#এলোকেশী_সে
#মাহমুদা_লিজা
পর্বসংখ্যাঃ১৪
আধ বেড়ানো দরজার এপাশে অস্হির রকমের পায়চারি করছেন নিজাম মজুমদার। মেয়ের ঘরটার সামনে এসে নিজেকে পুরোপুরি ভরহীন লাগছে। সাহসে কুলোচ্ছে না মেয়ের চোখে চোখ মেলাতে। তবুও দরজায় পরপর দুটো টোকা দিয়েই দিলেন তিনি। সুনশান নিস্তব্ধতায় মৃদু আওয়াজের শব্দটা তোড়ার কর্ণে পৌঁছে গেল ক্ষণিকের ব্যবধানে। কোমল স্বরে জবাব এল -“দরজা খোলা।”
আসন্ন পরীক্ষার সময়সীমা ঘনিয়েছে। তাইতো রাত জেগে পড়া আয়ত্ত্ব করতে হয় তোড়াকে। বইয়ের টেবিলে বসে গুনগুন করে পড়ছিল। তার জবাবের পর কারো আওয়াজ না শুনে ঘাড় ঘুরিয়ে পেছনে দেখতেই চমকে গেল সে। স্নিগ্ধ আদলটায় এবার বিদ্বিষ্ট ভাব। ফের দৃষ্টি রাখল বইয়ের পাতায়। গুনগুনে পড়ার শব্দটা পরিবর্তিত হলো উচ্চ আওয়াজে। নিজাম মজুমদার বুঝতে পারলেন মেয়েটা তার উপস্থিতিতে যারপরনাই ত্যক্ত। তবুও মেয়ের নাম ধরে সম্বোধন করলেন। বইয়ের শক্ত মলাটটা উল্টে চার পায়ে দাঁড়িয়ে থাকা চেয়ারটা ছেড়ে উঠে এলো। সম্পর্কে বাবা নামক মানুষটার সামনে এসে দাঁড়াল। কোন ভণিতা ছাড়াই তিনি মেয়েকে শুধালেন -“তোমার কলেজ ফি পেমেন্ট করা হয়েছে?”
তোড়ার স্বাভাবিক স্বর -“জ্বি।”
মেয়ের জবাবে মুখটা ‘হা’ হয়ে গেল নিজাম মজুমদারের। বিস্মিত হয়ে ফের জানতে চাইলেন -” টাকা কোথায় পেয়েছ?”
শুকনো ঠোঁট জিভ বের করে ভিজিয়ে নিল। অবসরে অন্যের জামা বানিয়ে টুক টুক করে জমিয়েছিল টাকা। কলেজ ছুটির পর দুটো টিউশনি থেকে প্রাপ্ত অর্থগুলোও জমিয়ে রাখে। সেই জমানো টাকা থেকে তার কলেজ খরচসহ হাতখরচ চলে দিব্যি। তার লড়াইয়ের কোন বর্ণনা সে কাউকে দিতে চায়না। তাই স্বল্প ভাষায় জানাল -“আমিই দিয়েছি।”
নিজাম মজুমদার ‘চ’ শব্দ করে নিজের অসন্তোষ বোঝালেন মেয়েকে। মেয়ের নিমিত্তে ভরসার আদলে বললেন – “আমি এখনো বেঁচে আছিতো নাকি?”
তোড়ার মনে পড়ল তার বান্ধবীরা যখন আড্ডায় বুক ফুলিয়ে বলে -আমার বাবা সেরা বাবা, আমার বাবা আমার ভরসার আঁধার তখন মাথা নুইয়ে নিত সে। তারা সর্বোচ্চ প্রত্যয় নিয়ে বলত পৃথিবীতে খারাপ বাবা হয়না, বাবার কাছে মেয়েরা রাজকন্যা তখন তোড়া মনের অন্তঃস্থল থেকে তাচ্ছিল্য করে বিড়বিড় করে বলত -“ওসব আওড়ানো বুলি, সব মিথ্যে।” দিনের পর দিন বাবার অবহেলার হেতু অভিমান জমতে জমতে তীব্র ঘৃণায় বদলেছে। মনের কান্নার মৌন মিছিলে চিৎকার করা সংগ্রামী স্লোগান কেউ শুনেনি। সেই মিছিলেও জারি হয়েছিল সান্ধ্য আইন, নিষেধাজ্ঞা আরোপিত ছিল সেই মৌন