোথায় থেকে? কর্ণ একদম ঝালাপালা করে দিল। মেহেভীন আঁখিযুগল মেলতেই মুনতাসিমের স্নিগ্ধ মুখশ্রী খুব কাছ থেকে দেখতে পেল। সে অনুভব করল কারো শক্ত হাতের বাঁধনে সে আবদ্ধ রয়েছে। মুনতাসিম তাকে আষ্ঠেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরে নিশ্চিন্তে ঘুমোচ্ছে। মুনতাসিমকে এত কাছে থেকে দেখে, মেহেভীনের হৃদস্পন্দনের গতিবেগ অস্বাভাবিক ভাবে বেড়ে গেল। অদ্ভুত এক ভালো লাগার সংমিশ্রণের ভেতরটা সুখানুভূতিতে পরিপূর্ণ হয়ে উঠেছে। মুনতাসিমের অবাধ্য কেশ গুলো ললাটে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। মেহেভীন এক হাত বের করে সেগুলো যত্ন সহকারে সরিয়ে দিল। আচমকা মুনতাসিম আঁখিযুগল মেলে তাকালো। আকষ্মিক ঘটনায় মেহেভীন থতমত খেয়ে গেল। সে বিলম্ব না করে দ্রুত আঁখিযুগল বন্ধ করে নিল। মুনতাসিম ঘুম জড়ানো কণ্ঠে বলল,
–আপনার অভ্যাসটা ভিষণ খারাপ! এভাবে আঁখিযুগল দিয়ে ঘুমন্ত মানুষের সর্বনাশ করছেন৷ আপনি জানেন না। আমার বউ আছে। এখন আমি আমার বউয়ের সামনে মুখ দেখাব কি করে? আর অভিনয় করে লাভ নেই। আমি দেখেছি আপনি সজাগ হয়েছেন। মুনতাসিমের কথায় মেহেভীন গম্ভীর দৃষ্টিতে মুনতাসিমের দিকে দৃষ্টিপাত করল। সে কণ্ঠে গম্ভীরতা বজায় রেখে বলল,
–আমাকে জড়িয়ে ধরে শুয়ে আছেন কেন? আমাকে জড়িয়ে ধরার আগে বউয়ের কথা মনে পড়েনি? আমাকে ছাড়ুন বলছি!
–কে বলেছে আমি জড়িয়ে ধরেছি? আমার মতো মানুষ কোনো নারীকে জড়িয়ে ধরতেই পারে না! আপনি রাতে আমার কাছে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরেছেন।
–মিথ্যা কথা, আমার কাউকে জড়িয়ে ধরার অভ্যাস নেই।
–কিন্তু আমার আছে। কোলবালিশ ভেবে ধরে ফেলেছি। এত ভাব নেওয়ার কিছু নেই। এমনিতেই আপনাকে ছোঁয়ার ইচ্ছে আমার নেই।
–অথচ আমাকে ছুঁয়ে আছেন! হাত সরান আমি বাড়ি যাব। মেহেভীনের কথায় মুনতাসিমের আঁখিযুগল বিস্ময় হয়ে গেল। সে সহজ-সরল মুখভঙ্গি করে জবাব দিল,
–আমার রাগিনীর রাগ আমার ভিষণ প্রিয়। রাগিনীকে রাগাতে আমি ভিষণ আনন্দ পাই। রাগিনী রাগ করলে সমস্ত মুখশ্রী রক্তিম বর্ন ধারণ করে, তখন আমার রাগিনীকে এত্ত গুলো ভালোবেসে দিতে ইচ্ছে করে। আপনি রাগ করছেন কেন? আমি তো আপনার সাথে মজা করছিলাম৷ তাই বলে আপনি আমাকে বাপের বাড়ি চলে যাওয়ার হুমকি দেখাবেন!
