যদি_দেখার_ইচ্ছে_হয় #আফসানা_মিমি |পর্ব: একুশ|

0
454

#যদি_দেখার_ইচ্ছে_হয়
#আফসানা_মিমি
|পর্ব: একুশ|

অপরাধীরা যতোই চালাক হোক না কেন। ছোট্ট একটি ভুলের জন্য ধরা পড়েই যায়। হোক সেটা ত্রিশ বছর পর বা সত্তর বছর পর। রুনা নিত্যদিনের মতোই পূন্যালয়ে যাওয়ার জন্য তৈরী হয়ে নেয়। মিষ্টি রান্না করছিল, শরীর যতোটা খারাপ থাকুক না কেন সে তার মনি মাকে রন্ধ্রনশালায় পা মাড়াতে দেয় না। রুনা পরিপাটি হয়ে মিষ্টিকে দেখতে আসে। মেয়েটা নাকে আঁচল চেপে রান্না করছে। তার মনি মাকে সে কষ্ট দিবে কিন্তু সে ঠিকই কষ্ট করছে।
” তোকে মানা করলেও শুনিস না, মা। কতোকরে বললাম আমি রান্না করি, রাজি হলি না। দেখ তো, এখন কত কষ্ট হচ্ছে!”

মিষ্টি নাক চেপেই ভ্রু যুগল কুঁচকে নেয়। খুন্তি রুনার দিকে তাক করে বলে,” মা ডাকছো কিন্তু মায়ের কাজ করতে দিচ্ছো না! তুমি কেমন মা শুনি?”

” মশকরা করিস না। তোর কতদূর হলো, অন্তিক এলো বলে। রান্না শেষ করে জিরিয়ে নে তো এবার। আমি চললাম।”

মিষ্টির বলতে ইচ্ছে করছে, তুমি যেও না মনি মা! আমার মন আজ কু ডাকছে। আসন্ন বিপদের আশংকা হচ্ছে। মুখে কিছু না বললেও রুনা বুঝতে পারেন।
” এদিকে আয় দেখি!”

মিষ্টি যেন এই ডাকটারই অপেক্ষায় ছিল। ধীরপায়ে মনি মার দিকে এগিয়ে এসে জড়িয়ে ধরে বলে,” আমার একা একা ভালো লাগে না। ভয় হয়।”
রুনা পরম মমতায় মিষ্টির পিঠে হাত বুলিয়ে বলে, ” আমার সাহসী বাঘিনীকে এতো দুর্বল হলে চলবে? আমি তো তোকে এই শিক্ষা দেইনি,মা! শত্রুদের সামনে ভয় নয়, মোকাবিলা করতে হয়। শক্তি দিয়ে নয়, বুদ্ধি দিয়ে পরাজিত করতে হয়।”

” আমার মাঝে আরেকটি অস্তিত্ব অনুভব করার পর থেকে সাহস নামক বল পাই না, মনি মা! আমার ক্ষতি হোক কিন্তু আমাদের ভালোবাসা চিহ্নের কোনো ক্ষতি হতে দিতে পারব না।”

মিষ্টি কথাগুলো বলেই চোখের জল ফেলতে থাকে। রুনা হেসে চোখের জল মুছে দেয়। মিষ্টির মাথায় হাত বুলিয়ে বলে, ” আর কিছু সময়, এই বুঝি অন্তু এলো। তুই ফ্রেস হতে হতেই দেখবি চলে এসেছে।”

” আচ্ছা, সাবধানে যেও!”

” আমাদের ছেড়ে তো ভালোই আছো দেখছি, নতুন সংসার গড়েও নিয়েছো।”

রুনা বাহিরে পা বাড়াতে নিতেই পুরুষালী কণ্ঠস্বর শুনতে পায়। তার সামনে হাসিমুখে একজন ছেলে দাঁড়িয়ে আছে। রুনা দৃষ্টি ঝাপটিয়ে চেনার চেষ্টা করছে সে। কিছুক্ষণ পর স্মৃতির পাতা থেকে ছেলেটিকে চেনার পর রুনার চোখের কোণায় অশ্রু জমা হয়। ছেলেটি পিয়াস, মোল্লা বাড়িতে এই ছেলেটাই তার সাথে মান অভিমান বিনিময় করতো।