মিছিলেও। এসব ভেবে আজ আর কষ্ট হয়না বরং নিষ্ঠুর কিছু অনুভূতি হয়। তাইতো বাবা নামক মানুষটাকে ভীষণ সহজ ভাষায় বলল -“সেই কথা আমি আর আমার মা ভুলে গিয়েছিলাম। ভুল বলছি আমাদেরকে ভুলানো হয়েছে। নিজের দায়িত্ব নিতে শিখে গেছি, এখন আর ভরসা পাবার কোন ইচ্ছে নেই। নড়বড়ে শিরদাঁড়াটাকে টেনেটুনে শক্ত করে চারপাশে বেষ্টনী দিয়ে ঘিরেছি। এত সহজে সে ভিত নড়বে না আর।”
নিজাম মজুমদারের নিকট দুর্বোধ্য ঠেকল সহজ ভাষাগুলোও। প্রতিটা অক্ষরে ছিল তীব্র ঘৃণা, প্রতিটি শব্দে ছিল দু’জন মানুষের প্রতি করা অবহেলা আর অসম্মানের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ, প্রতিটি বাক্যে ছিল নিজের প্রতি দৃঢ়তা।
কথা বাড়ালেন না নিজাম মজুমদার। নিজের সন্তানের কাছে তিনি সত্যিই অপরাধী। জীবনের এই দশায় এসে অনুতাপ হচ্ছে কিন্তু তার মাশুলবাবদ তিনি পাচ্ছেন মানসিক যন্ত্রণা। বিশেষ করে অবহেলায় ক্ষত-বিক্ষত হৃদয়ের মানুষ দু’টো যখন নিজের চতুর্দিকে শক্তপোক্ত প্রাচীর দাঁড় করিয়েছে তখন সেই প্রাচীরে এসে বারবার ফিরে যাওয়ার মত মানসিক টানাপোড়েনে তিনিও নিমজ্জিত হচ্ছেন। এসেছেন অনেক কথা নিয়ে, সেসব কথা গলা অবধি এসে আঁটকে গেছে। এর মত নিষ্ঠুর যাতনা আর কি হতে পারে!
মেয়ের স্নিগ্ধ আদলটার দিকে কখনো যদি প্রণিধান হত তবে নিশ্চয়ই সন্তানের জন্য মমতার খামতি হতো না। আজ মনে হচ্ছে তিনি পৃথিবীর সবচেয়ে মায়াবী কন্যার পিতা৷ রূপকথার রাজকন্যারাও বুঝি তার কন্যার মত সুশ্রী নয়! কন্যার কক্ষ পরিত্যাগের মুহূর্তটায় হৃদয়ে পদপৃষ্ঠে শুকনো পাতার মর্মরের যাতনা উত্থিত হল।
সিঁড়ি বেয়ে শ্লথ গতিতে নামলেন নিজাম মজুমদার। নিজের ঘরে নিঃশব্দে প্রবেশ করে সোজা চলে গেলেন বারান্দায়। আজ ঘুম আর চোখের পাতা ছুঁয়ে দিবে না।
_______
টেবিলে বসে ঢুলে ঢুলে পড়তে থাকা তোড়ার মনোযোগে বিঘ্ন ঘটল পরিচিত প্রিয় মানুষটার কন্ঠধ্বনিতে। পেছনে না ঘুরেই দৃষ্টি চোপায়ায় থাকা বইয়ে রেখে জানাল -“পড়ছি মাস্টারমশাই।”
তোড়ার স্বল্প ভাষাটা বুকের কম্পন বাড়িয়ে দিল। অসহায়বোধ করল অহন। শ্যামরঙা আদলটা যেন অমাবস্যায় ছেয়ে গেল। গম্ভীর রাশভারি স্বরে শুধালো -“দূরে ঠেলে দিচ্ছো এলোকেশী? ভস্ম হওয়া কাষ্ঠকে অগ্নিভীতি দেখিও না।”
চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল তোড়া। বইটা বন্ধ করে ঘুরে দাঁড়াল। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বলল -“আগুনে ঘি ঢাললে পরবর্তী পরিস্থিতিতে কি ঘটে মাস্টার মশাই?”
