এলোকেশী_সে #মাহমুদা_লিজা পর্বঃ৯

0
461

#এলোকেশী_সে

#মাহমুদা_লিজা

পর্বঃ৯

পড়ার টেবিলটায় রাখা বইয়ে গভীর মনোযোগ তোড়ার। পড়ায় মনোনিবেশকারী মেয়েটা খুব করে চেষ্টা চালাচ্ছে দ্রুত পড়া শেষ করতে। লাল হাফ সিল্কের জমিনে পদ্মফুলের চিত্রায়ণ দিবে আজ। হাতের কলমটা নিজের লম্বাচুলের গোছায় গুঁজে দিয়ে বাংলা বইয়ের কবিতাটা বোঝার চেষ্টা করছে। গভীর সেই মনোযোগে ব্যাঘাত ঘটল দরজায় কড়া নাড়ার শব্দে । বিরক্তির রেশ আদলে টেনে চেয়ার ছেড়ে উঠে নিজের ঘরের দরজাটার ছিটকিনি টেনে দোর খুলতেই চক্ষু চড়কগাছ হলো। লম্বা সুতনু পুরুষটা দরজার পাশের দেয়ালটায় ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে। মাথার সামনের চুলগুলো কপালে ঝুলে রয়েছে। চশমার আড়ালে থাকা নয়নজোড়া বেশ গম্ভীর লাগছে। বা’হাত দিয়ে তোড়াকে ইশারা করল সরে দাঁড়াতে।
ইশারায় নির্ঘাত কোন মন্ত্র ছিল নয়ত এক লহমায় মেয়েটা সরে দাঁড়াতো নাকি! পা টেনে টেনে তোড়ার ঘরে এসে সোজা বিছানায় বসল অহন। মেয়েটা তখনো দরজার কপাট আগলে দাঁড়িয়ে। সচরাচরের মত অহন মাথা দুলিয়ে বলল -“এদিকে আয়।”
সম্মোহিতার ন্যায় সেই আদেশটাও মানল তোড়া। খানিক দূরত্ব রেখে দাঁড়াল সে। ঘাড় ঘুরিয়ে দরজার দিকে দেখল একবার, পাছে কেউ না দেখে নেয়। পুনরায় দৃষ্টি রাখল অহনের পানে। ক্ষণিকের ব্যবধানে আবার দৃষ্টিও সরিয়ে নিল। অহন শান্ত স্বরে বলল -“চেয়ারটা টেনে বস।”
নিজের মাথাটাকে দুলিয়ে ছোট্ট করে বলল -” সমস্যা নেই, বলেন।”

নিজের হাতে থাকা শপিং ব্যাগটা তোড়ার দিকে বাড়িয়ে অহন বলল -“সাদা ওড়না।”
অহনের বলা দুই শব্দের বাক্যটা শুনেই ঠোঁটজোড়া আলগা হয়ে গেল তোড়ার। অবিশ্বাসের চূড়ায় চড়ল যেন। স্বর নিচু করে বলল -“কে এনেছে? আপনি গিয়েছিলেন?”
অহন হাসল মৃদু শব্দ করে। চশমাটা টেনে খুলে নিজের পাশে রেখে বলল -“উহু, আনিয়েছি মিরানকে দিয়ে। ”
হাত বাড়িয়ে প্যাকেটটা নিয়ে টেবিলে রেখে ফের এসে দাঁড়াল অহনের সামনে। অহন মৃদু হেসে জিজ্ঞেস করল -“আঁকাআকি শিখেছিস কবে থেকে? ”
চমকে উঠল তোড়া। বুকের ভেতর ধকধক করে উঠল। দৌড়ে গেল টেবিলের কাছে। খাতায় দুটো প্রিয় চোখের স্কেচ এঁকেছিল সে। সেই মানুষটা যদি নিজের চোখের স্কেচ চিনে ফেলে তাহলে ভয়াবহ কলংক বাঁধবে। খাতাটা বন্ধ করে বইয়ের নিচে রেখে বলল – “মা শিখিয়েছে।”
টনটনে ব্যাথাটা উপেক্ষা করে অহন বলল -“অয়নকে বললে তোর আঁকা শাড়ির ছবি তুলে দিবে, তোর ডিজাইন করা শাড়িটা খুব সুন্দর হয়েছে।”
বুকের উপর থেকে যেন পাহাড় নেমে গেল মেয়েটার। আজকাল সে একটু বাড়িয়ে বাড়িয়ে ভাবা শুরু করেছে। ভাগ্যিস চোখের স্কেচ ঐ মানুষটার চোখে পড়েনি।
অহন পা বাড়াল চলে যাওয়ার জন্য, তখনই পেছন থেকে শুনল -“ভাইয়া!”
সঙ্গে সঙ্গে ঘুরে তাকাল অহন। ক্ষিপ্ত নয়নে তাকিয়ে নিজের ঠোঁটে তর্জনী রেখে ‘উসসস’ শব্দ করল। আচমকা আচরণটুকু হজম হলো না তোড়ার। ভয়ে চুপসে গেল। অপলক সে-ও চেয়ে রইল ঐ অগ্নি দৃষ্টিতে। বুকটায় খপ করে উঠল যেন।
নিজেকে স্বাভাবিকরূপে ফিরাতে সময় নিলো না অহন। ব্যাথায় টনটন করা শরীরটা বয়ে নিয়ে চলে গেল নিজের ঘরের দিকে। ঐ প্রস্হানটুকুই ইস্পাত-কঠিন হৃদয়কে চুরমার করে দিল। অনুভূতিগুলো ঠিকই অভিমান ঠিকরে বেরিয়ে এলো। নয়নজোড়ায় অশ্রু হয়ে ঝরে পড়ল চাপা পড়া অনুভূতিগুলো। আগ্নেয়গিরির লাভার মত সুযোগ পেলেই যেন সব অনুভূতি উপচে পড়বে। দরজাটায় খিল দিয়ে চাপা পড়া কান্নাটা আজ সামলাতে পারছে না মেয়েটা। কি নিদারুণ নিষ্ঠুর নিয়তি! না চেয়েও কেন নিজের এলোমেলো হৃদয়টায় ভালবাসাদের জন্ম হলো!