–আমি আপনাকে হুমকি দেখাচ্ছি না। আপনি কালকে মাকে কি বলেছিলেন? সেটা আপনার মনে নেই! মুনতাসিম নিষ্পলক চাহনিতে মেহেভীনের দিকে দৃষ্টিপাত করে আছে। মুনতাসিমের আঁখিযুগল জুড়ে আজ শুধুই মুগ্ধতা। সুখ গুলো আর মুনতাসিমের হৃদয়ে ধরা দিয়েছে। আজ বিষাদ সুখকে নয় সুখে বিষাদকে ভালোবাসার চাদরে মুড়িয়ে ফেলছে। ধরনীর বুকে নিজেকে সবচেয়ে সুখী মানুষ বলে হচ্ছে মুনতাসিমের। সে প্রসন্ন মন নিয়ে মেহেভীনকে বলল,
–পাশ ফিরলেই আপনাকে দেখতে পাব। এমন একটা দিনের জন্য আমি কতগুলো প্রহর অপেক্ষা করেছি। আমার অপেক্ষার ফল সার্থক হয়েছে। ধমনীর বুকে সবচেয়ে সুখী মানুষটা হচ্ছে আমি। আপনাকে দেখলে আমার ভেতরের দুঃখ গুলো বিলুপ্ত হয়ে যায়। এই যে আপনি আমায় সুখ এনে গুলো দিলেন। এই সুখ কোনো কেঁড়ে নিয়েন না। যদি কখনো আমার প্রতি কোনো অভিযোগ আসে মনে, তবে নির্দ্বিধায় বলে দিবেন। আমি অভিযোগ করার সুযোগ রাখতে দিব না। আপনি আমার পাশে থাকলে, আমি আপনাকে হৃদয়ের গুপ্ত কুঠুরিতে আগলে রাখব। আমি কখনোই চাইনি আমাদের মাঝে প্রেম হোক। কারন প্রেমে বিচ্ছেদ হয়। আমি সব সময় চেয়েছি আপনি আমায় ভালোবাসুন। আমার মায়ায় জড়িয়ে যান। ভালোবাসায় কখনো বিচ্ছেদ হয় না। আর মায়া কখনো কাটানো যায় না। আমি আপনাকে হালাল ভাবে চেয়েছি বলেই আপনার থেকে দুরত্ব বজায় রেখে চলেছি, কারন হারামে আরাম নেই। সেজন্য বোধহয় আমাদের মাঝে মনমালিন্য হতো। আমি একদম বিয়ের দিন আপনার সামনে দাঁড়াতে চেয়েছিলাম। কিন্তু আপনার বিপদের কথা শুনে স্থির থাকতে পারিনি। বিয়ের মতো সুন্দর আর পবিত্র জিনিস দু’টো নেই। যখন থেকে কবুল বলেছেন। আমাকে স্বামী হিসেবে গ্রহণ করেছেন। তখন থেকেই আপনার আঁখিযুগলে আমার জন্য মুগ্ধতা দেখেছি। আগে আমি রাগ করলে কষ্ট পেলে আপনাকে দ্বিগুন যন্ত্রণায় ছটফট করতে দেখিনি। কিন্তু কালকে আমি আপনাকে আমার জন্য ভয়ংকর ভাবে পুড়তে দেখেছি৷ এরপরেও আপনার প্রতি আমার রাগ জমে থাকতে পারবে? আপনাকে আঁকড়ে ধরে বাঁচার ইচ্ছেটা যে আরো দ্বিগুন ভাবে বেড়ে গেল ম্যাডাম। এতক্ষণ মুনতাসিমের কথা গুলো মনযোগ দিয়ে শুনছিল মেহেভীন। আজকাল মুনতাসিমের সবকিছুই তার ভালো লাগে। কবুল বলার পর থেকে আলাদা একটা টান তৈরি হয়েছে মুনতাসিমের প্রতি। যেটা আগে তার কখনোই ছিল না। হালাল জিনিস হোক বা সম্পর্ক সেটা সব সময় সুন্দর হয়। তা মেহেভীন বিয়ের পর থেকেই উপলব্ধি করতে পারছে। মেহেভীনের মুখশ্রীতে স্নিগ্ধতা ছড়িয়ে পড়েছে। মেহেভীন নরম কণ্ঠে বলল,
–আপনি অনেক সুন্দর কথা বলতে পারেন। এভাবে সবার সাথে কথা বললে, প্রতিটি মানুষ আপনার ওপর দুর্বল হয়ে পড়বে। সত্যি করে বলুন কতজনকে এভাবে গিলিয়েছেন? আল্লাহ তায়ালা আপনাকে দারুন একটা ক্ষমতা দিয়েছে। আপনি খুব সহজে মানুষের মনের গভীরে চলে যেতে পারেন।
–আপনার মনের গভীরে কতটা গিয়েছি ম্যাডাম?