তোড়ার অতি স্বাভাবিক আচরণ মানতে পারছে না অহন। নিজাম সাহেবের সাথে তার কথোপকথন পুরোটাই শুনেছিল সে। ঐ ভঙ্গুর মেয়েটার যন্ত্রণা ভোলাতে এসেছিল কিন্তু এসে নিজেই তব্দা খেয়ে বসেছে। উল্টো মেয়েটা তাকে যন্ত্রণা দিচ্ছে। তার নীরবতায় মৃদু হাসল তোড়া, নিচু স্বরে বলল -“মাস্টার মশাই, ব এর ঘাড়ে আঁকড়ি না টানলে ক হয় না তাইনা! কিন্তু ক এর আঁকড়ি মুছে দিলে ব হয়ে যায়। নির্মম ব্যাপার স্যাপার তবে এমনটাই হয়। তবে আমাকে আঁকড়ি ভেবে নিন। চাইলে স্হান দিবেন নয়ত দিবেন না কিন্তু নিজেকে দহন করা চলবে না মাস্টার মশাই।”
অহনের চোখে কৌতূহল খেলছে। কি কঠিন কথা বলল মেয়েটা। রহস্য টানছে নিজের চারপাশে। তবু চারদেয়ালের বন্ধ দরজায় প্রহরী তো সে একজনই। যাকে সে অঘোষিতভাবে স্হান দিয়েছে হৃদয়ের গোপন কুঠুরিতে। ছাই রঙা ট্রাউজারের পকেটে হাত ঢুকিয়ে মাথা নেড়ে সায় দিয়ে অহন বলল -“আমৃত্যু অপেক্ষা করব তোড়ারাণী। আমি পথভোলা পথিক নয়, আমি ক্লান্ত পথচারী। একদিন না একদিন গন্তব্যে ঠাঁই মিলবে নিশ্চিত।”
তোড়া হাসল। সম্পর্কের ভবিতব্য তার অজানা তবুও অনুভূতিরা বাঁধা মানে না। অজানা ভবিতব্য হয়ত ক্লান্ত পথচারীটাকেই গন্তব্যে টেনে নিবে। আশাহত হলো না মেয়েটা। স্বপ্ন বুনন বড়ই অদ্ভুত শক্তি দেয়, সে বলেই জানাল -“রাহী হয়ে আসলে মঞ্জিল তো আগলে নিবেই।”
ফের টেবিলের কাছে এসে বইটা হাতে নিয়ে তোড়া বলল -“ঘরে যান, রাত হয়েছে, ঘুমিয়ে পড়ুন।”
অহন হাসল। কবে সে এ ঘরটায় না এসে তার এলোকেশীকে নিজের ঘরে নিয়ে যাবে সে ভাবনায় বিভোর। আজ হোক বা কাল হোক এই রহস্যময়ীকে শক্ত বাঁধনে সে আগলে নিবেই। শত ঝড় ঝাপটা আসুক, হাত সে ছাড়বে না। তার ভালবাসার জোর এত ঠুনকো নাকি। পাহাড়ের মত অটল সে। এই মুহূর্তে কঠিন একটা সিদ্ধান্ত নিল সে- হুটহাট এভাবে ঘরটায় ঢুকে আসবে না সে, অচঞ্চলাকে আর অনাকাঙ্ক্ষিত কোন ঝুট ঝামেলায় রাখতে নারাজ। এখনো অধিকার জন্মেনি তাকে সর্বসম্মুখে আগলে রাখার। বৈধ অধিকারটুকু হয়ে যাক, সে দুনিয়ার সামনে লড়বে এখন না হয় আড়ালেই লড়ে যাক।
________
মা মারা যাওয়ার পর বাবা আর ভাইদের চোখের মণি ছিল, পরিস্থিতির নিষ্ঠুরতায় তাদের অমতে, অলক্ষ্যে ঘর ছেড়ে এলো। না জানি তারা কিভাবে আছে, কি করছে এসব ভেবে ফুপিয়ে কেঁদে উঠল অনু। একদিকে বাবা, ভাই অন্যদিকে অয়ন। এতক্ষণ চুপচাপ অনুর কান্নারত মুখটা দেখছিল অয়ন। এই রমণীর রাগ হোক কিংবা কষ্ট হোক, যখনই মেয়েটা কেঁদে ওঠে তখনই নীরবে তাকে দেখে যায়। মানুষটার হাসিতে সে কতবার ঘায়েল হয়েছে জানা নেই, তবে তার কান্নারত আদলটাও বেশ কমনীয়। ক্ষণে ক্ষণে তার ফুপিয়ে ওঠা গভীর মনোযোগ দিয়ে দেখতে থাকল অয়ন। নিঃশব্দে সরে এলো স্ত্রীর সামনে থেকে। খানিক বাদে আবার ফিরে এলো, আগের মতই বসে পড়ল। গলা দিয়ে উহুম শব্দ করে বলল -“অসময়ে কি বানের জলে ভাসাবে নাকি? এমনি শীত শীত লাগছে, এখন যদি চোখের জলে বন্যা হয় তখন কে আগলে নিবে, শুনি।”
তবুও থামল না অনু। এবার হেঁচকি তুলে কান্না শুরু করল, মিনমিন করে বলল -“বাবাকে দেখতে মন চাচ্ছে।”