________

তিন দিন বাদে ফিরেছে কানন। সদ্য কৈশোরে পা রাখা দুই ছেলেকে পড়ায় মনোযোগী হওয়ার জন্য সেই সন্ধ্যা থেকে তাগাদা দিচ্ছে। মাঝেসাঝে নিজাম মজুমদারকে বিঁধিয়ে কথা বলছে। তার মতে তোড়াকে প্রায়োরিটি দিতে গিয়ে নিজের দুই ছেলের প্রতি হেয়ালিপনা করছে ঐ পুরুষটা।
কাননের বলা কথাগুলো শুনে সবাই থেমে থাকলেও মেহেরজান প্রতিবাদ করল -“সবে আইজকা আইসাই তুমি ঘরে ক্যাচাল করতে চাইতাছো? তোমার সমস্যাডা কি? আমার পোলায় একবার চরম ভুল করছে, এরপর আমি তারে আর কোন ভুল করতে দেখলে সোজা বাইর কইরা দিমু। তোমারে জানাইয়া রাখি, এই বাড়ি আমার নামে। আমি যারে ইচ্ছা রাখতে পারুম, যারে ইচ্ছা বাইর কইরা দিতে পারুম।”
এতক্ষণ শাশুড়ির ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে সব শুনে মুচকি হাসল রুবাবা। ঐ মানুষটাকে কঠিন চাপে রেখেছেন তিনি। প্রতিটা মুহূর্তে তিনি মনে করিয়ে দেন মেয়ের খরচে এক বিন্দু ছাড় দেয়ার মন মানসিকতা নেই, মেয়ের অধিকারে পাই টু পাই তিনি বুঝিয়ে দিয়েছেন। ঐ মানুষটার মানসিক উচাটনে বেশ নির্বিকার অতীতের নিরীহ এই রমণী। শারীরিক যন্ত্রণায় প্রতিষেধক আছে কিন্তু মানসিক যন্ত্রণার মত দুর্গতি দ্বিতীয়টা হয় না। তার প্রতিকার বা প্রতিষেধক আপেক্ষিক। নিজে যে যন্ত্রণায় দগ্ধে দগ্ধে এতদিন গুজার করেছে সেই নিষ্ঠুর মানসিক যন্ত্রণাটা তিলে তিলে ঐ মানুষটার উপর আরোপ করেছে রুবাবা। তবে ঐ মানুষটার বাকি দুই সন্তানের সাথে কোন অন্যায় তিনি করছেন না। তাদের প্রতিও রয়েছে মাতৃস্নেহের অনুরূপ টান। শত হোক মাতৃ হৃদয় তার।