–মনের গভীরে তো দূর মনের ধারে কাছেও আসতে পারেন নি স্যার। এবার উঠে তৈরি হয়ে নিন৷ সবাই বলবে নতুন বউয়ের লজ্জা নেই। কত বেলা হয়ে গিয়েছে এখনো ঘুমোচ্ছে। মায়ের কাছে যাওয়ার জন্য মনটা ভিষণ ছটফট করছে।
–আমার কাছে থাকতে ভালো লাগছে না? মেহেভীন উত্তর দিল না৷ মুহুর্তের মধ্যে মেহেভীনের মুখশ্রী মলিনতায় ছেয়ে গেল। মেহেভীনের মলিন মুখশ্রীর দিকে দৃষ্টিপাত করে মুনতাসিম বলল,
–আমি নিয়ে যাব। তবে আমার একটা শর্ত আছে।
–কি শর্ত?
–আপনি দু’দিনের বেশি থাকতে পারবেন না।
–কেন? আমি তো ভাবছি সাতদিন থাকব। আমাদের দু’জনের গৃহের দুরত্ব তো খুব একটা বেশি না!
–তাহলে যেতেই দিব না। আমি বউ ছাড়া থাকতে পারব না।
–এতদিন কিভাবে থেকেছেন?
–এতদিন বউ ছিল না। এখন বউ হয়েছে। আগেকার ব্যাপার আর এখনকার ব্যাপারের অনেক তফাৎ আছে।
–বিয়ে করার সাথে সাথে আপনার মস্তকটাও গিয়েছে। কেমন ছোট বাচ্চাদের মতো আরচণ করছেন! কথা গুলো বলেই মেহেভীন উঠে ফ্রেশ হতে চলে গেল। মুনতাসিম কম্বল মুড়ি দিয়ে মুখশ্রী ঢেকে ফেলল। আজকে তার কিছুতেই আস্তরণ ছাড়তে ইচ্ছে করছে না। দীর্ঘদিন পরে সে প্রশান্তিতে ঘুমিয়েছি। ভেতরটা আজ আনন্দে মনের শহরের অলিতে-গলিতে মিছিল করছে।
আজ চারদিন হলো মেহেভীন মায়ের কাছে এসেছে। মাকে একা ছেড়ে যেতে ইচ্ছে করছে না। এদিকে মুনতাসিম ও রাগ করে আছে। রাইমা বেগম বুঝিয়ে বলাতে মেহেভীন আজকে চলে যাবে। মায়ের কোলে মস্তক রেখে মেহেভীন শায়িত আছে। রাইমা বেগম মেহেভীনের মস্তকে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে।
–আব্বু থাকলে দু’দিন আগেই চলে যেতাম। আব্বু নেই সেজন্য তোমাকে একা রেখে যেতে ভয় লাগছে আমার৷ এদিকে উনিও রাগ করে আছেন। আজকাল উনি রাগ করলে, কষ্ট পেলে আমার ভেতরটা ভিষণ পুড়ে জানো আম্মু। আমি সহ্য করতে পারি না৷ উনি ভালো থাকলে আমিও ভালো থাকি। উনার রাগের কাছে হার মেনেই যেতে রাজি হয়েছি। আরো তিনটা দিন থাকার ইচ্ছে ছিল। রাইমা বেগম মেয়ের কথায় মুচকি হাসলেন৷