অয়নের হাসি পেল এবার। তবুও হাসি দমিয়ে রেখে বলল -“ডিল ডান, চলো রেডি হয়ে নাও। বাবার বাড়ি রেখে আসি।”
কথাটা শোনামাত্রই থেমে গেল অনু। বিস্ফোরিত নয়নে অপলক চেয়ে রইল অয়নের দিকে। মানুষটার গম্ভীর চাহনি দেখে বেশ ভড়কাল। পরক্ষণেই ফিক করে হেসে দিয়ে অয়ন বলল -“পাঁচিল টপকে অসুস্থ শরীর নিয়ে জা/ন হাতে নিয়ে তোমায় সাথে করে নিয়ে এসেছি অসুর সাহেবের কাছে ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য! বাহ, কি আনন্দ। এমন একটা রোমান্টিক ওয়েদারে অসুর সাহেবের জন্য বউ কান্না করছে, তাতেই হিংসায় জ্বলে যাচ্ছি।”
অয়নের হাসি দেখেই অনুর রাগ চড়ে বসল। ক্ষেপে গিয়ে ধুম করে বিছানা ছেড়ে দৌড় লাগাল দরজার দিকে, চেচিয়ে বলল -“আমি যাচ্ছি তোড়ার কাছে। ওর সাথেই ঘুমাবো।”
অয়ন তড়িঘড়ি করে এসে আটকালো অনুকে। তার হাতজোড়া নিজের একহাতে আগলে নিয়ে বলল -“পাগল নাকি! এত কায়দা করে নিয়ে এসেছি বর রেখে ননদের কোলে ঘুমানোর জন্য! আস্তাগফিরুল্লাহ, নাউজুবিল্লাহ, কি অলক্ষুণে কাজ কারবার। এমন করে না বউ। আমি জ্ঞান হারাব, মরে যাব, ওপারে চলে যাব।”
অনু নিজের হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করছে খুব, কড়া স্বরে বলল -“ছাড়ুন, আমি থাকব না এখানে। আপনি সবসময় উল্টোপাল্টা কথা বলেন।”
শীতল চাহনি নিয়ে অনুর বাচ্চামো দেখছিল অয়ন। একটা সময় এক টানে বুকে জড়িয়ে বলল -“এখন বলো, এখানে থাকবে না।”
স্হির হয়ে গেল অনু। তার শ্বাসপ্রশ্বাসের অস্বাভাবিক গতি স্পষ্ট টের পাচ্ছে অয়ন। স্ত্রীর মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বলল -“রাগ কমেছে?”
তার মৌনতায় সন্তুষ্ট হলো অয়ন। ঠোঁট গোল করে শ্বাস ছেড়ে বলল -“আপনার মোহরানার সম্পূর্ণ অংশ বুঝে নিন।”
অয়নের হাতে থাকা ছোট্ট বক্সটার দিকে তাকিয়ে বিস্মিত হলো অনু। সহাস্যে বক্সটা খুলে কাগজের নোটগুলো দেখে জিজ্ঞাসু দৃষ্টি নিয়ে তাকাল। তার অনামিকায় সাদা পাথরের গোলাকার আংটিটাকে প্রবেশ করিয়ে অয়ন বলল -“ধর্মমতে আপনার সমস্ত পাওনা আমি নির্ধারিত সময়ে পরিশোধ করেছি ম্যাম আর আমার পক্ষ থেকে আংটিখানা আপনার জন্য উপহার। বলতে পারেন প্রথম উপহার।”
নির্বাক অনু। চুপটি করে চেয়ে রইল স্বামীর পানে। অয়ন ফের বলতে শুরু করল -” আমার কোন আচরণ তোমায় এতটুকু কষ্ট দিলেও আমাকে জানাবে। আমি নিজেকে শুধরে নিব। যদি কখনো মনে হয় বয়সটা আবেগের ছিল, তাই আমার সাথে সম্পর্কেও আবেগে জড়িয়েছ তাহলে আমাকে জানিও। তোমার সকল মতামতকে আমি সম্মান করব। যদি কখনো ছেড়ে যেতেই চাও জানিয়ে দিও, স্বেচ্ছায় জীবনটাও দিয়ে দিব। আমি তোমায় ভালবাসি অনু, ভীষণ ভালবাসি। তুমিতো বোবা যন্ত্রটায় লিখে পাঠাতে। আমি অপেক্ষায় ছিলাম যেদিন নিজের করে পাবো সেদিনটার জন্য।”
স্ত্রীর চোখের কোণের আনন্দ অশ্রুকণা নিজ হাতে মুছে নিল অয়ন। তপ্ত অধরযুগলের উষ্ণ ছোঁয়া এঁকে দিল প্রিয়তমা স্ত্রীর কপালে।
চলবে…….
(কি দিনকাল এলো! ছোট ভাইয়ের বাসরের গল্প লিখতে হচ্ছে, আর ওদিকে বড়জনের সবে প্রেমে হাতেখড়ি হয়েছে। কি আর করার আপনারাও দেখুন আর পড়ুন। 🤣🤣🤣🤣)