” সুখে আর রইলাম কই! তোরা আমার সুখের নীড়ে ভাগ বসাতে চলে এসেছিস।”

পিয়াস বিস্তর হাসে। সে মাথা নীচু করে অপরাধীর ন্যায় দাঁড়িয়ে বলে,” আমি তোমাদের নিতে এসেছি চাচী। চাচা তোমার কথা শুনে ঠিক নেই। অসুস্থ হয়ে পড়েছে।”

কায়েসের অসুস্থতার কথা শুনে রুনার চোখমুখ শক্ত হয়ে আসে। অভিমানের পাল্লা যে খুব ভারি! এত বছরেও মানুষটা তার একটিবারের জন্যও খোঁজ নেয়নি। সে কী জানতো না যে, রুনা পূন্যালয়ে আছে। বুকে পাথর চেপে নির্লিপ্ত কণ্ঠে বলে,” ডাক্তারের কাছে না নিয়ে এখানে কী করছো?”
” চাচার ডাক্তার নয়, তোমাকে প্রয়োজন।”
” আমি যাব না।”
মিষ্টি এবার এগিয়ে এসে রুনার কাঁধে হাত রেখে বলে, ” বাবার কোনো দোষ নেই মনি মা! আমরা সবাই এক নই, বাবা মানুষটা একটু সহজসরল। তোমার দূরত্ব তাকে অসহ্যকর ব্যাধি প্রদান করেছে। আমি বাবার অস্থিরতার সাক্ষী মনি মা! তিনি তোমার পথ চেয়ে রোজ বাড়ির সামনে দুই থেকে তিন ঘণ্টা বসে থাকেন। বাবা মনে করেন, তুমি যেমনভাবে কোনো এক সকালে বাবাকে ফেলে চলে এসেছো ঠিক এমন এক সকালে বাবার কাছে ফিরে আসবে।”

রুনার চোখ বেয়ে অশ্রু ঝড়ছে। তবে কী সে কাঁদছে? এতো বছরের মনের কোণে জমিয়ে রাখা কষ্ট কী মিইয়ে যাচ্ছে? ভাঙা স্বরে রুনা প্রশ্ন করে, ” অন্তিক কোথায়?”
” অন্তিক গাজীপুরে। শাওন জরুরী কল করেছিল। দাদার মৃত্যুর ব্যাপারে কিছু একটা বলতে চায়। আমিও যেতে চেয়েছিলাম কিন্তু অন্তিক নিষেধ করে। এখানে তোমাদের ফিরিয়ে আনতে বলে।”

রুনা গভীর নিঃশ্বাস ত্যাগ করে। পূন্যালয়ের মায়া কী তবে এখানেই শেষ করতে হবে তাকে?
—————–

মিষ্টিরা যখন পিয়াসের ভাড়া বাসায় পৌঁছে তখন ভোর সকাল। মিষ্টি ইচ্ছে করেই সকালের সময়টা বেছে নিয়েছে। বাড়ির কাছাকাছি আসতেই মিষ্টি পিয়াসের উদ্দেশ্যে বলে, ” ভাইয়া,আমি আচার খাব।”

” সাত সকালে খালি পেটে আচার খাবি? কিছু খেয়ে নে, তারপর খাস!”

রুনার কথার প্রত্ত্যুত্তরে মিষ্টি জিদ ধরে সে এখনই আচার খাবে। পিয়াস বিষয়টা বুঝতে পেরে রুনাকে শুনিয়ে শুনিয়ে বলে, গলির মোড়ে একটা শপ চব্বিশ ঘণ্টা খোলা থাকে। তা তুমি অপেক্ষা করতে পারবে? নাকি গিয়ে খাবে। অবশ্য গিয়ে খেলে তোমারই লাভ, যত ইচ্ছে খেতে পারবে।”

” শপে বসে খাব।”

পিয়াস নিষ্টিকে নিয়ে বেরিয়ে পড়ে। রুনার উদ্দেশ্যে বলে, ” আমি ফোন করে আফিয়াকে বের হতে বলে দিচ্ছি। তুমি সামনে আগাও চাচী! ”

রুনাকে কোনো কথা বলার সুযোগ না দিয়ে মিষ্টিকে নিয়ে বেড়িয়ে পঠে পিয়াস। মিষ্টি মুচকি হেসে কৃতজ্ঞতার সহিত পিয়াসের দিকে তাকায়।
” ধন্যবাদ ভাইয়া।”
” মানুষের মনের আশা পূরণ করতে কতোই না আনন্দ পাওয়া যায়, তাই না মিষ্টি!”