–স্বামী জিনিস হচ্ছে আল্লাহর দেওয়া শ্রেষ্ঠ উপহার। তাকে ভালোবাসতে জানলেই তার ভালো থাকা, খারাপ থাকার ওপরে নির্ভর করে স্ত্রীর ভালো থাকা, খারাপ থাকা। সেখানে ভালোবাসা আছে। সেখানে কষ্ট থাকবে স্বাভাবিক। ভালোবাসলেই পুড়তে হবে। ভালোবাসার পরে-ও যদি কেউ না পুড়ে। তাহলে সেখানে কখনোই ভালোবাসা ছিল না। মুনতাসিম ছেলেটা ভিষণ ভালো।ছেলেটাকে ভালোবাসার চাদরে মুড়িয়ে রাখিস৷ নিজের সবটুকু দিয়ে আগলে রাখিস৷ ধরনীর সবচেয়ে সুখী আর ভাগবতী নারীটি হবি তুমি। মুনতাসিমের মনটা রাজার মতো। আমি জানি সে তোকে রানীর মতো করে রাখবে। বিয়ের মতো পবিত্র জিনিসটা এমনই হয়। যার প্রতি কোনোদিন কোনো টান ছিল না৷ সে ভালো থাকলেই কি বা খারাপ থাকলেই কি? তাতে আমাদের কোনো যায় আসত না। বিয়ের মতো পবিত্র বন্ধনে আবদ্ধ হবার পরে, মানুষটার প্রতি টান আপনা-আপনি চলে আসে। মানুষটার সবকিছু অদ্ভুত ভাবে ভালো লাগতে শুরু করে। মানুষটাকে আগা থেকে গোড়া পর্যন্ত জানতে ইচ্ছে করে। রাইমা বেগমের কথা শেষ হবার সাথে সাথে কলিং বেল বেজে উঠল। মেহেভীন উঠে বসলো। মুনতাসিম চলে এসেছে। মেহেভীন ব্যাগ নিয়ে কক্ষ থেকে বের হলো। সারাদিন সে কাজে ব্যস্ত থাকে বলেই রাতে মেহেভীনকে নিতে এসেছে। মুনতাসিম রাইমা বেগমের সাথে কুশল বিনিময় করল। মুনতাসিম আরো কিছু বলতে যাচ্ছিল। তখনই রাইমা বেগম আঁখিযুগল দিয়ে ইশারা করতেই দু’জন বিদায় নিয়ে চলে গেল।
ঘড়ির কাঁটায় রাত একটা ছুঁই ছুঁই। খাওয়া-দাওয়া শেষ করে সবে মাত্র মাত্র কক্ষে এসেছিল মুনতাসিম। তখনই মুঠোফোনটা টুং করে বেজে উঠল। সে ফোনটা নিয়ে দেখল অচেনা নাম্বার থেকে মেসেজ এসেছে। ইনবক্সে একটা ভিডিও পাঠিয়েছে কেউ। ভিডিওটা ওপেন করতেই মুনতাসিমের সমস্ত মুখশ্রীতে আঁধার ঘনিয়ে এল। চিন্তায় মস্তক ভারি হয়ে আসতে শুরু করল। ভয়ংকর কিছুর আভাস পাচ্ছে সে। এই ঝাড়ের সাথে সে কিভাবে মোকাবেলা করবে? নিজেকে ভিষণ দুর্বল লাগছে তার। অদ্ভুত ভাবে হাত কাঁপছে। শীতের মধ্যেও কর্ণ বেয়ে ঘাম গড়িয়ে পড়ছে। তবে কি সত্যি টা সামনে চলে আসার সময় এসে গিয়েছে। কথা টা ভাবতেই রুহু কেঁপে উঠল তার। সে চারিদিকে হাহাকার দেখতে পাচ্ছে। কিছু তিক্ত সত্য আনন্দ শুষতে শুরু করে দিয়েছে। মুনতাসিমের ভাবনার মাঝের মেহেভীন কক্ষে প্রবেশ করল। মেহেভীনকে দেখেই মুনতাসিম দ্রুত ফোনটা লুকিয়ে ফেলল।
চলবে…..