রুবাবার ঠোঁটের কোণে রহস্যময় হাসিটা কাননের বুকে বিদ্ধ হলো। অভিশাপকারীনির আদলে এই রমণীও রুবাবাকে ইশারা করে বলল -“আমার সাথে অন্যায় করলে আল্লাহ কাউরে ছাড় দিবে না, ধ্বংস হয়ে যাবে সে।”
কাননের কুৎসিত বদদোয়াটা শুনেই অনিমা খেঁকিয়ে বললেন -“অন্যের জন্য বদদোয়া দেয়ার আগে ভাবিস, কারণ অন্যের অনিষ্টে তোর হাতও যুক্ত হয়েছিল।”
কানন দমল না বরং দ্বিগুণ তেজে সে-ও বলল -“আমায় দোষ দিয়েন না বড় ভাবী, আমিও স্বপ্ন নিয়ে শ্বশুর ঘরে এসেছি। ঐ মানুষটাই স্বপ্ন দেখিয়েছে। আমারও ইচ্ছে করে স্বামী সন্তান নিয়ে সুস্থ পরিবেশে থাকার।”
সিঁড়ির কোণায় তোড়াকে দেখতে পেয়ে তাকে তার বাবার বিরুদ্ধে উস্কানোর জন্যই ইমোশনাল কথাবার্তা শুরু করেছে কানন। কিন্তু ঘটল হিতে বিপরীত। বাবার প্রতি শত অভিযোগ থাকলেও অন্য কারো মুখ থেকে বাবার নামে কুৎসা শুনতে ভীষণ নারাজ সে। সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে এসে মায়ের পাশে দাঁড়িয়ে বেশ জোরালো কন্ঠে বলল -“একদম সব দোষ থেকে নিজেকে ধুয়ে সরাতে চাইলেও পারবেন না, কারণ এক হাতে তালি বাজে না। দোষ শুধু বাবা নামক মানুষটাই করেনি, আপনিও তালে তাল মিলিয়ে দোষে সঙ্গ দিয়েছেন।”

রক্তের টান মুছে না – কথাটা অক্ষরে অক্ষরে প্রমাণ পেলো সবাই। রুবাবাও হাসল, বাবার নামটা উঠলে সবার আগে যেই মেয়েটা নাক সিটকায়, সেই মেয়েটাই সময়ে বাবার অপমানের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়। অনিমা, কলি আর মেহেরজান চকিতে তাকাল তোড়ার পানে। এই মেয়েটার মনের অন্দরমহল আজও কারোর পদধূলিরঞ্জিত হয়নি, হওয়ার সুযোগ পায়নি। নয়ত তার মনটা কেউ পড়তে পারেনি কেন!
ভূতের মুখে রাম নাম শোনার মত চমকালো কানন। তার করা প্রতিটা কৌশলে ছাই চাপা দিচ্ছে সবাই। অতীতের ঘটনার পুনরাবৃত্তি না হয়! সেই চিন্তাটুকু গ্রাস করেছে তাকে।

_______

অয়নের সামনে সাদা কাগজে কৃষ্ণবর্ণের লেখাটুকু ছুঁড়ে ফেলল অহন। শরীর দুলিয়ে হাসতে হাসতে বলল -“আমার জন্য কত সুন্দর লাভ লেটার রেখেছে বইয়ে। কে রেখেছে জানিস? আমার ছাত্রী। ”
কথাটুকু শেষ করে আবারও হাসতে লাগল অহন। অয়ন কাগজটা হাতে নিয়ে কয়েকবার পড়ল। দমফাঁটা হাসি পেলেও নিজের হাসিকে আঁটকে সে আবারও পড়তে শুরু করল -” প্রিয় স্যার, আপনার হাসি, আপনার লুক আমাকে ঘায়েল করেছে, আমার রাতের ঘুম কেড়ে নিয়েছে। আপনার ঐ কিলার লুক আমার হৃদয়ে আলোড়ন তুলেছে। ভেবে দেখলাম আপনাকে ছাড়া আমি বাঁচব না। আমায় নিজের সঙ্গী করে নিন স্যার।
~ইতি
আপনার প্রেমে মশগুল হওয়া অতসী।”

এবার আর নিজেকে সংযত রাখতে না পেরে হো হো করে ভাইয়ের পিঠে চাপড় দিয়ে হাসতে শুরু করল অয়ন। হাসতে হাসতে তার চোখের কোণে জল জমা হয়েছে। নিজের হাসি থামিয়ে অয়ন স্বাভাবিক স্বরে প্রশ্ন করল -“চিঠিটা পাওয়ার পর কাকে মিস করেছিস?”
আনমনে অচেতনে অহনের মুখ দিয়ে বের হলো -” এলোকেশী সেই মেয়ে, যার এক পলক চাহনি আমার হৃৎস্পন্দনের গতি বাড়িয়ে দেয়। রেহনুমা মজুমদার তোড়া।

ভাইয়ের লুকোনো অনুভূতিটা কর্ণকুহরে পৌঁছানোর আগেই নিউরনে সাড়া তুলেছে। তার মনে পড়ল অনুর কথা। আনমনে গেয়ে উঠল –
“chot lagi hain usey
phir kyun mehsoos mujhe
hoo raaha?
dil to bata de
kya hain iraada teraa!

নিজের ঘরে যাওয়ার পথে থমকে দাঁড়াল তোড়া। বারবার মনে হয় গানের লাইনগুলো শুধু তার জন্য তৈরী হয়েছে।

চলবে……..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here