কথাটা বলে দুজনেই একসাথে হেসে উঠে। বহুকালের মান অভিমান আজ ভাঙবে।

পিয়াসের অ্যাপার্টমেন্টের সামনে বিশাল বাগান রয়েছে যেখানে এক পাশে গাড়ি পার্কিং করার জায়গাও আছে। রুনা চারপাশ ভালো করে লক্ষ্য করে খুব সন্তুষ্ট হয়। সে শুনেছে এত বিশাল বড় এরিয়াতে বাচ্চারা বিকালে খেলা করে রুনার মন তখন পীন্যালয়ের জন্য কাঁদবে না। সময় পাড় করতে পারবে। রুনা সামনেরদিকে আগাতে নিলেই কেউ একজন তার কাঁধে হাত রাখে। রুনা ভাবে পিয়াস অথবা মিষ্টি। পিছনে ফিরে যখন মানুষটাকে দেখতে পায় তখন তার হাত থেকে ব্যাগগুলো জমিনে আছড়ে পড়ে। কাঁপা কাঁপা স্বরে শুধায়,
” অন্তিকের বাবা!”

আনতিকের বাবার যেন বিশ্বাসই হচ্ছে না। কাঁপা হাতে সে রুনা গালে হাত রেখে বলে,” তুমি ফিরে এসেছো রুনা!”

অন্তিকের মা চোখ বন্ধ করে নেয়। কতদিন পর সে মানুষটার স্বর শুনতে পারছে? কতদিন পর মানুষটা ছোঁয়া অনুভব করছে? সে মাথা হ্যাঁ বোধক ইশারা করে সম্মতি জানায়। আর ওদিকে কায়েসের বিশ্বাস হচ্ছে না। সে কাপা হাতে রুনার হাত ধরে ব্যাগগুলো এরেক হাতে নেয়। সামনের দিকে এগিয়ে যেতে নিয়ে রুনার উদ্দেশ্যে বলে,
” চলো একসাথে হাঁটি।”

” আমাকে কিছু বলার নেই, অন্তিকের বাবা?”

এক পা সামনে এগিয়েও থেমে যায় কায়েস। রুনার কণ্ঠস্বর আজ কত বছর পর শুনছে! অন্তরে যেন ধাক্কা খেল সেই কথায়। কত অভিযোগ জমা আছে সেথায়! কায়েস নির্বোধ, অবুঝ ছিল পূর্বে। তারই সামনে বউ বাচ্চার উপর কতেই না অত্যাচার হতো! কিন্তু সে কিছুই বলতে পারত না।

” শেষ বয়সে অভিযোগ করার মতো কিছু নেই, রুনা! মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তোমার পাশে থাকতে চেয়েছিলাম। উপরওয়ালা হয়তো সেই আশা পূরণ করেছেন।”

দূর থেকে পিয়াস ও মিষ্টি সবটাই দেখছে। পিয়াস নির্বিকার হলেও মিষ্টি নয়, সে দুজনকেই কাছ থেকে দেখেছে। বুঝেছে তাদের মনের কষ্ট। তাইতো আজ তাদের এখানে এনে দাঁড় করাতে পেরেছে।

—————————–

জীর্ণশীর্ণ হয়ে অন্তিক পিয়াসের ফ্ল্যাটের সামনে এসে কলিং বেল চাপ দেয়! কিয়ৎসময় পর মিষ্টি এসে দরজা খুলে দেয়। অন্তিকের জীর্ণশীর্ণ অবস্থা দেখে চিৎকার করে ওঠে সে। ততক্ষণে অন্তিক জমিনে লুটিয়ে পড়ে। মিষ্টি অন্তিকের মাথা নিজের কোলে রেখে অস্থির চিত্তে বলতে শুরু করে, ” চোখ খুলো অন্তু! কী হয়েছে তোমার? আমার দিকে তাকাও না! এই অন্তু, এই!

চলবে………………

[ছোট পর্ব হয়েছে তাই না! হয়েছে কী,শীতে হাত চলেই না। সরি]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here